ফিরে দেখা বারো-এক
পয়লা ডিসেম্বর এক বেদনার নাম। এদিন টঙ্গীর ময়দানে একশ্রেণির বিপথগামী লোকের হাতে মারাত্মকভাবে হতাহত হয়েছিলেন শতশত আলিম-তালিবে ইলম ও সাধারণ তাবলীগী ভাই। কী ছিল তাঁদের অপরাধ? তারা দিল্লীর মাওলানা সা‘দ সাহেবের মারাত্মক ভ্রান্তিসমূহ মেনে নিতে পারেননি। তারা চেয়েছিলেন, তিনি সংশোধিত হোন, দ্বীনী মেহনতে নতুন নতুন বিদআতের ধারা প্রবর্তন থেকে নিবৃত্ত হোন। দ্বীনের একটি মেহনতকে সঠিক পন্থায় চলমান রাখার এই কল্যাণকামিতাপূর্ণ প্রয়াসকে যে উগ্র শ্রেণিটি দ্বীনী সহনশীলতার সাথে গ্রহণ করতে পারেনি; বরং মাওলানা সা‘দ সাহেবের সকল বিভ্রান্তিসহ তার ইতাআতকে গায়ের জোরে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে তারাই সেদিন ধর্ম ও মানবতার সকল সীমানা লঙ্ঘন করে সংঘটিত করল এমন এক তা-ব, যা এই দ্বীনী মেহনতের ইতিহাসকে কালিমালিপ্ত করে দিল।
দ্বীনী মেহনতের ইতিহাস কখনো ভুলবে না টঙ্গী ময়দানের এই ন্যক্কারজনক ঘটনা। ইতিহাসের পাতা ভারাক্রান্ত হয়ে থাকবে শত শত উলামা-তলাবা ও দ্বীনদার মুসলমানের রক্ত ও অশ্রুতে। আমরা প্রত্যাশা করি, আমাদের ভাই ও বন্ধুদের এই রক্ত ঝরানো কোরবানী উম্মাহ্র হেদায়েতের অসীলা হবে, হক-না হকের পার্থক্য এবং হকপন্থী-বাতিলপন্থীর পরিচয় নির্ধারণে এক উজ্জ্বল আলোর মিনার হয়ে থাকবে।
এই প্রেরণা ও প্রত্যাশা থেকেই আলকাউসারের বর্তমান সংখ্যায় ‘ফিরে দেখা বারো-এক’ শীর্ষক এই সংক্ষিপ্ত আয়োজন। আল্লাহ তাআলা এই আয়োজনটুকু কবুল করুন এবং পাঠক সাধারণের জন্য উপকারী করুন, আমীন। -সম্পাদক
‘তার নৈতিক দায়িত্ব হয়ে গেছে পদত্যাগ করা
নিজেকে নিজে বরখাস্ত করা’
-মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম
[২৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪০ হি. / ৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ঈ. জুমাবার]
হামদ ও ছানার পর,
وَ اعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللهِ جَمِیْعًا وَّ لَا تَفَرَّقُوْا وَ اذْكُرُوْا نِعْمَتَ اللهِ عَلَیْكُمْ اِذْ كُنْتُمْ اَعْدَآءً فَاَلَّفَ بَیْنَ قُلُوْبِكُمْ فَاَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهٖۤ اِخْوَانًا وَ كُنْتُمْ عَلٰی شَفَا حُفْرَةٍ مِّنَ النَّارِ فَاَنْقَذَكُمْ مِّنْهَا كَذٰلِكَ یُبَیِّنُ اللهُ لَكُمْ اٰیٰتِهٖ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُوْنَ.
মুহতারাম ভাই ও বন্ধুগণ! আমরা একটা কঠিন সময় পার করছি। এরকম সময়ে বয়ান করার জন্যে খুব শক্তিশালী মনের দরকার। এমন একটা পরিস্থিতি আমাদের উপর দিয়ে যাচ্ছে যে, এর জন্যে এই উম্মত যতই কাঁদুক, যতই চোখের পানি ফেলুক তা তার শোক ও দুঃখ নিবারণের জন্যে যথেষ্ট নয়। যারা পরিস্থিতি জানেন তাদের কাছে টঙ্গীর ঘটনা এক দুর্বিষহ ঘটনা। এই আঘাত সহ্য করা আমাদের মতো দুর্বলদের পক্ষে অনেক কঠিন।
মুসলিম উম্মাহ্র উলামার উপর এর আগেও আঘাত এসেছে, কিন্তু সেই আঘাত এসেছিল ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে। সেই ক্ষমতাসীনরা মুসলিম হোক কিংবা অমুসলিম। যেমন বৃটিশ আমলে বৃটিশ সরকার এদেশের হাজার হাজার আলেমকে ফাঁসি দিয়েছে। হত্যা করে গাছে গাছে ঝুলিয়ে রেখেছে এবং শত শত মাদরাসা বন্ধ করে দিয়েছে। তারা তো ছিল অমুসলিম। তারা আলেমদেরকে হত্যা করেছে এবং মাদরাসাগুলি বন্ধ করে দিয়েছে। এক হিসেব মতে খুবসম্ভব আজকের এই বাংলাদেশ নামক ভূখ-েই তারা আঠারো হাজার মাদরাসা বন্ধ করেছে। আমার হিসেবটা কমবেশি হতে পারে। যতদূর মনে পড়ে, আঠারো হাজার মাদরাসা তারা এই ভূখণ্ডে বন্ধ করেছে। এর আগেও এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে।
আব্বাসী আমলে যখন হারূনুর রশীদের পুত্র মামুনুর রশীদ ক্ষমতায় তখন মামুনুর রশীদ মুতাযিলা মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত ছিল। মুতাযিলা মতবাদটি গ্রীক দর্শন আর ইসলাম এই দুইয়ের সমন্বয়ে তৈরি। গ্রীক দর্শনের আলোকে মুতাযিলা সম্প্রদায় ইসলামকে ব্যাখ্যা করেছে। সেই ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তারা ইসলামের অনেক মূল আকীদা-বিশ্বাসের উপর আঘাত হেনেছে। মামুনুর রশীদ তাদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। তাই তার ইচ্ছা ছিল যে, মুসলিম জাহানের প্রভাবশালী আলেমগণও তাদের সেই মতবাদ মেনে নিক। এর জন্য সে বিভিন্ন এলাকা থেকে বড় বড় আলেমদেরকে বাগদাদে ডেকে নিয়েছে। আর তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করেছে, তারা যেন মুতাযিলা মতবাদকে মেনে নেয়। এদের মধ্যে তখন তিন ভাগ হয়ে গেল। এ তিন ভাগই হকপন্থী। ঈমানের শক্তির পার্থক্যের কারণে একদল মুখে মুখে মেনে নিয়েছে, কিন্তু মন থেকে মানেনি। আরেক দল কৌশল করে এমন কথা বলেছে, যাতে ওরা মনে করেছে যে হাঁ, বুঝি আমাদেরটাই মানল। আরেকদল সেই কৌশলও নয়, সরাসরি অস্বীকার করেছে। সেই অস্বীকারকারীদের মধ্যে একজন ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহ.। তিনি এদের নেতা। যারা অস্বীকার করেছে এদের কাউকে হত্যা করে দেওয়া হয়েছে। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের উপর এমন অত্যাচার চালিয়েছিল যে, তাঁর তো মরে যাওয়ারই কথা। আল্লাহ তাআলা হেফাজত করেছেন যে, তাঁকে জীবিত রেখেছেন। জল্লাদ দিয়ে তাঁকে চাবুক মারা হতো এবং প্রত্যেকে তার গায়ের জোর দিয়ে চাবুক মারতো। গায়ের জোর দিয়ে চাবুক মারাতেও মামুনুর রশীদ সন্তুষ্ট হতে পারতো না। তার প্রতি লা‘নত করে বলতো যে, গায়ে আর জোর নেই? এতটুকুতেই শেষ?
তো ক্ষমতাসীনদের দ্বারা আলেমদের উপর নির্যাতনের তো নজির আছে। সব আমলেই আলেম সরকারের শরীয়তবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে সরকার তা সহ্য করতে পারে না। সে তো সরকারের ব্যাপার। কিন্তু ক্ষমতাসীন নয়, দ্বীনের কথা বলে, নামায পড়ে, মানুষকে নামাযের জন্য ডাকে, মানুষকে মসজিদে ডাকে, সুন্নতের অনুসরণ করতে বলে- এরকমের শ্রেণিও আলেম-উলামার গায়ে হাত তুলেছে, নিষ্ঠুর-নির্দয়ভাবে হত্যা করার মতো আক্রমণ চালিয়েছে, এমন ঘটনা বোধহয় এই প্রথম। দেখে দেখে মাথায় আঘাত করেছে, মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। দেখে দেখে হাতের উপর আঘাত করেছে, হাত ভেঙে ফেলেছে। পায়ের উপর আঘাত করেছে, পা ভেঙে ফেলেছে। এরকমের শত শত। দু-চার জন, পাঁচ-দশ জনের নয়, শত শত জনের হাত পা ভেঙে ফেলেছে। মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। আমি শুনিনি কখনো, আমার পড়াশোনা খুব বেশি নয়, কিন্তু এই চৌদ্দশ বছরের ইতিহাস যতটুকু পড়া আছে তাতে এই রকমের পরিস্থিতি বোধহয় কখনও আসেনি।
মাওলানা সা‘দ সাহেব নিযামুদ্দীন কেন্দ্রে বসে কী বিভ্রান্তি কী গোমরাহি কথাবার্তা প্রচার করছে এরা অধিকাংশেই জানে না। তারা কেবল মনে করছে, নিযামুদ্দীন কেন্দ্রে যখন আছেন, উনি আমাদের আমীর, কাজেই আমাদের উচিত তার কথা মতো চলা। কিন্তু আমীর হওয়ার যোগ্যতা বা গুণ যে তার ভিতরে নেই, সেই খবর তাদের নেই। খবর থাকলে তারা প্রথমেই তার অনুসরণ করতো না। ইলম থাকতে হবে, তাকওয়া পরহেযগারি থাকতে হবে। এটা তো দাওয়াতি কার্যক্রম, দাওয়াতি কার্যক্রমের আমীর যে হবে তার মধ্যে অবশ্যই পরিপক্ক ইলম থাকতে হবে। এ লোকের তো ইলমের অবস্থা খুবই ভয়ঙ্কর। কুরআন ও হাদীসের এমন এমন ব্যাখ্যা দিচ্ছে, যা বিশুদ্ধ ইলমের অধিকারী কারো দেওয়ার কথা নয়। তারপর তাকে কেন্দ্র করে যখন সারা বিশে^ এভাবে কাজের মধ্যে বিভক্তি দেখা দিল, পরস্পরে মারামারি হানাহানি শুরু হয়ে গেল তখন তো তার নৈতিক কর্তব্য ছিল এই কথা বলা যে, আসো সবাই একসঙ্গে কাজ করি, আমার আমীর হওয়ার খাহেশ নেই, মশওয়ারা করে একজনকে আমীর বানান। আমরা তার অধীনে কাজ করব। এই তো করা উচিত ছিল।
যাকে কেন্দ্র করে বিশৃংখলা হয় তার তো আমীর পদে থাকা উচিত নয়। এব্যাপারে ইসলামের শিক্ষা আমরা পাই হযরত ওমর রা.-এর কাছে। তাঁর আমলে হযরত সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. কূফার গভর্নর ছিলেন। কূফা তার আমলে বিজিত হয়। সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের নেতৃত্বেই হয়। ওমর রা.-এর আমলে বিখ্যাত দুটি যুদ্ধ হয়েছিল। একটা কাদিসিয়ার যুদ্ধ, আরেকটা ইয়ারমুকের যুদ্ধ। ইয়ারমুকের যুদ্ধ হয়েছিল রোমানদের বিরুদ্ধে। আর কাদিসিয়ার যুদ্ধ হয়েছিল ইরানিদের বিরুদ্ধে। সে কালের পৃথিবীতে এই দুই রাষ্ট্র ছিল সবচেয়ে ক্ষমতাধর। ইরানে ছিল সাসানী সাম্রাজ্য। সাসানী শাসকদের শাসন। ওমর ফারূক রা.-এর আমলে এদের রাজা ছিল ইয়াযদগিরদ। আর এ সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল ইরাক থেকে হিন্দুস্তান পর্যন্ত। মানে ইরাক-ইরান- আফগানিস্তান-পাকিস্তান এই বিস্তৃত এলাকা। এবং মধ্য এশিয়াও এই সাসানী সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। তাদের সঙ্গে মুসলিম আমলে ওমর ফারূক রা.-এর আমলে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে যুদ্ধ হয়েছিল, সেটা হল কাদিসিয়ার যুদ্ধ। এই যুদ্ধের সেনাপতি ছিলেন সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা.। তিনি আশারায়ে মুবাশশারার একজন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একসঙ্গে যেই দশজন সম্পর্কে জান্নাতের সুসংবাদ শুনিয়েছেন, সেই দশজনের একজন সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা.। তো তাঁর নেতৃত্বে ইরানীদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের জয় হয়।
ওমর ফারূক রা. তাকে কূফার গভর্নর নিযুক্ত করেছিলেন। কূফার কিছু লোক সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা.-এর বিরুদ্ধে অপবাদ তুলল। কূফার কিছু লোক সবসময় এ কাজ করেছে। শান্তিবাদী শাসকদেরকে তারা সহজে মেনে নেয়নি। হযরত সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা.-এর বিরুদ্ধে তাদের কেউ অপবাদ তুলল। তিনটা অপবাদ : ঠিকভাবে নামায পড়ে না। যুদ্ধে নিজে যায় না। আর গনীমতের মাল ঠিকভাবে বণ্টন করে না। ওমর ফারূক রা. তাকে মদীনায় তলব করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, সা‘দ তোমার বিরুদ্ধে এই এই অভিযোগ। তোমার কী জবাব? তিনি জবাব দিলেন এবং ওমর ফারূক রা. সন্তুষ্ট হয়ে গেলেন। কিন্তু তার পরও তদন্ত দল পাঠিয়ে দিলেন কূফায়। যাতে তার দাবির সত্যতা প্রমাণ হয়ে যায়। কারণ কেবল তার কথায় যদি রায় দিয়ে দেন তাহলে লোকে বলবে পক্ষপাতিত্ব করেছে। বিচার ইনসাফসম্মত হয়নি। ন্যায্য বিচার হয়নি- একথা যাতে কেউ বলতে না পারে।
তদন্তকারী দল গিয়ে প্রত্যেক মসজিদে মসজিদে মানুষকে জিজ্ঞেস করে, তোমাদের শাসক সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস কেমন? যার কাছেই জিজ্ঞেস করে, যাদেরকেই জিজ্ঞেস করে সবাই তাঁর প্রশংসা করে। প্রশংসা করবেই। ইসলামের শ্রেষ্ঠ দশজনের একজন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাতেগড়া মানুষ। জীবিত থাকতেই জান্নাতের সুসংবাদ পেয়ে গেছেন। তিনি ঠিকভাবে নামায পড়বেন না! যুদ্ধে পিছিয়ে থাকবেন! যিনি কাদিসিয়ার যুদ্ধে সেনাপতি ছিলেন তিনি যুদ্ধে পিছিয়ে থাকবেন! যিনি বিস্ময়কর এক অভিযানের মাধ্যমে মাদায়েন জয় করেছেন, তিনি যুদ্ধে যান না!
ইরানীদের রাজধানী ছিল মাদায়েন। কাদিসিয়ার যুদ্ধে যখন তারা পরাজিত হল, তখন অবশিষ্ট সেনাবাহিনী মাদায়েন চলে গেল। মাদায়েন হল টাইগ্রিসের পূর্ব তীরে। এখন টাইগ্রিসের দু’পাড়েই বাগদাদ। তো পূর্ব পাড়ে ছিল তৎকালীন প্রাচীন ইরানের রাজধানী মাদায়েন। ইরানী-সৈন্যরা মাদায়েনে চলে গেলে সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. তাঁর সেনাদেরকে হুকুম দিলেন, চলো আমরা মাদায়েনে গিয়ে তাদের উপর আক্রমণ চালাব।
ওরা আশঙ্কা করেছিল যে, মাদায়েন আক্রমণ হতে পারে। তাই টাইগ্রিসের সেতু তারা ভেঙ্গে দিল। এখন কীভাবে ওপারে যাবে? তো তিনি বাহিনীকে হুকুম দিলেন- নদীর উপর দিয়েই ঘোড়া ছুটিয়ে দাও, নদীর উপর দিয়েই পদযোগে চল, যাত্রা কর। আল্লাহ তোমাদেরকে হেফাজত করবেন। এর আগে তো মূসা আ.-কেও আল্লাহ তাআলা হেফাজত করেছিলেন। মূসা আ.-কে আল্লাহ তাআলা বনী ইসরাঈলসহ সেই লোহিত সাগর পার করে নিয়ে আসেন কোনোরকম যানবাহন ছাড়া, নৌকা-জাহাজ ছাড়া। তো যদি আল্লাহ তাআলা মূসা আ.-কে বনী ইসরাঈলসহ লোহিত সাগর পার করাতে পারেন বিনা বাহনে, সেই আল্লাহই তো আছেন, এরপর এটা তো সাগর নয়, নদী। দজলা নদী। যদিও ছোটখাট নয়, দজলা নদী তো পৃথিবীর বড় বড় নদীর একটি। তো সেই আল্লাহই আছেন। আল্লাহই আমাদের সাহায্য করবেন। আমরা তো তাঁর কালিমা বুলন্দ করার জন্যে, তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার জন্যে কাজ করছি। সুতরাং তোমরা সবাই নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ো। যে যেই হালে ছিলেন সেই হালেই নদীতে নেমে পড়লেন এবং সবাই নিখুঁতভাবে নিরাপদভাবে দজলা নদীর পূর্বপাড়ে চলে গেলেন। কেউ ডুবে যায়নি, মারা যায়নি এবং কেউ ক্লান্ত হয়ে পড়েনি। যতটুকু হয়েছিল তা এই যে, এক সৈনিকের হাতে একটা পেয়ালা ছিল সেই পেয়ালাটা তার হাত থেকে ছুটে গেল। ওপারে গিয়ে দেখলেন কারো কিছু হারায়নি। যার কাছে যা ছিল সব সুরক্ষিত আছে। কোনো কিছুই হারায়নি, কেবল তার একটা পেয়ালা হারিয়ে গেল। বলে, আল্লাহ এই বাহিনীর কারো কিছু হারায়নি, আমার পেয়ালা হারিয়ে গেল। আমি তো এই বাহিনীর একজন নিন্দিত লোক হয়ে থাকব। এই বলতেই দেখা গেল যে, ঢেউয়ের পানিতে পেয়ালা ভেসে ভেসে চলে আসছে। আসতে আসতে একদম তার কাছে এসে থেমে গেল। সেই পেয়ালা নিয়ে তিনি চলে গেলেন। এভাবেই আল্লাহ তাআলা তাদেরকে সাহায্য করেছিলেন। এ বাহিনীর সেনাপতিই তো সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা.।
তো সবাই বলে তার মতো শাসক হয় না, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করার মতো কোনো কিছুই নেই। এক জায়গাতে এক লোক দাঁড়িয়ে গেল। সে দাঁড়িয়ে বলল, ঠিক মত নামায পড়ে না, যুদ্ধেও যায় না, আর গনীমতের মাল ন্যায্যভাবে বণ্টন করে না। সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের মুখের উপর বলে দিল। একজন শ্রেষ্ঠ সাহাবী, জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজনের একজন, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে দিল। সা‘দ রা. বললেন, আল্লাহ! এই লোক যদি এটা বাহাদুরি দেখানোর জন্য করে থাকে- আমি এক পাহলোয়ান বীর, আমি কাউকে ডরাই না, গভর্নরের মুখের উপরও আমি মিথ্যা কথা বলতে পারি। তার উপর অপবাদ আরোপ করতে পারি। যদি বাহাদুরির জন্য করে থাকে, তাহলে আল্লাহ তুমি তাকে দেখিয়ে দাও।
দেখানোর দরকার ছিল। শ্রেষ্ঠ দশজনের একজনই যদি এরকম অপরাধী হয়ে যায় তাহলে সাহাবায়ে কেরামের উপর আর কী আস্থা থাকবে? তাই দেখানোর দরকার ছিল। (তিনি বললেন,) আল্লাহ! তুমি তাকে ...। সাথে সাথে দুআ কবুল হয়ে যায়। সে এত দীর্ঘ আয়ু পায় যে, জীবনের প্রতি অতিষ্ট হয়ে পড়ে। আর বাঁচতে মনে চায় না। আর এমন ফকির হয়ে গেল যে, মসজিদের সামনে সামনে দাঁড়ায় আর ভিক্ষা করে করে খায়। আর এক ফিতনায় পড়ে গেল। এই বৃদ্ধ বয়সেও, এমন বুড়ো যে, ভ্রু নীচের দিকে ঝুঁকে পড়েছে, তাকানোর জন্য ভ্রু ধরতে হয়। তা না হলে মানুষকে দেখতে পায় না; এমন বুড়ো হয়ে গেছে- এই বৃদ্ধ বয়সেও সে মেয়েদেরকে উত্যক্ত করত। এ হল আযাব। আযাবের তো নানান ধরন আছে। আল্লাহ্র গজব নানাভাবেই হয়। এটা ছিল তার উপর আল্লাহ্র এক গযব। সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা.-এর বদ দুআ লেগে গেছে। যাহোক, শেষ পর্যন্ত প্রমাণ হয়ে গেল যে, তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছিল সব মিথ্যা। সব ভিত্তিহীন।
কিন্তু তারপরও তিনি সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাসকে কূফার এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে দিলেন। অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে গেছে। তারপরও তিনি তাকে এই পদে রাখলেন না, বরখাস্ত করলেন। কেন করলেন? একজন শাসকের বিরুদ্ধে জনগণ যদি এরকম অভিযোগ তুলে, তোলার সাহস পায় তাহলে সেই শাসক ওইখানে শান্তি-শৃংখলা কীভাবে রক্ষা করবে? তা ছাড়া এমন হয় যে, একদম কোনো ভিত্তি নেই, সম্পূর্ণ অপবাদ তারপরও কিছু লোক এটা বিশ্বাস করে। জগতে এমন ঘটনাও আছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময়ও এমন ঘটনা ঘটেছে। ভিত্তিহীন কথাতেও কিছু লোক বিশ্বাস করেছে। তো হযরত সা’দ রা.-এর বিরুদ্ধে এ মিথ্যা অভিযোগ কিছু লোক যদি বিশ্বাস করে তাহলে তারা ফিতনা ছড়াবে, বিশৃংখলা হবে। তো শান্তি-শৃংখলা রক্ষার স্বার্থে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসকে সেখান থেকে বরখাস্ত করলেন। এর দ্বারা কী শিক্ষা পাওয়া গেল?
যখন অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া সত্ত্বেও, নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাসকে বরখাস্ত করা হল তখন বর্তমানকালের সা‘দ, মাওলানা সা‘দ কান্ধলভী তার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও, কুরআন-হাদীসের অপব্যাখ্যা দেওয়া সত্ত্বেও, ভুল মাসআলা-ফতোয়া প্রচার করা সত্ত্বেও কী করে দাওয়াত ও তাবলীগের আমীর থাকতে পারেন? থাকার অধিকার কি তার থাকে? না।
বিশেষত যখন তাকে কেন্দ্র করে মসজিদে মসজিদে হানাহানি শুরু হয়ে গেল, মসজিদে মসজিদে মারামারি লেগে গেল। এই মারামারি করছে দাড়িওয়ালা, টুপিওয়ালা, জুব্বাওয়ালা মানুষরা। নামাযী মানুষ; যারা মানুষকে নামাযের জন্য ডাকে তারা যদি এরকম মারামারি হানাহানিতে লিপ্ত হয় তাহলে এর দ্বারা কী বার্তাটা সারা জাহানের মানুষের কাছে যাবে? এরা মানুষের কাছে কীসের দাওয়াত দিবে?
তারা তো আলেম-উলামার ঠ্যাং ভাঙ্গেনি, আলেম-উলামার মাথায় আঘাত করেনি; তারা দাওয়াতের মাথায় আঘাত করেছে। আমার তো দুঃখ এই যে, মাদরাসার ছাত্র এবং আলেমদের পা ভেঙে গেছে, মাথা ফেটেছে তাদের জন্য নয়, তাদের জন্য দুঃখ আছে, কিন্তু তারচেয়ে অনেক বেশি দুঃখ ওইসমস্ত লোকের জন্যে, যারা আলেমদের গায়ে হাত তুলেছে। যারা আলেমদের হাত-পা ভেঙে দিয়েছে। তাদের জন্যেই আমার ব্যথাটা বেশি। তারা কী কাজটা করেছে! কী ভয়ানক কাজ তারা করেছে! তারা নিজের জীবনের ধ্বংস ডেকে এনেছে এবং দাওয়াতী কার্যক্রমের গলায় ছুরি বসিয়েছে।
এখন এইসমস্ত লোক, দাওয়াত ও তাবলীগের লোক কোন্ মুখে মানুষের কাছে দাওয়াত নিয়ে যাবে? কোন্ মুখে মানুষকে বলবে- মসজিদমুখী হতে, সুন্নতের উপর আমল করতে? এই কি সুন্নত- আলেমদের হাত-পা ভেঙে দাও! এই কি সুন্নত!! নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে কী সুন্নত শিক্ষা দিয়েছেন? আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কীভাবে থাকতে বলেছেন? اِنّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ اِخْوَةٌ সমস্ত মুমিন ভাই ভাই। এই ভাই ভাই হয়েই তো তারা এতদিন ছিল। শত্রু আপন হয়ে গেছে, ভাই ভাই হয়ে গেছে- এই দাওয়াত ও তাবলীগের কাজের ওসিলায়। আর এখন সেই ভাই ভাই একে অন্যের শত্রু হয়ে গেছে। এমনকি বাপ-ছেলে একে অন্যের শত্রু।
আমার জানা আছে এরকম যে, এক ঘরে বাপ হল সা‘দপন্থী আর ছেলে হল সা‘দবিরোধী, দুইজনের একজনও আরেকজনের মুখ দেখতে চায় না, কথা বলে না। এক ঘরে দুই ভাই সারা জীবন একসঙ্গে তাবলীগ করেছে। আর এখন এই দুই ভাই- এক ভাই আরেক ভাইকে সহ্য করতে পারে না। এগুলো সকলের জানা ঘটনা। এগুলো সা‘দ সাহেবেরও তো জানার কথা। বিশেষ করে টঙ্গীতে কী ঘটেছে তা তো তার না জানার কথা নয়। তার তো সঙ্গে সঙ্গে পদত্যাগ করার কথা ছিল। তার তো নৈতিক দায়িত্ব হয়ে গিয়েছিল- আমাকে নিয়ে তোমরা মারামারি হানাহানি করবে? না, আমি এই পদে থাকতে পারি না।
আজকাল দুনিয়ায় খ্রিস্টান-ইহুদীরা তো এই কাজ করছে। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় যখন কোনো বিশৃংখলা দেখা দেয় তখন দায়-দায়িত্ব নিজ মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করে। আর আপনি কেমন আমীর, এমনিই তো আমীর স্বঘোষিত। কারণ, যথাযথ মাশওয়ারার মাধ্যমে তাকে আমীর বানানো হয়নি। আমীর হওয়ার অধিকারই তার নেই। তা সত্ত্বেও জবরদখল করে তিনি আছেন। তো যখন শুনেছেন- তাকে কেন্দ্র করে মানুষে মানুষে, মুসল্লিতে মুসল্লিতে এরকম মারামারি, রক্তপাত তখন তো তার নৈতিক দায়িত্ব হয়ে গেছে পদত্যাগ করা, নিজেকে নিজে বরখাস্ত করা। তাও করছে না, এখনো বহাল তবিয়তে বসে আছে।
তো বলছিলাম যে, সা‘দপন্থীদের অধিকাংশ এমন, তারা এটা জানে না যে, সা‘দ সাহেব কুরআন-হাদীসের অপব্যাখ্যা করেছে, ভুল মাসআলা প্রচার করেছে; এগুলো তাদের জানা নেই। তারা শুধু ঐটুকুই জানে যে, উনি আমীর, উনাকেই তো মানা উচিত। অধিকাংশই এরকম। আর যারা জানে, তাদের মধ্যে এক ধরনের লোক আছে, তারা মনে করছে অভিযোগগুলো ঠিক নয়, অর্থাৎ অপপ্রচার; কিন্তু সচেতন ব্যক্তিরা জানে, এগুলো অপপ্রচার নয়- আলেমগণ তার মুখের কথা মানুষকে শোনাচ্ছেন, নিযামুদ্দীন এবং বিভিন্ন জায়গায় যে বয়ান করেছেন তার রেকর্ড শোনাচ্ছেন মানুষকে যে, দেখো সা‘দ সাহেব কী কথা বলেন। তিনি ইউসূফ আ.-এর সমালোচনা করেন, তিনি মূসা আ.-এর সমালোচনা করেন, তিনি উহুদের যুদ্ধের মুজাহিদদের সমালোচনা করেন, তিনি ভুল মাসআলা বলেন। তিনি দ্বীনী কাজ সম্পর্কে বলেন যে, মসজিদের বাইরে যে দ্বীনী কাজ তা দ্বীন নয়। দ্বীনী কাজ হবে মসজিদে। এর বাইরে কোনো কাজ আর দ্বীন নয়। তার মানে কী মাদরাসাগুলো সব ফালতু? এগুলো কোনো দ্বীনী কাজ না? ওয়াজ মাহফিল মসজিদের বাইরে হয়- এগুলো সব ফালতু কাজ? তো মসজিদের বাইরে যত কাজ হয় এগুলো কোনো দ্বীনী কাজ না? এরকমের মনগড়া মাসআলা বয়ান করছে। তার রেকর্ড মানুষকে শোনানো হচ্ছে এবং লিখিত আকারে বই আকারে এসে গেছে। যা বলেছে সব হুবহু শোনানো হচ্ছে, দেখানো হচ্ছে। দুই কানে শুনছে তারপরও মানে না। এটা কী? ‘ইনাদ’, জিদ। আসলে মানুষের অন্তরে যখন জিদ এসে যায় তখন সে আর হক মানতে পারে না। ইহুদীরা মুসলমান হতে পারেনি, মদীনার ইহুদীরা মুসলমান হতে পারেনি, কেন হতে পারেনি? কুরআন মজীদে আল্লাহ বলেছেন যে, মদীনার ইহুদীরা- یَعْرِفُوْنَهٗ كَمَا یَعْرِفُوْنَ اَبْنَآءَهُمْ তারা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চিনতো যেমন নিজেদের ছেলে সন্তানকে চিনতো। তা সত্ত্বেও জিদের কারণে তারা ঈমান আনেনি।
ওই জিদ যখন মানুষের অন্তরে ঢুকে যায় তখন সত্য মানতে চায় না। এদের মধ্যে জিদ এসে গেছে। তাই এখন ঠিক বৃটিশ যে কাজ করেছিল, ইংরেজরা যে কাজ করেছিল সে কাজ এখন তারা করছে, তারা আলেম-উলামাকে মারছে। বৃটিশ হাজার হাজার মাদরাসা বন্ধ করেছিল, এরাও বলছে, দাবি তুলছে- সব মাদরাসা বন্ধ করে দাও।
আল্লাহ তাআলা এদের সবাইকেই সঠিক বুঝ দিয়ে দিন। আমরা এদের জন্যে দুআ করি, এরা আমাদের ভাই। এরা সুপথে আসুন এবং এই দাওয়াত ও তাবলীগের মাঝে যে বিভক্তি দেখা দিয়েছে, আল্লাহ তাআলা তা দূর করে দিন- আমীন।