কিতাবের মুকাদ্দিমা ও খাতিমা : মুতালাআ ও ইসতিফাদার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
الحمد لله وسلام على عباده الذين اصطفى، أما بعد:
কিতাবের ‘মুকাদ্দিমা’ ও ‘খাতিমা’-য় গুরুত্বপূর্ণ অনেক মালুমাত থাকে। যে ফনের কিতাব, ঐ ফন ছাড়াও অন্যান্য অনেক ‘উসূলী’ ও ‘উমূমী’ মালুমাতও অনেক সময় মুকাদ্দিমা ও খাতিমায় উল্লেখ করা হয়। যদিও প্রত্যেক কিতাবে মুকাদ্দিমা ও খাতিমা থাকে না। কোনো কিতাবে মুকাদ্দিমা থাকে কিন্তু খাতিমা থাকে না। আবার কোনো কিতাবে খাতিমা থাকে কিন্তু মুকাদ্দিমা থাকে না।
কিতাব মাখতুত হলে কখনো তাতে ‘নাসিখ’-এর পক্ষ থেকেও মুকাদ্দিমা বা খাতিমা বা উভয়টি থাকে, কখনো কিতাবের ‘মুমলী’র পক্ষ থেকেও মুকাদ্দিমা বা খাতিমা থাকে। যেমন আল্লামা খাত্তাবী রাহ. (৩৮৮ হি.)-এর ‘মাআলিমুস সুনান’-এর শুরুতে হাফেয আবু তাহের সিলাফী রাহ. (৫০৭ হি.)-এর মুকাদ্দিমা রয়েছে।
কিতাব যদি পুরনো কোনো মাতবূ হয় তাহলে তাতে প্রকাশকের পক্ষ থেকে خاتمة الطبع অথবা মুকাদ্দিমা থাকে। আর নতুন মাতবূ কিতাবসমূহে সাধারণত মুহাক্কিকের পক্ষ থেকে মুখতাসার, মুতাওয়াসসিত অথবা মুফাসসাল মুকাদ্দিমা উল্লেখিত হয়। কখনো কিতাবের ব্যাখ্যাকার অথবা টীকাকারের পক্ষ থেকেও মুকাদ্দিমা থাকে। যেমন আল্লামা আবদুল হাই লখনবী রাহ. النافع الكبير لمن يطالع الجامع الصغير নামে ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান রাহ.-এর কিতাব الجامع الصغير (في فروع الحنفية)ة-এর মুকাদ্দিমা লিখেছেন।
এটা জরুরি নয় যে, প্রত্যেক মুকাদ্দিমার গুরুত্ব ও উপকারিতা একসমান হবে। কিন্তু এতে কি সন্দেহ আছে যে, অনেক কিতাবের ‘মুকাদ্দিমাতুত তাহকীক’ মাশাআল্লাহ, ফাওয়ায়েদে ভরপুর থাকে। এই কারণেই বড় ব্যক্তিদের ‘মুকাদ্দিমাতুল কুতুব’ স্বতন্ত্র কিতাব আকারে ছাপার রেওয়াজও আছে। নিকটবর্তী সময়ে এর গুরুত্বপূর্ণ নমুনা হল আল্লামা বানূরী রাহ. ও শায়েখ যাহেদ কাউসারী রাহ.-এর ‘মুকাদ্দিমাতের’ সংকলন।
সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল স্বয়ং মুসান্নিফে কিতাবের মুকাদ্দিমা ও খাতিমা, হোক না সে মুকাদ্দিমা কিতাবের দিবাচার মতো অল্প কয়েক লাইনের। হতে পারে যে, মুসান্নিফ এই কয়টি লাইনেই তার রচনার প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে দিয়েছেন, অথবা কিতাবে তার মানহাজ বা ইলতিযামাত বর্ণনা করেছেন, অথবা তার মাসাদির ও মাআখিযের বিবরণ দিয়েছেন। কিতাব থেকে ইসতিফাদা করার ক্ষেত্রে এই প্রত্যেকটি বিষয় থেকেই অনেক সহযোগিতা পাওয়া যায়।
কিন্তু আফসোসের বিষয় হল, সাধারণত মুকাদ্দিমা ও খাতিমার প্রতি তালিবে ইলমদের দৃষ্টি থাকে কম। তারা মুকাদ্দিমাকে মুকাদ্দিমা মনে করে এবং খাতিমাকে খাতিমা মনে করে এর মুতালাআ ছেড়ে দেয়। অথচ এমনটি না হওয়া উচিত ছিল।
‘মুকাদ্দিমাত’ সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে কোনো কোনো নাসেখে কিতাবের পক্ষ থেকেও তাসাহুল হয়েছে। মুকাদ্দিমাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে কোনো কোনো নাসেখ ঐ মুকাদ্দিমাকে তার নুসখায় উল্লেখ করেননি। যদি কোনো মাতবূ নুসখা এধরনের মাখতূত থেকে ছাপানো হয় তাহলে তাতেও ঐ মুকাদ্দিমা অনুপস্থিত থাকে।
কোনো কোনো কিতাবের মুকাদ্দিমা দীর্ঘ হওয়ার কারণে তাকে ভিন্ন কিতাব আকারেও সংরক্ষণ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে এর বিপরীতও হয়েছে যে, কোনো কোনো মুকাদ্দিমা না মূল কিতাবের সঙ্গে আছে আর না ভিন্নভাবে তা সংরক্ষণ করা হয়েছে।
হাকেম আবু আবদুল্লাহ নিশাপুরী রাহ.-এর ‘আলমাদখাল’, যার উপর আমাদের হযরতুল উস্তায নু‘মানী রাহ. ‘তাবসেরা’ লিখেছেন, এটি হাকেমের ‘কিতাবুল ইকলীল’-এর মুকাদ্দিমা। কিন্তু হাকেম রাহ. ‘আলমুসতাদরাক আলাসসহীহাইন’ -এর শুরুতে যে মুকাদ্দিমা লিখেছিলেন তা হয়ত এখন নিখোঁজ।
মুসতাদরাকের একাধিক জায়গায় এই মুকাদ্দিমার হাওয়ালা রয়েছে। ইমাম নববী রাহ.-এর শরহে সহীহ মুসলিমের মুকাদ্দিমার এক জায়গায় ‘আলমাদখাল ইলা মারিফাতিল মুসতাদরাক’-এর হাওয়ালা এসেছে। খুব সম্ভব এটিই মুসতাদরাকের ঐ মুকাদ্দিমা, যা এখন আমাদের কাছে নেই।
স্বয়ং ইমাম নববী রাহ.-এর ‘মুকাদ্দিমা শরহে মুসলিম’ও কোনো কোনো এডিশনে নেই। দাওরায়ে হাদীসের বছর মাদরাসা থেকে আমি এমন নুসখাই পেয়েছিলাম। শরহে নববীতে বিভিন্ন জায়গায় الفصول المتقدمة -এর হাওয়ালা এসেছে। আমি বলি, কোথায় সেই ফুসূল? তখন বড় ভাইজান করাচীতেই ছিলেন। তাকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, ‘অন্য এডিশনে তালাশ কর, শুরুতে ইমাম নববী রাহ.-এর বিস্তারিত একটি মুকাদ্দিমা আছে।’ এখন তো সকল তালিবে ইলমের নুসখায়-ই হয়ত এই মুকাদ্দিমা আছে। কিন্তু গুরুত্ব সহকারে এটি মুতালাআ করে- এমন তালিবে ইলমের সংখ্যা হয়ত অনেক কম হবে।
ইমাম বাইহাকী রাহ.-এর ‘আসসুনানুল কুবরা’-এর মুকাদ্দিমা (المدخل إلى معرفة السنن الكبرى) প্রথমে অসম্পূর্ণ ছেপেছিল। এখন শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা হাফিযাহুল্লাহু ওয়ারা‘আহু-এর তত্ত্বাবধানে মাশাআল্লাহ, এর পরিপূর্ণ নুসখা দুই খ-ে ছেপে এসেছে।
তো এটি একটি লম্বা সিলসিলা। এখন মাকসাদ শুধু তালিবে ইলমদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া। দরসী কিতাবের মুকাদ্দিমা, দরসী কিতাবের শারেহ ও মুহাশশীদের মুকাদ্দিমা গুরুত্ব সহকারে পড়া উচিত।
সুচিন্তিত নেযামুল আওকাত অনুযায়ী কাজ করলে সময়ে বরকত হয়। যেসব لا يعني-তে আমরা লিপ্ত বা নিজের এহাতার বাইরে যেসব তাকাল্লুফে লিপ্ত থাকি ওইসব থেকে পরহেজ করলেও সময়ের অনেক বরকত পাওয়া যায়। যেমনটি পূর্বে বলা হয়েছে, কোনো কোনো কিতাবের মুসান্নিফ প্রকৃতপক্ষে তার কিতাবে মুকাদ্দিমা লিখেছিলেন, কিন্তু এখন মাতবূ নুসখায় ঐ মুকাদ্দিমার অস্তিত্ব নেই। তো এরকম মুকাদ্দিমা যদি কোথাও পাওয়া যায় তবে তার কদর করা উচিত।
আমি হিদায়ার মতন ‘বিদায়াতুল মুবতাদী’-এর মুকাদ্দিমার তালাশে ছিলাম। আলহামদু লিল্লাহ, তা বিদায়ার ঐ নুসখায় পেয়েছি, যা ড. সায়েদ বাকদাশের তত্ত্বাবধানে ছেপেছে।
দরসী কিতাবসমূহের মধ্যে ‘কানযুদ দাকায়েক’-এর সংক্ষিপ্ত মুকাদ্দিমা তো আলহামদু লিল্লাহ মাতবূ নুসখায়ও আছে। কিন্তু ‘আলবিক্বায়া’র মুকাদ্দিমা আমাদের দরসী নুসখাসমূহে নজরে পড়েনি। কিছুদিন আগে আমাদের শাগরিদ মাওলানা সাঈদ আহমাদ বিন সিরাজুল ইসলামের কাছে ‘উমদাতুর রিআয়া আলা শারহিল বিকায়া’র একটি নুসখা পাওয়া গেল, যা ১৪৩৭ হি. সনে ‘আলমাজমাউল ফিকহী লিল আল্লামা আবদিল হাই আলফিরিঙ্গী মাহাল্লী’ কর্তৃক ছেপেছে। এতে ‘আলবিকায়া’র যে মতন উল্লেখ করা হয়েছে তার শুরুতে মুসান্নিফের মুকাদ্দিমা আছে। মুনাসিব মনে হল যে, মুকাদ্দিমার ইবারত এখানে নকল করে দেই। যেন তলাবায়ে কেরাম নিজেদের ডায়েরিতে এটি নোট করে রাখে। পরে হয়ত কখনো এর জরুরত পড়বে, তখন এটি কাজে আসবে।
‘আলবিকায়া’র খুতবা-
بسم الله الرحمن الرحيم
حَمْدُ مَنْ جَعَل العلم أجلّ المواهب الهَنِيّةِ وأسناها، وأعلى المراتب السّنِيّةِ وأسماها: أحسنُ ما يُفْتَتَحُ به الكلامُ.
وشُكْرُ مَنْ خَصّ علم الأحكام والشرائع بأنه أقوى الوسائل إليه والذرائع: أيمَنُ ما يُسْتَنْتَجُ به المرام.
فنحمده حمدًا لا انصرام لعدده، ولا انفصام لمدده، على ما أنعم وأولى، مِنْ نعمه الظاهرة والباطنة، وأكرم وأبلى مِنْ قِسَمِه البادية والكامنة.
وأبصرنا الصراط المستقيم ومنهجَ الرشاد، ويسرنا الايتساء بكرام الأسلاف والأجداد، في نشر الأحكام وتبليغ الشرائع، والله ولي الإرشاد.
ونصلي على رسوله محمد الهادي للخلق إلى سواء السبيل، الموازي علماء أمته لأنبياء بني إسرائيل১ ، وعلى كرام صحابته المستظلين بظلال سحابته، صلاة تترادف أمدادها وتتضاعف أعدادها.
وبعد، فإن الولدَ الأعَزّ عبيد الله ـ صرف الله أيامه بما يحب ويرضاه ـ لما فرغ من حفظ الكتب الأدبية، وتحقيق لطائف الفضل، ونكت العربية، أحببت أن يحفظ في علم الأحكام كتابًا رائعًا، ولعيون مسائل الفقه راعيًا، مقبول الترتيب والنظام، مستحسنًا عند الخواص والعوام، وما ألفيت في المختصرات ما هذا شأنه.
فألفتُ في رواية كتاب >الهداية<، وهو كتاب فاخر، وبحر مواج زاخر، كتاب جليل القدر، عظيم الشأن، زاهر الخطر، باهر البرهان، قد تمت حسناته، وعمت بركاته، وبهرت آياته: مختصرًا جامعًا لجميع مسائله، خاليًا عن دلائله، حاويًا لما هو أصحُّ الأقاويل والاختيارات، وزوائدَ فوائدِ الفتاوى والواقعات، وما يحتاج إليه من نظم الخلافيات، موجِزًا ألفاظَه نهايةَ الإيجاز، ظاهرًا في ضبط معانيه مخايلُ السِّحر ودلائلُ الإعجاز.
موسومًا بـ>وقاية الرواية في مسائل الهداية<.
والله المسؤول أن ينفع حافظيه والراغبين فيه عامة، والولدَ الأعزّ عبيد الله خاصة<.
গভীরভাবে পড়লে এই মুকাদ্দিমায় হাসিল করার মতো অনেক বিষয় আছে। এমনকি ‘রাসমুল মুফতী’র তালিবে ইলমদের জন্যও এখানে তাদের ফনের সাথে সম্পৃক্ত ইলম রয়েছে। আল্লাহ তাআলা কদর করার তাওফীক দান করুন- আমীন।
هذا، وصلى الله تعالى وبارك وسلم على سيدنا ومولانا محمد خاتم النبيين لا نبي بعده، وعلى آله وصحبه أجمعين، والحمد لله رب العالمين.
২/১/১৪৪১ হি.
সোমবার