রবিউল আউয়াল ১৪৪১   ||   নভেম্বর ২০১৯

গুনাহ মাফের আশায় সড়ক পরিষ্কার

শাহাদাত সাকিব

আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত কত ঘটনা ঘটে। সব ঘটনা একরকম নয়। কিছু ঘটনার উপর আমরা শুধু চোখ বুলিয়ে যাই। স্মৃতির মণিকোঠায় সেগুলো কোনো স্থান পায় না। আবার কিছু ঘটনা আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে গভীরভাবে। যুগের পর যুগ হৃদয়জগতে জ¦লজ¦ল করতে থাকে। চেতনাকে সমৃদ্ধ করে, জীবনের অঙ্গনে নতুন উদ্যমে কাজ করার প্রেরণা জোগায়। এমন একটি ঘটনাই কয়েকদিন আগের একটি জাতীয় দৈনিকের খবর হয়েছে।

তিনি একজন সাধারণ মানুষ। নাম সুলতান মুন্সি। থাকেন মুন্সিগঞ্জ জেলা সদরে। একটি অভিনব কাজ করে সবার দৃষ্টি কেড়েছেন। মুন্সিগঞ্জের কাটাখালি থেকে সার্কিট হাউস পর্যন্ত সড়ক ও আশপাশ এলাকা নিজ উদ্যোগে একাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে তুলেছেন। সড়কের  যেখানে যে সমস্যা ছিল তা-ও মেরামত করে দিয়েছেন তিনি। দীর্ঘ এক মাস ধরে একা এ কাজগুলো করেছেন। একটি ভ্যানগাড়ি, বেলচা ও কাস্তে নিয়ে প্রতিদিন তিনি এ পরিষ্কার অভিযানে নামতেন। এক মাস কঠোর পরিশ্রম করে কাটাখালি থেকে সার্কিট হাইজ পর্যন্ত পুরো সড়কটির দুই পাশের সব ময়লা-আবর্জনা  ও ঘাস পরিষ্কার করেছেন। এখন এ সড়কে চলার সময় সবার মন জুড়িয়ে যায়।

সুলতান মুন্সি বলেন, গুনাহ মাফের জন্যই তিনি এ অভিযান চালিয়েছেন।  তার কথা হল, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা এবং রাখা গুনাহ মাফের একটি মাধ্যম।

তিনি সার্কিট হাউজের দক্ষিণ পাশের আদর্শ মাদরাসাটির সড়ক ও মাদরাসার আশপাশের এলাকাও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে দিয়েছেন। কাটাখালি টু সার্কিট হাউজ ও রনছ গ্রামের সড়ক পুরো অংশটিই তিনি পরিষ্কার করেছেন। (নয়া দিগন্ত ১৯-১০-২০১৯)

আমাদের চারপাশে কত ময়লা পড়ে থাকে। পথের ধারে, পথের মাঝে কখনো স্তুপ হয়ে থাকে ময়লা-আবর্জনা। সেগুলো আমাদের কষ্টের কারণ হয়। চলাচলে ব্যাঘাত ঘটায়। রাস্তার এসব ময়লা-আবর্জনা ও অন্যান্য কষ্টদায়কবস্তু সরিয়ে দেয়া অনেক সাওয়াবের কাজ। এখানকার নাগরিক জীবনে এইসব কাজের জন্য আলাদা বিভাগ ও কর্মী থাকে। এইসব বিভাগের যারা কর্মী ও দায়িত্বশীল তাদের কর্তব্য, দায়িত্বপালনে সচেতন হওয়া। তারা যদি তাদের দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করেন তাহলে যেমন কাজে ফাঁকি দেওয়ার অপরাধ থেকে বাঁচতে পারবেন তেমনি জনগণের সেবা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার যে সাধারণ ইসলামী বিধান সে বিধান পালনেরও সাওয়াব পাবেন। কারণ ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে, মানুষের অন্তরের ভালো প্রেরণার আল্লাহ তাআলার কাছে অনেক মূল্য। মানুষ যদি তার নির্ধারিত দায়িত্বটিও সেবার মানসিকতা নিয়ে পালন করেন তাহলে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সেবার সাওয়াবও পাবেন। এর সাথে সমাজের প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য, পরিবেশকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার ক্ষেত্রে আন্তরিক হওয়া। সমাজের সকলে সচেতন ও আন্তরিক না হলে শুধু পরিচ্ছন্নকর্মী দিয়ে কোনো সমাজকে পরিচ্ছন্ন রাখা সম্ভব নয়। ইসলাম আমাদেরকে খুব তাকীদের সাথে পরিচ্ছন্নতার নির্দেশ দান করেছে। অন্যান্য জাতির সাথে যেসব ক্ষেত্রে মুসলিম জাতির পার্থক্য সূচিত হওয়ার কাম্যতা হাদীস শরীফে পাওয়া যায় তন্মধ্যে একটি হচ্ছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। ইরশাদ হয়েছেÑ

طَهِّرُوا أَفْنِيَتَكُمْ، فَإِنّ الْيَهُودَ لَا تُطَهِّرُ أَفْنِيَتَهَا.

তোমাদের আঙ্গিনাসমূহ পাক-সাফ রাখ। ইহুদীরা তাদের আঙ্গিনা পাক-সাফ রাখে না। Ñআলমুজামুল আওসাত ৪/২৩১

কাজেই শুধু শারীরিক পবিত্রতা নয়, আশপাশের পরিবেশকেও পাক-সাফ রাখা ইসলামে কাম্য। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, যে বিষয়টি মুসলিম জাতির আলাদা বৈশিষ্ট্য হিসেবে পরিস্ফুট থাকার কথা ছিল সেটিতেই যেন মুসলিমরা বেশি অবহেলার প্রমাণ দিচ্ছে।

সুলতান মুন্সি একজন বৃদ্ধ মানুুষ। মাথায় টুপি। মুখে সফেদ দাড়ি। দেহে বার্ধক্যের ছাপ স্পষ্ট। জীবনের এ পড়ন্ত বেলায় দুপুরের তপ্ত রোদেও তিনি অবিশ্রান্ত কাজ করেছেন। শরীরের ঘাম ঝরিয়েছেন কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য, গুনাহ মাফের আশায়। আমরা সুলতান মুন্সি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারিÑ কীভাবে স্বার্থহীনভাবে কাজ করতে হয়। কাজের মধ্যে কেমন নিমগ্ন থাকতে হয়। কেবলমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার চেতনা নিয়ে কীভাবে দেশের কল্যাণ ও মানুষের সেবা করতে হয়। 

যে কাজটি করতে বিপুল শ্রমশক্তির প্রয়োজন ছিল তা সুলতান মুন্সি একাই করেছেন। কারো সাহায্য লাভের আশায় তিনি বসে থাকেননি। আসলে এভাবে অন্যের সহযোগিতা লাভের আশায় বসে থাকলে অনেকক্ষেত্রে শেষে আর কাজই হয় না। মানুষের মনের বিশ্বাস ও আভ্যন্তরীণ চেতনা যখন কোনো কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে তখন মনের ভেতর থেকেই মানুষ কাজের শক্তি লাভ করে। ভেতরের এই চেতনা না থাকলে কাজ হয় প্রাণশূন্য।

রাস্তার ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়। কোটি কোটি টাকা খরচ হয় এ খাতে। কিন্তু এর কাক্সিক্ষত ফলাফল আমাদের চোখের সামনে কতটুকু। যারা পথচারী, পথের প্রতিবেশী তারাও মনে করেন এগুলোর উন্নয়ন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার ও রাখার দায়িত্ব আমাদের নয়। ফলে পথচারীদের জন্য কষ্টদায়ক ও পথের আশপাশের পরিবেশের সৌন্দর্যহানীকর কিছু সরিয়ে দেয়ার কোনো গরজ অনুভূত হয় না। অথচ এর বিনিময়ে রয়েছে অনেক আজর ও সাওয়াব।

একটি বিষয় লক্ষণীয়। সুলতান মুন্সি  এ পরিচ্ছন্ন অভিযান দায়সারাভাবে করেননি। বরং পূর্ণ নিখুঁত ও সুন্দরভাবে করেছেন, যা পথচারীদের চোখ জুড়িয়ে দেয়। স্থানীয়রা বলেছেন, সুলতান মুন্সি এত সুন্দরভাবে রাস্তা পরিষ্কার করেছেন যে, হাজার হাজার টাকা দিয়ে শ্রমিক নিয়োগ দিলেও এত সুন্দর করে পরিষ্কার করা সম্ভব হত না। এই সড়কে চলাচলকারী জাকির হোসেন জানান, সত্যিই সড়কটি দিয়ে চলতে গেলে মনটা ভরে যায়। এত সুন্দর হয়েছে, যা কোনোদিনই আমার কল্পনায় ছিল না। তিনিও জানেন না, এ কাজ কে করেছেন। সুলতান মুন্সির কথা জেনে তার জন্য দুআ করে বলেন, এমন মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সবাই কাজ করলে দেশ সোনার দেশে রূপান্তরিত হত।

যে কাজ হৃদয়ের ভেতরের চেতনা থেকে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য করা হয় তা সুন্দর ও নিখুঁত হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ, যেনতেনভাবে দায়িত্ব পালন ও বৈষয়িক লাভ-ক্ষতির হিসাব এখানে থাকে না। অনন্ত জীবনের অন্তহীন সুখের হাতছানি ব্যক্তিকে সংশ্লিষ্ট কাজটি নিখুঁত ও সুন্দরভাবে সম্পাদন করতে উদ্বুদ্ধ করে। এ চেতনা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনার মানসিকতা না থাকার দরুন আজ দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি জেঁকে বসেছে। জনগণের সেবা করাÑ এ যেন খাতা-কলম আর মুখের বুলির মাঝেই সীমাবদ্ধ। বাস্তব জীবনে যার কোনো বাস্তবায়ন নেই। দেশপ্রেম, দেশপ্রেম চিৎকারে গলা ফাটানো, মঞ্চ কাঁপানো, শ্রোতাদের মাতানোÑ এতটুকু করেই আমরা দায়িত্ব শেষ করি। আমাদের কাজকর্মে দেশপ্রেমের কোনো প্রকাশ ঘটে না।

এসকল মেকি দেশপ্রেমিকের সাথে যখন সুলতান মুন্সির মত প্রকৃত দেশপ্রেমিকদের দেখি তখন মনে সান্ত¦না পাই। ভাবি, এখনও আছেন কিছু প্রকৃত মানুষ। আধারে যারা হাতে নিয়ে আছেন আলোর প্রদীপ। সে আলো আমাদের পথ দেখায়। সুলতান মুন্সি এ দেশপ্রেমের পাঠ শিখেছেন ঈমানের পাঠশালা থেকে। এ পাঠশালাই তাকে প্রকৃত দেশপ্রেমের পাঠ শিখিয়েছে।

আসলে প্রকৃত দেশপ্রেমের চেতনা আসবে ঈমানী অনুভূতি থেকে। এ অনুভূতিই আমাদেরকে দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করবে। কারণ, মানবসেবা ও সমাজসেবা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। খোলাফায়ে রাশেদীন আল্লাহর নৈকট্যলাভের মাধ্যম মনে করেই শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন। কেবল একজন শাসক হওয়া  কখনো তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। তাই আমাদের দেশপ্রেম হোক ঈমানী চেতনায় আলোকিত ও উদ্ভাসিত।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবায়ে কেরামের চেয়ে বড় দ্বীনদার আর কে হতে পারে? তাদের চেয়ে বেশি ঈমানী চেতনায় আর কারা উদ্দীপ্ত থাকতে পারে। তাঁদের পবিত্র জীবনে আমরা যখন জনসেবা ও সমাজগঠনের বিস্তৃত অধ্যায় দেখতে পাই তখন বুঝতে পারি যে, দ্বীনদারির সাথে এর কোনো সংঘর্ষ নেই; বরং এটি দ্বীনদারিরই এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দেখুন হাদীসের এক বিখ্যাত কিতাব মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বায় এই বর্ণনা আছে যে, বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবু মূসা আশআরী রা. যখন বসরার শাসনকর্তা হয়ে এলেন তখন তিনি বসরার অধিবাসীদের লক্ষ্য করে বলেনÑ

إِنّ أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ بَعَثَنِي إِلَيْكُمْ لِأُعَلِّمَكُمْ سُنَّتَكُمْ، وَإِنْظَافَكُمْ طُرُقَكُمْ.

আমীরুল মুমিনীন আমাকে তোমাদের নিকট পাঠিয়েছেন যেন তোমাদের ‘সুন্নাহ’ শিক্ষা দেই এবং তোমাদের পথ-ঘাট পরিষ্কার করার শিক্ষা দান করি। Ñমুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৫/২৬৪

এটা খিলাফতে রাশেদার আমলের কথা, যা ছিল ইসলামের শিক্ষা ও বিধানের পঠন-পাঠন এবং বিস্তার ও বাস্তবায়নের স্বর্ণযুগ। পরবর্তী সকল যুগের জন্য সে যুগ ছিল অনুসরণীয়। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা ও নির্দেশনার অনুসরণ ও সঠিক বাস্তবায়নের কারণে সে যুগকে বলা হয় আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগেরই যেন প্রলম্বিত রূপ। সেই যুগে সামাজিকভাবে পথ-ঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়টি কত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে। সুন্নাহ্র শিক্ষাদানের সাথে পথ-ঘাট পরিষ্কার রাখার শিক্ষার উল্লেখ হয়েছে। আসলে দ্বিতীয় বিষয়টি প্রথম বিষয়টি থেকে আলাদা কিছু নয়। সুন্নাহর শিক্ষার সাথে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার শিক্ষাও আছে। তবে বিশেষ গুরুত্বের কারণে একে আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে, আমাদের দ্বীনের শিক্ষা পুরোপুরিভাবে অনুধাবন করা এবং অনুসরণ করা। এই দ্বীন আমাদের জীবন ও সমাজ সর্বঙ্গ সুন্দর করতে পারে। এই দ্বীনই আমাদের নিজেদের প্রতি এবং দেশ ও সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল হতে শেখায়, সামষ্টিক চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার শিক্ষা দান করে।

এ দেশ আমাদের সবার। আমরা সবাই এ দেশের নাগরিক। সকলের সম্মিলিত চেষ্টাতেই এ দেশ হয়ে উঠতে পারে শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতিক। প্রত্যেকে আমরা যে যেখানে আছি সেখানকার চারপাশের পরিবেশ যদি সুন্দর করে রাখার চেষ্টা করি তাহলে আমাদের দেশ হয়ে উঠতে পারে অনেক বেশি সুন্দর। দেশকে সুন্দর করার দায়িত্ব কেবল সরকারের নয়, আমাদের সবার। তাই এ বিষয়ে সকলকেই সচেতন হতে হবে। যদি প্রত্যেক এলাকায় এমন সুলতান মুন্সি জেগে ওঠে, যারা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে মানুষের সেবা ও শান্তির জন্য চারপাশের পথ ও পরিবেশকে সুন্দর করার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়ে ওঠে তাহলে এদেশ সোনার দেশে পরিণত হবে ইনশাআল্লাহ।

 

 

advertisement