যিলকদ ১৪৪০   ||   জুলাই ২০১৯

রুয়াত ও শাহাদাতই যেহেতু ভিত্তি, এমন ঘটতেই পারে, প্রসঙ্গ : ঈদুল ফিতর ১৪৪০ হি.

* আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।

** ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।

প্রশ্ন : শাবান ১৪৪০ হিজরীর চাঁদ নিয়ে বেশ বিতর্ক হয়েছিল। সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনে বিভিন্ন ধরনের খটকা ছিল। সেগুলো নিয়ে আপনার শরণাপন্ন হয়েছিলাম। আলহামদু লিল্লাহ আপনার ‘তাশাফফী বখশ’ উত্তরে পাঠক মহলে বেশ স্বস্তি এসেছে। পাঠক মহলের পক্ষ থেকে আপনার শুকরিয়া আদায় করছি।  এবারের ঈদের চাঁদ নিয়েও কিছু বিতর্ক উঠেছে। কিছু মানুষ সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা ছড়িয়েছে। তাই এ বিষয়টি নিয়ে আবারো আপনার শরণাপন্ন হলাম। অনুমতি হলে এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা ছিল।

উত্তর : আচ্ছা বলুন।

প্রশ্ন : ২৯ রমযান সন্ধ্যায় তো অধিকাংশ এলাকায় আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। চাঁদ দেখা কমিটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে। রাত প্রায় ৯ টার সময় চাঁদ দেখা যায়নি বলে ঘোষণা দিয়েছে । এরপর হঠাৎ করে রাত ১১ টার সময় ঘোষণা দেয় চাঁদ দেখা গিয়েছে। কিছু কিছু মানুষ তো এটা নিয়ে হাসছে, কেউ কেউ তো বলছে- তাহলে কি রাত ১১ টার সময় চাঁদ উঠল!  শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টা কি একটু বিশ্লেষণ করবেন?

উত্তর :  আসলে চান্দ্রমাস শুরু হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে শাহাদাতে হেলাল অর্থাৎ নতুন চাঁদ দেখার সংবাদ বা সাক্ষ্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে প্রমাণিত হওয়ার উপর। কখনো দ্রæত সাক্ষ্য পাওয়া যায় তখন দ্রæত  ফয়সালা করা যায়। আবার কখনো সাক্ষ্য পৌঁছতে দেরি হয়, সাক্ষ্য যাচাই-বাছাই করতে সময় লাগে তখন ফয়সালা দেরিতে হয়। আবার কখনো ঠিক সময়ে সাক্ষ্য না পাওয়ার কারণে তারাবী পড়া হয়ে থাকে বা সেহরি করে ৩০তম রোযা শুরু করা হয়ে থাকে, এরপর চাঁদ প্রমাণিত হয়। শরয়ী পন্থায় যথাযথভাবে নতুন চাঁদ প্রমাণিত হলে তা গ্রহণ করা জরুরি, যদিও তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছতে বিলম্বই হোক না কেন। ইতিহাসে এ সবকিছুরই নজীর আছে।

প্রশ্ন : উদাহরণস্বরূপ দু-একটা বলবেন কি?

উত্তর :  ইতিহাসের বিভিন্ন কিতাবে বিভিন্ন প্রসঙ্গে  এগুলোর আলোচনা আসে। ইতিহাসের কিতাবাদিতে যাদের নযর আছে তাদের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট। হাফেজ ইবনে হাজার রাহ. তাঁর ইম্বাউল গুমর বি আবনাইল উমর-এ নবম হিজরী শতাব্দীর প্রথমার্ধের অনেক বছরের হিলাল বিষয়ক তথ্য পেশ করেছেন। সেখানে এসবের নজীর পাওয়া যায়। ইবনে জুবায়ের রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তার হজ্ব সফরনামাতে এক বছরেরও বেশি সময়ের হিলাল বিষয়ক তথ্য দিয়েছেন সেখানেও কিছু নমুনা পাওয়া যায়।

দূরে যাওয়ার দরকার কী!  হাদীস শরীফের যখীরাতেও তো এর উদাহরণ আছে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশায়ই এ ধরনের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। যেমন,

عَنْ رِبْعِيِّ بْنِ حِرَاشٍ، عَنْ بَعْضِ أَصْحَابِ رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ قَالَ: أَصْبَحَ النّاسُ صِيَامًا لِتَمَامِ ثَلَاثِينَ، قَالَ: فَجَاءَ أَعْرَابِيّانِ، فَشَهِدَا أَنّهُمَا أَهَلّا الْهِلَالَ بِالْأَمْسِ، فَأَمَرَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ النّاسَ فَأَفْطَرُوا.

রমযানের ত্রিশতম দিন সকালে সবাই রোযা অবস্থায় ছিল। ইত্যবসরে দুজন বেদুঈন এসে সাক্ষ্য দিল যে, তারা গতকাল সন্ধ্যায় চাঁদ দেখেছে। সেমতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবাইকে রোযা ভাঙ্গার আদেশ করলেন (ও ঈদ পালন করলেন)। -মুসনাদে আহমাদ ৫/৩৬২, ৩৬৩, হাদীস ২৩০৬৯

عَنْ رِبْعِيِّ بْنِ حِرَاشٍ، عَنْ رَجُلٍ، مِنْ أَصْحَابِ النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ قَالَ: اخْتَلَفَ النّاسُ فِي آخِرِ يَوْمٍ مِنْ رَمَضَانَ، فَقَدِمَ أَعْرَابِيّانِ، فَشَهِدَا عِنْدَ النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِاللهِ لَأَهَلّا الْهِلَالَ أَمْسِ عَشِيّةً، فَأَمَرَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ النّاسَ أَنْ يُفْطِرُوا، زَادَ خَلَفٌ فِي حَدِيثِهِ،: وَأَنْ يَغْدُوا إِلَى مُصَلّاهُمْ.

রমযানের শেষ দিনে মানুষের মাঝে অস্থিরতা বিরাজ করছিল যে, আজ কি ৩০ তম রমযান, নাকি পয়লা শাওয়াল (তারা সবাই রোযা অবস্থায়ই ছিলেন)। এমন সময় দু’জন বেদুঈন এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে সাক্ষ্য দিল যে, আল্লাহর কসম! তারা গতকাল সন্ধ্যায় হেলাল দেখেছে। সেমতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবাইকে রোযা ভেঙ্গে (ঐ দিনই) ঈদগাহে যাওয়ার আদেশ করলেন। -সুনানে আবু দাউদ খ. ৪, পৃ. ২৭, হাদীস ২৩৩৯

عَنْ أَبِي عُمَيْرِ بْنِ أَنَسٍ، عَنْ عُمُومَةٍ لَهُ مِنْ أَصْحَابِ رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ، أَنّ رَكْبًا جَاؤوا إِلَى النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَشْهَدُونَ أَنّهُمْ رَأَوُا الْهِلَالَ بِالْأَمْسِ، فَأَمَرَهُمْ أَنْ يُفْطِرُوا، وَإِذَا أَصْبَحُوا أَنْ يَغْدُوا إِلَى مُصَلّاهُمْ.

আবু উমাইর বিন আনাস বিন মালিক রাহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবী আমার এক চাচা আমার কাছে বর্ণনা করেন, মেঘের কারণে আমরা শাওয়ালের নতুন চাঁদ দেখতে পাইনি। আমরা (পরের দিন) রোযা রাখি। দিনের শেষভাগে একটি কাফেলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে গতকাল চাঁদ দেখার সাক্ষ্য দিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকদের রোযা ভঙ্গ করার ও পরের দিন ঈদগাহে যাওয়ার নির্দেশ দেন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১১৫৭; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ১৫৫৭; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৯৫৫১; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৭৩৩৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৬৫৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২০৫৮৪

প্রশ্ন :  আসলে এ বিষয়ে হানাফী মাযহাবের ফয়সালা কী? কেউ কেউ তো বলছিল ফতোয়ার কিতাবে নাকি শাহাদাত দেরীতে আসলে তা গ্রহণ না করার কথা আছে!

উত্তর : একথা যেই বলে থাকুক বিলকুল গলত বলেছে। শুধু হানাফী মাযহাব না, নির্ভরযোগ্য সকল ফিকহী মাযহাবের সিদ্ধান্ত এটাই যে, শাহাদাত দেরীতে পাওয়া গেলেও তার মধ্যে যদি প্রয়োজনীয় শর্তাবলি বিদ্যমান থাকে তাহলে তা কবুল করা জরুরি। হানাফী মাযহাবের বিশিষ্ট ইমাম, ইমাম আবু হানিফা রাহ.-এর খাছ শাগরিদ, মাযহাবের সমস্ত মৌলিক কিতাবের সংকলক ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান আশশাইবানী রাহ. তার কিতাব ‘কিতাবুল হুজ্জাহ আলা আহলিল মাদীনাহ’-তে সুস্পষ্টভাবে একথা বলেছেন। সরাসরি ইমাম আবু হানীফা রাহ.-এর হাওয়ালায় তিনি মাসআলাটি উল্লেখ করেছেন। দলীল হিসেবে উপরের সর্বশেষ হাদীসখানা পেশ করেছেন। -কিতাবুল হুজ্জাহ খ. ২, পৃ. ৩৭৭, কিতাবুস সিয়াম, باب الرجل يصوم يوم الفطر، وهو يظن أنه من شهر رمضان.

অন্য তিন মাযহাবের কিতাবেও মাসআলাটি এভাবেই আছে। তবে ফতোয়ার কিতাবে একথাটা অবশ্যই আছে যে, দেরীতে আসা ‘সাক্ষী’র মধ্যে যদি প্রয়োজনীয় কোনো শর্ত না পাওয়া যায় বা বিভিন্ন আলামত দ্বারা বুঝা যায় যে, সাক্ষ্যটা সন্দেহযুক্ত তাহলে তা কবুল হবে না। কিন্তু এটা তো সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা মাসআলা। কারণ ত্রæটিযুক্ত বা সন্দেহযুক্ত শাহাদাত ঠিক সময়ে আসলেও তো তা ধর্তব্য নয়।

প্রশ্ন :  ফতোয়ার কোন্ কিতাবে এ মাসআলা আছে?

উত্তর : কয়েক কিতাবেই আছে। ফাতাওয়া কাযীখান-এও আছে। খুলাসাতুল ফাতাওয়ার হাওয়ালায় ফাতাওয়া আলমগীরিতেও আছে (খ. ১, পৃ. ১৯৮)।

প্রশ্ন : অপেক্ষা এবং পূর্বের ঘোষণা পরিবর্তনের আশঙ্কা থাকায় যে পেরেশানী হয়- এটার কী হবে? এবার তো অনেক মানুষ তারাবীও পড়ে নিয়েছিলেন।

উত্তর : আসলে যার কাছে শরীয়তের হুকুম-আহকামের কদর আছে, সে তো এই অপেক্ষায় লুতফ (বিশেষ আনন্দ) অনুভব করে। ঘোষণা পরিবর্তনের সম্ভাবনায়ও সে ঘাবড়ায় না। আপনি মানুষের তারাবীহ পড়ে ফেলার কথা বলছেন! অথচ আমরা যে ঘটনাগুলো উল্লেখ করলাম, তাতে  তো শুধু তারাবীহ না; বরং সেহরী খেয়ে রোযাও শুরু করা হয়েছে, তাতে কী হয়েছে?! তারা কি এর সওয়াব পাবে না! কোন্ আমলের সওয়াব কীভাবে দিতে হয় সেটা তো আল্লাহই ভালো জানেন। হেলাল প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ঐ রাতটি তো শরীয়তের দৃষ্টিতে রমযানের রাত হিসেবে পরিগণিত। তাই তারাবীহ পড়া, এতেকাফকারীগণ মসজিদে অবস্থান করা- সবই তো শরীয়তের হুকুম মোতাবেক হয়েছে। আল্লাহ তাআলা সবাইকে এর আজর দান করবেন। আবার যখন হেলাল প্রমাণিত হয়ে গেল, এখন এটি পহেলা শাওয়ালের রাত। মনে রাখবেন, এখলাসের সাথে সুন্নত অনুযায়ী কেউ আমল করলে আল্লাহ তাআলা তার আমল কখনো বিনষ্ট করেন না।

প্রশ্ন : আচ্ছা ২৯ রমযানের সন্ধ্যায় শাওয়ালের হেলাল বিষয়ে কী হয়েছিল এবং পরবর্তীতে কী ঘটেছিলো- পুরো বিষয়টা কি একটু বিস্তারিত বলবেন?

উত্তর : ২৯ রমযান সন্ধ্যায় বায়তুল মোকাররমস্থ ইসলামিক ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে  চাঁদ দেখা কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। যদ্দুর জানতে পেরেছি, চাঁদ দেখা কমিটির বৈঠকে বিশিষ্ট উলামায়ে কেরাম ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা ছিলেন। কমিটি জেলায় জেলায় খবর নিয়েছে, চাঁদের খবর সংগ্রহের চেষ্টা করেছে, এর পরও সতর্কতামূলকভাবে এক দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করেছে। তারপরও যখন কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি তখন ঘোষণা করেছে।

আমাদের দেশে বেসরকারিভাবেও কিছু চাঁদ দেখা কমিটি আছে। তারাও তাদের নিয়ম অনুযায়ী  চাঁদের সংবাদ সংগ্রহের চেষ্টা করে। সেদিন রাত ৯টা পর্যন্ত অন্য কোনো কমিটির পক্ষ থেকেও চাঁদ দেখার কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি।

জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির ঘোষণার পর দেশের বেশ কিছু এলাকা থেকে বেশ সংখ্যক ব্যক্তির চাঁদ দেখার সংবাদ আসতে থাকে। যেমন-

কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারি, নাগেশ্বরী, লালমনিরহাট জেলার সদর থানা, আদিতমারি, পাটগ্রাম, নীলফামারী জেলার সদর থানা, ঠাকুরগাঁও জেলার সদর থানা, মাদারীপুরের কালকিনি।

আমাদের কাছেও এতেকাফের হালতে বিভিন্ন এলাকা থেকে খবর আসতে থাকে। এসকল সংবাদের প্রেক্ষিতে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি আলেমদের পরামর্শক্রমে দ্বিতীয়বার বৈঠকে বসে। নিয়ম অনুযায়ী যাচাই-বাছাই করে ৫ই জুন রোজ বুধবার ঈদুল ফিতরের ঘোষণা করে।

প্রশ্ন :   ঈদের চাঁদের ক্ষেত্রে তো শুনেছি, শুধু সংবাদ যথেষ্ট নয়। “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি...”-এর এলান ও শাহাদাতের অন্যান্য ফরমালিটিসহ শাহাদাত পাওয়া যাওয়া জরুরি। তো এইদিকে কি জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি লক্ষ্য রেখেছেন?

উত্তর :  লক্ষ্য রাখারই কথা। খোদ আমাকেই তো বলা হল, আপনি মেহেরবানী করে সাক্ষীদেরকে স্থানীয় কমিটির সামনে উপস্থিত হতে বলুন। আমরা অবশ্য তা পূর্বেই বলেছি এবং সেখানকার আলেমগণ সেই ব্যবস্থা নিয়েছেনও। কিন্তু আরেকটা বিষয় হল, যদি হেলাল দেখার বিষয়টি ‘শুহরত ও ইস্তেফাযাহ’-এর পর্যায়ে পৌঁছে যায় তাহলে শাহাদাতের সকল ফরমালিটি পালন না করলেও চলে। ২৯ রমযানের রাত দশটা সাড়ে দশটার দিকে রুয়াতের বিষয়টা আসলে ইসতেফাযাহ-এর পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে অর্থাৎ বিশ্বস্ত ও অবিচ্ছিন্ন সূত্রে অনেক এলাকা থেকে বহু মানুষের হেলাল দেখার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে।

প্রশ্ন :  যারা চাঁদ দেখেছেন তারা তো সন্ধ্যার সময়ে চাঁদ দেখেছেন, তো সে খবর রাত ৯ টার পরে ছড়ায় কেন?

উত্তর : যারা চাঁদ দেখেছেন তাদের কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কেউ কেউ যোগাযোগের নম্বর বা মাধ্যম না পাওয়ায় জানাতে পারেনি। আর অনেকেই ভেবেছেন, আমরা যেমন দেখেছি অন্যরাও তেমনি দেখে থাকবে। কিন্তু রাত ৯টার সময় যখন চাঁদ না দেখা যাওয়ার ঘোষণা আসে, তখন তারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে চারদিকে জানাতে শুরু করে। আমাদের দেশের লোকদের মাঝে চাঁদ দেখা গেলে কীভাবে কী করতে হবে এগুলো ব্যাপকভাবে জানাও নেই, আবার চর্চাও নেই। যার কারণে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে।

প্রশ্ন :  কেউ চাঁদ দেখলে তার কী করা উচিত?

উত্তর : নিজে যখন চাঁদ দেখবে আশপাশের লোকজনকেও তা দেখাবে। নিকটতম স্থানীয় দায়িত্বশীলদেরকে জানাবে বা অন্য যেভাবেই হোক দায়িত্বশীলদের কাছে খবরটা পৌঁছাবে। নিকটতম মাদরাসা-মসজিদের খেদমতে নিয়োজিত আলেমগণের শরণাপন্ন হয়ে তাদের মাধ্যমেও খবরটা পৌঁছাতে পারে। এরপর যদি প্রয়োজন হয় এবং তার সাক্ষ্য তলব করা হয় তখন উপস্থিত হয়ে নিয়ম অনুযায়ী তার সাক্ষ্য পেশ করবে।

প্রশ্ন :  থানা পর্যায়ে বা জেলা পর্যায়ে যারা চাঁদ দেখা কমিটির সাথে যুক্ত, তাদের কাছে যদি চাঁদ দেখার সংবাদ আসে তো তারা কী করবে?

উত্তর :  দ্রæত সংবাদটি কেন্দ্রে পৌঁছাবে। যদি ক্ষেত্রটি ‘শাহাদাত’-এর হয় তাহলে নিয়ম অনুযায়ী সাক্ষ্য গ্রহণ করে তা দাপ্তরিক নিয়মানুযায়ী (সাধারণত এক অফিস থেকে অন্য অফিসে যেভাবে ডকুমেন্ট আদান-প্রদান করা হয় সেভাবে ) কেন্দ্রে পৌঁছাবে।

প্রশ্ন : স্থানীয় কোনো আলেম বা মসজিদের দায়িত্বে থাকা ইমামের কাছে যদি কেউ এসে চাঁদ দেখার সংবাদ দেয় তখন তারা কী করবেন?

উত্তর : যত দ্রæত সম্ভব এ সংবাদ জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি বা তার শাখা কমিটিকে অবহিত করবে।

প্রশ্ন : ২৯ রমযান সন্ধ্যায় যারা চাঁদ দেখেছে তাদের দেখাটা যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে শরীয়তসম্মত কারণে প্রমাণিত না হত তাহলে তাদের কী করতে হত?

উত্তর : এবারের চাঁদ নিয়ে  এ প্রশ্ন হয় না। কারণ এখানে তো এটা প্রত্যাখ্যান করার কোনো শরয়ী কারণ  ছিল না। যদি কখনো এমন হয় যে, কারো দেখাটা যথাযথ দায়িত্বশীল শরীয়তসম্মত কারণে গ্রহণ করেন না, তখন সে সবার সাথে ঈদ করবে। নিজে একা ভিন্নভাবে ঈদ করবে না।

প্রশ্ন :  কিন্তু সেক্ষেত্রে তো আমাদের ঈদুল ফিতর প্রকৃত ঈদুল ফিতর হওয়ার বিষয়টি সন্দেহযুক্ত হয়ে যেত। কারণ, হয়ত তা ২য় শাওয়াল!

উত্তর : এ  বিষয়ে তো আল কাউসার-এর শাওয়াল ১৪৪০হি. সংখ্যায় সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। এ প্রশ্ন তো আপনি তখনো করেছেন। তখন আপনাকে বলা হয়েছিল-

বাস্তবে যদি কোথাও হিলাল দেখা গিয়েও থাকে তথাপি তা শরয়ী তরীকায় যথাযোগ্য কর্তৃপক্ষের সামনে প্রমাণিত না হওয়ার কারণে তা ধর্তব্য না হয়, এর কারণে অন্যদের আমল ক্ষতিগ্রস্ত হবে না; যার দলীল হল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ হাদীস-

الصّوْمُ يَوْمَ تَصُومُونَ، وَالفِطْرُ يَوْمَ تُفْطِرُونَ، وَالأَضْحَى يَوْمَ تُضَحّون.

অর্থাৎ, সিয়াম সেদিন, যেদিন তোমরা রোযা রাখ; ‘ফিতর’ সেদিন, যেদিন তোমরা রোযা ছাড়। আর কুরবানী সেদিন, যেদিন তোমরা কুরবানী কর। এবং আয়েশা রা.-এর এ আছার-

إِنّمَا النّحْرُ إِذَا نَحَرَ الْإِمَامُ، وَعُظْمُ النّاسِ، وَالْفِطْرُ إِذَا أَفْطَرَ الْإِمَامُ، وَعُظْمُ النّاسِ.

অর্থাৎ, কুরবানী(র দিন) তো সেদিন, যেদিন ইমাম (মুসলমানদের রাষ্ট্রপ্রধান) ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কুরবানী করে এবং ফিতর (ঈদুল ফিতর) তো সেদিন, যেদিন ইমাম ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ রোযা ছাড়ে।

এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে দেখুন মাসিক আলকাউসার মে ২০১৪ ঈ., পৃ. ১৩-২০ এবং নভেম্বর ২০১৪ ঈ., পৃ. ১৩-১৯

প্রশ্ন : যদি সাক্ষ্য পাওয়া না যেত এবং রাত নয়টার সিদ্ধান্তই বহাল রাখা হত তাহলে তো আমরা একা হয়ে যেতাম!

উত্তর : এভাবে যদি যদি করে প্রশ্ন করতে থাকলে তো জবাব দেয়া মুশকিল। এ বিষয়ে তো আলকাউসার এর শাওয়াল ১৪৩৯হি. মোতাবেক জুলাই ২০১৮ঈ. সংখ্যায় সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। সেখানে বিষয়টি বিস্তারিত আছে।

আমাদের আমল যদি হাদীস ও  ফিকহ অনুযায়ী হয়ে থাকে, শরীয়তের হুকুম মোতাবেক হয়ে থাকে তাহলে আমরা একা হওয়ায় অসুবিধার কী আছে?!

আসলে কিন্তু আমরা একা হয়ে যেতাম এমন নয়। কারণ, ব্রæনাইতে ঈদুল ফিতর হয়েছে (আমাদের একদিন পর) বৃহস্পতিবার। তাছাড়া আমরা একা এজন্যও হতাম না- কারণ, অধিকাংশ মুসলিম দেশগুলো যা করে আমরাও তাই করি। তারাও স্থানীয় হেলাল দেখা হিসাবে আমল করে আমরাও স্থানীয় হেলাল দেখা হিসাবে আমল করি।

আসলে মনকে শরীয়তের বিধানের অনুগামী বানাতে হবে। দেখার বিষয় হল, আমাদের এ কাজ শরীয়তের মাসআলা মোতাবেক সঠিক হয়েছে কি না। হয়ে থাকলে আপত্তির সুযোগ নেই।

প্রশ্ন : আমাদের দেশে যারা শরয়ী হুকুম লঙ্ঘন করে আগে আগে রোযা-ঈদ করে তারা এবার কী করেছে?

উত্তর : সাদ্রায় খোঁজ নিয়েছিলাম। বললেন, তারা মঙ্গলবার ঈদ করেছেন। আমি বললাম, তাহলে তো পিছিয়ে থাকলেন! আফ্রিকার মালিতে তো সোমবার ঈদ হয়েছে।

প্রশ্ন : এবারের শাওয়ালের চাঁদ দেখা নিয়ে যা ঘটল তা  এড়ানোর উপায় আছে কি না?

উত্তর : এমন কখনই হবে না এটাতো মুশকিল। এ ধারণা ঠিক নয় যে, এ ধরনের অবস্থা শুধুমাত্র ব্যবস্থাপনার ত্রæটির কারণেই হয়। কখনো কখনো এটা বাস্তব ওযরের কারণেও হতে পারে।  এ বছর লিবিয়ায় কী হয়েছে?! ওখানে তো প্রথমে চাঁদ দেখা যায়নি বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কয়েক ঘণ্টা পর চাঁদ দেখার সাক্ষ্য পাওয়া যাওয়ায় পুনরায় আগের ঘোষণার বিপরীতে চাঁদ প্রমাণিত হওয়ার ঘোষণা আসে। এটা তো এই ঈদুল ফিতরেরই ঘটনা। আপনি পত্র-পত্রিকা দেখলে পুরো ডকুমেন্ট পেয়ে যাবেন।

তারপরও এটা জরুরি যে, আমাদের হেলাল কমিটি যেন ব্যবস্থাপনা আরো মজবুত ও সুন্দর করার চেষ্টা করে। যেমন ২৮ তারিখ থেকে পত্র-পত্রিকা ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে যে, যে ব্যক্তি চাঁদ দেখবে সে যেন জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির শাখাকমিটিগুলোতে জানায় বা অন্য যেভাবেই হোক খবরটা যেন সংশ্লিষ্ট  দায়িত্বশীলদের কাছে পৌঁছায়। প্রচারপত্রে সরাসরি কেন্দ্রে খবর পৌঁছানোর জন্যও কিছু ফোন নাম্বার দেয়া থাকবে। গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণার পাশাপাশি মোবাইলে মোবাইলে বার্তা প্রেরণ করেও এই সচেতনতা ব্যাপক করা যায়। তাছাড়া যিনি চাঁদ দেখবেন তিনি নিকটতম মাদরাসা-মসজিদের যিম্মাদারদের শরণাপন্ন হয়ে তাদের মাধ্যমেও খবর পৌঁছাতে পারেন ।

চাঁদ দেখা কমিটির শুধু জেলা পর্যায়ের শাখাই যথেষ্ট নয় বরং থানা পর্যায়ে, ইউনিয়ন পর্যায়েও এর শাখা থাকতে হবে। স্থানীয় মাদরাসা-মসজিদে কর্মরত নির্ভরযোগ্য আহলে হক আলেম ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন বা প্রশাসনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কমিটি গঠিত হবে। ছোট পুস্তিকা আকারে বা স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কমিটির সদস্যদেরকে চাঁদ প্রমাণিত হওয়ার মাসায়েল, শাহাদাতের শর্তাবলী ও নিয়মাবলী জানিয়ে দেয়া থাকবে। এই কমিটিগুলো সার্বক্ষণিকভাবে সাধারণ মুসল্লিদের সাথে সরাসরি সম্পর্ক রাখবে এবং কেন্দ্রের সাথেও এ কমিটিগুলোর সম্পর্ক নিশ্চিত করতে হবে। মোটকথা, কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সকল কমিটিকে আরো সুশৃঙ্খল এবং পারস্পরিক যোগাযোগ আরো মযবুত ও তড়িৎ করতে হবে।

আমরা আশা করব, জাতীয় হিলাল কমিটি এই বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবেন।

* জাযাকুমুল্লাহু খাইরান।

** سبحانك اللهم وبحمدك، أشهد أن لا إله إلا أنت، أستغفرك وأتوب إليك.

সাক্ষাৎকার গ্রহণে- মাওলানা সায়ীদুল হক

 

 

advertisement