নবীজীর দস্তরখানে
৪২. খাদ্য-সচেতন হওয়া : খাবারের প্রকারের মধ্যে সমন্বয় বজায় রাখা
আজ সাফওয়ানের বড় মামা বেড়াতে এসেছেন। সাফওয়ানের জন্য খেলনা নিয়ে এসেছেন। সাথে এনেছেন হরেকরকম ফল- আঙুর, কমলা, আপেল, আনারস আরো কত কী! সফওয়ানের খুশি যেন আর ধরে না। একবার এই ফল খায় আরেকবার ওই ফল। এটা থেকে একটু খায় আবার ওটা থেকে একটু।
আম্মু মামাকে আনারস খেতে দিয়েছেন। এখন সাফওয়ানও আনারস খেতে চায়। আম্মু বললেন, বাবা! কেবল তুমি দুধ খেয়েছ। এখন আনারস খেয়ো না; পেটব্যথা করবে। পরে খেয়ো।
নাহ, সে এখনি আনারস খাবে। মায়ের মানা সে শুনল না। অগোচরে আনারস খেয়ে নিল। দুপুর গড়িয়ে যখন বিকেল এল। সাফওয়ানের পেটব্যথা শুরু হল। সে যে কী ব্যথা! সাফওয়ানকে ডাক্তারের কাছে নেওয়া হল। কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না পেটব্যথার। সাফওয়ানও কিছু বলছে না; যদিও তার মনে পড়ছে আম্মুর কথা- ‘বাবা! কেবল তুমি দুধ খেয়েছ। এখন আনারস খেয়ো না; পেটব্যথা করবে।’
পরে আম্মুর মনে পড়ল- ও না দুধ খাওয়ার পর আনারস খেতে চেয়েছিল! ঠিক সে লুকিয়ে লুকিয়ে আনারস খেয়ে নিয়েছে। তাকে জিজ্ঞেস করে এমনটিই জানা গেল।
ডাক্তার ঔষধ দিলেন। আম্মু নামায পড়ে আল্লাহর কাছে দুআ করলেন। সাফওয়ান সুস্থ হল, বাসায় এল। সে এবার প্রতিজ্ঞা করল- সবসময় আব্বু-আম্মুর কথা শুনবে; তার বুঝে আসুক বা না আসুক। এখন আর সাফওয়ান ইচ্ছেমত যা তা খায় না; আগে আম্মুকে জিজ্ঞেস করে তারপর খায়।
যাইহোক, খাবারের ব্যাপারে এই সচেতনতাও আমরা নবীজীর দস্তরখান থেকে শিখেছি। নবীজী খাবারের বিভিন্ন প্রকারের মধ্যে সমন্বয় বজায় রাখতেন। কোন্টার সাথে কোন্টা খেতে হবে বা কোন্টার সাথে কোন্টা খাওয়া যাবে না- এ ব্যাপারে সচেতন থাকতেন। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন-
كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: يَأْكُلُ الْبِطِّيخَ بِالرّطَبِ فَيَقُولُ: نَكْسِرُ حَرّ هَذَا بِبَرْدِ هَذَا، وَبَرْدَ هَذَا بِحَرِّ هَذَا.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তরমুজের সাথে রুতাব (আধা কাঁচা-আধা পাকা খেজুর) খেতেন এবং বলতেন, এটার গরম দূর করছি ওটার ঠাণ্ডা দ্বারা আর এটার ঠা-া দূর করছি ওটার গরম দ্বারা। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৩৬; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৮৪৩
সুতরাং আমরাও খাদ্য-সচেতন হব; এ বিষয়ে জানব ও মেনে চলব।
৪৩. সমবেতভাবে খেলে বরকত হয়
আমরা ইতিপূর্বে জেনেছি- বিসমিল্লাহ বলে শুরু করলে খাবারে বরকত হয়, পাত্রের মাঝখান থেকে না খেয়ে একপাশ থেকে খেলে বরকত হয়, খাবার প্রচ- গরম অবস্থায় না খেয়ে স্বাভাবিক ঠাণ্ডা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলে খাবারে বরকত হয়। আজ আমরা খাবারে বরকত হওয়ার আরেকটি বিষয় জানব ইনশাআল্লাহ।
একদিন কিছু সাহাবী নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, আল্লাহর রাসূল! আমরা খাবার খাই কিন্তু পরিতৃপ্ত হই না। একথা শুনে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন-
لَعَلّكُمْ تَأْكُلُونَ مُتَفَرِّقِينَ؟
সম্ভবত তোমরা আলাদা আলাদা খাও?
তারা উত্তরে বললেন, জী। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
اجْتَمِعُوا عَلَى طَعَامِكُمْ، وَاذْكُرُوا اسْمَ اللهِ عَلَيْهِ، يُبَارَكْ لَكُمْ فِيهِ.
তোমরা সমবেতভাবে খাও এবং বিসমিল্লাহ বল, তাহলে খাবারে বরকত হবে। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩২৮৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৭৬৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬০৭৮
বরকত লাভের জন্য এই হাদীসে দুইটি বিষয় বলা হয়েছে, এক. সমবেতভাবে খাওয়া, দুই. বিসমিল্লাহ বলা। সিন্দী রাহ. এই হাদীসের টীকায় লিখেছেন-
فَبِالِاجْتِمَاعِ تَنْزِل الْبَرَكَاتُ فِي الْأَقْوَاتِ وَبِذِكْرِ اسْمِ اللهِ تَعَالَى يَمْتَنِعُ الشّيْطَانُ عَنِ الْوُصُولِ إِلَى الطّعَامِ.
সমবেতভাবে খাওয়ার কারণে খাবারে বরকত হয় আর বিসমিল্লাহ বলার দ্বারা শয়তান খাবার পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না (এবং খাবারের বরকত নষ্ট করতে পারে না)। (হাশিয়াতুস সিন্দী আলা সুনানে ইবনে মাজাহ, আলোচ্য হাদীসের টীকা দ্রষ্টব্য)
সমবেতভাবে খেলে খাওয়ার মধ্যে আলাদা একটা তৃপ্তি ও আনন্দ লাভ হয়। তেমনিভাবে বরকতও হয়।
এ তো আমাদের দৈনন্দিন দেখা বাস্তবতা, পরিবারের সকলে একসাথে খেতে বসলে দস্তরখানে যেমনিভাবে আনন্দ বিরাজ করে তেমনি বরকতও হয়। সকলে তৃপ্তিভরে খেতে পারে; পক্ষান্তরে যার যার মত এক এক সময়ে খেলে দেখা যায়, যে পরে খেতে আসে সে হয়ত খাবার পায় না বা তৃপ্তিভরে খেতে পারে না। আবার সমবেতভাবে খাওয়ার কারণে দশ জনের খাবার বার-চৌদ্দ জনও খেতে পারে।
মোটকথা, সমবেতভাবে খেলে বরকত হয়। এখন এ সমবেতভাবে খাওয়ার দুটি অর্থ হতে পারে-
এক. সকলে একসাথে একটি বড় পাত্রে খাওয়া।
দুই. সমবেতভাবে এক দস্তরখান বা এক মজলিসে আলাদা আলাদ পাত্রে খাওয়া।
এ হাদীসের শব্দ-অর্থের ব্যাপকতা থেকে আশা করা যায় এ দুই পদ্ধতির যে পদ্ধতিই অবলম্বন করা হোক ইনশাআল্লাহ উক্ত বরকত লাভ হবে।