মুহাররম ১৪৪১   ||   সেপ্টেম্বর ২০১৯

সারামণির সারাবেলা

বিনতে কাসিম

ঘরের কোণে ছোট্ট বাগানটিতে প্রজাপতিরা ওড়াউড়ি করছে। লালগোলাপের কলিগুলো পূর্ণ পাপড়ি মেলে হাসছে আর দুলছে। উঠানের মাঝে সাদাকালো ডোরাকাটা ছাগলছানা দুটি ছোটাছুটি করছে। পুকুরপাড় জুড়ে লেজ তুলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হরিণের মতো ফুটফুটে এঁড়ে বাছুরটি। বাঁশঝাড়ের ফাঁকে নীলরঙা মাছরাঙাটি শিকারের জন্য ওঁত পেতে আছে। আমবাগানের শাখায় শাখায় ঝুটিপরা কবুতরগুলো বাকবাকুম ডাকছে। সাথে শালিক চড়–ইদের কিচির মিচিরও নেই থেমে। মুরগিগুলো বাচ্চাদের নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে আধারের খোঁজে। বারান্দায় ঝোলানো খাঁচায় আদরের পোষা কালো ময়নাটি পাকা পেঁপের হলুদ টুকরোগুলোতে ঠোকর বসাচ্ছে আর মিষ্টি সুরে ডেকে চলেছে সাঁরামণি সাঁরামণি।

তবুও সারামণির ভালো লাগছে না। সোনালী মালা পরা পাখিটি থেকে থেকে আওড়ে যাচ্ছে সারামণির শেখানো বুলি-  ও আমার ময়না! কেন কথা কয় না!! ময়নার কণ্ঠে এ ডাক শুনলে সারামণি যেন খুুশিতে উড়তে চাইত। কিন্তু আজ তার কিছুই ভালো লাগছে না। বারান্দার একপাশে গালে হাত দিয়ে মোড়া পেতে আনমনে বসে আছে সারামণি।

চুলগুলো উশকোখুশকো। পড়ার টেবিলটা অগোছালো। আলনায় কাপড়গুলো এলোমেলো। আর শোকেসে খেলনাগুলো ওলটপালট পড়ে আছে। সারামণির তাতে কোনো খেয়াল নেই।

ঝুড়িভর্তি ফল- আম-আতা-আনারস। বয়ামভর্তি নিমকি-বিস্কুট। সবগুলো তার প্রিয় খাবার। কিন্তু তাতে তার কোনো মন নেই।

বিশেষ করে মেহেদীরাঙা হাতের দিকে তাকালে সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। ডুকরে ওঠে বুবুজানের জন্য। মা-ও যে সান্ত¡না দিবেন তা-ও না। মুখে কিছু বলতে পারেন না। আঁচল দিয়ে শুধু চোখ মুছেন।

এক সপ্তাহ হল বুবুজান চলে গেছেন শ্বশুরবাড়ি। বুবুজানের বিয়ে হবে বলে সারামণির আনন্দের অন্ত ছিল না। তাই বলে বুবুজান এভাবে তাকে একলা ফেলে চলে যাবেন- এটা সে কল্পনাও করতে পারেনি। মেহমান আসবে বলে সে বুবুজানের কাছে আবদার করেছিল সাজিয়ে দিতে। বুবুজান তার হাতে  মেহেদীর ফুল এঁকে দিয়েছিলেন আর কেঁদেছিলেন। এখন সে বুঝতে পারছে সে কান্নার রহস্য।

কলিংবেল বাজছে। সারামণির কানে আওয়াজ পৌঁছছে। কিন্তু সে শুনছে না। ময়নাটি বলে উঠল- সাঁরামণি, সাঁরামণি, আপুমণি, আপুমণি, আস সালামু আলাইকুম। আপুমণি, সালাম- শুনে সে চেতন ফিরে পেল। গেল দরজার দিকে। দরজা খুলে দেখে বুবুজান দাঁড়িয়ে। একঝাপ্টায় গলা জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল সে। বুবুজান নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত করলেন তাকে। সারামণি যেন এতক্ষণে তার প্রাণ ফিরে পেয়েছে।

নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দেওয়া সারামণি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠল। গোছানো শুরু করল সে টেবিলের বই খাতা। আলনার কাপড় চোপড় এবং শোকেসের খেলনাপাতি। বুবুজান তার জন্য কেটে নিয়ে আসলেন ইয়া বড় ফজলি আম।

-বোনটি আমার না খেতে খেতে চেহারাটা ভেঙে পড়েছে। বললেন বুবুজান।

: বুবু তুমি কোথায় ছিলে এতদিন? তুমি নেই বলে আমার কিছুই ভালো লাগছিল না। কেউ আমাকে এখন গল্প শোনায় না। ফুল-বেণি বেঁধে দেয় না। পিঠা বানিয়ে খাওয়ায় না।

-আচ্ছা, এখন থেকে সব হবে। তুমি মন খারাপ করো না। তোমার মন ভার দেখলে যে আমারও কষ্ট লাগে! বলে বুবু তেল চিরুনি আর লালফিতা নিয়ে আসলেন।

সারামণি মুহূর্তে আগের মতো হয়ে উঠল। খৈ ফুটতে আরম্ভ করল তার মুখে।

: বুবু তুমি আমাকে কত গল্প শোনাতে মনে আছে?

- হাঁ, তা কি আর ভোলা যায়!

: তোমার গল্পগুলো শুনতে খুব মজা লাগে। আচ্ছা, তুমি যে আমাকে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের একটা ঘটনা শুনিয়েছিলে, তা আবার শোনাও না!

-কোন্ সে ঘটনা?

: ঐ যে হযরত ইবরাহীম আ.-এর মূর্তিভাঙ্গার ঘটনা। -তুমি তো এ ঘটনা অনেকবার শনেছ! আজ তুমি একটু আমাকে শোনাও দেখি!

: আল্লাহর নবী হযরত ইবরাহীম আ.-কে আল্লাহ যখন নবুওত দিলেন তিনি তাঁর পিতা ও অন্যান্য মুশরিকদের বোঝালেন- দেখ, তোমরা যে মূর্তিপূজা কর এটা অনেক খারাপ কথা। এগুলো গোমরাহী। ওরা বলে যে, না, তোমার কথা শোনা যাবে না। আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের এমনটাই করে আসতে দেখেছি।

তারপর তারা একদিন পর্ব-উৎসবে গেল। হযরত ইবরাহীম আ. তাদের সাথে না গিয়ে মূর্তিগুলো ভেঙে চুরমার করে দিলেন। আর বুড়ো মূর্তিটাকে আস্ত রেখে দিলেন।

তারা ফিরে এসে তাদের মিথ্যা মাবুদের এরকম দুর্গতি দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়ল। তারা হযরত ইবরাহীম আ.-কে জিজ্ঞাসা করল। বল, কে এই কা- ঘটাল? তখন তিনি বললেন- আমাকে কেন? তোমাদের বড় খোদাকে জিজ্ঞাসা কর- তাদের এমন দুরবস্থা কী জন্য?

তারপর...? ও, তারপর তারা হযরত ইবরাহীম আ.-কে দাউ দাউ আগুনে ফেলে দিল। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাঁর এই বন্ধুর জন্য উত্তপ্ত আগুনকে আরামদায়ক ঠা-া করে দিলেন।

-মাশাআল্লাহ, তোমার তো দেখি পুরোপুরিই মনে আছে।

: আচ্ছা বুবু! কাফেররা এত বোকা হয় কেন? তারপর আবার কত বড় জালিম দেখেছ?

-হাঁ, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মানে না, তারাই বোকা এবং নির্বোধ।

এই হযরত ইবরাহীম আ.-এর একজন স্ত্রী ছিলেন। নাম কী জানো?

: না তো!

-তাঁর নাম হচ্ছে- সারা। হযরত সারা আলাইহাস সালাম।

: আমার নামে নাম!

-হাঁ, তাঁর নামেই তোমার নাম সারা। যাতে তুমি তাঁদের মতো জীবন গড়তে পার।

: আচ্ছা বুবু, তাহলে কার নামে তোমার নাম?

-সেটা আরেক দিন বলব- ইনশাআল্লাহ।

: তাহলে আজকে হযরত সারা আ.-এর একটা গল্প শোনাও না!

-হযরত সারা আ.-কে আল্লাহ তাআলা অনেক ভালোবাসতেন। পড়ন্ত বয়সে একবার তিনি ও তার স্বামী হযরত ইবরাহীম আ. ঘরে অবস্থান করছিলেন। হযরত ইবরাহীম আ.-এরও বয়স অনেক এবং হযরত সারা আ.-এরও তাই। এরমধ্যে সুঠামদেহী কয়েকজন যুবক তাদের ঘরে এসে হাজির। হযরত ইবরাহীম আ. ছিলেন এমনিতেই অতিথি পরায়ণ। এরকম অভিজাত মেহমান পেয়ে তো খুব খুশি! তাড়াতাড়ি মেহমানদের জন্য আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলেন। নাদুসনুদুস একটি বাছুর ভুনা করে উপস্থিত করলেন তাদের সামনে।

: ওয়াউ, একটা আস্ত বাছুর!

-হাঁ। কিন্তু কী হল শোন। হযরত ইবরাহীম আ. এত আন্তরিকতার সাথে এত ব্যবস্থা করলেন, কিন্তু তারা খাবারের দিকে হাত বাড়াচ্ছে না। কোনো কিছু খাচ্ছে না।

 বলতে পার কী জন্যে?

: আ...। আমি তো তাই চিন্তা করছি- খাবে না কী জন্যে? নিশ্চয় রহস্য আছে। এ... মনে হয় রোযা রেখেছে।

-না, রোযা নয়। দেখতে মানুষের মতো হলেও তারা ছিলেন আল্লাহ তাআলার ফেরেশতা। ফেরেশতারা তো মানুষের মতো খাওয়া-দাওয়া করেন না। তারা এসেছিলেন হযরত ইবরাহীম আ. ও হযরত সারা আ.-এর জন্য আল্লাহ তাআলার তরফ থেকে সুসংবাদ নিয়ে।

: কী সুসংবাদ?

-হাঁ, তা-ই বলছি। তারা বললেন, আপনারা সুসংবাদ গ্রহণ করুন ইসহাকের এবং ইসহাকের পর ইয়াকুবের।

: মানে?

-মানে তারা বললেন, আপনাদের একটি ফুটফুটে সন্তান হবে। আল্লাহর পক্ষ থেকে তোহফা। তার নাম হবে ইসহাক। সে হবে অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং নেককার। আল্লাহ তাআলা তাকে হেদায়েত ও নবুওত দান করবেন। আর হযরত ইসহাক আ.-এর পুত্র হবে হযরত ইয়াকুব আ.। তিনিও নবী হবেন।

: ও আচ্ছা। তারপর?

-শোনো তারপর কী হয়েছে। এই বুড়ো বয়সে তারা সন্তানের খবর শুনে তো হতবাক। হযরত সারা আ. তো মুখে হাত দিয়ে বলেই ফেললেন- এই বয়সে...! ফেরেশতাগণ বললেন, আপনি দুনিয়াবী বিবেচনায় আশ্চর্য বোধ করছেন। তাই বলে কি আল্লাহ তাআলার রহমত ও কুদরতের বিবেচনায় এটাকে অসম্ভব কিছু ভাবছেন! আল্লাহ তাআলা এই বয়সেই নিআমত দান করবেন। আল্লাহ তাআলা মহা প্রজ্ঞাবান।

আল্লাহ তাআলা হযরত সারা আ.-এর ঘর উজালা করে দান করলেন পুত্র হযরত ইসহাক আ.-কে। হযরত ইসহাক আ.-এর পুত্র ছিলেন নবী হযরত ইয়াকুব আ.। আর তোমাকে যে হযরত ইউসুফ আ.-এর কাহিনী শুনিয়েছি, তিনি ছিলেন হযরত ইয়াকুব আ.-এরই পুত্র। আল্লাহ তাআলা এ বংশে আরো অনেক নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন! আসলে আল্লাহ পাক কাউকে কবুল করলে এমনই হয়।

: আচ্ছা বুবু, তুমি এত সুন্দর সুন্দর গল্প জানো কোত্থেকে?

-কেন! কুরআনে কারীমেই তো আল্লাহ তাআলা এসব ঘটনা বলে দিয়েছেন। সূরা হূদ, সূরা হিজ্র ও সূরা যারিয়াতে এ ঘটনাটির বিবরণ রয়েছে।

: কই! আমিও তো কুরআন শরীফ পড়ি। সেদিন তিনবেলা করে তিন দিনে বাবাকে পুরো ত্রিশপারা শুনালাম। এগার পারার শেষ ও বার পারার শুরুতে সূরা হূদ। চৌদ্দ পারায় সূরা হিজ্র আর ছাব্বিশ পারার শেষ ও সাতাশ পারার শুরুতে সূরা যারিয়াত। তুমি বললে এখুনি সূরা তিনটি শোনাতে পারব- ইনশাআল্লাহ। কিন্তু ঘটনা তো দেখলাম না।

-বারাকাল্লাহ। বোনটি আমার! তুমি তো সবে কুরআন মাজীদ হিফয করেছ। যখন অর্থ শিখবে তখন সব বুঝবে। তখন দেখবে শুধু মজা আর মজা!

: বুবু আমার! তাহলে আমাকে কুরআন মাজীদের অর্থ শিখিয়ে দাও না!

এতক্ষণে সারামণির চুলে বেণি গাঁথা শেষ। লালফিতা দিয়ে বুবুজান সুন্দর করে ফুল বানিয়ে দিয়েছেন। বললেন- এখন তো বেলা ডুবে যাচ্ছে। একটু খেলা করে আসো। মাগরিবের পর আমরা ‘এসো আরবী শিখি’ পড়ব- ইনশাআল্লাহ।

সারামণি মাথা কাত করে বলল- ঠিক আছে।

বেণি দুলিয়ে নাচতে নাচতে চলে গেল সে বারান্দায়। তার ময়নার সাথে কথা বলতে।

 

 

advertisement