ভ্রাতৃত্বের চর্চায় আলোকিত হোক আমাদের সমাজ
একজন আল্লাহ-বিশ্বাসী মুমিনের নিকট ঈমানের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় থাকতে পারে না। ঈমান তার কাছে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি প্রিয়। মুমিন এমনই হয়। যে ঈমান তার কাছে এতটা প্রিয়, এতটা মর্যাদার, সেই ঈমান যখন তার মতোই আরেকজন মানুষ ধারণ করে তখন তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি অনিবার্য। এটা ঈমানের ভ্রাতৃত্ব। দেশ-কাল-ভাষা-বর্ণের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে এ ভ্রাতৃত্ব ছড়িয়ে পড়ে দূর-বহুদূর। কোনো পূর্বপরিচয় নেই, একজন আরেকজনের ভাষাও বোঝে না- এমন দুইজন মুমিনও যখন ঈমানের দাবিতে একত্রিত হয়, তখন মুহূর্তেই যেন তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে হৃদ্যতা। ভাষার সীমাবদ্ধতা, দেশের ভিন্নতা এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। পবিত্র কুরআনের ঘোষণা-
اِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ اِخْوَةٌ
মুমিনরা পরস্পর ভাই-ভাই। -সূরা হুজুরাত (৪৯) : ১০
স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যে ভ্রাতৃত্বের ঘোষণা করে দিয়েছেন, সেই ভ্রাতৃত্বকে ছোট করে দেখার অবকাশ কোথায়! পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব তো আরও কত কারণেই সৃষ্টি হতে পারে। একই দেশের নাগরিক, একই এলাকার বাসিন্দা, একই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র, একই কর্মক্ষেত্রে কর্মরত ইত্যাদি কত কারণেই তা গড়ে ওঠে! তবে যত কিছুই হোক, কুরআনের ঘোষণার সঙ্গে আর কোনো কিছুর তুলনা চলে! ঈমানী এই বন্ধন যে কেবল দুইজন ঈমানদার ব্যক্তির ঈমানের বিন্দুতে একত্রিত হওয়ার ফলে গড়ে ওঠে- বিষয়টি এখানেই শেষ নয়। কুরআন ও হাদীসের নানা জায়গায় নানা আঙ্গিকে বর্ণিত হয়েছে এ বন্ধনের গুরুত্বের কথা। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
لاَ تَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتّى تُؤْمِنُوا وَلاَ تُؤْمِنُوا حَتّى تَحَابُّوا. أَوَلاَ أَدُلُّكُمْ عَلَى شَىْءٍ إِذَا فَعَلْتُمُوهُ تَحَابَبْتُمْ أَفْشُوا السَّلاَمَ بَيْنَكُمْ.
তোমরা যতক্ষণ ঈমান না আনবে ততক্ষণ বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর যতক্ষণ তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা সৃষ্টি না হবে, ততক্ষণ তোমরা মুমিনও হতে পারবে না। আমি কি তোমাদেরকে একটি কাজের কথা বলে দেব, যা করলে তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা সৃষ্টি হবে? তোমাদের মধ্যে সালামের ব্যাপক প্রচলন ঘটাও। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৪
কথা তো খুবই সহজ- নিজে ঈমানদার হতে হলে অন্য মুমিনদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করতে হবে। এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা গড়ে তোলার একটি পন্থাও নির্দেশ করেছেন- সালামের ব্যাপক প্রসার ঘটাও। আর বাস্তবতা এমনই- পারস্পরিক সালামের বিনিময় যখন হয়, তখন মন থেকে হিংসা-বিদ্বেষ কর্পুরের মতোই উড়ে যায়। সালামকে বলা যায় মুমিনের মন জয় করার এক অব্যর্থ হাতিয়ার।
প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিজরতের পর মদীনা মুনাওয়ারার আনসারগণ হিজরতকারী মুসলমানদের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের যে নমুনা প্রদর্শন করেছেন, তা সত্যিই বিরল। ঘরবাড়ি ফেলে, আত্মীয়স্বজন ছেড়ে শুধুই নিজেদের ঈমান রক্ষার তাগিদে দূর মদীনায় যারা হিজরত করেছিলেন, তাদের একেকজনকে মদীনার একেকজন মুসলমানের ভাই বানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। প্রিয় নবীজীর হাতে গড়ে ওঠা ভ্রাতৃত্বের এ বন্ধনকে তারা এতটাই মাথা পেতে নিয়েছেন যে, তারা তাদের এ ভাইদেরকে নিজেদের ঘরে আশ্রয় দিয়েছেন, নিজেদের সম্পদে অংশীদার বানিয়ে নিয়েছেন, এমনকি কেউ কেউ তো নিজের একাধিক স্ত্রীর মধ্যে কাউকে তালাক দিয়ে নতুন এই ভাইয়ের বিয়ের ব্যবস্থা পর্যন্ত করতে চেয়েছেন। পবিত্র কুরআনে মদীনার আনসারদের এ ত্যাগ ও সহযোগিতার বিবরণ এসেছে এভাবে-
وَ الَّذِیْنَ تَبَوَّؤُ الدَّارَ وَ الْاِیْمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ یُحِبُّوْنَ مَنْ هَاجَرَ اِلَیْهِمْ وَ لَا یَجِدُوْنَ فِیْ صُدُوْرِهِمْ حَاجَةً مِّمَّاۤ اُوْتُوْا وَ یُؤْثِرُوْنَ عَلٰۤی اَنْفُسِهِمْ وَ لَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ ۫ وَ مَنْ یُّوْقَ شُحَّ نَفْسِهٖ فَاُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ.
...আর যারা মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে এই নগরীতে বসবাস করেছে এবং ঈমান এনেছে, তারা মুহাজিরদেরকে ভালবাসে এবং মুহাজিরদেরকে যা দেওয়া হয়েছে তার জন্যে তারা অন্তরে আকাক্সক্ষা পোষণ করে না, আর তারা তাদেরকে নিজেদের ওপর অগ্রাধিকার দেয়, নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও। যাদেরকে অন্তরের কার্পণ্য থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে তারাই সফলকাম। -সূরা হাশর (৫৯) : ৯
কারও যখন সচ্ছলতা থাকে, তখন সে সহজেই অন্যকে সহযোগিতা করতে পারে। এতে তার কোনো কষ্ট পোহাতে হয় না। কিন্তু অসচ্ছলতাকে কাঁধে করে, নিজেরা অভাবগ্রস্ত হয়ে নিজেদের প্রয়োজনের তুলনায় অন্য কারও প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া মোটেও সহজ নয়। মদীনার আনসারগণ এই কঠিন কাজটিই করে ভ্রাতৃত্বের প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন।
মুমিনদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তুলনা করেছেন একটি দেহের সঙ্গে। এক অঙ্গের অসুস্থতায় পুরো দেহই যেমন কাতর হয়ে পড়ে, ঠিক পৃথিবীর এক অঞ্চলের একজন মুসলমানের ব্যথাও অনুভব করতে হবে অন্য সব অঞ্চলের মুসলমানদের। তখনই এই ভ্রাতৃত্বের মর্যাদা রক্ষা হবে। হাদীস শরীফের ভাষ্য-
تَرَى الْمُؤْمِنِينَ فِي تَرَاحُمِهِمْ وَتَوَادِّهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ كَمَثَلِ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى عُضْوًا تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ جَسَدِهِ بِالسَّهَرِ وَالْحُمّى.
তুমি মুমিনদের দেখবে- তারা পারস্পরিক দয়া-ভালোবাসা আর মায়া-স্নেহের বিষয়ে একটি দেহের মতো। দেহের এক অঙ্গ যখন আক্রান্ত হয়, তখন পুরো শরীরই অনিদ্রা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০১১
এই হল ভ্রাতৃত্বের নমুনা। আরেক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
الْمُؤْمِنُ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضًا.
মুমিনগণ যেন একটি প্রাচীর, যার একটি ইট আরেকটিকে শক্তি যোগায়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৪৪৬
একটি দেয়ালের সবগুলো ইট মিলেই তা গড়ে ওঠে। প্রতিটি ইটই ভিন্ন ভিন্ন, কিন্তু দেয়ালের অস্তিত্বের জন্যে ইটগুলোর সম্মিলন অপরিহার্য। একটি ইটের উপর স্থাপিত হয় আরেকটি ইট, সেটার উপর আরও একটি। ইট গাঁথা হয় পাশাপাশিও। এভাবেই গড়ে ওঠে একেকটি দেয়াল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র একেকটি ইট দিয়ে তৈরি হয় বড় বড় প্রাসাদ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ইটের সঙ্গেই মুমিনদের তুলনা করেছেন। ইট যেমন একে অন্যকে সহযোগিতা করে, মুমিনরাও একে অন্যের পাশে দাঁড়ায়- সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায়। এই সহযোগিতার ওপর ভর করেই গড়ে ওঠে ঈমানী ভ্রাতৃত্ব, মুমিনদের সমাজ। ভ্রাতৃত্বের এই শিক্ষা ছড়িয়ে আছে মুমিনের পদে পদে। পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করতে প্রতিদিনই সে উপস্থিত হয় মসজিদে। ধনী-গরীব আপন-পরের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে দৈনিক এভাবে পাঁচবার একই কাতারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে যায় তারা। জীবনের অন্য সকল ক্ষেত্রে ভ্রাতৃত্বকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে এই একটি আমলের শিক্ষাই তো যথেষ্ঠ হওয়ার কথা। একই শিক্ষা পাওয়া যায় ঈদের উৎসবে এবং হজে¦র ময়দানে। লক্ষ লক্ষ মুসলমান গায়ে দুটি সাদা চাদর জড়িয়ে এক প্রভুর আহ্বানে হাজির। সবার লক্ষ্য এক, মুখেও সবার একই উচ্চারণ- লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক...। ঈদুল আযহায় আবার ভ্রাতৃত্ব রক্ষার ধরনটা ভিন্ন। যাদের সামর্থ্য আছে তারাই তো ঈদে পশু কুরবানী করে। নিজের টাকায় কেনা পশু নিজ হাতে কুরবানী করার পর এর কিছু অংশ নিজের ঘরে রেখে দেয়, কিছু বিলিয়ে দেয় আত্মীয়স্বজন আর পড়শীদের মাঝে, আর কিছু দেয় গরীব ও অসচ্ছলদেরকে, যাদের কুরবানী করার সামর্থ্য ছিল না। ফলে সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও ঈদ ও কুরবানীর আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয় না তারা। এভাবেই পূর্ণ হয় ঈমানী ভ্রাতৃত্বের দাবি।
ঈমানী এই ভ্রাতৃত্ব কীভাবে রক্ষা করতে হবে, মুমিনের পাশে মুমিনকে কীভাবে দাঁড়াতে হবে- এর কিছু নমুনাও বলে দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। লক্ষ করুন-
إِنَّ الْمُؤْمِنَ مِنْ أَهْلِ الإِيمَانِ بِمَنْزِلَةِ الرَّأْسِ مِنَ الْجَسَدِ يَأْلَمُ الْمُؤْمِنُ لأَهْلِ الإِيمَانِ كَمَا يَأْلَمُ الْجَسَدُ لِمَا فِي الرَّأْسِ.
ঈমানদারদের সঙ্গে একজন মুমিনের সম্পর্ক ঠিক তেমন, যেমন সম্পর্ক দেহের সঙ্গে মাথার। ঈমানদারদের দুঃখ-কষ্ট ঠিক সেভাবেই সে অনুভব করে, যেমন মাথা দেহের ব্যথা অনুভব করে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২৮৭৭
ঈমানের এ বন্ধনকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো দেশ গোত্র ভাষা কিংবা সময়ের ফ্রেমে আটকে দেননি। তাঁর নির্দেশনা এসব সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে ছড়িয়ে আছে বহুদূর পর্যন্ত। তাই তো দূর কোনো দেশের কোনো মুসলমান ভাইয়ের কষ্টকর কোনো সংবাদে অন্য মুসলমানগণ ব্যথিত হন। যথাসম্ভব সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। এই ব্যথা এই কষ্ট আর এই সহযোগিতা ঈমানের দাবি।
ভ্রাতৃত্বের এই দাবি মেটাতে গিয়ে মুমিন তার সবটুকু সাধ্য ব্যয় করবে। সময়ের চাহিদা বুঝে সে এগিয়ে আসবে। মুমিনের পাশে মুমিন থাকবেই। কখনো অর্থ দিয়ে, কখনো পরামর্শ দিয়ে, কখনো প্রয়োজন হলে শুধুই সঙ্গ দিয়ে সে তাকে সহযোগিতা করবে। বিপদের মুহূর্তে পাশে এসে কিছুক্ষণ বসে সান্ত¡নার বাণী শোনালেও মানসিক শক্তি বেড়ে যায় অনেক। সঙ্গত কারণেই ভ্রাতৃত্বের এই বন্ধন রক্ষা করার ফযীলতও খুবই ঈর্ষণীয়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنْ كَانَ فِي حَاجَةِ أَخِيهِ كَانَ اللهُ فِي حَاجَتِهِ.
যে তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূর্ণ করে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূর্ণ করে দেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৪৪২
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলা হয় ‘আসসাদিকুল মাসদূক’। তিনি সর্বদাই সত্য বলেছেন। তিনি এখানে আমাদেরকে কথা দিচ্ছেন- কেউ তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করে দিলে আল্লাহও তার প্রয়োজন পূরণ করে দেবেন। এই প্রতিশ্রুতির পর আর কী চাই আমরা!
সহযোগিতা বলতে আমরা বুঝি কেবলই বিপদে পাশে দাঁড়ানোকে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর গ-িকে আরও অনেক বিস্তৃত করে দিয়েছেন। দেখুন- তিনি বলেছেন-
انْصُرْ أَخَاكَ ظَالِمًا ، أَوْ مَظْلُومًا، قَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ هَذَا نَنْصُرُهُ مَظْلُومًا فَكَيْفَ نَنْصُرُهُ ظَالِمًا قَالَ تَأْخُذُ فَوْقَ يَدَيْهِ.
তুমি তোমার ভাইকে সাহায্য করো, সে জালিম হোক কিংবা মজলুম হোক। সাহাবায়ে কেরাম প্রশ্ন করলেন ইয়া রাসূলুল্লাহ! মজলুমকে তো আমরা সাহায্য করব। কিন্তু জালিমকে কীকরে সাহায্য করব? তিনি বললেন, তাকে তার জুলুম থেকে বাধা দেবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৪৪৪
এই হাদীসে দুটি বিষয় লক্ষণীয়। এক. মুমিন সকলেই একে অন্যের ভাই। এই ভ্রাতৃত্ব সর্বাবস্থায়ই সত্য। একজন মুমিন শয়তানের ধোঁকায় পড়ে কোনো পাপে জড়িয়ে পড়তে পারে, অন্যায়ভাবে কারও ওপর হাত ওঠাতে পারে। এসবই অপরাধ, কিন্তু এতে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন বাতিল হয়ে যায় না। তাই তো হাদীসে মজলুমকে যেমন ভাই বলা হচ্ছে, জালিমকেও একইসঙ্গে ভাই বলেই উপস্থাপন করা হচ্ছে।
দুই. জালিমকে তার জুলুম থেকে ফিরিয়ে রাখাটাই তার জন্যে সহযোগিতা। অন্যায় ও জুলুমে লিপ্ত হয়ে সে জাহান্নামের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল। সে পথ থেকে তাকে ফিরিয়ে ন্যায় ও কল্যাণের পথে তুলে আনাটাই তার জন্যে প্রকৃত সহযোগিতা। হাদীসে এই সহযোগিতার কথাই বলা হচ্ছে- তোমার ভাই যদি জুলুম করে তাহলে তার হাত ধরে তাকে জুলুম থেকে বাধা দাও।
যে কোনো প্রয়োজনে, যে কোনো সংকটে মুমিন আল্লাহ তাআলার দরবারে প্রার্থনা করবে- এটাই তো স্বাভাবিক। নিজের প্রয়োজনে মানুষ যেমন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, তেমনি অন্যের প্রয়োজন পূরণের জন্যও দুআ করে। এ দুআ করাটাও ভ্রাতৃত্বের পরিচায়ক। ভ্রাতৃত্ব রক্ষায় এ দুআ করার পুরস্কার বিশেষভাবে বর্ণিত হয়েছে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র বাণীতে-
مَنْ دَعَا لأَخِيهِ بِظَهْرِ الْغَيْبِ قَالَ الْمَلَكُ الْمُوَكّلُ بِهِ آمِينَ وَلَكَ بِمِثْلٍ.
যে তার ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার জন্য দুআ করে, তার জন্য নিয়োজিত ফেরেশতা তখন ‘আমীন’ বলে এবং এও বলে, তোমার জন্যেও এ দুআ কবুল হোক। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭৩২
এই তো ভ্রাতৃত্বের পরিচয়। বিপদাপদে পাশে দাঁড়াবে, সুখে-দুঃখে কাছে থাকবে, অন্যায় করলে কিংবা ভুল পথে চললে ন্যায়ের পথে ফিরিয়ে আনবে, তার প্রয়োজন পূরণের জন্যে আল্লাহর কাছে দুআ করবে। ঈমানী ভ্রাতৃত্বের এই দাবিগুলো যদি আমরা রক্ষা করতে পারি, তাহলে আর বলে দিতে হয় না- একজন মুমিনের সঙ্গে আরেকজন মুমিন কোন ধরণের আচরণ করতে পারে না। তবুও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে এ বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন। ভ্রাতৃত্বের এ বন্ধন যেন ছিন্ন হয়ে না পড়ে, সে বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন-
الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ، لاَ يَظْلِمُهُ وَلاَ يُسْلِمُهُ، مَنْ كَانَ فِى حَاجَةِ أَخِيهِ كَانَ اللهُ فِى حَاجَتِهِ، وَمَنْ فَرّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً فَرّجَ اللهُ عَنْهُ بِهَا كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ، وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ.
মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করতে পারে না, তাকে শত্রুর হাতে তুলে দিতে পারে না। যে তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূর্ণ করে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূর্ণ করে দেন। যে একজন মুসলমানের কোনো সংকট সমাধান করে দেয়, এর বিনিময়ে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার একটি সংকটের সমাধান করে দেবেন। যে একজন মুসলমানের দোষ লুকিয়ে রাখে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দোষ লুকিয়ে রাখবেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮০
আরেক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
لاَ تَحَاسَدُوا وَلاَ تَنَاجَشُوا وَلاَ تَبَاغَضُوا وَلاَ تَدَابَرُوا وَلاَ يَبِعْ بَعْضُكُمْ عَلَى بَيْعِ بَعْضٍ وَكُونُوا عِبَادَ اللهِ إِخْوَانًا. الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لاَ يَظْلِمُهُ وَلاَ يَخْذُلُهُ وَلاَ يَحْقِرُهُ. التَّقْوَى هَا هُنَا. وَيُشِيرُ إِلَى صَدْرِهِ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ ، بِحَسْبِ امْرِئٍ مِنَ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ دَمُهُ وَمَالُهُ وَعِرْضُهُ.
তোমরা পরস্পর হিংসা করো না, একে অন্যকে ধোঁকা দিয়ো না, বিদ্বেষ পোষণ করো না, একজন আরেকজনের পেছনে লেগে থেকো না, একজনের বিক্রির সময় আরেকজন আগে বেড়ে বিক্রি করতে যেয়ো না, বরং সকলেই আল্লাহর বান্দা হয়ে যাও, ভাই ভাই হয়ে যাও। মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তাকে জুলুম করতে পারে না, তাকে লাঞ্ছিত করতে পারে না, তাকে তাচ্ছিল্য করতে পারে না। তাকওয়া তো এখানে- নিজ বুকের দিকে ইশারা করে তিনি তিনবার এ কথা বলেন। এরপর বলেন, একজন মানুষের অন্যায় হিসেবে এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলিম ভাইকে হেয় ও তাচ্ছিল্য করবে। প্রত্যেক মুসলমানের জন্যেই অপর মুসলমানের রক্ত, সম্পদ ও সম্মান হারাম! -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৬৪
এই হল হাদীসের নির্দেশনা। একটু লক্ষ করলেই আমরা দেখব, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীসদুটিতে যেসব কাজ থেকে আমাদের বারণ করেছেন, সেগুলোর প্রতিটিই এমন, যা ভ্রাতৃত্ব ও হৃদ্যতার পরিবেশ নষ্ট করে। সবশেষে তিনি বলে দিয়েছেন, একজন মুসলমানের প্রাণ হরণ করা যেমন হারাম, সম্পদ হরণ করা যেমন হারাম, তার সম্মান হরণ করাও হারাম। এত সতর্কবাণী ও নির্দেশনার পরও যদি দুইজন মুসলমানের মধ্যে পারস্পরিক স্বাভাবিক সম্পর্ক না থাকে, একজনের সঙ্গে আরেকজন কথা না বলে, তাহলে তাদের জন্য উচ্চারিত হয়েছে কঠোর হুঁশিয়ারি! নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
تُعْرَضُ الأَعْمَالُ فِى كُلِّ يَوْمِ خَمِيسٍ وَاثْنَيْنِ فَيَغْفِرُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ فِى ذَلِكَ الْيَوْمِ لِكُلِّ امْرِئٍ لاَ يُشْرِكُ بِاللهِ شَيْئًا إِلاَّ امْرَأً كَانَتْ بَيْنَهُ وَبَيْنَ أَخِيهِ شَحْنَاءُ فَيُقَالُ ارْكُوا هَذَيْنِ حَتّى يَصْطَلِحَا ارْكُوا هَذَيْنِ حَتّى يَصْطَلِحَا.
প্রতি বৃহস্পতিবার ও সোমবার মানুষের আমল (আল্লাহর দরবারে) উপস্থিত করা হয়। সেদিন আল্লাহ তাআলা এমন সকলকেই ক্ষমা করে দেন, যে তাঁর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করে না। তবে তাকে ছাড়া, যার এবং তার ভাইয়ের মাঝে বিদ্বেষ থাকে। তখন বলা হয়, এই দুইজনকে পিছিয়ে দাও, যতক্ষণ না তারা পরস্পর মিলে যায়, এই দুইজনকে পিছিয়ে দাও, যতক্ষণ না তারা মিলে যায়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৬৫
বোঝাই যাচ্ছে, বিষয়টি সহজ নয়। যেদিন আল্লাহ রাহমানুর রাহীমের পক্ষ থেকে সকল মুসলমানকে ক্ষমা করা হয়, সেদিনও পারস্পরিক বিদ্বেষপোষণকারী দুই মুমিনকে ক্ষমা করা হয় না! যেভাবেই হোক, দুইজন মুমিন যখন এমন অন্যায়ে জড়িয়ে পড়ে, তাদের ভ্রাতৃত্ববোধ যখন হারিয়ে যায়, যখন তারা একে অন্যের সঙ্গে কথা বলাও বন্ধ করে দেয়, একে অন্যের ক্ষতি কামনা করে, এমন পরিস্থিতিতে তাদের দুইজনকে মিলিয়ে দেওয়াটাও বড় সওয়াবের কাজ। হাদীসের বাণী লক্ষ করুন-
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন সাহাবায়ে কেরামকে প্রশ্ন করেছেন, আমি কি তোমাদেরকে নামায রোযা আর সদকার চেয়েও উত্তম কোনো কিছুর কথা বলব? তারা বললেন, অবশ্যই বলুন। তিনি বললেন-
إِصْلاَحُ ذَاتِ الْبَيْنِ وَفَسَادُ ذَاتِ الْبَيْنِ الْحَالِقَةُ.
পারস্পরিক সম্প্রীতি সৃষ্টি করে দেওয়া। আর পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট করে দেওয়া তো (দ্বীনকে) মুণ্ডিয়ে দেয়। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯২১
আরেক বর্ণনায় এসেছে, উক্ত হাদীসের শেষে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
لَا أَقُولُ تَحْلِقُ الشّعرَ، وَلَكِنْ تَحْلِقُ الدِّينَ.
আমার এ কথার উদ্দেশ্য এটা নয় যে, তা চুল মু-িয়ে দেয়। বরং তা দ্বীনকে মুণ্ডিয়ে দেয়। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৫০৯
শেষ কথা, যে ঈমানকে বুকে ধারণ করে আমরা নিজেদেরকে মুমিন হিসেবে পরিচিত করছি, সেই ঈমানের দাবিকে পূর্ণ করতে হলে আমাদের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আরও সুসংহত করতে হবে, কোথাও বিপরীত কিছু দেখা গেলে তা দূর করে পারস্পরিক সম্প্রীতি সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হতে হবে। শান্তির সমাজ পেতে চাইলে এই ভ্রাতৃত্বের বিকল্প নেই।