বাবরি মসজিদ মামলার রায় : কিছু প্রশ্ন ও বাস্তবতা
রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ হবে- এটা আগে বলা হয়েছিল। অনুমান করা হয়েছিল বাবরি মসজিদ মামলার রায়টি স্বাভাবিক নিয়মে আরো কয়েকদিন পর ঘোষণা করা হবে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে রায় ঘোষণার তারিখ জানানো হল। ৯ নভেম্বর ছুটির দিন কোর্ট বসিয়ে রায় ঘোষণা করা হল এবং সবরকম দলীল-যুক্তির বাইরে গিয়ে একটি অস্বাভাবিক রায়ে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের জমি দিয়ে দেওয়া হল হিন্দুদের মন্দির নির্মাণের জন্য।
রায় ঘোষণার প্রস্তুতির সময় থেকেই একটা অনুমান দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল যে, রায়টিতে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু বিষয় চলে আসতে পারে। কারণ, রায় ঘোষণার আগে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কিছু পদক্ষেপ ও আচরণ এজাতীয় সন্দেহ তৈরি করছিল। রায় ঘোষণার আগে আগে প্রধান বিচারপতি অযোধ্যার প্রশাসক ও পুলিশ প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং রায় ঘোষণার পরের পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিশেষ প্রস্তুতি রাখতে আহ্বান জানান। বিচারপতির এসব পদক্ষেপ মিডিয়ায় প্রচার হচ্ছিল এবং জনমনে রায় নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সন্দেহ তৈরি করছিল। ভারতীয় গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের অনেকেই তখন বলতে শুরু করেছিলেন, বিচারপতির রায় ঘোষণার আগেই এজাতীয় পদক্ষেপ একটি নজিরবিহীন ঘটনা। বিচারপতির কাজ আইনশৃঙ্খলা নিয়ে বৈঠক করা নয়। নিরপেক্ষ ও নিরাবেগ থাকাই তার দায়িত্ব। রায় ঘোষণার আগেই তিনি প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করে বেড়াবেন এবং পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে আগে থেকেই বিভিন্ন রকম পদক্ষেপ রাখতে শুরু করবেন- এটা বিচারপতিসুলভ নির্বিকার ও পক্ষপাতমুক্ত আচরণের সঙ্গে মানানসই নয়।
এরপর নির্দিষ্ট দিনে যখন রায় ঘোষণা শুরু হল, পূর্ব থেকে তৈরি হওয়া সন্দেহই বাস্তবে রূপ নিল। রায় ঘোষণার সময় রায়ের একেকটি অংশ প্রচার হচ্ছিল। একসময় পুরো রায়টিই সামনে চলে আসল; যেখানে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের জায়গাটিকে হিন্দুদের রামমন্দির নির্মাণের জন্য দিয়ে দেওয়া হল এবং মুসলমানদেরকে আলাদা একটা মসজিদ নির্মাণের জন্য সরকারের তরফ থেকে ৫ একর জায়গা বরাদ্দ দেওয়ার কথা বলা হল।
এ রায় শুধু ভারত নয়, পুরো উপমহাদেশ এবং গোটা দুনিয়ায় অযৌক্তিক ও ন্যায়বোধ-শূন্য একটি রায় হিসেবে চিহ্নিত হল। মুসলমানরা হতাশ হলেন এবং দেশে দেশে বেদনা ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ল।
১৯৯২ সনে ঐতিহাসিক এ মসজিদটিকে আঘাতে আঘাতে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। তখন মুসলমানরা কষ্ট পেয়েছেন। উগ্র হিন্দুরা ভারতে হাজারো মুসলমান শহীদ করেছে। মসজিদ শহীদ করা, এরপর মুসলমানদের ওপর আঘাত করায় বাবরি মসজিদ ইস্যুতে উগ্র হিন্দুদের দ্বারা উপমহাদেশের মুসলমানদের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে তখন। আবার ২৭ বছর পর গত ৯ নভেম্বরের এ রায় সেই বেদনাদায়ক ও রক্তাক্ত ক্ষতকে আরো বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এ রায় যেন মুসলমানদের হৃদয়ের ক্ষতে লবণ ছিটিয়ে দেওয়ার মতো ভূমিকা রেখেছে।
রায় ঘোষণার পরদিন ছিল হযরতপুর মারকাযুদ দাওয়াহ প্রাঙ্গণে মারকাযের কেন্দ্রীয় মসজিদ নির্মাণকাজের উদ্বোধনী দুআর মজলিস। আগের দিন ভারতে বাবরি মসজিদের জায়গায় মন্দির নির্মাণের রায়, পরের দিন মারকাযের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ইফতিতাহের দুআ মজলিস। মনটা বিষণ্ন ও ভারাক্রান্ত ছিল। আলোচনার একপর্যায়ে সেই মজলিসে আমি বলেছি, ইসলামের আইনশাস্ত্র পড়াশোনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক। সেজন্য মানব রচিত আইনে আলোচিত বিভিন্ন মামলার খবর ও খুঁটিনাটি প্রায়সময়ই আমি পর্যবেক্ষণ করে থাকি। আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক এবং আদালতের সিদ্ধান্ত ও সিদ্ধান্তের বিশ্লেষণ, রায় ও রায়ের সঙ্গের মন্তব্যের ওপরও চোখ রাখি। বাবরি মসজিদ মামলা ও রায়ের ক্ষেত্রেও এটা ঘটেছে। বাবরি মসজিদ কেন্দ্রিক মামলাটি দুটি কারণে আমার ভেতরে আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল। প্রধানত মসজিদের ভূমি কেন্দ্রিক এ মামলার সঙ্গে আমাদের দ্বীনী আবেগ জড়িত। দ্বিতীয় কারণটি হল, আলোচিত একটি মামলা এটি। কোন্ গ্রাউন্ডে ও যুক্তিতে কে কী বলছেন এটা দেখতে চেয়েছি। তাই এ লেখায় মামলার রায়ের কয়েকটি পয়েন্ট নিয়ে এবং সে আঙ্গিকে দরকারি কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করব।
রায়ের প্রধান ভিত্তিটাই সন্দেহমূলক
ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ও তার সহকর্মী অন্য বিচারপতিরা ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ মামলার রায় দিয়েছেন গত ৯ নভেম্বর। সেই রায়ে তারা মসজিদের স্থানটিকে হিন্দুদের দিয়ে দিলেন। শুধু তাই নয় বরং সেখানে মন্দির নির্মাণের ব্যবস্থা করতে সরকারকে নির্দেশ দিলেন। আর অন্য কোনো জায়গায় মসজিদ নির্মাণের জন্য মুসলমানদেরকে ৫ একর জায়গা বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানালেন। এটাই হচ্ছে এই রায়ের মূল কথা। এই রায় দেওয়ার পেছনে মূল ও ভিত্তিগত যে প্রধান যুক্তিটি রায়ে বলা হয়েছে, সেটি হল, বাবরি মসজিদ কোনো খালি জায়গায় নির্মাণ হয়নি। ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বক্তব্য ছিল, মসজিদ যে জায়গাটিতে নির্মাণ হয়েছে সেখানে আগে থেকেই কোনো একটা কিছুর স্থাপনা ছিল। রায়ে একথাও বলা হয়েছে যে, সেই স্থাপনা যে কোনো মন্দিরের ছিল এমন কোনো তথ্য প্রমাণিত হয়নি। তার মানে হল, মন্দির ছিল- এমন কথা প্রমাণিত না হওয়া সত্ত্বেও নিছক সন্দেহের ভিত্তিতে মসজিদের জায়গাটিকে মন্দির বানানোর জন্য দেওয়া হল। ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে মুসলমানদের ‘অপরাধ’ সাব্যস্ত হল, তারা কেন কোনো খালি জায়গায় মসজিদ বানালেন না? প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে, এরকম অপ্রমাণিত একটা সন্দেহের ভিত্তিতে যারা বর্তমানে ওই ভূমির দখলে আছে (অর্থাৎ বাবরি মসজিদ ও মুসলমান) আদালত তাদের উচ্ছেদ করতে পারেন কি না।
ভারতের উচ্চ আদালতের বিচারকরা হয়ত জানেন না যে, ইসলামের বিধান অনুযায়ী মসজিদ বানানোর জন্য কোনো খালি জায়গা আবশ্যক নয়। আগে কোনো বাড়িঘর বা স্থাপনা ছিল এমন জায়গাতেও এর বৈধ মালিকগণ কর্তৃক মসজিদ নির্মাণ হতে পারে। যেহেতু রায়ের ভাষ্য ও যুক্তি অনুযায়ীই মসজিদের ওই জায়গায় হিন্দুদের মূল দাবি- রামমন্দির থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হয়নি, তাই ধরে নিতে কোনো সমস্যা নেই যে, অতীতের মুসলিম শাসকরা বৈধ জায়গাতেই মসজিদটি বানিয়েছেন। তারা যে বৈধ জায়গায় মসজিদটি বানাননি- এরকম যুক্তি-প্রমাণ এ রায়েও তুলে ধরা যায়নি।
দ্বিতীয় বিষয়টি হল, বাবরি মসজিদের জায়গাটি রায়ের আগ পর্যন্ত দখলে ছিল মুসলমানদের (অর্থাৎ মসজিদের)। মালিকানা ও দখলিস্বত্ব ধারাবাহিকভাবে থাকার পরও কেবলমাত্র ওই জায়গায় পূর্ব থেকে কিছু একটি স্থাপনা ছিল- প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের এমন পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে জায়গাটি থেকে বৈধ মালিকদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। বিনিময়ে অন্য জায়গায় তাদেরকে ৫ একর জায়গা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। মালিকানা ও দখলিস্বত্ব আছে এমন কোনো পক্ষকে উচ্ছেদ করার জন্য এজাতীয় যুক্তি ও সিদ্ধান্ত কীভাবে যৌক্তিক বলে গণ্য হতে পারে? দুনিয়ার যে কোনো আদালতেই এমন নজির পাওয়া মুশকিল হবে। এ যেন হেরে যাওয়া খেলোয়াড়কে মূল ট্রফি দিয়ে জয়ী পক্ষকে সান্ত¡না পুরস্কার দেওয়ার নামান্তর।
বৈপরীত্যে ভরা রায়
রায়টি শুধু মসজিদ উচ্ছেদ ও হিন্দুদের মন্দির নির্মাণের এ সিদ্ধান্তের কারণেই প্রশ্নবিদ্ধ নয়, বরং আরো প্রশ্ন ও অযৌক্তিকতা এই রায়ের মধ্যে বিদ্যমান। রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা এবং এর পূর্বে একাধিকবার সেখানে জোর করে মূর্তিস্থাপন অন্যায় হয়েছে, বে-আইনি হয়েছে। রায়ের এই অংশটি থেকেও দুটি প্রশ্ন সৃষ্টি হয়।
এক. ’৯২ সালে মসজিদ ভেঙ্গে ওই স্থানে মূর্তিস্থাপন যদি বে-আইনিই হয়, তাহলে সেই মসজিদের জায়গাটি এখন মন্দির নির্মাণের জন্য হিন্দুদের দেওয়া হল কীভাবে?
দুই. ’৯২ সালে মসজিদ ভেঙে মূর্তিস্থাপন বে-আইনি হলে ওইসময় মসজিদ ভাঙার ঘটনায় নেতৃত্বদানকারী বিজেপি নেতা আদভানিসহ অন্য যেসব উগ্র হিন্দু নেতারা যুক্ত ছিল তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তির ঘোষণা হল না কেন? একটি রায়ে কোনো অন্যায় ঘটনাকে শুধু বে-আইনি বলে ক্ষান্ত হয়ে গেলে সেটা কি আদালতের রায় হিসাবে যথেষ্ট হয়? সেই অন্যায় ও বে-আইনি কাজের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিবর্গের স্পষ্ট শাস্তি কিংবা শাস্তির প্রক্রিয়া শুরু করার বিষয়টি আদালতের রায়ে তো থাকার কথা ছিল। অথচ এমন কোনো কথা ওই রায়ে নেই।
তাছাড়া এখানে আরেকটি জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার আশংকা তৈরি হয়েছে। বাবরি মসজিদ ভাঙার একটি মামলা আদালতে এখনও চলমান। সেই মামলার কার্যক্রম এখনো শেষ হয়নি বা ইচ্ছা করেই শেষ করা হয়নি। (যদিও এর আগেই অবসরে চলে যাওয়া প্রধান বিচারপতি তড়িঘড়ি করে জায়গাটি হিন্দুদের দিয়ে গেছেন) অনেকেই এখন আশংকা করছেন ৯ নভেম্বরের বাবরি মসজিদের জায়গা বিষয়ক এই চূড়ান্ত রায়টি বাবরি মসজিদ ভাঙার চলমান মামলায় দোষীদের পক্ষে ব্যবহার হতে পারে। অর্থাৎ এই রায়ে যেহেতু মসজিদের জায়গা মন্দিরের জন্য দেওয়া হয়ে গেছে, তাই এই রায়ের সূত্র ধরে চলমান মামলায় এই যুক্তি উত্থাপিত হতে পারে যে, অভিযুক্তরা মসজিদ ভেঙে অন্যায় কিছু করেনি। ইতিপূর্বে সেখানে মূর্তিস্থাপন করেও তারা বে-আইনি কিছু করেনি। কারণ চূড়ান্ত রায়ে তো সেই জায়গা মন্দিরকেই দেওয়া হয়েছে।
মূলত অযৌক্তিক একটি রায়ের ভেতরে অনেক রকম বৈপরীত্যই চোখে পড়ার কথা। লক্ষ করলেই সে বৈপরীত্যগুলো দেখতে পাওয়া যায়। একটি দিয়ে অপরটিকে ঢাকার চেষ্টা করা হলেও বিভিন্ন পর্যায়ের পক্ষপাত ও অসদুদ্দেশ্য রায়টির বিভিন্ন অংশে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
গ্রাম্য সালিশের মতো ভারসাম্যের বিচার!
বাবরি মসজিদের মূল জায়গাটিকে মন্দিরের জন্য দিয়ে অন্য জায়গায় মসজিদের জন্য ৫ একর জায়গা বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। বেশিরভাগ মুসলিম নেতৃবৃন্দ এ ৫ একর জায়গার ঘোষণা প্রত্যখ্যান করেছেন। আদালত সচেতনভাবে অথবা অসচেতনভাবেই এ কাজটি করেছে। অযৌক্তিক যুক্তির ভিত্তিতে মসজিদের জায়গা মন্দিরের জন্য দিয়ে মসজিদের জন্য আলাদাভাবে ৫ একর জায়গা দেওয়ার কথা বলেছে। বাস্তবে রায় আইনসিদ্ধ ও যুক্তিযুক্ত হলে মসজিদের জন্য এই বিকল্প জায়গা দেওয়ার দরকার ছিল না। বরং অন্যের জমি দখলের জন্য তারা অভিযুক্ত হত। আসলে মসজিদের জন্য ভারতের আদালতের রায়ে সরকারের দেওয়া ৫ একর জায়গা মুসলমানদের কোনোই দরকার নেই। কারণ মসজিদের জন্য বিকল্প জায়গা দিয়ে বাবরি মসজিদ কেন্দ্রিক মুসলিমদের ন্যায্য আবেগ ও ক্ষতের কোনোরকম উপশম হবে না। ভারতের একজন জনপ্রিয় মুসলিম নেতা ও লোকসভা সদস্য যথার্থই বলেছেন যে, মুসলমানরা এত দরিদ্র হয়ে যায়নি যে, মসজিদ বানানোর জন্য তাদেরকে অন্যের থেকে জায়গা ভিক্ষা নিতে হবে। তাই মনে হচ্ছে এ রায়ের ক্ষেত্রে বিভিন্নরকম বৈপরীত্য সৃষ্টি করে বাস্তবতা ও ন্যায্যতা এড়িয়ে গিয়ে একধরনের ‘গ্রাম্য বিচার’ করার চেষ্টা করা হয়েছে।
বাবরি মসজিদ হেফাজত এবং এ বিষয়ক মামলার সুষ্ঠু রায়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল ভারতরাষ্ট্রের সাংবিধানিক ভিত্তি ও মর্যাদার ইস্যু। ’৪৭ পূর্ব সময়ে বলা হয়েছিল, সে দেশের মুসলমানরা ন্যায়বিচার ও ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না, হিন্দু-মুসলিম সকলকে সমতার চোখে দেখা হবে। সেইসব প্রতিশ্রুতি ও নীতির একটি অগ্নিপরীক্ষা ছিল বাবরি মসজিদ মামলার রায়ের বিষয়টি। বাস্তবতা হল, সেই ন্যায্যতা ও আস্থা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি এই রায়ে। বরং মুসলমানদের স্পষ্ট অধিকারকে আঘাত করে হিন্দু-পক্ষপাতিত্ব প্রকটভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
বাবা-ছেলের ঝগড়ায় গ্রাম্য বিচারের একটি গল্প লোকমুখে মশহুর হয়ে আছে। বাবার বিরুদ্ধে অন্যায় ও জুলুমের অভিযোগ দায়ের করে ছেলে। গ্রাম্য সালিশে সে অভিযোগ প্রমাণিত হয়। তখন বাবাকে ধমক দিয়ে বলা হয়, ছেলের প্রতি জুলুম না করতে আর ছেলেকে বলা হয়, বাবার কাছে ক্ষমা চাইতে। এভাবে প্রকৃত বিচারের দিকে না গিয়ে ভারসাম্য তৈরির যে সিদ্ধান্ত গ্রাম্য সালিশে দেওয়া হয়- তারই একটি নমুনা-মহড়া দেখা গেল বাবরি মসজিদ মামলার রায়ে। মূল জমি মন্দির বানানোর জন্য হিন্দুদের দিয়ে মুসলমানদের ‘সান্ত¡না’ দিতে মসজিদের জন্য ৫ একর জায়গা দেওয়ার সিদ্ধান্ত সেই গ্রাম্য সালিশেরই একটি নমুনা। যদিও এটাকে গ্রাম্য-বিচার বলাও মুশকিল। যদি এমন হত যে, বাবরি মসজিদের জায়গা কাউকে না দিয়ে মসজিদ-মন্দিরের জন্য অন্য কোথাও ৫ একর করে জায়গা বরাদ্দ করা হত তাহলে দৃশ্যত এটাকে গ্রাম্য-বিচার বলে অভিহিত করার পথ খোঁজা যেত। কিন্তু তা তো হয়নি। সেটা যদি হত তবুও প্রশ্ন দাঁড়িয়ে যেত যে, যে কথা সালিশে খাটে তা কি সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে মানায়! আদালত তো যুক্তি-তর্ক ও আইনের বাইরে যেতে পারে না।
মোদি সরকারের মুসলিমবিরোধী আঘাতের ধারা
বিশ্লেষকরা বলেন, বাবরি মসজিদ মামলার এই রায়টি হল ভারতের মুসলমানদের প্রতি হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকারের তৃতীয় আঘাত। প্রথমে এনআরসির মাধ্যমে লাখ লাখ মুসলমানকে অ-ভারতীয় সাব্যস্ত করা হল। আসাম থেকে শুরু করে এনআরসির এ ধারা এখন সারা ভারতজুড়েই চালু করার খবর পাওয়া যাচ্ছে এবং বিজেপি সভাপতি কট্টর হিন্দুবাদী অমিত শাহ-এর ঘোষণায় স্পষ্ট হয়েছে যে, তা একমাত্র মুসলমানদের জন্যই করা হচ্ছে। কারণ এনআরসিতে ক্ষতিগ্রস্ত অন্যদের ভিন্ন আইনে ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়ে যাচ্ছেন। দ্বিতীয় আঘাত হল, কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বাতিল করে সেই রাজ্যটিকে পুরোপুরি কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশেষায়িত রাজ্য কাশ্মীরকে খণ্ড-বিখণ্ড করে, প্রাদেশিক মর্যাদাও বিলুপ্ত করা হয়েছে। অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে সেখানকার মুসলমানদের। এই অবরুদ্ধতা নানা রূপে নানা মাত্রায় চালানো হচ্ছে সেখানে।
এখন শোনা যাচ্ছে, মুসলমানদের ওপর মোদি সরকারের চতুর্থ যে আঘাতটি আসতে যাচ্ছে সেটি হচ্ছে, মুসলিম পারসনাল ল বোর্ডকে বাতিল করে দিয়ে মুসলিম পারিবারিক আইন উঠিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ। পুরো ভারতজুড়ে অভিন্ন পারিবারিক আইন ও দ-বিধি প্রয়োগের পাঁয়তারা শুরু করেছে বিজেপি সরকার। আঘাত একের পর এক আসছেই ভারতের মুসলমানদের ওপর। এসব ঘটনা পরম্পরা দেখে অনেকেই ’৪৭ পূর্বের ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরাতে বাধ্য হচ্ছেন। বিশেষত যখন বাবরি মসজিদ মামলার এই অযৌক্তিক রায়ের পরও এই রায়ের জন্য স্বাধীন ভারতের সংবিধান প্রণেতা ও প্রথম ক্ষমতাসীন দল ভারতের জাতীয় কংগ্রেসকে অভিনন্দন জানাতে দেখা গেল তখন ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ইংরেজদের বিদায়ের পূর্বে একদিকে অখ- ভারত, অপরদিকে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি- এই দ্বিমুখি বিতর্কের মধ্যে যারা পৃথক আবাসভূমির দাবিটি জানিয়েছিলেন, তাদের দাবি ও শংকার যৌক্তিকতাই নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে বলে বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন।
’৪৭-এর ইতিহাসে চোখ
উপমহাদেশে দীর্ঘ অন্যায় দখলদারিত্ব ছেড়ে যখন ইংরেজরা বিদায় নিতে বাধ্য হচ্ছিল তখন অখ- ভারত ও মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি- এ দু’ ধারায় এখানকার জনগণ ও নেতৃবৃন্দ বিভক্ত হয়ে পড়েন। যারা পৃথক আবাসভূমির দাবি জানিয়েছিলেন তাদের সে দাবির ভিত্তিতেই প্রথমে পকিস্তান, পরে সে পাকিস্তানের মধ্য থেকেই ১৯৭১ সনে স্বাধীন বাংলাদেশ জন্মলাভ করে। ভারতের বর্তমান ঘটনাবলী তাদের ’৪৭ পূর্ব সময়ের দাবি ও আশংকাগুলোরই বাস্তবতা তুলে ধরছে। তাদের আশংকা ছিল, যদি অখ- ভারতে একসঙ্গে থাকা হয় তাহলে প্রায় দ্বিগুণ হিন্দু জনগোষ্ঠীর কাছে মুসলমানদের বারবার বঞ্চিত হতে হবে, আঘাত পেতে হবে। মুসলমানেরা স্বাচ্ছন্দে ও নিরাপদে তাদের ধর্মপালন ও জীবনযাপন করতে পারবে না। পৃথক আবাসভূমির পক্ষের নেতৃত্বের মাঝে কংগ্রেসের অনেক নেতাকে দেখার পর এজাতীয় আশংকা বদ্ধমূল হয়ে উঠেছিল। কারণ, তারা দেখেছিলেন, অখ- ভারতের দাবিদার কংগ্রেসের অনেক হিন্দু নেতার বাইরের চেহারা একরকম এবং ভেতরের স্বরূপটা আরেক রকম। ’৪৭ পূর্ব সময়ে মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ থেকে নিয়ে এদেশীয় নেতাদের মধ্য থেকে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি, মাওলানা ভাসানী, এমনকি তৎকালীন ছাত্রনেতা এবং পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান হিন্দু-মুসলিম ইস্যুতে কংগ্রেসের বহু নেতার ভেতর-বাইরের দ্বিমুখি চেহারা দেখে পৃথক আবাসভূমির পক্ষে আন্দোলন করেছেন। কংগ্রেস নেতাদের অনেকের হিন্দুবাদী চেহারা দেখে তাদের মধ্যে প্রবল অবিশ্বাস জন্ম নিয়েছিল। তারা অনুধাবন করেছিলেন- এই হিন্দু নেতাদের সঙ্গে এক ভারতে থাকলে দ্বীন-ঈমান নিয়ে মুসলমানদের জীবন চলা কঠিন হয়ে যাবে। এসন্দেহ শুধু মুসলিম লিগারদের মধ্যেই ছিল না; বরং কংগ্রেসের তৎকালীন কোনো কোনো বড় নেতাও তাদের লেখায় বড় বড় হিন্দু নেতাদের এমন চেহারার বর্ণনা দিয়ে গেছেন। স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা মাওলানা আবুল কালাম আযাদের লেখাও এজন্য পড়া যেতে পারে। হিন্দুত্ববাদী বিজেপিকে বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও সে জায়গায় মন্দির নির্মাণের ব্যবস্থা করার জন্য আলাদা করে কিছু বলার নেই, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার ভারতীয় কংগ্রেস যে বাবরি মসজিদ বিষয়ক ৯ নভেম্বরের রায়কে অভিনন্দন জানাল, এতে কি এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় না যে, আমাদের তখনকার মরহুম নেতৃবৃন্দের শংকাটা বাস্তবানুগ ছিল। কংগ্রেসের এ আচরণ কি ’৪৭ পূর্ব সময়ের শংকাকেই বাস্তব প্রমাণিত করল না?
বাবরি মসজিদ বিষয়ক ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের রায় এবং তার প্রতিক্রিয়ায় আবার প্রমাণিত হল, ভারতের সংবিধানে যা লেখা আছে, তার সঙ্গে তাদের বাস্তব আচরণের কোনো মিল নেই। তারা দাবি করে, ভারত পৃথিবীর বৃহৎ গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। বাস্তবে কাজে-কর্মে ও আচার-আচরণে ভারত একটি হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র এবং এই হিন্দুত্ববাদী চেতনায় ভারতের প্রধান দল- বিজেপি ও কংগ্রেসের মধ্যে বিশেষ কোনো ভিন্নতা নেই। একারণেই কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বাতিলের পর বিতর্কের মুখে নরেন্দ্র মোদি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিলেন, বরং সাহস থাকলে কংগ্রেস প্রতিশ্রুতি দিক, তারা ক্ষমতায় এলে ৩৭০ ধারা বহাল করবে।’ মোদির এ চ্যালেঞ্জ কংগ্রেস গ্রহণ করেনি, কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। এর মূল কারণ, তারা সবাই হিন্দু স্বার্থের বেলায়, মুসলিম দমনের বেলায় এক ও অভিন্ন। তারা গোড়ায় এক। গরুর গোশত ইস্যুতে মুসলিম হত্যা, পথেঘাটে মুসলমানদের মারধর করা, এনআরসির নামে ভারতের মুসলমানদের দেশছাড়া করার মতো ইস্যুগুলোতে হিন্দু কট্টরপন্থী বিজেপির বিরুদ্ধে কংগ্রেসের বিশেষ কোনো ভিন্ন অবস্থান নেই।
ভারতের ক্ষমতাসীন ও বিরোধী প্রধান দলগুলোর অবস্থান একইরকম। হিন্দুত্ববাদের পক্ষ-বিপক্ষে কারো আওয়াজ-আচরণ রূঢ়, কারো কিছুটা নমনীয়, কিন্তু মনোভাব ও চেতনা তাদের অভিন্ন। এর বাইরে ভিন্ন অবস্থান নিয়ে সেখানে যেসব হিন্দু আছেন তারা অতি মুষ্টিমেয়, তারা কোণঠাসা ও ভয়াবহভাবে সংখ্যালঘু। তাদের অবস্থান ও স্বর সবসময় হিন্দুত্ববাদের চাপের মধ্যেই থাকে।
কথা কি এখানেই শেষ হয়ে যাবে?
নিশ্চয়ই না। যেমনিভাবে কট্টর হিন্দুরা মুসলিম নির্যাতন বন্ধ করবে না, বেছে বেছে মুসলমানদের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো জবরদখল অব্যাহত রাখতে চাইবে। কখনো গরুকে মুসলিম প্রাণের চেয়ে বেশি মর্যাদা দিয়ে তাদের হত্যা করবে, কখনো এনআরসির নামে তাদের উচ্ছেদ করবে, তেমনি আঘাতে আঘাতে নিশ্চয় একদিন বিশ কোটির অধিক মুসলমানের রক্তও কথা বলা শুরু করবে। তখনকার পরিস্থিতি কী হতে পারে সে কথাও উন্মত্ত হিন্দুবাদীদের ভেবে রাখা দরকার। আর বাবরি মসজিদসহ অন্যান্য বে-দখল হয়ে যাওয়া মসজিদগুলো নিশ্চয় তখন আবার এক আল্লাহ্র সামনে সিজদায় অবনত মুসল্লীদের দিয়ে ভরে উঠবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ্র ঘর যে মূর্তি দিয়ে দীর্ঘদিন অপবিত্র রাখা যায় না এর বড় প্রমাণ তো বাইতুল্লাহ শরীফ। এ মাসআলাও দখলদারদের জেনে রাখা ভালো যে, কোনো জায়গায় মসজিদ স্থাপিত হওয়ার পর বে-দখল হয়ে গেলে দখলমুক্ত হওয়ার সাথে সাথে তা আবার মসজিদ হিসেবেই চালু হয়ে যায়। সুতরাং তারা যদি ভেবে থাকে এভাবে সব কিছু স্থায়ীভাবে শেষ করে দেওয়া যাবে তবে ভুল করবে।