যিলহজ্ব ১৪৪০   ||   আগস্ট ২০১৯

তাবলীগ জামাতের বর্তমান সংকট : কিছু জিজ্ঞাসা ও জবাব

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

(মুযাকারা মজলিস-২)

* আমি আলকাউসার রবিউল আউয়াল ১৪৪০ হিজরী সংখ্যায় আপনার মুন্সিগঞ্জের বয়ানটি পড়েছি। মাশাআল্লাহ পল্লবী জামে মসজিদের বয়ানের মত এটিও সহজ-সরল ও অনেক উপকারী হয়েছে।

** পুরো বয়ানটি পড়েছেন তো?

* জী, পুরো বয়ানটি পড়েছি। রবিউল আউয়াল সংখ্যা ও রবিউস সানী সংখ্যা থেকে উভয় কিস্তি পড়েছি। রবিউস সানী সংখ্যা থেকে মুযাকারা মজলিসটি পড়েছি। আর জুমাদাল আখিরাহ সংখ্যা থেকে ‘সীরাতের আলোকে কাজের সংস্কার : দাবি ও স্বরূপ’ শিরোনামে মদীনা মুনাওয়ারার মজলিসটিও পড়েছি।

আলহামদু লিল্লাহ, আমার কাছে অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে গেছে। তবে দু-একটি বিষয়ে যদি আরো জানতে পারতাম ভালো হত।

** বলুন।

* একটা কথা কোনো কোনো এতাআতী ভাই বলে বেড়াচ্ছে যে, মাওলানা সা‘দ সাহেবের  যেসব  ভুল ধরা হচ্ছে সেগুলো তার বয়ানের ‘কাটপিস’ দ্বারা ধরা হচ্ছে, নতুবা তার বক্তব্যের আগ-পর যদি শোনা হয় তাহলে তার ভিন্ন অর্থ হয় এবং আপত্তি আর থাকে না।

দলীল হিসেবে তারা পেশ করে সা‘দ সাহেবের ঐ কথাটা যে, ‘হেদায়েত আল্লাহর হাতে হলে, আল্লাহ নবী কেন পাঠিয়েছেন’। তারা বলে, এই কথার আগ-পর শুনলে নাকি আর আপত্তি থাকে না।

** শুনুন, একজন আড়াই ঘণ্টা বয়ান করেছেন। আড়াই ঘণ্টার মধ্যে দুই ঘণ্টার কথা শুদ্ধ। শুরুর এক ঘণ্টা আর শেষের এক ঘণ্টা, মাঝখানে আধাঘণ্টা ভুল বলেছেন। আমি যদি আপনাকে আড়াই ঘণ্টার বয়ান দিয়ে দিই আপনি কী বুঝবেন? আড়াই ঘণ্টার পুরোটা তো ভুল বলেননি তিনি? আড়াই ঘণ্টার পুরোটা আপনার সামনে রেখে দিলে ভুল কথাটা আপনি বের করবেন কীভাবে? সেটা তো চিহ্নিত করে দিতে হবে।

এটা তো স্বীকৃত তরীকা যে, বক্তব্যের যে অংশটার প্রতি আপনি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছেন, চাই তা সঠিক হোক বা ভুল, আপনার কর্তব্য হল, সে অংশটা চিহ্নিত করে দেয়া। কারণ সেটা চিহ্নিত করে না দিলে ধরবে কীভাবে মানুষ? এই চিহ্নিত করাকে যদি কেউ নাম দেয় ‘কাটপিস’ তাহলে সেটা অন্যায়।

কাটপিস তখন বলা যায় যখন আগ-পর থেকে এমন কথা বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে, যে কথাসহ হলে আর আপত্তি থাকে না। এজন্য আপত্তিকারী এক অংশ রেখেছে আরেক অংশ বাদ দিয়ে দিয়েছে।

এমন কাজ করেছেন আহমদ রেযা খান বেরলভী। তিনি আমাদের আকাবিরের বক্তব্যের আগ-পর বাদ দিয়ে নিজ থেকে আপত্তিকর বক্তব্য সৃষ্টি করে তাদের উপর আরোপ করে দিয়েছেন। এ ধরনের কাজ বেদআতীরা করে; উলামায়ে কেরাম করেন না। উলামায়ে কেরাম উদ্ধৃতি উল্লেখ করার ক্ষেত্রে আমানতদারী রক্ষা করে থাকেন। উদ্ধৃত অংশের সাথে সম্পৃক্ত এমন  কোনো কিছু আগ-পর থেকে বাদ দেন না, যা যুক্ত হলে ভিন্ন অর্থ দাঁড়ায়। সুতরাং কাটপিসের আপত্তি তখন চলবে যখন আগ-পরের কথা যুক্ত করলে কোনো আপত্তি আর থাকে না।

আর জানা থাকা ভালো যে, কারো বক্তব্য উদ্ধৃত করার ক্ষেত্রে শুধু সংশ্লিষ্ট অংশ উল্লেখ করা- এটি একটি স্বীকৃত নীতি। কুরআনে কারীম ও হাদীস শরীফে তাই করা হয়েছে। সালাফের আমলও এমনই ছিল। তাই এটাকে ব্যঙ্গ করে কাটপিস নাম দেওয়া মারাত্মক অপরাধ।

এখন এরকম একটা দৃষ্টান্ত দেখান, যেখানে উলামায়ে কেরাম আপত্তি করেছেন অথচ আগ-পরের কথা যুক্ত করলে আপত্তি আর বহাল থাকে না।

উদাহরণস্বরূপ মাওলানা সা‘দ সাহেবের ঐ কথাটাই ধরুন। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা বল, হেদায়েত আল্লাহর হাতে। হেদায়েত আল্লাহর হাতে হলে আল্লাহ নবী কেন পাঠিয়েছেন।’ একথাটা সঠিক না ভুল? ভুল। তিনি আরেক বয়ানে স্পষ্ট বলেছেন, ‘দেখ, হেদায়েত একমাত্র আল্লাহর হাতে।’ তার সে বয়ানও পড়েছি আমি।

প্রশ্ন হল, এক বয়ানে সহীহ বলেছেন, তাই বলে কি আরেক বয়ানে যে গলত কথা বলেছেন সেটা সহীহ হয়ে যাবে? গলতটা তো গলতই থাকবে।

তাই বলতে হবে, ঐ বয়ানে আমি যা বলেছি তা ঠিক। আর এই বয়ানে যেটা বলেছি সেটা ভুল। তার অনুসারীদের বলতে হবে- হাঁ, হযরতের এখানে ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু সহীহ কথাটা তিনি অন্য বয়ানে বলেছেন। এভাবে বলতে হবে! কিন্তু তা না করে উল্টো সিনাজুরি।

মাওলানা সা‘দ সাহেব এ কথার আগে পরে যতই বলেছেন কিন্তু এ কথার ইসলাহ বা সংশোধনী আসেনি। তার মুখে ভুল কথা, ভুল উপস্থাপন এসে গেছে। নিয়ম হল, ভুল উপস্থাপন হলে তওবা করতে হবে। বলতে হবে, ‘এটা ভুল হয়ে গেছে আমার। এভাবে না বলে কথাটা এভাবে বলা উচিত ছিল।’ কিন্তু তিনি সংশোধনী দিচ্ছেন না অথচ তারা তার পক্ষ থেকে সাফাই বয়ান করছে। আবার উল্টো উলামায়ে কেরাম সম্পর্কে বলছে, তারা কাটপিস শুনে ফতোয়া দেন।

আপনি পুরো আলোচনা শুনুন এবং তার যে কথা ‘তোমরা বল, হেদায়েত আল্লাহর হাতে। হেদায়েত আল্লাহর হাতে হলে আল্লাহ নবী কেন পাঠালেন?’ এ কথার সংশোধনী এসেছে কি না পুরো বয়ানে তা দেখুন। পুরো বয়ানে অন্যান্য কথা ভালো বলেছেন সেজন্য কি এই ভুল শুদ্ধ হয়ে যাবে? এতে যে বলার ও উপস্থাপনার ভুল হয়েছে তা মেনে নিতে হবে। এটা না মানা হঠকারিতা।

কাটপিছ বলে বলে কোনো কোনো এতাআতী ভাই যে অভিযোগ করছে, যদি তাদের এই অভিযোগ সত্য হত তাহলে তারা দারুল উলূম দেওবন্দের ফতোয়াতে উদ্ধৃত সা‘দ সাহেবের বক্তব্যগুলো উল্লেখ করে ওনার অডিও পেশ করতে পারত যে, এই দেখুন, সা‘দ সাহেবের পুরো বয়ান। এতে কোনো আপত্তি নেই। আর এই দেখুন দেওবন্দের পেশকৃত উদ্ধৃিত। তাতে আগ-পর থেকে এই এই কথা বাদ দেওয়া হয়েছে, যার কারণে আপত্তি সৃষ্টি হয়েছে।  পেয়েছেন এই পর্যন্ত এমন কোনো অডিও এতাআতীদের পক্ষ থেকে?! পাননি। পাবেনও না ইনশাআল্লাহ।

* তারা আপনার বিরুদ্ধেও অনেক প্রোপাগান্ডা করেছে। বলেছে, মাওলানা সা‘দ সাহেব আওরঙ্গবাদের বয়ানে ওলীমা বিষয়ে যে আলোচনা করেছেন আপনি

নাকি সেটাকে কাট-ছাট করে আপত্তি করেছেন। পুরো বক্তব্য উদ্ধৃত করলে নাকি আর আপত্তি হতো না।

কিন্তু রবিউল আওয়াল ১৪৪০ হিজরী সংখ্যায় এবং পরবর্তীতে স্বতন্ত্র পুস্তিকা আকারে আপনার পুরো বয়ানটা পড়লাম। দেখলাম, ওলীমা সংক্রান্ত সা‘দ সাহেবের পুরো বক্তব্যই আপনি উর্দু ভাষায় লিখে দিয়েছেন। প্রোপাগান্ডাকারীরা যতটুকু অংশ উদ্ধৃত করেছে আপনি পূর্বাপরসহ তার চেয়ে বেশি উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আমরা দেখেছি, আপত্তি আপন জায়গায় বহাল আছে। যেটাকে সা‘দ সাহেবের ভ্রান্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে সেটা ঠিকই সেখানে উপস্থিত। জানি না, তারা কেন এরূপ প্রোপাগান্ডা করল।

** ব্যস, দুআ করি, আল্লাহ তাআলা তাদের হেদায়েত দান করুন। আসলে যারা গোমরাহির পক্ষ অবলম্বন করতে চায় তাদের তো ভুল প্রোপাগান্ডা ছাড়া কোনো রাস্তাও থাকে না।

 

[প্রসঙ্গ : আমীর ও শূরা]

* আমীর আর শূরা বিষয়ে শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গি কী- এ বিষয়ে যদি কিছু বলতেন। তারা যে বলে, আমীরের এতাআত জরুরি। আসলে ‘আমীরের এতাআত জরুরি’- এ কথার অর্থ কী? তাছাড়া সাধারণ আমীর আর আমীরুল মুমিনীন- এ দুইয়ের মধ্যে কী পার্থক্য?

** আমীরের এতাআত জরুরি। কথা ঠিক। কিন্তু বাস্তবে কোন্ আমীরের এতাআত জরুরি, কোন্ আমীরের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক সরাসরি- এ বিষয়গুলো আপনাকে জানতে হবে।

আমীরের কিন্তু অনেক স্তর আছে। আপনার সরাসরি সম্পর্ক হল, যিনি আপনার চিল্লার সময়ের আমীর তার সঙ্গে। আপনার মহল্লার বা হালকার আমীর যিনি তার সঙ্গে। আর যারা হালকার বা চিল্লার সময়ের আমীর তাদের দ্বীনী আমীর হলেন স্থানীয় উলামায়ে কেরাম। বুঝতে পেরেছেন? এ বিষয়টা অনেকে ধরতে পারে না।

কোনো তানযীম, তাহরীক বা কোনো দ্বীনী জামাতের আমীর আর আমীরুল মুমিনীন বা খলীফাতুল মুসলিমীন দুটি এক কথা নয়। এ সম্পর্কে কিছু আলোচনা হয়েছে জুমাদাল আখিরাহ সংখ্যায় প্রকাশিত মদীনা মুনাওয়ারার মজলিসে ‘খুরূজ আলাল আমীরের হাকীকত’- এই শিরোনামের অধীনে।

আপনি জানেন, বর্তমানে মুসলিম উম্মাহর কোনো আমীরুল মুমিনীন বা খলীফাতুল মুসলিমীন নেই।

হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ. হযরত মাওলানা ইউসুফ রাহ. এবং হযরত মাওলানা এনামুল হাসান রাহ. ধারাবাহিকভাবে তাবলীগ জামাআতের যিম্মাদার বা আমীর ছিলেন। তবে তাঁরা কেউ আমীরুল মুমিনীন ছিলেন না। বরং তাঁরা এই তাহরীক অর্থাৎ হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ. দাওয়াতের যে পদ্ধতির দিকে উদ্বুদ্ধ করেছেন সে পদ্ধতির যে কাজ, সে কাজের যিম্মাদার বা আমীর ছিলেন। খলীফাতুল মুসলিমীন বা আমীরুল মুমিনীন ছিলেন না। এখন মাওলানা সা‘দ সাহেব যদি সঠিক পন্থায় আগের তিন হযরতের মত নিয়মতান্ত্রিক আমীর হতেনও, তাহলে তিনি এ কাজের আমীর হতেন; আমীরুল মুমিনীন নয়।

তাই এ ধরনের কাজের আমীরের ক্ষেত্রে আমীরুল মুমিনীন বা খলীফাতুল মুসলিমীনের বিধান প্রয়োগ করাটা নতুন আরেক বিদআত। কারণ, এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য অনেক। আমীরুল মুমিনীনের অধীনে তো নাহী আনিল মুনকারের সব কাজ হবে। এটা তার দায়িত্ব। কাফেরের সঙ্গে জিহাদ করবে, হদ কায়েম করবে।

আমীরুল মুমিনীনের অনেক কাজ। তার শক্তি থাকতে হয়। শুধু নসীহতের লোক আমীরুল মুমিনীন হতে পারেন না, যিনি শুধু উপদেশ দিবেন। আপনি গ্রহণ করলে মেহেরবানি, না করলে তার কিছু করার নেই। কারণ, ক্ষমতা প্রয়োগের শক্তি ও অধিকার তো তার নেই। আমাদের কিতাবের ভাষায় বলে ‘কুওয়াতে ক্বাহেরা’। আমীরুল মুমিনীনের কাছে ‘কুওয়াতে ক্বাহেরা’ থাকতে হয়।

আর আমীরুল মুমিনীন একাধিক হয় না। ইসলামে একাধিক আমীরুল মুমিনীন নেই। শুধু একজন।

এখন সমস্যা হল, দ্বীনী জামাতের যিম্মাদারের ওপর আমীরুল মুমিনীন ও খলীফাতুল মুসলিমীনের সকল বিধান প্রয়োগ করা হচ্ছে। এজন্য বলে বেড়াচ্ছে যে, ‘শূরা চলবে না’, ‘ফয়সালওয়ালা শূরা চলবে না’, পরিচালনার একমাত্র পদ্ধতি ইমারত। আমীরের সহযোগী হিসেবে থাকবে শূরা। আমীর শূরার অধীন হবেন না।’ মাওলানা সা‘দ সাহেবও এমনটাই বলেন। তার মতে, শূরা থাকবে; তারা মাশওয়ারা দেবে; আমীরের ইচ্ছা- মানলে মানল, না মানলে নাই। এই হল তার নিকট শূরার অবস্থান।

সুতরাং এ কথা বলা যে, যে কোনো দ্বীনী কাজে শুধু আমীরের পদ্ধতিই চলবে, শূরার পদ্ধতি চলবে না। আমীরের পদ্ধতি ফরয; শূরার পদ্ধতি হারাম- এটা ভুল কথা। এটা খুব ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করুন।

এক হল, ইসলামী খেলাফত। সেক্ষেত্রে ইমারতের পদ্ধতি নির্ধারিত। আমীর থাকবে আর তার সহযোগিতার জন্য থাকবে শূরা। আর শূরার কথা মানতে আমীর বাধ্য, যদি শূরা শরয়ী দলীল পেশ করে। যেখানে মাসআলার বিষয় এবং শূরা দলীল দিয়ে বলছে, সেখানে তিনি যেহেতু আমীর, ব্যস এজন্য ‘ম্যয় নেহী মানতা’- এমন বলার অধিকার নেই। এছাড়াও আরো ক্ষেত্র  রয়েছে যেখানে আমীরকে শূরার পরামর্শ মানতে বাধ্য করা যায়। বিষয়টি আল্লামা তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যাগ্রন্থ তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিমে কিছুটা বিস্তারিত লিখেছেন। মোটকথা ইসলামী খেলাফতের ক্ষেত্রে নিয়ম হল, আমীর এবং তার সহযোগিতার জন্য শূরা।

এছাড়া অন্য যে কোনো দ্বীনী কাজে আমীরের পদ্ধতি এবং শূরার পদ্ধতি দুটোই মুবাহ। যেমন একটা মাদরাসা, একটা খানকাহ বা একটা ইসলামী রাজনীতির দল পরিচালিত হবে, তো কীভাবে পরিচালিত হবে? কোনো তাহরীক, কোনো তানযীম বা কোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কুরআন-হাদীসের কোথাও কি এরকম নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে যে, সেটা পরিচালনার একমাত্র পদ্ধতি হল একজনকে অবশ্যই আমীর বানাতে হবে? এরকম হলে দলীল চাই। এখানে আমীরুল মুমিনীনের হাদীস নিয়ে আসলে হবে না। সেটা তো ভিন্ন প্রসঙ্গ। প্রশ্ন হল, কোনো তানযীম, কোনো তাহরীক বা কোনো দ্বীনী জামাআতের ক্ষেত্রে কি শরীয়ত আমীরের পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছে?

হাদীস শরীফে আছে, ‘তোমরা তিনজন যদি সফরে বের হও, একজনকে আমীর বানিয়ে নাও।’ সে সফরটা দাওয়াতের সফরও হতে পারে, ইলমের সফরও হতে পারে, আবার সাধারণ সফরও হতে পারে। তো যখন সফরে আমীর বানাতে বলা হয়েছে, আমরা যে কোনো সফরের জন্যই আমীর বানাতে পারি। আর যেহেতু সফর অবস্থায় আমীরের দরকার হয় সেহেতু যৌথভাবে যখন কোনো দ্বীনী কাজ করব তখনও আমীরের দরকার হতে পারে। তাই বলা যায়, সেখানে যেহেতু আমীরের কথা বলা হয়েছে সেহেতু এখানেও আমীর হলে ভালো। বলতে পারেন। কিন্তু যদি বলেন, আমীর বানানো ফরয, তাহলে ফরয বলার জন্য ফরয সাব্যস্ত হয় এমন দলীল লাগবে কি না? অবশ্যই। ফরয-ওয়াজিব বলতে হলে কি এমনিই বলা যাবে? না। তাহলে সে দলীল কোথায়? তাছাড়া সফরে আমীর বানানোর যে বিধান সেটাও তো ফিকহের দৃষ্টিতে মুস্তাহাব; ওয়াজিব বা ফরয বিধান নয়।

মোটকথা, ইসলামী খেলাফত বা কুওয়াতে ক্বাহেরাওয়ালা ইমারতে আম্মাহ ছাড়া অন্য বিষয়ে শরীয়ত আমীরের পদ্ধতি ফরয করে দেয়নি। তবে যেহেতু আমরা  সফরের ক্ষেত্রে দেখলাম আমীর নির্ধারণের কথা, সেখান থেকে আমরা এ বিষয়টি গ্রহণ করতে পারি যে, এখানেও একজন আমীর হলে ভালো। কিন্তু আপনি একে ফরয বলতে পারেন না। ফরয বলার জন্য আলাদা দলীল থাকা জরুরি। কারণ উদ্দেশ্য হল সুন্দর পরিচালনা। এর জন্য একজন আমীর এবং তার সহযোগিতার জন্য শূরা- এটা একটা পদ্ধতি এবং ভালো পদ্ধতি।

আবার এটাও একটা পদ্ধতি যে, একটা মজলিসে শূরা হল; সে শূরার মধ্যে ফায়সাল থাকবে। ফায়সালের ক্ষেত্রে আবার বিভিন্ন সূরত হতে পারে।

ক. নির্ধারিত একজন ফায়সাল থাকবে। তাকে আমরা আমীর বানালাম না; বরং ফায়সাল হিসেবে ধরলাম।

খ. যখন মজলিসে বসি তখন মশওয়ারা করে একজনকে ফায়সাল বানিয়ে নিলাম। মজলিসে বসার পর প্রথম কাজ হল ফায়সাল বানানো। এরপর তিনি যা ফায়সালা করবেন তার উপর আমল হবে।

গ. মশওয়ারা করে ফায়সালও একাধিক নির্ধারণ করে নিলাম। যেমন তিনজন ফায়সাল হবে। অর্থাৎ শূরার সদস্য অনেক কিন্তু ফায়সাল তিনজন। তারা পর্যায়ক্রমে ফায়সাল হবে।

এই সব সূরতই বৈধ। শরীয়তের পরিভাষায় এটাকে মুবাহ বলে। এর কোনোটাকে যদি কেউ নাজায়েয বা হারাম বলে, তাকে অবশ্যই দলীল দিতে হবে। হাঁ, এ সূরতগুলোর মধ্যে কোন্টা উত্তম, কোন্টা দ্বিতীয় স্তরের সেটা নিয়ে  বলা যেতে পারে। সেখানে দুই মত হতে পারে। কিন্তু শূরার পদ্ধতিকে হারাম বলে দিবেন- এটা হতে পারে না। হারাম বলার জন্য কোনো দলীল নেই।

* তারা তো বলে, শরীয়তে আমীরবিহীন শূরার নাকি কোনো অস্তিত্বই নেই।

** কিন্তু যদি আমরা দেখাতে পারি? আচ্ছা, খলীফাতুল মুসলিমীন বা আমীরুল মুমিনীন নির্ধারণ করা ছোট কাজ না বড় কাজ? বড় কাজ। কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোনো দ্বীনী জামাআতের আমীর নয়; বরং খলীফাতুল মুসলিমীন নির্ধারণ করা। এটা কত বড় কাজ! হযরত ওমর রা. তার পরের খলীফা কে হবেন তা ঠিক করে দিয়ে যাননি; বরং ছয় জনের একটি শূরা বানিয়ে দিয়েছেন। বলুন তো, এ শূরার আমীর কে ছিলেন? কেউ ছিল না। খলীফাতুল মুসলিমীন ঠিক করার মত এত গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য হযরত উমর রা. যে শূরা ঠিক করে দিয়েছেন সে শূরার কোনো আমীর ছিল না! ইতিহাস দেখুন! সে শূরার কোনো আমীরই ছিল না। ঐ শূরা কীভাবে ফায়সালা করবে তাও তিনি বলে গেছেন। সবাই যদি একমত হয়ে যান, তাহলে তো হল। নতুবা কীভাবে কী করবে সে পন্থাও তিনি বলে গেছেন। কিন্তু শূরার আমীর ঠিক করে দেননি। তাহলে যে বলা হয়, ‘আমীর বিহীন শূরার কোনো অস্তিত্ব নেই’- কে বলল? এত বড় গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য যে শূরা ঠিক করা হয়েছিল, সে শূরারই তো আমীর ছিল না।

তো বলছিলাম, শূরার ফায়সাল যদি একজন নির্ধারিত থাকে তাহলে তো সহজ। একাধিক ফায়সাল হলে পর্যায়ক্রমে ফায়সালা করবে। এটা একটা মুবাহ পদ্ধতি। আমার শব্দটা মনে রাখুন! বলেছি, এটা একটা মুবাহ পদ্ধতি। এই পদ্ধতি ইসলামী খেলাফত বা ইসলামী রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে নয় এবং যেসব বিষয় আঞ্জাম  দেওয়া সরাসরি খলীফাতুল মুসলিমীনের কাজ সেসব ক্ষেত্রেও নয়; বরং অন্যান্য সাধারণ ঘরোয়া, সামাজিক বা প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়ের ক্ষেত্রে অথবা কোনো দ্বীনী কাজের পরিচালনার ক্ষেত্রে যে মশওয়ারা হয়, সে মশওয়ারার ক্ষেত্রেই হল এই পদ্ধতি। আর কুরআন মাজীদের যে আয়াত-

وَ اَمْرُهُمْ شُوْرٰی بَیْنَهُمْ

‘মুমিনদের কাজ মশওয়ারার মাধ্যমে হয়’ তাতে ‘মশওয়ারার মধ্যে সব সময়ের জন্য একজন নির্ধারিত আমীর বাধ্যতামূল থাকতে হবে’- এ কথার কোনো দলীল নেই এবং শরীয়তেও এর কোনো প্রমাণ নেই; বরং পূর্বোল্লিখিত সব সূরতই মুবাহ। এই মুবাহ পদ্ধতিগুলোর কোনো একটাকে কেউ যদি হারাম বলতে চায়, তার জন্য দলীলের প্রয়োজন, যা অনুপস্থিত। সে দলীল কারো কাছে নেই। তারা জোরজবরদস্তি করে ইসলামী খেলাফতের বিধানগুলো এখানে প্রয়োগ করছে। কিছুটা ধরতে পেরেছেন তো?

তাদের আরেক সমস্যা হল, তারা ইমারতের পদ্ধতির কথা তো খুব বলে, কিন্তু আমীর নির্ধারণের শরয়ী পদ্ধতি কী- তা বেমালুম ভুলে যায়। যদি ইমারতের সূরত অবলম্বন করতে হয়, তাহলে শরয়ী পদ্ধতিতে আমীর নির্ধারণ হতে হবে তো? নাকি স্বয়ংক্রিয় কেউ আমীর হয়ে যেতে পারে? রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা তিনজন সফরে যাচ্ছ তো একজনকে আমীর বানিয়ে নাও। ‘বানিয়ে নাও’ বলেছেন। বলেছেন-

فَلْيُؤَمّرُوا أَحَدَهُمْ

“তারা যেন একজনকে আমীর বানিয়ে নেয়”। তাহলে ‘বানাতে’ হবে তো? নাকি এমনি হয়ে যাবে? বানাতে হবে। নাকি তিনজন সফরে রওয়ানা হয়েছে, একজন নিজে নিজে বলবে, আমি আমীর?! আমীর তো মশওয়ারা করে ঠিক করতে হবে।

দাওয়াত ও তাবলীগে হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ. থেকে এনামুল হাসান রাহ. পর্যন্ত ইমারতের পদ্ধতি চলেছে, কোনো সমস্যা হয়নি। প্রথম হযরত মাওলানা  ইলিয়াস রাহ., তারপর হযরত মাওলানা ইউসুফ রাহ., তারপর হযরত মাওলানা এনামুল হাসান রাহ.। এরপর কী হয়েছে?

১৯৯৫ ঈসায়ীতে এনামুল হাসান রাহ.-এর ইন্তিকাল। ইন্তিকালের পর মজলিসে শূরা বসেছে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট একজনকে আমীর বানাতে পারেননি। হাজ্বী আবদুল ওয়াহহাব রাহ.-এর বক্তব্যে কথাটা আছে যে, সুনির্দিষ্ট একজনকে আমীর না বানানোর প্রস্তাব মাওলানা সা‘দ সাহেবই দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “আপনারা আমাকে আমীর বানাবেন না। কারণ, আমাকে আমীর বানালে দিল্লীর লোকেরা কেটে পড়বে, যারা যোবায়েরুল হাসান ছাহেবকে চাচ্ছেন। আর যোবায়েরুল হাসান ছাহেবকে বানালে মেওয়াতের লোকেরা কেটে পড়বে, যারা আমাকে চাচ্ছেন। এজন্য আমাকেও আমীর বানাবেন না, তাকেও আমীর বানাবেন না।” যাহোক, সে মজলিসে কাউকে আমীর বানানো যায়নি। বরং ফায়সালা হল-

فی الحال يہ تين حضرات مولانا اظھار الحسن صاحب، مولانا  زبير الحسن صاحب، مولانا  سعد صاحب کام کو ليکر چليں گے  انشاء اللہ تعالی۔

“ফিলহাল এই তিন হযরত- মাওলানা ইযহারুল হাসান ছাহেব, মাওলানা যোবায়েরুল হাসান ছাহেব এবং মাওলানা সা‘দ ছাহেব কাজ নিয়ে চলবেন ইনশাআল্লাহু তাআলা।”

পরে এ তিনজন কীভাবে কাজ নিয়ে চলেছেন জানেন তো? পর্যায়ক্রমে একেকজন ফায়সাল হতেন। হাঁ, কারো পালাতে তিনি মাওলানা সা‘দ সাহেবকে বলেছেন, আপনিই ফায়সালা করুন। সেটা তার বিষয়। পালা যোবায়েরুল হাসান সাহেবের ছিল, কিন্তু তিনি সা‘দ সাহেবকে বলেছেন, ফায়সালা আপনিই করুন! এটা তার শারাফতের বিষয়।

তো হযরত মাওলানা এনামুল হাসান রাহ.-এর ইন্তিকালের পর এ শূরা একক

যিম্মাদার ঠিক করে দেয়নি; বরং মজলিসে শূরার মাধ্যমে উমূরগুলো চালিয়ে নেওয়ার ফায়সালা করেছেন।

আচ্ছা, হযরত মাওলানা যোবায়েরুল হাসান রাহ.-এর ইন্তিকাল কবে জানেন তো? ২০১৪ সালে। ১৯৯৫ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত প্রায় বিশ বছর। এ বিশ বছর তাবলীগের কাজ আমীরওয়ালা শূরার তরিকায় চলেছে, নাকি পর্যায়ক্রমে ফায়সালওয়ালা শূরার তরিকায়? ফায়সালওয়ালা শূরার তরিকায়। মাওলানা সা‘দ সাহেব কি বিশ বছর যাবৎ এ তরিকার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেছেন? না। এ পদ্ধতিকে কি ইহুদী-নাসারার পদ্ধতি বলেছেন? না। এটাকে হারাম বলেছেন? না। পুরো বিশে^র উলামায়ে কেরাম জানতেন কি না যে, তাবলীগের কাজটা এখন ফায়সালওয়ালা শূরার অধীন? জানতেন। এর বিরুদ্ধে কি কোনো ফতোয়া এসেছে? না। কেন আসেনি? আর সা‘দ সাহেবও বা কেন আপত্তি করেননি? তাবলীগের সব লোক সব জায়গায় কেন খামোশ ছিলেন? হয়ত কেউ আফসোস করেছেন; বলেছেন, আমরা একজন আমীর বানাতে পারলাম না! আফসোস তো ঠিকই আছে, কিন্তু কেউ কি একথা বলেছেন যে, আমরা হারাম তরিকায় আছি? না। তাহলে এখন এটা হারাম হয়ে গেল কেন? এ প্রশ্ন হয় কি না? হয়।

আসলে হারাম হওয়ার কোনো দলীল নেই। কারণ, এটা একটা মুবাহ পদ্ধতি। তবে ওটা হলে ভালো হত। যখন সেটা সম্ভব ছিল, হয়েছেও। আর যখন সম্ভব হয়নি তখন থেকে ফায়সালওয়ালা শূরা চলছে। এখন আপনি বলুন, বিশ বছর আগের চেয়ে হালাত এখন কি আরো ভালো হয়েছে না খারাপ? খারাপ। তাবলীগের মধ্যে যোগ্য মানুষের সংখ্যা কি বিশ বছর আগে বেশি ছিল, না এখন? নিশ্চয়ই আগে বেশি ছিল। তখন তো যাঁরা শূরার সদস্য ছিলেন তাঁদের একেক জনই বিশাল বিশাল ব্যক্তি। প্রশ্ন হল, বিশ বছর আগে একজনকে আমীর বানানো সম্ভব হয়নি; সেজন্য ফায়সালওয়ালা শূরা অবলম্বন করা হয়েছিল। আর এখন যোগ্য মানুষের সংখ্যা কি এতই বেড়ে গেছে যে, ফায়সালওয়ালা শূরা হারাম হয়ে গেছে?! হায়! এগুলোও কেন বোঝাতে হবে? এসব তো স্পষ্ট কথা।

এরপরও আমাদের আপত্তি নেই, যদি আমীরের সিফাতওয়ালা ব্যক্তি পাওয়া যায় আর যিম্মাদারগণ তাকে মশওয়ারার মাধ্যমে আমীর বানিয়ে নেন। সেটা ভালো, খুব ভালো। কিন্তু এটা কেমন কথা যে, ইমারতের পদ্ধতি ভালো, তাই বলে মশওয়ারা ছাড়াই কেউ নিজে নিজে আমীর হয়ে যাবে?! এটা তো হতে পারে না। শরীয়তে এর কোনো বৈধতা নেই।

হযরত মাওলানা এনামুল হাসান রাহ.-এর ইন্তিকালের পর মজলিসে শূরা বসেছিল। কিন্তু কাউকে আমীর বানানো সম্ভব হয়নি। ফলে ফায়সালওয়ালা শূরা গঠন করা হয়েছিল। এ ফায়সালরা একজন একজন করে চলে যাচ্ছেন। সহজ বুদ্ধি ছিল আবার মজলিস বসানো, ফায়সাল বাড়ানো। কিন্তু মজলিসও বসানো হয়নি, ফায়সালও বাড়ানো হয়নি। ঠিক আছে, হযরত মাওলানা যোবায়েরুল হাসান রাহ. যতদিন ছিলেন তবু তো দুজন ছিলেন। কিন্তু তাঁর ইন্তিকালের পর এখন তো মজলিস বসানো জরুরি হয়ে গেছে কিন্তু বসানো হয়নি।

খুব সহজ ছিল মাওলানা সা‘দ সাহেবের জন্য মজলিস বসানো। তিনি মজলিস ডাকতে পারতেন। রায়বেন্ড, কাকরাইলসহ বড় বড় মারকায থেকে পুরনোদের ডাকতে পারতেন। এতদিন তো ফায়সালওয়ালা শূরা ছিল। ফায়সালগণ একজন একজন করে চলে গেছেন। আমি একা পড়ে গেছি। এখন কী পদ্ধতি অবলম্বন করা হবে- আপনারা মশওয়ারা দিন। পঁচানব্বইয়ের আগে যে পদ্ধতি ছিল আমরা কি আবার সে পদ্ধতির দিকে ফিরে যাব, না এ বিশ বছর যে পদ্ধতি ছিল সে পদ্ধতিই বহাল থাকবে? এ পদ্ধতিই যদি থাকে তাহলে আরো ফায়সাল দরকার। আর যদি আগের তরিকায় ফিরে যাই তাহলে যিম্মাদার কে হবে?

মোটকথা, হযরত মাওলানা যোবায়েরুল হাসান রাহ.-এর ইন্তিকালের পর মশওয়ারা করার দরকার ছিল। কিন্তু মাওলানা সা‘দ সাহেব মশওয়ারা করেননি। বরং এককভাবে ফায়সালা করে যাচ্ছেন। এটা অন্যায় হয়েছে। কারণ ১৯৯৫-এ হযরতজীর শূরা তাকে আমীর বানানো দূরের কথা, একক ফায়সালও বানায়নি; বরং তিনজনের একজন বানিয়েছে। সুতরাং মাওলানা যুবায়েরুল হাসান রাহ.-এর ইন্তিকালের পর যখন তিনি একা হয়ে গেলেন তখন এ কথা বলা যে, ‘তিনি ওই শূরার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এখন একমাত্র ফায়সাল’- তা আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সে শূরা তো তাকে একাধিক ফায়সালের একজন হিসাবে গ্রহণ করেছিল। এতে এ কথা কখনো সাব্যস্ত হয় না যে, তারা তাকে একমাত্র ফায়সাল হিসাবেও মেনে নিতেন। আমীরের প্রসঙ্গ তো আরো দূরে থাকল।

তাদের অনেকে বলে, ২০১৭ ঈ. সালে টঙ্গিতে মাওলানা সা‘দ সাহেব মশওয়ারার মাধ্যমে আমীর নির্বাচিত হয়েছেন। আশ্চর্য কথা! দাবি করা হচ্ছে, মাওলানা সা‘দ সাহেব ২০১৪ ঈ. সালে হযরত মাওলানা যোবায়েরুল হাসান রাহ.-এর ইন্তিকালের পর থেকে আমীর; আর দলীল দেয়া হচ্ছে, ২০১৭ সালের টঙ্গির এক মজলিস দিয়ে!! উপরন্তু সে মজলিসে স্থানীয় মুরব্বী মাওলানা যুবায়ের ছাহেবই ছিলেন না; বিশ্বের বড় বড় পুরনো মুরুব্বীরা ছিলেন না। আপনিই বলুন, এমন মজলিস দিয়ে সা‘দ সাহেব আমীর হয়ে যাবেন- এসব কি কথা? এগুলো কি মাসআলা?

তাছাড়া ২০১৭ ঈ.-এর ইজতিমায় তাকে আমীর বানানোর যে কথাটা প্রচার করা হয়ে থাকে, তার হাকীকত যারা জানে তাদের কাছে বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, এখানে মূলত মশওয়ারার উসূল মোতাবেক  কোনো মশওয়ারা এবং ফায়সালা হয়ইনি। সে প্রসঙ্গে অন্য কোনো ফুরসতে বিস্তারিত বলব- ইনশাআল্লাহ।

আশা করি, কথা মোটামুটি সাফ হয়েছে যে, মাওলানা সা‘দ সাহেব তরিকা মত আমীর হননি। ‘আহলুল হল ওয়াল আকদ’ যারা তারাও তাকে আমীর বানাননি। ‘বিশ্ব আমীর’ বলতে হলে বিশে^র যারা দাওয়াত ও তাবলীগের কর্ণধার, যারা তাবলীগের মূল ব্যক্তি, তাদের সমন্বয়ে মজলিস হয়ে মশওয়ারার মাধ্যমে আমীর হতে হবে। কিন্তু মাওলানা সা‘দ সাহেবের  ক্ষেত্রে তা হয়নি।

এখন তারা মাসআলা বানিয়েছে যে, তিনজন ফায়সাল ছিলেন। দুজনের ইন্তিকালের পর যিনি জীবিত আছেন তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমীর হয়ে গেছেন। এটা বিদআতি মাসআলা। শরীয়তে এ মাসআলার কোনো দলীল নেই। এটা সম্পূর্ণ তাদের বানানো। আবার কখনো বলে, ‘তখন যে তিনজন ফায়সাল ছিলেন তিন জনই আমীর ছিলেন। দুই আমীরের ইন্তিকালের পর এখন একজন আমীর আছেন।’ শরীয়তে একসঙ্গে একাধিক আমীরের কোনো ভিত্তি নেই। আশ্চর্য, তারাই বলে, আমীর একজন, আবার তারাই বলে, তখন তিন আমীর ছিল!

কথা লম্বা হয়ে গেল। তাই সারকথা সংক্ষেপে বলে দিচ্ছি।

প্রথম কথা : কোনো দ্বীনী তানযীম বা তাহরীক, কোনো ঘর বা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে তা ‘ইমারতের তরিকাতেই পরিচালিত হতে হবে, ফায়সালওয়ালা শূরার তরিকায় পরিচালিত হওয়া নাজায়েয’- এমন কোনো মাসআলা আমাদের জানামতে শরীয়তে নেই। যদি কেউ বলে, ‘আছে’, তাকে অবশ্যই কুরআন-সুন্নাহ ও ইজমায়ে উম্মত থেকে দলীল দেখাতে হবে। কিংবা কমপক্ষে কোনো মুজতাহিদ ইমামের বক্তব্য দেখাতে হবে।

আমাদের জানামতে উভয় পদ্ধতিই মুবাহ। এক মুবাহ পদ্ধতি, যেটা উত্তম, সেটার ওপর আগের তিন হযরতের যামানায় আমল হয়েছিল। তৃতীয় হযরত (মাওলানা এনামুল হাসান রাহ.)-এর ইন্তিকালের পর এ পদ্ধতির ওপর আমল করার কোনো সুযোগ হয়ে ওঠেনি। মশওয়ারা মজলিসে সুনির্দিষ্ট একজনকে আমীর বানানো সম্ভব হয়নি। তাই মশওয়ারার ভিত্তিতেই ফায়সালওয়ালা শূরার তরিকা অবলম্বন করা হয়েছে। এ মুবাহ তরিকার ওপর বিশ বছর যাবৎ আমল হয়েছে; কেউ কোনো আপত্তি করেনি। এখন হঠাৎ করে তা নাজায়েয হয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই।

দ্বিতীয় কথা :  কোনো দ্বীনী তানযীম বা তাহরীক আমীরের পদ্ধতিতে পরিচালিত হলে আমীর নির্ধারণ ও নির্বাচনের ক্ষেত্রে শরীয়তের যে নীতি সে নীতি অবলম্বন করতে হবে। সে নীতির তোয়াক্কা না করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কারো আমীর হয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।  দুই ফায়সালের ইন্তিকালের পর তৃতীয় ফায়সাল যিনি জীবিত আছেন তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমীর হয়ে যাবেন এটা ভুল মাসআলা ও বিদআতি মাসআলা। শরীয়তে এর কোনো ভিত্তি নেই। বরং মশওয়ারার মাধ্যমে আমীর নির্ধারণ করতে হবে। দুঃখের বিষয়, মাওলানা সা‘দ সাহেব ও তার অনুসারীরা এ নীতির প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ করেননি।

তৃতীয় কথা : ধরে নিলাম, মাওলানা সা‘দ সাহেব নিযামুদ্দীন মারকাযের আমীর; কিন্তু এখানে আপনার আমীর কে? আপনার হালকার আমীর, আপনার মহল্লার আমীর এবং আপনার চিল্লার আমীর- তারা হলেন আপনার মূল আমীর। আর উলামায়ে কেরাম তো সবক্ষেত্রেই শরয়ী আমীর। আপনার এলাকার আলেমদের কথা বলছি। তারা শরয়ী বিষয়ে আমীর; প্রশাসনিক আমীর নয়। কারণ মাসআলার বিষয়ে তারা যিম্মাদার।

এখন আপনার এলাকার আহলে হক উলামায়ে কেরাম, যাদের থেকে আপনি মাসআলা-মাসায়েল শেখেন, যাদের কথা শুনেই আপনি আমল করেন, সে আলেমগণ যদি বলেন, ‘আপনার এ পদ্ধতি ভুল’, তাহলে কি আপনি এ আলেমদের কথা শুনবেন, না দিল্লীর হুজুরের কথা? এটার কী মাসআলা বলুন দেখি?

* তখন তো ওরা বলে, এরা তাবলীগ থেকে ছুটে গেছে। আমীরকে যারা মানবে না তারা তাবলীগের কেউ না!

** তাবলীগের ওপর কি কারো ঠিকাদারি আছে? মনে রাখবেন, কোনো ব্যক্তি বিশেষের কাছে তাবলীগের ঠিকাদারি নেই। তাবলীগসহ যে কোনো দ্বীনী কাজের উপর ঠিকাদারি আছে একমাত্র শরীয়তের। এখন শরীয়তের বিধান অনুযায়ী যদি কাউকে বলা হয়, ‘আপনার এ পদক্ষেপটা ভুল’, আর সে বলে, ‘আপনারা আবার কে’, তাহলে কেমন হবে বিষয়টা? শরীয়তের ক্ষেত্রে উলামায়ে কেরামই তো যিম্মাদার। এখানে কেউ  ‘আপনারা আবার কে’- এ কথা বলতে পারবে না।

* ওরা তো বলে, আলেমরা তাবলীগে সময় লাগান না। তারা তাবলীগের কী বুঝবেন?

** ‘তাবলীগের কী বুঝবেন’ মানে? তাবলীগের বিষয় বুঝতে হলে কি তাবলীগের প্রচলিত এ মেহনতে সময় লাগাতে হবে?

শরীয়ত কি আলেমের নির্দেশনা মানার ক্ষেত্রে হেদায়েত ও উসূল দেয়নি? দিয়েছে। সেখানে কি আছে, কোনো আলেমের কথা মানতে হলে শর্ত হল, যে বিষয়ে ঐ আলেম কথা বলবেন সে বিষয়ে তার সরাসরি সংশ্লিষ্টতা থাকতে হবে? ব্যবসার মাসআলা হলে শুধু ঐ আলেমের কথা মানা যাবে, যিনি ব্যবসা-বাণিজ্যের লোক, যার কোম্পানি-ফ্যাক্টরি আছে!

এটা ঠিক যে, ফতোয়া দিতে হলে যে বিষয়ে ফতোয়া দেওয়া হয় তার বাস্তব অবস্থাও জানতে হবে। কিন্তু এই জন্য কি মুফতীকে ঐ কাজ ও পেশাতে যোগ দিতে হবে? এই কি আশ্চর্য কথা! আদালতের কোনো বিষয়ে ফতোয়া দিতে হলে মুফতীকে বিচারপতিও হতে হবে? সরকারকে ফতোয়া দিতে হলে মুফতীকে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে হবে? তাহলে এ এতাআতীদের বিষয়ে কথা বলতে হলে আগে এতাআতী হতে হবে! কারণ সে তো এতাআতী নয়; এতাআতীদের বিষয়ে সে কী বুঝবে!! তাদের কথার অর্থ তো এমনই দাঁড়াচ্ছে।

তার মানে যে যেটা করে না সে বিষয়ে তার হেদায়েত শোনা যাবে না। এটাই তো দাঁড়াল নীতি! শরীয়তে এ নীতি আছে? শরীয়তের নীতি হল, যে বিষয় সম্পর্কে আপনি জিজ্ঞেস করছেন, কুরআন-সুন্নাহ এবং ইসলামী ফিকহ-ফতোয়ার আলোকে সে বিষয়ে তার জ্ঞান আছে কি না? যদি জ্ঞান থাকে তাহলে ঐ বিষয়ে তার নির্দেশনা মানা জরুরি।

এতাআতীরা যে বিপথগামিতার শিকার তার একটা দলীল এটাও যে, তারা শরীয়তের বিষয়ে নতুন নতুন কথা ও নীতি আবিষ্কার করে। শরীয়তের স্বীকৃত নীতি না মেনে নতুন নতুন নীতি আবিষ্কার করে। এটা কঠিন বিদআত। এটা এতাআতীদের বিপথগামিতার একটা দলীল।

শরীয়তের নীতি হল, যার যে বিষয়ে জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে সে কথা বলবে না এবং ঐ বিষয়ে তার কথা গ্রহণ করা যাবে না। এটা হল শরীয়তের স্বীকৃত নীতি। আর তারা নীতি বানিয়েছে, শুধু জ্ঞান থাকা যথেষ্ট নয় বরং সরাসরি কাজের সঙ্গে জড়িত থাকতে হবে এবং সে কাজের একজন সদস্য হতে হবে। তারপর তার কথা মানা যাবে। এটা হল নতুন নীতি; বিদআতী নীতি। তাদের আবিষ্কার করা নীতি। শরীয়তে এর কোনো অস্তিত্ব নেই।

আর এই কথা তো কত বড় মূর্খতা যে, তাবলীগ তারাই করে, আলেমরা করে না! সুবহানাল্লাহ! শরীয়তে তাবলীগ কাকে বলে তা জানলে হয়ত এমন কথা উচ্চারণও করত না।

তো বলতে চাচ্ছিলাম, দিল্লীর আমীরের এতাআতের আগে তো মাকামী আমীরের এতাআতের প্রসঙ্গ আসে। এখন তারা আরেকটা ছুতা বের করেছে যে, মাওলানা যোবায়ের সাহেব, রবিউল হক সাহেবদেরকে তো নিযামুদ্দীন আমীর বানিয়েছে। এখন আবার নিযামুদ্দীন তাদেরকে বরখাস্ত করে দিয়েছে। এজন্য এখন আর তাদের ফায়সালা চলবে না। তারা এখন আর ফায়সাল না! নিযামুদ্দীন যেহেতু বরখাস্ত করে দিয়েছে এজন্য নাকি সব শেষ! সুবহানাল্লাহিল আযীম! বিষয়টি হল বাংলাদেশ তাবলীগ মারকাযের। তাই বাংলাদেশের উলামায়ে কেরাম ও সাথীরা যেহেতু তাদেরকে যিম্মাদার মানছেন, তাই বাংলাদেশে তারা ফায়সালই থাকবেন। সেখান থেকে বরখাস্ত করলেই বরখাস্ত হয়ে যাবে না। কে না জানে এ বরখাস্ত করা মতলব-নির্ভর। উসূল-নির্ভর নয়।

যদি বলেন, প্রথমে তো নিযামুদ্দীনই তাদেরকে নিয়োগ দিয়েছে, এখন আবার বরখাস্ত করে নিয়েছে, তাহলে প্রশ্ন হল, এ বরখাস্ত দ্বারা কী হবে? কাজ তো তারা এখানে করছেন। এখানে যারা ইলমী যিম্মাদার এবং কাজের যিম্মাদার তারা সবাই এ হযরতদেরকে ফায়সাল ও যিম্মাদার মানছেন। ব্যস! এটাই যথেষ্ট। নিযামুদ্দীন থেকে বরখাস্ত করলেই বা কি। নিযামুদ্দীনের পক্ষ থেকে ফায়সাল না- ঠিক আছে; কিন্তু এ দেশে কাজ করতে হলে কি তাদের পক্ষ থেকে ফায়সাল হতে হবে? এ মাসআলা কোথায় আছে? আমরা এ দেশের সবাই তাদেরকে ফায়সাল হিসেবে গ্রহণ করলাম; তারা আমাদের তত্ত্বাবধান করবেন- এতে আপত্তি কিসের? তাছাড়া নিযামুদ্দীনের বরাতে আপত্তি করতে চাইলে বর্তমান নিযামুদ্দীনকে মূল নিযামুদ্দীনের উসূলের উপর আসতে হবে।

কুরআন-সুন্নাহর আলোকে কেউ কি এ কথা বলতে পারে যে, এখানকার উলামায়ে কেরাম ও মূল সাথীরা যদিও মাওলানা যুবায়ের সাহেব ও রবিউল হক সাহেবদেরকে ফায়সাল ও যিম্মাদার হিসেবে গ্রহণ করেছেন, কিন্তু সা‘দ সাহেব বরখাস্ত করার কারণে তাদেরকে আর ফায়সাল ও যিম্মাদার হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না? কোনো দারুল ইফতা দিতে পারবে এই ফতোয়া?

যা হোক, কথা মোটামুটি সাফ হয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে বুঝার তাওফীক দান করেন।

* আরো কিছু প্রশ্ন ছিল।

** আগামী মজলিসে- ইনশাআল্লাহ।

 

 

[আল্লাহর ওয়াস্তে মিথ্যাচার থেকে বিরত থাকুন]

 * তবে নগদেই একটা বিষয় জানা দরকার। গত ২২ জুলাই ২০১৯ ঈসায়ী তারিখে আপনার দিকে নিসবত করে ১৫ মিনিট ১১ সেকেন্ডের একটি অডিও বয়ান ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়। বয়ানের শিরোনাম হল- ‘মাওলানা সাদ সাহেব বিষয়ে মুফতী আবদুল মালেক সাহেবের রুজু’। তো এর হাকীকত কী- যদি একটু খুলে বলতেন?

** ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন!

আসলে যারা এই মিথ্যাচার করেছে তাদের কাছেই আপনি এর হাকীকত জিজ্ঞাসা করুন। তবে আমার দিকে গলদভাবে নিসবত করে যে অডিওটি সম্প্রচার করা হয়েছে- এটা যে উদ্দেশ্য প্রণোদিত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মজার কথা হল- আমার নামে বিকৃত করে যে অডিওটি বানানো হয়েছে আমি তা পুরোটা শুনেছি। সেখানে রুজুমূলক কোনো বক্তব্যই আপনি খুঁজে পাবেন না। মানে, জাল করেও সুবিধা করতে পারেনি।

গত ৫ নভেম্বর ২০১৮ ঈসায়ী তারিখে বাইতুল জান্নাত মোল্লা জামে মসজিদ মিরপুর-১২, ঢাকা-এ মাওলানা সা‘দ সাহেবের শুযূয ও চিন্তাগত বিপথগামিতা বিষয়ে একটি মজলিস অনুষ্ঠিত হয়। সেই মজলিসে শুধু এই অধমেরই বয়ান হয়েছিল। https://www.youtube.com/watch?v=dvaXTRdFC_0  এই লিংক থেকে তা শুনে নিতে পারেন।

তো সেই বয়ানে আমি প্রথমে ভূমিকাস্বরূপ কিছু কথা বলেছিলাম। সেখানে বলেছি- উম্মত বিভক্ত হয়ে যাওয়া একটি অপরাধ। তারপর সেই বিভক্তির পর হকের ভিত্তিতে এক না হওয়া আরেকটি অপরাধ। এই দুই অপরাধের পর আমরা যেন তৃতীয় অপরাধ না করে বসি। অর্থাৎ যবান ও কলম নিয়ন্ত্রণে রাখি। হাতকে নিয়ন্ত্রণে রাখি। মুমিনের যবান, কান, হাত, কলম প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণহীন হতে পারে না।

নসীহতমূলক এ কথাগুলো প্রথমে আমি একটু বিস্তারিত করে বলেছি। বয়ানটি শুনলে আপনি বুঝতে পারবেন। আফসোস, সেই ভাইয়েরা এ উপদেশ গ্রহণ করার পরিবর্তে উল্টো হকের বিরুদ্ধেই তাদের মেধা-প্রতিভা ক্ষয় করছে এবং নিজের ঈমান-আমলকে বরবাদ করছে।

সেই বয়ানে আমি আরো বলেছি- সব ভুল একরকম নয়। কোনো কোনো ভুল হয় ছোট ভুল। কোনোটা হয় বড়। কোনো ভুল হয় অনিচ্ছায়। কোনোটা হয় স্বেচ্ছায়। কোনো ভুল হয় আমলী। কোনো ভুল হয় ফিকরী। তো সব ভুল একরকমও নয়, এক স্তরেরও নয়।

হযরত মাওলানা সা‘দ সাহেবের ভুল কোনো ছোট-খাটো ভুল নয়; বড় ধরনের ভুল। উছূলী ভুল, চিন্তাগত ভুল এবং বিদআতী পর্যায়ের ভুল। তাই এর পরিণতিও বহুত খতরনাক। এজন্য উলামায়ে কেরাম এ বিষয়ে এত মজবুত অবস্থান গ্রহণ করেছেন। কেননা এটা দ্বীনী বিষয়। আকীদার বিষয়। শরীয়তের বিধানের বিষয়। উলামায়ে কেরাম এ পরিস্থিতিতে খামোশ থাকতে পারেন না।

অনেকেই যেহেতু তার ভুলগুলো সম্পর্কে জানতে চান তাই তার ভুলের স্বরূপ ও হাকীকত নিয়ে আমি আলোচনা করেছি এবং একটি একটি করে কয়েক প্রকারের কয়েকটি ভুল খুলে খুলে বর্ণনা করেছি। আমার উপস্থাপনভঙ্গি এরকম ছিল যে, প্রথমে আমি প্রশ্ন উত্থাপিত করি-

অনেক ভাই বুঝতে চান- মাওলানা সা‘দ সাহেব এমন কী ভুল করে বসেছেন যে, এখন তাকে মানা যাবে না? ভুল কারই বা না হয়। কতজনেরই তো ভুল হয়। আর তিনি তো ভুল থেকে রুজুও করেছেন। তারপরও এত কথা কেন? কী এত বড় অপরাধ হয়ে গেল যে, উনার বিরুদ্ধে এতকিছু বলতে হচ্ছে?

তো এভাবে আমি প্রশ্নটা উত্থাপন করে পরে বিস্তারিতভাবে উদাহরণসহ এটা খোলাসা করেছি। কিন্তু সেই বন্ধুরা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে আমার সেই বক্তব্যকে বিকৃত করেছে এবং শুধু প্রশ্নটা উল্লেখ করেছে। উত্তর আর উল্লেখ করেনি। তারপর বয়ানের শেষে যে নছীহতমূলক বক্তব্যের মাধ্যমে ইতি টেনেছি, অর্থাৎ সেই শুরুর কথা- আমরা যেন তৃতীয় অপরাধ না করে বসি, হাত ও যবানের হেফাযত করি। সেই শেষের কিছু কথা এখানে যুক্ত করে দিয়েছে।

হায়! যবান হেফাযতের যে নছীহতটি নিয়ে তারা বিকৃতি করেছে, এতে যদি তারা অন্তত আল্লাহকে ভয় করত!

আর প্রশ্নটাও যে উল্লেখ করেছে তাতেও দাজ্ল ও ধোঁকাবাজি রয়েছে। আমি বলেছি- ‘একটা বিষয় আমাদের অনেক ভাই বুঝতে চান, সেটা হল, হযরত মাওলানা সা‘দ সাহেব দামাত বারাকাতুহুম, হযরতের এমন কী অপরাধ হয়ে গেল...’। এভাবে বলে তারপর প্রশ্ন তুলে ধরেছি। কিন্তু আমি যে বলেছি- ‘অনেক ভাই বুঝতে চান’ একথা তারা বাদ দিয়ে দিয়েছে। (মূল বয়ান ও ওদের প্রচারিত কাটছাটকৃত বয়ান মিলিয়ে শুনলে স্পষ্ট বুঝতে পারবেন।) ফলে কর্তিত বক্তব্য থেকে মনে হচ্ছে- আমি বলছি- মাওলানা সা‘দ সাহেব এমন কী অপরাধ করে বসেছেন যে, তার বিরোধিতা করা লাগবে! ভাবটা যেন এমন- সা‘দ সাহেবের ভুল তেমন কোনো ভুল নয়। তাই সেটার মোকাবেলা করাও দরকার নেই। লা হাউলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আযীম। অথচ এ জালিয়াতি না করলে শ্রোতা সঠিক অর্থটিই বুঝত। অর্থাৎ মাওলানা সা‘দ সাহেবের ভুলগুলো খতরনাক কিসিমের ভুল। এজন্য উলামায়ে কেরাম এত পেরেশান। তাই আজ সেগুলো নিয়ে আলোচনা করতে হচ্ছে।

তো মাওলানা সা‘দ সাহেবের যে ভ্রান্তিগুলো আমি উল্লেখ করেছি, একদিকে তারা তা বিলকুল উল্লেখই করেনি। দ্বিতীয়ত মাওলানা সা‘দ সাহেবের বিভ্রান্তিগুলো আলোচনার পূর্বে ভূমিকাস্বরূপ যে কথাগুলো বলেছি, সেটাও কাটছাট করে জোড়াতালি দিয়ে উল্লেখ করেছে।

বলুন, শুধু প্রশ্ন উল্লেখ করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা আর জবাব বাদ দিয়ে তা প্রচার করে দেওয়া কোন্ ধরনের রুচি?

* তাহলে তারা অপনার বয়ান কাটপিস করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার ষড়যন্ত্র করছে?!

** কাটপিস বা কাটছাট কিংবা বিকৃতি যাই বলেন- এটা যে কুরুচিপূর্ণ কাজ তা তো বলাই বাহুল্য। তাদের নিকট যদি তাদের অবস্থান সঠিক মনে হয় এবং উলামায়ে কেরামের অবস্থান গলত মনে হয় তাহলে তাদেরকে বলব, আপনারা আপনাদের শুদ্ধতা দলীলের মাধ্যমে প্রমাণ করুন। মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা কত খারাপ কথা! দ্বীনের নামে এ কেমন বদদ্বীনী!!

আমি তো আগেই বলে এসেছি যে, এ ধরনের কাটছাটের কাজ বিদআতীরা করে। এতাআতী ভাইয়েরা যে বিদআত ও গোমরাহীর শিকার- এর একটা দলীল এটাও যে তাদেরকে নিজেদের সহীহ সাব্যস্ত করার জন্য মিথ্যাচার করতে হচ্ছে। অবশ্য বাতিল ও না হক বিষয় সাব্যস্ত করার জন্য এ ধরনের না হক পন্থা অবলম্বন ব্যতীত কোনো উপায়ও থাকে না। তবে এরকম মিথ্যাচার যে এবারই প্রথম তা নয়।

যাইহোক, আমাদের কর্তব্য হচ্ছে, এরকম মিথ্যা প্রোপাগান্ডায় প্রভাবিত ও বিভ্রান্ত না হয়ে হকের সাথে থাকা। আহলে হক উলামায়ে কেরাম যেভাবে রাহনুমায়ী করেন সেমতে চলা। আল্লাহ তাআলাই একমাত্র তাওফীকদাতা। وهو الهادي إلى سواء السبيل

মনে রাখবেন, মাওলানা সা‘দ সাহেবের ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের যে অবস্থান তা একমাত্র দ্বীনের খাতিরে। উনার বড় বড় উসূলী ভুল, ভ্রান্তি-বিচ্ছিন্নতা ও চিন্তাগত বিপথগামিতার কারণেই সে অবস্থান গ্রহণ করা হয়েছে। তাই যতক্ষণ না মাওলানা সা‘দ সাহেব এ সবকিছুর ইসলাহ করে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের তরীকায় ফিরে আসেন ততক্ষণ ঐ অবস্থান আপন জায়গায় বহাল থাকবে। এটা কোনো বৈষয়িক দ্বন্দ্ব নয় যে, কোনো পার্থিব কারণে কিংবা বিনা কারণে তা নিরসন হয়ে যেতে পারে। জানা কথা, অনেকবার রুজুর পরও মাওলানা সা‘দ সাহেব এখনও আগের মতোই বিচ্ছিন্নতা ও চিন্তাগত বিপথগামিতায় বহাল আছেন। আর উনার অনেক অনুসারীরা তো নাউযুবিল্লাহ কয়েক ধাপ এগিয়ে। আল্লাহ রক্ষা করুন- আমীন।

سبحانك اللهم وبحمدك أشهد أن لا إله إلا أنت أستغفرك وأتوب إليك.

প্রস্তুতকরণ : মাহমুদ বিন ইমরান ও মুহাম্মাদ আশিক বিল্লাহ তানভীর

 

 

advertisement