টকশো-পর্যালোচনা : ‘টঙ্গী থেকে কোথায়?’ বলি, বাস্তবতা থেকে কোথায়?!
১-১২-২০১৮ঈ.। টঙ্গীর বিশ্বইজতিমা ময়দানে নিরীহ নিরপরাধ আলিম-তালিবে ইলম ও দ্বীনদার তাবলীগী সাথীদের উপর ন্যক্কারজনক হামলার ঘটনায় ধর্মপ্রাণ প্রত্যেক মুসলিমের হৃদয়ে যে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে তা এখনো শুকায়নি। সেদিনের আক্রমণের শিকার উলামা ও তলাবাদের কেউ কেউ এখনো পর্যন্ত স্বাভাবিক চলৎশক্তি ফিরে পাননি। ফিরতে পারেননি পঠন-পাঠনের কর্মমুখর সাধারণ জীবনে। ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, এই নির্মম হামলার ঘটনাটি ঘটেছে তাবলীগের কাজের সাথে যুক্ত একশ্রেণির লোকের মাধ্যমে।
এই ঘটনা জাতি হিসেবেও আমাদের জন্য লজ্জাজনক। তাবলীগ জামাতকে ঘিরে চলমান বিরোধের উপস্থিতি পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র, কিন্তু মারধর ও রক্তারক্তির এ ন্যক্কারজনক ঘটনাটা ঘটল বাংলাদেশে! বিশ্বইজতিমার আয়োজনকারী দেশের মর্যাদা এতে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। যেমনিভাবে ক্ষুণœ হয়েছে খোদ ইজতিমা ও তাবলীগ জামাতেরও সুনাম।
সংবাদমাধ্যম তার স্বভাব অনুযায়ী একে চিত্রিত করেছে ধর্মের নামে সহিংসতা ও তাবলীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষ হিসেবে। ফলে ঘটনার নেপথ্য কারণ ও এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের আলোচনা থেকে গেছে দৃশ্যপটের বাইরে। হতাহতের যেটুকু খবর উপস্থাপন করা হয়েছে তাও পূর্বাপর ছাঁটাই করে। আর যেসব মন্তব্য প্রতিবেদন বা প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছাপা হয়েছে তাতেও গোড়ার কথাটি না পেড়ে এবং সমস্যার উৎসমূলের সন্ধান না করে আলোচনা করা হয়েছে বিক্ষিপ্ত ও অপ্রাসঙ্গিক নানা বিষয় নিয়ে।
ঘটনার পরদিন বেসরকারি টেলিভিশন ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি একটি টকশোর যে আয়োজন করে। টঙ্গীর ঐ ভয়াবহ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তারা আলোচনার যে বিষয় নির্ধারণ করে, তার নাম দেয়া হয় ‘টঙ্গী থেকে কোথায়?’ অনুষ্ঠানে সঞ্চালক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খালেদ মহিউদ্দিন। আর কথা বলতে স্টুডিওতে উপস্থিত হয়েছিলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মুহাম্মাদ আফজাল এবং সাথে ছিলেন তাবলীগ জামাতের (সা‘দপন্থী) ‘পুরনো সাথী’ জনাব আশরাফ আলী। এছাড়া দূর থেকে আলোচনায় যোগদান করেছিলেন আরেক মাওলানা সাহেব।
আলোচকদের বিভিন্নমুখী বক্তব্য শ্রোতাম-লী ও পাঠকবর্গকে যে বার্তা দেয় তাকে বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা এ লেখার উদ্দেশ্য। যদিও সবার সব বক্তব্যের উপর পর্যালোচনা করা এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে মুশকিল। এর জন্য দরকার দীর্ঘ প্রবন্ধের। তাই আপাতত আমরা অল্প কিছুদিক নিয়েই আলোচনা করব, ইনশাআল্লাহ।
এ সংঘর্ষ কেন?
সঞ্চালক প্রথমেই জনাব আশরাফ আলীর কাছে জানতে চান- ‘আমরা কেন ইজতেমাকে কেন্দ্র করে সহিংসতা দেখছি। সারা পৃথিবীর মানুষকে শান্তির বাণী শোনানোর জন্য এ ইজতেমার আয়োজন করা হয় বলে আপনারা যারা ইজতেমার মুরব্বী আছেন তাদের মুখে শুনেছি। তো ইজতিমার মাঠে এ সংঘর্ষ কেন?’
জনাব আশরাফ আলী এ প্রশ্নের সোজাসুজি উত্তরে না গিয়ে তাবলীগের এই মেহনতের সূচনালগ্ন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত কারা কীভাবে একে পরিচালনা করে আসছেন- সেই ইতিহাস বলতে শুরু করেন। হযতরজী ইলিয়াস রাহ. ও হযরতজী ইউসুফ রাহ.। এরপর তৃতীয় হযরতজী এনামুল হাসান রাহ.-এর যুগে এসে দশ সদস্যের যে শূরা গঠিত হয় এবং তাঁর ইন্তেকালের পর দশজনের মধ্য থেকে আবার তিনজনের যে জামাত তৈরি করে দেয়া হয় কাজ পরিচালনার জন্য। এবং এর কিছুদিন পর একজনের ইন্তেকাল হয়ে যাওয়ায় অবশিষ্ট দুজন : মাওলানা যুবায়েরুল হাসান রাহ. ও মাওলানা সা‘দ সাহেব যে যুগ্মভাবে নেতৃত্ব দিতে থাকেন এই জামাতের, অবশেষে চার বছর আগে (২০১৪ তে) যুবায়েরুল হাসান রাহ.-এরও ইন্তিকাল হয়ে গেলে সর্বশেষ সদস্য হিসেবে সা‘দ সাহেব যে এককভাবে সবকিছু চালাতে থাকেন... এই লম্বা কারগুযারি শোনানোর পর জনাব আশরাফ আলী বলেন, “প্রায় পৌনে দুই বছর তখন তিনি একাই চলতে থাকলেন। এখন কারো কারো কথা আইসা গেল, তাইলে তিনজনে যেহেতু একসঙ্গে ছিল তাহলে এখন আরেকটা জামাত বানাইয়া দেওয়া হোক। একা চলবে, একা চলা বোধহয় ঠিক নয়।... তাই আরেকটা জামাত বানাইয়া দেওয়া হোক। এখানে এসে দুইটা মত দাঁড়াইয়া গেল। শুরুটা হল ওখান থেকে বিরোধের।” মাঝখানে নিজের মন্তব্যও জুড়ে দেন : “আসলে তো একাই [একা চালানোই] ছিল নিয়ম। মাঝখানে একটা সাময়িক কারণে...। যেহেতু ইসলামী নিয়ম অনুযায়ী সবসময় একজন আমীরের অধীনে চইলা আসাটাই সুন্নত।”
জনাব আশরাফ আলী তার এই বক্তব্যে যেমন ১ ডিসেম্বর ইজতিমা মাঠে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনার প্রকৃত কারণ ও নেপথ্যের মূল বিষয়গুলো চেপে গেছেন, তেমনি তাবলীগ জামাতের দু’পক্ষের মাঝে চলমান বিরোধকে (কাজ পরিচালনায়) ইমারতের পদ্ধতি গ্রহণ করা হবে নাকি শুরা পদ্ধতি এই তর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছেন। এভাবে সুকৌশলে আলোচনাকে অন্য খাতে প্রবাহিত করার হীন প্রয়াস চালিয়েছেন। সেইসাথে আশ্রয় নিয়েছেন ইতিহাস বিকৃতি এবং শরয়ী মাসআলার গলত উপস্থাপনের মতো জঘন্য অপরাধের। যদিও এ সবকিছুর পর্যালোচনা এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে সম্ভব নয়।
বিরোধের প্রকৃত কারণ কী?
সচেতন পাঠকমাত্রই জানেন, তাবলীগ ইস্যুতে চলমান দ্বন্দ্ব বিরোধের মূলে রয়েছে মাওলানা সা‘দ সাহেবের চিন্তাগত বিপথগামিতা ও শরীয়া পরিপন্থী বিভিন্ন বক্তব্য ও মনগড়া ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। যেগুলো পরিহার করে সংশোধিত হওয়া ছাড়া বিশ্বব্যাপী পরিচালিত একটি দাওয়াতী মেহনতের কর্ণধার হিসেবে তাকে মেনে নেয়ার অর্থ- কোটি কোটি মানুষের চিন্তা, বিশ্বাস এবং আদর্শ ও মূল্যবোধের বিচ্যুতির পথ উন্মুক্ত করে দেয়া। দ্বীন ও ঈমানের হেফাযত এবং উম্মতের রাহনুমায়ীর দায়িত্বপ্রাপ্ত হক্কানী আলেমসমাজ যা কখনোই হতে দিতে পারেন না; বরং এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক ও সজাগ করাকে তারা নিজেদের কর্তব্য মনে করেন। তারা সেই কর্তব্য পালনের তাগিদে প্রথমত ও প্রধানত সা‘দ সাহেবকে তার ভুলগুলো আন্তরিকতার সঙ্গে ধরিয়ে দিয়ে তার ইসলাহের চেষ্টা করেছেন। তাকে শূরার মধ্যে থেকে কাজ করার আহ্বানেরও অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, তাকে বিচ্ছিন্নতা, বিপথগামিতা থেকে রক্ষা করা। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে চলা এই ইসলাহ ও সংশোধন-চেষ্টা যখন ব্যর্থ হয়েছে এবং একের পর এক তার আচরণে তারা হতাশ হয়েছেন তখন তার চিন্তাগত বিচ্ছিন্নতা ও বিপথগামিতা থেকে সর্বসাধারণকে বাঁচানোর জন্য তার ব্যাপারে আপত্তির কারণগুলো সকলের কাছে স্পষ্ট করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু একদল লোক আলিমদের এই দ্বীনী কল্যাণকামিতাপূর্ণ উদ্যোগকে অভিনন্দন না জানিয়ে একে তাবলীগের বর্তমান ‘আমীরের’ বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা ধরে নেয় এবং তার প্রতি নিরঙ্কুশ, শর্তহীন ও প্রশ্নাতীত আনুগত্য প্রদর্শন করে নিজেদের এতাআতী বলে পরিচয় দিতে থাকে। চলমান সংকটে আলেমরা জাতির সামনে প্রকৃত ব্যাপার তুলে ধরায় তাদের প্রতিই এদের সমস্ত আক্রোশ গিয়ে পড়ে। ইজতিমার ময়দানে উলামা ও তলাবার প্রতি তাদের ভয়ানক সহিংস ও মারমুখী আচরণ থেকে যা দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। সুতরাং ইজতিমার ময়দানের ঐ নৃশংসতম হামলার পিছনে দু’পক্ষের বিরোধের কোনো যোগসূত্র খুঁজতে হলে সেটা এইভাবে, একদল যেখানে চাচ্ছে সা‘দ সাহেব তার ভুলগুলো স্বীকার করে নিজের ইসলাহ করে নিন, অন্যপক্ষ সেখানে তার কোনো ভুল নেই দাবি করে তার প্রতি আনুগত্য আরো জোরদার করছে এবং বিপরীতপক্ষ তার আনুগত্য মেনে নিয়ে তাকে তাবলীগের বর্তমান বিশ্বআমীর হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়ায় তাদের প্রতি বৈরী ও ক্ষাপপা হয়ে উঠছে। এই হচ্ছে বিরোধের ইতিকথা। কিন্তু জনাব আশরাফ আলী তার দীর্ঘ বক্তব্যে এই বাস্তবতাটি আড়াল করার চেষ্টা করেছেন। একই সাথে ১৯৯৫ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত তাবলীগ জামাত যে শুরায়ী নেযামে পরিচালিত হয়েছে সেটাকে হালকা করে নিতান্ত ঠেকার কাজ বলে চালিয়ে দেওয়ারও অপচেষ্টা করেছেন।
যেহেতু দাওয়াত ও তাবলীগের কাজটি একটি দ্বীনী কাজ তাই এটি কুরআন-সুন্নাহ অনুসারে হতে হবে। যারা এই কাজটি পরিচালনা করবেন তাদের চিন্তা-চেতনা, আকীদা-বিশ্বাস আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআর মাপকাঠিতে উন্নীত হতে হবে। কেননা তাদের আকীদা-বিশ্বাসটা যদি ভুল হয় বা তারা যদি শরীয়তের কোনো বিধানে বা দলীলে বিকৃতি সাধনের আশ্রয় নিতে শুরু করেন তাহলে বিশে^র কোটি কোটি মানুষের কাছে ভুল বার্তা যাবে, তারা বিভ্রান্তির শিকার হবে। আর যেহেতু এটা নিছক জাগতিক কোনো কর্মকা- নয়; বরং মুসলমানদের ঈমান-আমলের প্রশ্ন এখানে জড়িত, তাই এই বিশাল দাওয়াতী প্রতিষ্ঠানটির কর্তাব্যক্তিদের বিচ্ছিন্নতা ও চিন্তাগত বিপথগামিতা স্পষ্ট হওয়ার পরও চুপ করে থাকার উপায় নেই। তাই দারুল উলূম দেওবন্দের প্রকাশিত ফতোয়া ও শরয়ী মতামতের ভিত্তিতে হক্কানী আলেমসমাজ তার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছেন। তাদের কথা হল, কাজের শরয়ী উসূল পরিবর্তন করা যাবে না। কাজে বিদআত ঢোকানো যাবে না। কাজের যিম্মাদারগণের আকীদা-বিশ্বাস আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মোতাবেক হতে হবে। তাদের বয়ান সবপ্রকারের গোমরাহী ও বিকৃতিমুক্ত হতে হবে। এই তো তাদের দাবির সারকথা। তাদের এ দাবি ও আহ্বান বিরোধের সূত্রপাতের কারণ হবে কেন? বরং এটাই তো শরঈ নীতিমালার আলোকে বিরোধ নিরসনের একমাত্র মাধ্যম! আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ্র নীতি ও আদর্শ ছাড়া মুসলিম উম্মাহ্র মাঝে ঐক্য ও সংহতি রক্ষার আর কি কোনো ব্যবস্থা আছে? কিংবা নিজেদের কর্মতৎপরতার ভুল-শুদ্ধ বিচারের আর কি কোনো মানদ- আছে?
দায়ী কে, আপরাধী কারা?
“যেহেতু মাঠে ছিলেন বাংলাদেশের কওমী মাদরাসার কওমী নেসাবের ছাত্ররা। সা‘দপন্থীরা দশটা-এগারটার সময় মারমুখী হইয়া চতুর্দিকে তাদেরকে মাঠ থেকে বের করার জন্য আক্রমণ শুরু করেছে। সেখানে সরকারও যায় নাই, পুলিশও যায় নাই, সাধারণ লোকও যায় নাই। তারা গিয়েছে। সেজন্য আমি মনে করি, ওনারা এটা ভুল করেছেন।” সামীম মোহাম্মদ আফজালের এই অভিযোগর সূত্র ধরে সঞ্চালক জনাব আশরাফ আলীকে জিজ্ঞেস করেন, “জনাব সামীম আফজাল প্রশ্ন করলেন এবং আমাদেরও প্রশ্ন ছিল যে, প্রেক্ষাপটটা একটু বলবেন কি না। কেন নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের উপর হামলা করা হল...? আর গতকাল যে আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে তার পটভূমিই বা কী?
এই সুনির্দিষ্ট প্রশ্নে জনাব আশরাফ প্রথমে মুখ ফসকে স্বীকার করে ফেলেন এই পুরো ঘটনার নেপথ্যে তার কুশীলবের ভূমিকা পালনের কথা। পরে নিজেকে সামলে নিয়ে আলোচনার মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেন। কিন্তু ইনিয়ে বিনিয়ে বলা লম্বা বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে ১ডিসেম্বর তাদের ঐ আক্রমণের পটভূমিটা খুব স্পষ্ট করেই বলে ফেলেন। কেন তারা ময়দানে গিয়েছেন, কেন গেইট ভেঙ্গেছেন এবং এই সবকিছু করার আগে এ বিষয়ে প্ল্যান স্থির করেছেন... সবকিছুই উঠে এসেছে তার ‘বক্তৃতায়’। তার সেই তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্যের কয়েকটা লাইন দেখুন (তার ভাষায়) :
১. “গতকালের আক্রমণের ঘটনার পিছনের পটভূমিটা, সবচেয়ে বেশি আমার কাছে এটার খবর এজন্য আছে যে, এটাতে আমার অনেক কাজ করতে হয়েছে।”
২. “গত বছরে ইজতিমার আগে থেকেই
মাঠে মাদরাসার একটা অংশ, ছাত্রদের এবং মাদরাসার অংশরা সেই মাঠটাকে একরকম দখল করে রাখছে। অন্য পক্ষকে ওখানে কোনো প্রোগ্রাম করতে দেয়া হচ্ছে না। অথচ এটা সরকারি মাঠ।”
৩. “দুইটা দল হয়ে যাওয়ার পরে আমাদের যে মাওলানা সা‘দ সাহেবের সঙ্গে যারা আছেন, সবসময় এই প্রবণতা নিয়ে আমরা কাজ করতেছি, প্রস্তাব দিয়ে যাচ্ছি যে, সমান অধিকারে সমানভাবে সবাই কাজ করুক।”
৪. “যখন এরা সবসময় একটা গোঁয়ারতুমি করে যাচ্ছে যে, আমরা কোনো প্রতিষ্ঠান চালাইতে গেলে আমাদের জামাতকে বাধা দেয় এবং তারা মশওয়ারা করল যে, নিযামুদ্দীন থেকে জামাত আসবে না, সা‘দ সাব বাংলাদেশে আসতে পারবে না এবং এসমস্ত জিনিস উনারা যখন ঘোষণা করতে থাকল, ওয়াযাহাতি জোড়ের নামে আমাদের বদনাম, আমাদের যিম্মাদারের বদনাম তারা ব্যাপকভাবে চালাইতে থাকল তখন এটার বিরূপ প্রতিক্রিয়া হইতে হইতে এক বছরে গিয়া এই নতিজায় পৌঁছল যে, আমাদের পাঁচ দিনের জোড় এই (নভেম্বরের) ৩০ তারিখে ছিল। মজমাটা যেটা আসছিল। সেই ৩০ তারিখের পাঁচ দিনের আগে আমরা সরকারের কাছেও গেছি, বারবার গেছি, নির্বাচন কমিশনারের কাছে গেছি। ওনারা বলছে যে, আমাদের তরফ থেকে পূর্বনির্ধারিত বিষয় হিসেবে কোনো আপত্তি নাই।”
৫. “পরে যখন আমরা গাজীপুরের কমিশনারের কাছেও গেছি আপত্তি নাই বলে, তো উনি বলেছেন, দেখেন আপনারা মাঠের ভিতরে কীভাবে করবেন? নির্বাচনের আগে তো বড় ধরনের গ্যাদারিং করা যাবে না। আমরা বললাম, তাইলে এক কাজ করেন। ঠিক আছে, করা না গেলে আমরা করব না। কিন্তু তারা প্রচার করতেছে যে, আমরা করব। যেহেতু আমরা দুইটা পক্ষ হয়ে গেছি তাবলীগের মধ্যে, এখন একটা পক্ষ যদি অধিকার পায় তাহলে আরেকটা পক্ষ পাওয়ার দরকার। আর না পেলে উভয়ে না পাওয়া দরকার।”
৬. “আর সেটা তখনই সম্ভব হবে, মাঠটা যদি উভয় পক্ষ থেকে মুক্ত হয়ে সরকার তার অধিকার গ্রহণ করে। তখন ন্যায্যভাবে যার যা পাওনা সেটা দেয়।”
৭. “যেদিন গ-গোল হল, এর আগের দিন রাত্রেও গাজীপুরের পুলিশ কমিশনারের কাছে আমি সর্বশেষ আলাপ করেছি এই কথা, কারণ ওদের কাছে আমাকে বারবার যাইতে হইছে রিলেটেড হওয়ার কারণে...।”
৮. সঞ্চালক : “আপনারা গেইট ভেঙ্গে ঢুকেছেন?”
আশরাফ : “হাঁ, গেইট তো ভাঙতে হইছে। কারণ তার শেষ পরিণামটা শুনলেই বুঝতে পারবেন। আমরা যেরকম পূর্বেও বলেছি যে, আমাদেরকে শুধু আপনারা এটা করেন, সরকার জমিটা গ্রহণ করে নেক। যেন নিরপেক্ষভাবে দরকারের সময় উভয়কে ব্যবহারের সুযোগ দিতে পারে। এবং ঐসময় রাত্রে নয়টার সময়ও কমিশনারকে আমি এই প্রস্তাবটাই দিছি।”
এপর্যায়ে সঞ্চালক সামীম আফজাল সাহেবকে প্রশ্ন করেন, “গতকাল যে একজন মারা গেছেন এটির জন্য কোনো মামলা হওয়া উচিত কি না?”
সামীম : “যেহেতু একজন লোক মারা গেছে, অবশ্যই একটা মামলা হতে হবে। কিন্তু আশরাফ আলী সাহেবের কথা অনুসারে প্রথমেই তো উনি দায়ী হয়ে যান। কারণ উনি নিজে স্বীকার করছেন, গেইট ভেঙ্গে ওনারা ঢুকেছেন এবং যারা মাঠের ভিতরে ছিল তাদের ওপর ওনারা আক্রমণ করেছেন। তাহলে লোক উনার মারা গেছে, নাকি ঐ পক্ষের সেটা আমার জানার বিষয় না।”
দলাদলিটা কারা শুরু করল?
পাঠক লক্ষ করেছেন, জনাব আশরাফের নিজের বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, আক্রমণটা তারাই করেছিলেন এবং মাঠের অধিকারে সমান ভাগ পেতে সবকিছু ছিল আগে থেকে সাজানো। সুতরাং তার এই দ্ব্যর্থহীন স্বীকারোক্তির পর আর কোনো প্রমাণ না হলেও চলে। তবে কয়েকটা প্রশ্ন তাকে করতে হয় তার কথার সূত্র ধরেই :
ক. তিনি যে অভিযোগ করছেন ‘মাদরাসার ছাত্ররা মাঠ দখল করে রেখেছে অথচ মাঠে দু’পক্ষেরই সমান অধিকার পাওয়ার দরকার’- দয়া করে যদি বলতেন, কোন্ ঘটনার মধ্য দিয়ে তারা মাঠের অধিকার হারিয়েছেন?
খ. তিনি যে বলেছেন, ‘যেহেতু দুইটা দল হয়ে গেছে...’ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দলাদলিটা শুরু করেছে কারা, সেই ইতিহাসটা যদি একটু স্মরণ করতেন?
গ. কখন থেকে তারা সবকিছু আলাদা আলাদা করতে চাইছেন, কোন্ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে, সেটা যদি জনসম্মুখে স্পষ্ট ভাষায় বলতেন!
ঘ. তিনি অভিযোগ করেছেন, ‘সা‘দ সাহেবকে বাংলাদেশে আসতে বাধা দিয়েছে মাদরাসার লোকেরা’, কিন্তু সেই বাধাদানের কী কারণ তা যদি একটু হলেও স্পষ্ট করতেন!
জনাব আশরাফ আলী সাহেবের জানা থাকা উচিত যে, উলামায়ে কেরাম যা কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন দীনী কল্যাণকামিতার ভিত্তিতেই নিয়েছেন। পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত ও বিশৃঙ্খল করেছেন সাদপন্থী ভাইয়েরা। বিবাদ-বিসংবাদও তারাই তৈরি করেছেন। নি¤েœাক্ত প্রেক্ষাপট একটু স্মরণ করুন :
১. মাওলানা সা‘দ সাহেবের বয়ানে উপস্থিত আপত্তিকর বিষয়সমূহ এবং মাওলানা সা‘দ সাহেব কর্তৃক কাজের নাহজ পরিবর্তন করা এবং শূরা না মেনে নেওয়ার কারণে ২০১৬ ঈ.-এ উলামায়ে কেরামের প্রতিনিধি দল কাকরাইলে উপস্থিত হয়ে লিখিত আবেদন করেছিলেন যে, এসব বিষয় সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত মাওলানা সাঙদ সাহেবকে যেন এখানে দাওয়াত না করা হয়।
২.কাকরাইলের শূরার পক্ষ থেকেও মাওলানা সা‘দ সাহেবকে ২৭/১২/২০১৬-এ লেখা হয়েছিল যে, তিনি যেন ইজতিমার আগে (নিজেকে ইসলাহ করে) দারুল উলূম দেওবন্দকে আশ্বস্ত করেন এবং আশ্বস্ত করেই বাংলাদেশে তাশরীফ আনেন। যাতে এখানকার উলামায়ে কেরাম তার ব্যাপারে আশ্বস্ত হতে পারেন। সকল শূরার পক্ষ থেকে চিঠিতে দস্তখত রয়েছে খান মুহাম্মাদ শিহাবুদ্দীন নাসিম ভাইয়ের।
৩. ২০১৭-এর ইজতিমার আগে অনুষ্ঠিত জোড়ে নিযামুদ্দীন থেকে আসা জামাতকেও উলামায়ে কেরামের প্রতিনিধি দল মাওলানা সা‘দ সাহেবের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেওয়ার কথা বলেন।
৪. এই জোড়ে ভাই নাসীমের উপস্থিতিতে ওয়াসিফুল ইসলাম সাহেব উলামায়ে কেরামের প্রতিনিধি দলকে পরিষ্কার বলেছিলেন, যে পর্যন্ত দেওবন্দ আশ্বস্ত না হবে সে পর্যন্ত আমরা মাওলানা সা‘দ সাহেবকে এখানে আনব না। আর যদি আনিও বয়ান দিব না।
এই সব কিছু সত্ত্বেও ওয়াসিফুল ইসলাম সাহেব ওয়াদাখেলাফী করে ২০১৭-এর ইজতিমায় সুকৌশলে মাওলানা সাদ সাহেবকে দাওয়াত করেন এবং তার মাধ্যমে বয়ানও করান। অথচ তিনি সরকারের সাথেও ওয়াদা করেছিলেন যে, সাদ সাহেবকে কোনো বয়ান দিবেন না।
৫. ঐ ইজতিমায় তাবলীগের বড়দের অধিকাংশের অনুপস্থিতিতে মশোয়ারার নামে সম্পূর্ণ সাজানো একটি নাটকের আশ্রয় নিয়ে মাওলানা সাদ সাহেবকে কাজের আমীর বানানো হয়, অথচ না এর জন্য কোনো মশোয়ারা-মজলিস অনুষ্ঠিত হয়েছে আর না তা মশোয়ারার উমূরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। না এর জন্য প্রস্তাবাদি উত্থাপিত হয়েছে আর না কোনো ফায়সাল এর ফয়সালা করেছে। এরপরও একে মশোয়ারার মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্তের মতো গোটা দুনিয়ায় প্রচার করা হয়।
৬. ২০১৮-এর ইজতিমার আগে যে জোড় হয়েছিল সে জোড়ে নিযামুদ্দীন থেকে কেউ আসবেন না- সর্বসম্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে থাকলেও নিযামুদ্দীনের একটি জামাত আনা হয়। কিন্তু প্রশাসন থেকে অনুমতি না পাওয়ার কারণে তারা মাঠে যেতে পারেননি। এদিকে ওয়াসিফুল ইসলাম সাহেব ও নাসিম সাহেব জোড়ে উপস্থিত হননি; বরং উপস্থিত অনেককে ফোন করে করে বাইরে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন তারা।
৭. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে কাকরাইলের আহলে শূরার মধ্যে সমঝোতার জন্য উলামায়ে কেরামের যে জামাত গঠন করা হয়েছিল, যাদের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার তারা মৌখিক ও লিখিত ওয়াদাও করেছিল। অথচ কিছুদিন যেতে না যেতেই সা‘দপন্থী শূরাগণ কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই তা মানতে অস্বীকার করে।
৮. ২০১৮-এর ইজতিমায় মাওলানা সাদ সাহেবের তাশরীফ আনার বিষয়ে ফায়সালার জন্য মতামত জানতে প্রশাসন ও উলামায়ে কেরামের যৌথ একটি প্রতিনিধি দল দেওবন্দ ও নিযামুদ্দীন সফর করে। তারা দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে মাওলানা সা‘দ সাহেবের প্রতি অনাস্থা বহাল থাকার সংবাদই নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে কাকরাইলের শূরা ও উলামায়ে কেরামের যৌথ মজলিসে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, তিনি ২০১৮-এর ইজতিমায় আসবেন না। এর পরও তিনি তাশরীফ আনেন। এর পিছনে কে বা কারা সক্রিয় ছিল তা আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন।
এর পরের অবস্থা টঙ্গী হালকার একজন পুরনো সাথীর মুখে শুনুন। যদিও সবকিছুই জানা শোনা বিষয়, বিশেষ কারো উদ্ধৃতির এখানে প্রয়োজন পড়ে না। তিনি বলেন, “মাওলানা সা‘দ সাহেব ইজতিমার মাঠে যাওয়ার অনুমতি না পেয়ে কাকরাইল মসজিদে অবস্থান নেন। ইজতিমার তখন চূড়ান্ত সময়। টঙ্গীর মাঠে লক্ষ লক্ষ মুসল্লি। রাত পেরুলেই ইজতিমা শুরু। এর মাঝে হঠাৎ করে নযমের একদল মুরুব্বী মাঠ ছেড়ে, তাদের নির্ধারিত দায়িত্ব ও কাজ ফেলে কাকরাইলে চলে যান সা‘দ সাহেবের কাছে এবং কাকরাইলেই তারা ইজতিমা করার উদ্যোগ নেন এবং বিভিন্ন মাধ্যমে টঙ্গী ময়দান থেকে সাথীদেরকে সেখানে জড়ো করার চেষ্টা করেন। শুরু হয় চরম বিশৃঙ্খলা, বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব থেকে আগত লক্ষ লক্ষ সাথীর সঙ্গে এ তামাশার মধ্য দিয়েই তারা শুরু করেন একটি ভিন্ন ধারা ও জামাত।
“এই ঝামেলা ও বিশৃঙ্খলাকে অফিসিয়াল রূপ দেয় সা‘দ সাহেবের একটি সিদ্ধান্ত বা ফয়সালা। সে ফয়সালার নাম ‘উমুরে বাংলাদেশ’। এ উমুরে বাংলাদেশ নামক ফয়সালায় সা‘দ সাহেব তার ব্যক্তিগত মতামত খাটিয়ে তাবলীগের এতদিনের চলে আসা বেশ কিছু নিয়ম-কানুনকে নিজের মর্জিমত নির্ধারিত করে দিয়ে যান। এতে তিনি যে কয়টি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তার মধ্যে পরবর্তী ইজতিমার তারিখ নির্ধারণ ও জোড়ের দিন-তারিখ নির্ধারণ উল্লেখযোগ্য।
“এদিকে টঙ্গীর মাঠেও একটি ফয়সালা হয়। মাঠে উপস্থিত মুরুব্বীগণ এবং শুরার হযরতগণ সম্মিলিতভাবে সাথীদের সামনে ইজতিমার তারিখ ঘোষণা করেন। নিয়ম অনুযায়ী ইজতিমার মাঠেই পরবর্তী ইজতিমা ও জোড়ের তারিখ ঘোষণা হয়ে থাকে, এটাই ঐতিহ্য। সে হিসেবেই বিগত টঙ্গীর ইজতিমায় স্বয়ং প্রশাসনের সাথে আলোচনার মাধ্যমে পরবর্তী ইজতিমা ও জোড়ের তারিখ ঘোষিত হয়। ওদিকে সা‘দ সাহেব যেহেতু ‘উমুরে বাংলাদেশ’-এ ভিন্ন তারিখ ফয়সালা করেছেন তাই সবকিছুই ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়।
“তো ওনারা যেহেতু মাঠ ছেড়ে চলে গিয়ে মাঠের আলেম-উলামা এবং সাধারণ তাবলীগী ভাইদের সাথে বিরোধ ঘোষণা করেন তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা এখন মাঠে বহিরাগত হিসেবে গণ্য হন এবং টঙ্গীমাঠ আসল তাবলীগীদের সিদ্ধান্তেই থেকে যায় এবং মাঠের যিম্মাদারি জুমহুর উলামাপন্থী ব্যক্তিদের হাতেই থেকে যায়।”
এ সূরতে হাল থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, সা‘দপন্থীরা নিজেরাই ময়দান ছেড়ে চলে এসেছিলেন। এমন নয় যে, তাদেরকে ময়দান থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। এরপর বিশৃংখলা ও বিভক্তির সূচনা তারাই করেছেন, উলামায়ে কেরামের কল্যাণকামিতাপূর্ণ শরয়ী নির্দেশনা গ্রহণ না করে এবং শূরায় গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে।
তালীম থেকে উঠে সোজা মারপিটে?!
জনাব আশরাফকে সঞ্চালক প্রশ্ন করেন : এটি কি ঠিক যে, “আপনারা টঙ্গীর মাঠে যে নিরস্ত্র নিরীহ মাদরাসার ছাত্র বা যারা ছিল তাদের উপর আক্রমণ করেছেন?”
আশরাফ : “আমাদের হাতে অস্ত্র ছিল কি না (সঞ্চালক : লাঠি ছিল?) সমস্ত মিডিয়াতে তার প্রমাণ যে, লাঠি তো সব ভিতরে ছিল এবং ইটপাটকেল সব ভিতরেই ছিল। সারা রাস্তায় তো সাধারণ সাথীরা নিরবিচ্ছিন্নভাবে তালীম করতেছিল বসে বসে।”
সঞ্চালক : “আপনারা গেইট ভেঙে ঢুকেছেন?”
আশরাফ : হাঁ, গেইট ভাঙতে হইছে। কারণ তার শেষ পরিণামটা শুনলেই বুঝতে পারবেন। আমরা যেরকম পূর্বেও বলেছি যে, আমাদেরকে শুধু আপনারা এটা করেন, সরকার জমিটা গ্রহণ করে নেক। যেন নিরপেক্ষভাবে দরকারের সময় উভয়কে ব্যবহার করার সুযোগ দিতে পারে এবং ঐ রাত্রে নয়টার সময়ও কমিশনারকে আমি এই প্রস্তাবটাই দিছি। ওনারা বারবার ভিতরে গিয়েও প্রস্তাব দিছে। যখন ওরা ভিতর থেকে পরে আরো ইটপাটকেল ছোড়া শুরু করল...।”
জনাব আশরাফকে প্রশ্ন করা হল, তারা আক্রমণ করেছেন কি না? উনি এর সোজা উত্তর না দিয়ে বললেন, আমাদের কাছে অস্ত্র ছিল না; লাঠি-ইটপাটকেল সব ভিতরে ছিল। সেজন্য সঞ্চালক তাকে কষে ধরলেন, ‘আপনারা গেইট ভেঙেছেন কি না?’ এবার আর কথা ঘুরানোর কোনো সুযোগ পেলেন না। বললেন, উনাদেরকে গেইট ভাঙ্গতে হয়েছে মাঠের দখল নেওয়ার জন্য। আর গেইট ভাঙ্গার পর তারা কী করেছেন, তার কিছু অংশের হলেও ভিডিও এখনো অনেকের কাছে সংরক্ষিত আছে। আর এটাও জানা কথা যে, ঐ দিন জোড়ের নামে যারা মাঠ ঘেরাও করেছিল তাদের অনেকের ব্যাগে রড ছিল। কোনো কোনো মসজিদ থেকে মাঠের দিকে আসার সময় এরা নিজেদের ব্যাগে পাথর ঢোকাতেও দেখা গেছে। আক্রমণকারীরা যাতে না চেনার কারণে নিজেদেরই কারো আক্রমণের শিকার না হয় সেজন্য বিশেষ রঙের ফিতাও যে ব্যবহার হয়েছে সেটাও জানাশোনা বিষয়। যাইহোক, আক্রমণ উনারা করেছেন, গেইট উনারা ভেঙেছেন এ কথা স্বীকার করার পর অতিরিক্ত আলোচনার প্রয়োজন হয় না।
জনাব আশরাফের বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হয়েছে, জোড়টা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। ছিল উপলক্ষ মাত্র। আসল মাকছাদ ছিল, মাঠকে প্রতিপক্ষের দখলমুক্ত করা। জোড়ই যদি উদ্দেশ্য হত তাহলে ময়দানে আসার সময় ঢাকার বিভিন্ন মসজিদে তারা তাদের সামানাপত্র রেখে এসেছিলেন কেন?
এইসব কিছুর পর এখন খামোখা কেন ভিতর থেকে প্রথমে ইটপাটকেল ছোড়ার বাহানা পেশ করা হচ্ছে। গেইট তো তার ভাষ্যমতে তারা ভেঙেছেন মাঠের দখল নিতে। বাস্তবে যদি ভেতর থেকে ইটপাটকেল মারাও হয়ে থাকে সেটাও ষড়যন্ত্র হতে পারে। কারণ এটাও প্রমাণিত যে, সেদিন মাঠের ভেতরে অনেক এতাআতীও মওজুদ ছিল।
এখানে আরেকটা প্রশ্ন এসে পড়ে খুব স্বাভাবিকভাবে। আর তা হচ্ছে, একটা মাঠে নিজেদের দখল প্রতিষ্ঠার জন্য এত রক্তপাতের প্রয়োজন ছিল কি? বিশেষত দখলে থাকা মানুষগুলো যেখানে ছিল নিরস্ত্র ও তাদের বিশাল বহরের মোকাবেলায় খুবই নগণ্যসংখ্যক?! একারণেই সেদিনের হামলার শিকার অনেকে মন্তব্য করেছেন, “ওদের হামলার ধরন দেখে মনে হয়েছে ওরা সেদিন আমাদের মেরে ফেলার জন্যই এসেছিল।” বিশ্লেষকরা এই প্রাণনাশী হামলার কী লক্ষ্য, তাও নির্দেশ করেছেন : সেটা হল, এদেশে গলত এতাআতের মতাদর্শ প্রচারের প্রধান প্রতিবন্ধক আলেম-উলামাদের চরম শিক্ষা দেয়া, যাতে তারা এরপর তাবলীগের নাম পর্যন্ত না নেয়...!
‘এমন কী ঘটল যে তারা মারমুখী?’
সঞ্চালক তৃতীয় জনকে প্রশ্ন করেন, “এ ব্যাপারে আপনার কী বক্তব্য যে, ইজতেমা ময়দানকে কেন্দ্র করে গতকাল আমরা যে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা দেখলাম তার জন্য আপনি আসলে কাকে দায়ী মনে করেন এবং আপনি কি মনে করেন যে, এর কোনো সমাধানে আসা সম্ভব?”
জবাবে ওই ব্যক্তি শুরুটা করেন এভাবে : ‘যা ঘটেছে এটা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক... এ ঘটনার জন্য আমি নিন্দা জানাই। আমি সকলকে বলব, তওবা করে এবং নির্ভেজালভাবে তাওবা করে আল্লাহ্র কাছে যেন সকলেই ফিরে আসেন।” এরপর কারা দায়ী সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু না বলে এবং দেওবন্দের ফতোয়া ও অন্য সকল বাস্তবতাকে এড়িয়ে গিয়ে তৃতীয় পক্ষের উপর সমস্ত দায়-দায়িত্ব চাপিয়ে দেন। তার ভাষায় : “পৃথিবীতে আল্লাহ তাআলা এমন সমস্যা দেন নাই, যেটা সুরাহাযোগ্য নয়। তবে আমার মনে হয় যে, কোনো তৃতীয় পক্ষ বোধহয় এর মধ্যে আছে, যারা এদেরকে কাছাকাছি আসতে দিচ্ছে না।”
কেন তার এরকম ধারণা হল সে প্রসঙ্গে বলেন, “কারণ, এরা এরকম লোক ছিলেন, যারা এতদিন একসাথে চলেছেন একসাথে বসে খেয়েছেন... কিন্তু এমন কী ঘটল, যার কারণে তারা মারমুখী?”
‘এমন কী ঘটল’ একথার বিস্তারিত ব্যাখ্যা যদিও তিনি করেননি, কিন্তু পরে সঞ্চালকের আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমার কথা হইল, পূর্বেও যেমন সম্প্রীতি সৌহার্দ্য সহকারে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ হয়েছে এখনো যেন সেইভাবেই হয় এ প্রত্যাশাই রাখি। আর এটা সম্ভবও। কখন সম্ভব, ঐ যে তৃতীয় পক্ষের কথা বললাম। এদের নাক গলানো যখন বন্ধ হয়ে যাবে...। যারা নাকি আমরা তাবলীগের সাথে জড়িত নই বা ভালোবাসি, কিন্তু সেইভাবে আমরা সময় দিচ্ছি না- তাদেরকে এই বিষয়ে নাক গলানোর সুযোগ দেওয়াটাকে আমি ঠিক মনে করি না।”
তার এই কথা থেকে বোঝা যায়, তিনি বলতে চাচ্ছেন যে, এই ঘটনাতে মূল দোষটা সেই তৃতীয় পক্ষের, তাদের নাক গলানোতেই যত হট্টগোল, আক্রমণকারী সা‘দপন্থীদের এখানে কোনো দোষ নেই।
তৃতীয় পক্ষের কাঁধে দোষ চাপিয়ে নিজেদের দায়মুক্ত করার এমন ‘চান্স’টাকে লুফে নিতে ভুল করেননি- ইতিমধ্যেই দোষী সাব্যস্ত হয়ে যাওয়া জনাব আশরাফ। তাই এরপর কথা বলার আমন্ত্রণ পেতেই তিনি দাবি করে বসেন : “প্রতিষ্ঠানটা যতদিন নাকি আগের যে নিয়মে চলতেছিল ...ততক্ষণ বেশ সুন্দরই চলতেছিল, কিন্তু যখন নাকি এখানে মাদরাসাপক্ষ থেকে এসে উলামারা দাবি শুরু করলেন যে, আমরা এটা চালাব তখনই বিশৃঙ্খলা শুরু হয়ে গেল’!
জনাব আশরাফ তার এই বক্তব্যে ‘তৃতীয় পক্ষের’ তরজমাটা খুব সুন্দরভাবেই করে দিলেন। অর্থাৎ তাবলীগের চলমান সংকট নিরসনে যে সব উলামায়ে কেরাম এগিয়ে এসেছেন তারাই হলেন দু’পক্ষের সম্প্রীতি বিনষ্টকারী সেই তৃতীয় পক্ষ। আর তাদের ‘নাকগলানো’-এর তরজমাটা কী? এক কথায় সেটা হল সর্বস্তরের তাবলীগী ও দ্বীনদার শ্রেণীর সামনে প্রকৃত ব্যাপার উপস্থাপন- কেন মাওলানা সা‘দ সাহেবকে একটা দ্বীনী জামাতের দ্বীনী যিম্মাদার মানা যাবে না। শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে তার আনুগত্যে বাধা কোথায়, তার ব্যাপারে দারুল উলূম দেওবন্দের ফতোয়ায় কী বলা হয়েছে, তার প্রতি হক্কানী উলামায়ে কেরামের অনাস্থা প্রকাশের কারণ কী, তার মৌলিক ভুল ও ভ্রান্তিগুলো কী কী ইত্যাদি।
দ্বীনী দায়িত্ববোধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উম্মতের কঠিন দুর্দশার মুহূর্তে সঠিক দিকনির্দেশনা তুলে ধরতে তাদের এই প্রাণান্তকর প্রচেষ্টাকে যখন কেউ অযথা নাক গলানো বলে আখ্যায়িত করে বা এটাকে পরিচালনায় দখল দেয়া মনে করে তখন বিস্ময়ের অন্ত থাকে না।
দারুল উলূম দেওবন্দের ফতোয়ায় কী বলা হয়েছে, উলামায়ে কেরাম কী বলেছেন তা তো জানাই আছে। বই আকারে তা জাতির সামনেও এসেছে। সেখানে তো জোরালোভাবে বলা হয়েছে, কেউ যেন কারো হক নষ্ট না করে, জুলুম না করে। গায়ে হাত তোলা তো দূরের কথা, কোনো অন্যায় কথাও যেন কেউ না বলে।
যারা এত বছর একসাথে থেকেছেন, খেয়েছেন... তাদের মধ্যে হঠাৎ এমন কী ঘটল যে, তারা আজ পরস্পর বৈরী- এ প্রশ্ন তো আমাদেরও। আমরা যেটা দেখি তা হল, তিন হযরতজীর আমলে তো সবাই একসঙ্গেই ছিল। এখন যে বিভেদ দেখা দিয়েছে সেটা মাওলানা সা‘দ সাহেবের আমলেই শুরু হয়েছে। তার আমলেই দেখা যাচ্ছে, একটা শ্রেণী প্রচ-রূপে মারমুখী হয়ে উঠেছে। আর এই শ্রেণী কোন্টা এটাও আমরা ১২/১-এ টঙ্গীর ময়দানে দেখলাম। অতএব মারমুখী শ্রেণী কোন্টা তা চিহ্নিত। কেন তারা প্রচ- মারমুখী, এর নেপথ্য কারণ তো তারাই বলতে পারবেন, যারা এদেরকে আগ্রাসী করে তুলেছেন। তারা কোন্ কোন্ বক্তব্যের মাধ্যমে, কী কী উপায়ে এদেরকে যুদ্ধোন্মাদ করে তুলেছেন, এটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে আমরা যেটুকু বলতে পারি সেটা হল, মাওলানা সা‘দ সাহেবের ভুল ও ভ্রান্তিগুলো থেকে ফিরে না আসা, উল্টো ঐ ভুলগুলোর পক্ষে হুজ্জতবাজি করে সেই ভুল চিন্তা, বিশ্বাস ও মতাদর্শের উপরই তার অনুগত উপদলটিকে অটল অবিচল করে তোলার কাজটা যারা করে যাচ্ছেন তারা কিছুতেই এর দায় এড়াতে পারেন না। আলিম-উলামার দলীলভিত্তিক আলোচনার যুক্তিসঙ্গত কোনো জবাব তাদের কাছে না থাকায় তারা এই শ্রেণীটাকে ক্রমান্বয়ে মারমুখী করে তুলেছেন। এর প্রমাণও আমাদের কাছে আছে। ছোট্ট একটা উদাহরণ :
সা‘দপন্থী নামধারী মাওলানা শায়েখ আবদুল্লাহ মনসুর তার الإمارة هي السنة নামক কিতাবের ১৬ নং পৃষ্ঠাতে যা লিখেছেন তার সারকথা হল : যারাই মাওলানা সা‘দ সাহেবকে আমীর হিসাবে মানবে না তারাই ‘বিদ্রোহী’ ও ‘ফিতনাবাজ’দের অন্তর্ভুক্ত এবং তাদেরকে কতল করা ওয়াজিব!
তো যারা সংশোধনকামী উলামা ও হকপন্থী তাবলীগীদের ওয়াজিবুল কতল সাব্যস্ত করে, তারা ছাড়া একটি শ্রেণীকে আর কে উত্তেজিত করবে? মূলত তারাই পরিকল্পিতভাবে এই শ্রেণীটিকে উলামায়ে কেরামের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
তাঁকে নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই?!
“...তাবলীগটা চলবে। কিন্তু এখানে একজন বিতর্কিত লোককে পারিবারিক ওয়ারিসসূত্রে বসানোর ওনাদের যে পরিকল্পনাটা, এটা আমার মনে হচ্ছে জাতীয় স্বার্থে এটা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না।” সামীম মোহাম্মদ আফজালের এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে সঞ্চালক জনাব আশরাফ আলীর কাছে জানতে চান, “প্রশ্ন যেটা উঠেছিল যে, এরকম একটা পদে কি একজন বিতর্কিত লোককে রাখা যায় কি না?”
এর জবাবে জনাব আশরাফ সাহেব প্রথমে মাওলানা সা‘দ সাহেব যে বিতর্কিত এ কথাকেই অস্বীকার করেন। তিনি ধারণা দিতে চেষ্টা করেন যে, বিতর্ক কিছু থাকলে সেটা শুধু বাংলাদেশে। তার ভাষায়, “বিশ্ব এখন ছোট। বাংলাদেশ ছাড়া দুনিয়ার আর কোনো দেশে এ ধরনের কোনো বিষয় আপনারা পাইছেননি?”
সোজা কথায় তার দাবি, বাংলাদেশ ছাড়া সারা দুনিয়াতে কোথাও সাদ সাহেবকে নিয়ে বিতর্ক নেই। জনাব আশরাফ আলী সাহেব যেহেতু মাওলানা সা‘দ সাহেবের পক্ষে ব্যাপকভাবে কাজ করেছেন তাই এটা তার জানা থাকা দরকার এবং অবশ্যই তিনি এটা জানেন যে, বিশে^র যত দেশে এই দাওয়াত ও তাবলীগের মারকায আছে প্রায় সবখানেই এই বিভক্তিটা হয়ে গেছে।
মাওলানা সা‘দ সাহেবের বিতর্কিত বক্তব্য ও অবস্থানের কারণে তাকে নিয়ে বিতর্কটা খুব জোরেশোরেই চলছে সবখানে। জেনেবুঝে এই বিভক্তির তথ্যটা গোপন করার জন্য তিনি ঠুনকো একটা যুক্তির আশ্রয় নিলেন- “সারা দুনিয়াতে যেখানে ওনার সম্পর্কে বিতর্ক নেই। আর যদি থাকত আপনারা জানতেন, আর তাইলে সারা দুনিয়াতে উনি ইজতিমা করে বেড়াইতেন না।”
সারা দুনিয়াতে তিনি কাদের নিয়ে ইজতিমা করে বেড়াচ্ছেন, আর বিশ্বের দেশে দেশে তার ব্যাপারে মানুষের প্রতিক্রিয়া কী, জনাব আশরাফ সে বিষয়েও যদি একটু বলতেন! আর বাংলাদেশ ছাড়াও কোনো কোনো দেশে যে সা‘দ সাহেবকে ইজতিমায় শরীক হতে দেয়া হয়নি সে বিষয়টিও তিনি পুরোপুরি এড়িয়ে গেলেন।
একপর্যায়ে আশরাফ সাহেব বলেন যে, কিছু ভুল আছে ওনার। তবে সেটা বড় কিছু না : “একটা মানুষ যখন অহরহ প্রতিদিনে সাত-আট ঘণ্টা দ্বীনের কথা বলে, সেখানে দেওবন্দ ওনাকে সাতটা বিষয়ে সাবধান করেছেন। প্রত্যেকটা বিষয়ের জন্য পরবর্তী সময়ে দলীলসহ ওনার প্রত্যেকটার উত্তর লোকেরা অনেকেই লিখেছে যে, ওনার একটা কথাও তেমন ভুল হয় নাই। হাঁ, উপস্থাপনার ভুল যে, এরকম না বললেও চলত। এরকম জায়গা বিশেষের উপস্থাপনের ভুল আছে। তো সেটার জন্য উনি বলেছেন যে, ঠিক আছে, আমার যদি ওরকম ভুল নাও হয়, উপস্থাপনের ভুল হয় তবু আমি ভুল স্বীকার করতেছি।”
মাওলানা সা‘দ সাহেবের যেসব ভুল ধরা হয়েছে সেটা পুরা বক্তব্যটা না শোনার কারণে- উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এসমস্ত বক্তব্যগুলো থেকে যারা দোষ বের করছে এরকম কিছু কিছু জায়গার একটা কাটপিছ একটা বাক্য নিয়ে আসছে। ওভারঅল পুরা বক্তব্যটা কেউ শুনুক তখন ভিন্ন অর্থ দাঁড়াবে।”
জনাব আশরাফের এসব কথার উপর আমরা শুধু ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন-ই পড়তে পারি। জানি না, মানুষ একসাথে এত অবাস্তব কথা কীভাবে বলতে পারে। আমরা সংক্ষেপে শুধু এক-দুটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
তিনি বলেছেন, “ওনার একটা কথাও তেমন ভুল হয় নাই। হাঁ, উপস্থাপনের ভুল যে, এরকম না বললেও চলত।”
বিষয়টা যদি এমনই হতো তাহলে দেওবন্দের কী দরকার ছিল তাকে সতর্ক করার? আর দেওবন্দের সতর্কীকরণের ভিত্তিতে তিনিই বা কেন উদ্যোগী হলেন রুজু করতে? যদিও তিনি তার রুজুতে অটল থাকেননি; বরং একদিকে রুজু করেন আরেকদিকে একই ধরনের কথা বলতে থাকেন।
আশরাফ সাহেব বলেছেন, দেওবন্দ ওনাকে সাতটা বিষয়ে সাবধান করেছে। আসলে দেওবন্দ তার ফতোয়ায় উদাহরণ স্বরূপ সাদ সাহেবের কিছু ভ্রান্তি উল্লেখ করেছে। আর তা সাতটি নয়, বরং আটটি। সঙ্গে বলে দিয়েছে,
ہم نے اختصار کی وجہ سے یہ چند باتیں ہی عرض کی ہیں۔
অর্থাৎ আমরা সংক্ষেপের কারণে এ কয়টি কথাই আরয করছি। তাছাড়া দেওবন্দের ফতোয়ায় আরো রয়েছে, মাওলানা সাহেবের বয়ানে কুরআন হাদীসের দ্বারা গলত ইসতিদলাল এবং তাফসীর বির রায় পাওয়া যায়। এমন কথাও পাওয়া যায়- যাতে নবীদের শানে বেআদবি প্রকাশ পায়। এমন অনেক বিষয় রয়েছে যাতে তিনি জুমহুরে উম্মত এবং সালাফের ইজমার বাইরে চলে যাচ্ছেন সে ফতোয়ায় এ বিষয়েও সতর্ক করা হয়েছে যে, মাওলানা সা‘দ সাহেব ইলমের স্বল্পতার কারণে নিজের চিন্তাধারার ক্ষেত্রে এবং কুরআন-হাদীসের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে জুমহুর আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর রাস্তা থেকে সরে যাচ্ছেন। যা নিঃসন্দেহে গোমরাহীর রাস্তা। এ হলো দারুল উলূম দেওবন্দের ফতোয়ার বাস্তব চিত্র। আর জনাব আশরাফ কীভাবে তা বিকৃত উপস্থাপন করেছেন- তা আমরা মাত্রই শুনলাম।
জনাব আশরাফের বক্তব্য থেকে মনে হয়, দারুল উলূম দেওবন্দ ও হক্কানী উলামায়ে কেরাম খামোখাই সা‘দ সাহেবের বিরুদ্ধে লেগেছেন। অথচ ইতিমধ্যেই তারা সা‘দ সাহেবের বক্তব্যগুলো ধরে ধরে দেখিয়ে দিয়েছেন, তার ব্যাপারে আপত্তির কারণগুলো কী। তারা প্রমাণ করেছেন, সাদ সাহেব এমন অনেক চিন্তা-চেতনা, অনেক আকীদা-বিশ্বাস পোষণ করছেন এবং প্রচারও করছেন, যেগুলো ইসলামের সঠিক ও সর্বস্বীকৃত বিশ্বাসের পরিপন্থী। উদাহরণস্বরূপ, তিনি আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস সালামের ভুল ধরেছেন। তার কথামতে, হযরত মূসা আ.-এর ভুল হয়েছিল, হযরত ইউসুফ আ.-এর ভুল হয়েছিল, এমনকি আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত তাঁর নিজের মা‘মুলের খেলাফ কাজ করেছেন, যে কারণে তাকে কষ্ট পেতে হয়েছে। এভানে তিনি একাধিক নবী-রাসূলকে দোষারোপ করেছেন এবং করে যাচ্ছেন। নাউযুবিল্লাহ।
এছাড়াও তিনি কুরআন ও সুন্নাহ এবং সীরাতের ঘটনা ও শিক্ষার মনগড়া ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করছেন। দ্বীন ও দ্বীনী কাজের সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা নিজের মতো করে দিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন বিদআত আবিষ্কার করে সেগুলোকে সীরাত ও সুন্নাহ নাম দিচ্ছেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে হযরাতুল উস্তায মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেবের আলোচনাসমূহ এবং মাসিক আলকাউসারে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলো পড়ুন।
সা‘দ সাহেব যেহেতু একটি দ্বীনী জামাতের দ্বীনী যিম্মাদার, যার কথাগুলো দাওয়াত ও তাবলীগের সাথে সম্পৃক্ত বিশে^র লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে, তাই তার ভ্রান্তির শিকার হওয়ার অর্থ লক্ষ লক্ষ মানুষের বিভ্রান্ত ও বিপথগামী হওয়া। সে কারণে দারুল উলূম দেওবন্দের রাহনুমায়ীর আলোকে আলেমসমাজ তার ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছেন এবং সর্বসাধারণকে তার ভুলগুলো সম্পর্কে সতর্ক করাকে জরুরি বলে মনে করেছেন।
কিন্তু সা‘দ সাহেবের অনুগত উপদলটি তাকে রক্ষার জন্য বিভিন্ন হীন কৌশলের আশ্রয় নিয়ে লোকসমাজে প্রচার করে বেড়াচ্ছে, তার কোনো ভুল নেই। থাকলেও তেমন কিছু না, তাছাড়া ভুল কার না থাকে। অথচ ভুল যে আছে এটা তো তার রুজুনামার ভাষ্য থেকেই প্রমাণিত। আর ভুলটা যে কত মারাত্মক তাও আমরা একটু আগেই উল্লেখ করেছি। আর ভুল সবারই হয়- প্রযোজ্য ক্ষেত্রে একথা সত্য হলেও সব ভুল একরকম নয়। ভুলে ভুলে পার্থক্য আছে এবং কোন্ ভুলের ক্ষতির পরিধি কতটুকু সেটাও ভেবে দেখার বিষয় আছে।
সা‘দ সাহেবের বয়ানের চিহ্নিত বড় বড় ভ্রান্তিগুলো সরাসরি সা‘দ সাহেবের বয়ান ও ভাষণ থেকে পড়ুন ও শুনুন। তাহলেই হাকীকত পরিষ্কার হয়ে যাবে।
দারুল উলূম দেওবন্দের মতো প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশের সকল হক্কানী উলামায়ে কেরাম এবং বিভিন্ন দেশের হক্কানী উলামায়ে কেরাম, এমনকি খোদ নিযামুদ্দীনের মুরব্বীগণ মিলে সা‘দ সাহেবের বক্তব্যকে কাটপিছ করবেন- এটা একজন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কীভাবে বিশ্বাস করতে পারে!
দেওবন্দের রেফারেন্সে বিতর্ক করা যাবে না?!
দেওবন্দ কর্তৃক মাওলানা সা‘দ সাহেবকে তার ভুলের জন্য সতর্ক করে দেওয়ার কথাটা যেহেতু টকশোর গোটা আলোচনায় আলোচকদের মুখে বারবার উচ্চারিত হয় তাই এপর্যায়ে জনাব আশরাফ সাহেব প্রয়োজন বোধ করেন এ বিষয়েও একটা বিভ্রান্তিকর কুযুক্তির অবতারণা করার। তার ভাষায়, “দেওবন্দ একটা আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ইন্ডিয়ার মধ্যে, বাংলাদেশের জন্য, হানাফী মাযহাবের জন্য কেন্দ্রীয় মারকায। কিন্তু দাওয়াত ও তাবলীগ তো শুধু হানাফীদের না। দাওয়াত ও তাবলীগে চারও মাযহাবের লোক আছে। সারা দুনিয়ার লোক আছে। কাজেই শুধু দেওবন্দের কোনো ফায়সালা...। বা দেওবন্দ আমাদের মারকাযও না। ইলমী মারকায হানাফীদের জন্য। দাওয়াত ও তাবলীগের মারকায না। কাজেই দেওবন্দের কোনো মন্তব্যের উপরে দাওয়াত ও তাবলীগের উপর বিতর্ক করা যাবে না।”
এটা প্রধানত দ্বীন, শরীয়ত ও দাওয়াত সম্পর্কে তার খণ্ডিত ধারণা আর দ্বিতীয়ত দারুল উলূম দেওবন্দ ও দ্বীনী প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্দেশ্য, আদর্শ ও কর্মতৎপরতার পরিধি সম্পর্কে অজ্ঞানতা- দুইয়ের মিলিত ফল। আমরা অবাক হচ্ছি, তিনি কেন বুঝলেন না যে, সা‘দ সাহেবের ভুল ও ভ্রান্তির সম্পর্ক হল আকীদা-বিশ্বাস ও দ্বীনী মূল্যবোধের সঙ্গে। এর সাথে মাযহাবের ভিন্নতার কোনো সম্পর্ক নেই। হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী, হাম্বলী- মাযহাব যার যেটাই হোক, আকীদা-বিশ্বাসে এবং চিন্তা-চেতনায় সবাই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর অনুসারী। আর দারুল উলূম দেওবন্দ হচ্ছে উপমহাদেশীয় অঞ্চলে সেই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআরই তরজুমান বা প্রতিনিধি। এ হিসেবে সকলের অভিভাবক ও কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান।
আর তিনি যে বলছেন, দারুল উলূম শুধু ইলমের মারকায, দাওয়াত ও তাবলীগের মারকায না- প্রশ্ন হচ্ছে, দাওয়াত ও তাবলীগ কি তাহলে ইলম ছাড়া চলবে? কোনো দীনী কাজ কি দীনী ইলম ছাড়া চলতে পারে? সা’দ সাহেবের বিভ্রান্তিগুলো সম্পর্কে সতর্ক করে দারুল উলূম দেওবন্দসহ দীনী ইলমের কেন্দ্রগুলো তো তাদের দায়িত্বই পালন করেছেন। দীনী ইলমের নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো যখন দীনী ইলমের ভিত্তিতে ওদের বিভ্রান্তিসমূহ চিহ্নিত করে দিয়েছেন তখন অবশ্যই তা আমলে নিতে হবে। নতুবা তারা বিভ্রান্ত ও বিচ্যুত ফের্কা হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে যাবেন।
নিজেদের দোষ-ত্রুটি এবং দুর্বলতাগুলো ঢাকার জন্য না জেনে কিংবা জেনে-বুঝে সব ধরনের বাস্তবতাকে অস্বীকার করার যে কৌশল জনাব আশরাফরা নিয়েছেন তা কি আখিরাতে তাদের রক্ষা করতে পারবে?