যমযম : চিরবহমান পবিত্র ঝর্ণাধারা
যমযম। কী মধুর নাম! কী সুন্দর উচ্চারণ! পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম পানি। এ পানি শুধু পিপাসাকাতর কলিজাকেই শীতল করে না, হৃদয় ও আত্মাকেও এক অপার্থিব প্রাপ্তিতে পরিতৃপ্ত করে। দেহ ও মনকে সজীব করে তোলে। মক্কা নগরীতে আল্লাহর এক মহা নিদর্শন হল যমযম কূপ। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভ‚মিতে আল্লাহ তাআলা এ কূপ উৎসারিত করেছেন।
পরবর্তীতে যমযমকে কেন্দ্র করেই আবাদ হয়েছিল পবিত্র মক্কা নগরী। পানি না থাকায় ইতিপূর্বে এখানে কোনো মানুষ বসবাস করত না। এ ক‚প উৎসারিত হওয়ার পর ইয়ামানের জুরহুম গোত্র খবর পেয়ে এখানে আসে এবং হাজেরা রা.-এর অনুমতি নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। ইসমাঈল আ. বড় হয়ে এ গোত্রেই বিবাহ করেন এবং ধীরে ধীরে পবিত্র মক্কা নগরী গড়ে উঠে। তাই বলা যায়, যমযম কুপই ছিল বর্তমান মক্কা আবাদ হওয়ার প্রধান অবলম্বন।
যমযম চিরবহমান। আজ পর্যন্ত এর পানি কখনো শুকায়নি। হাজার হাজার বছর ধরে কোটি কোটি হাজ্বীর তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের পিপাসা মিটিয়ে আসছে। তারা নিজেরা পান করছেন এবং বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন পৃথিবীর দূর-দূরান্তের জনপদে। ফলে মক্কায় না গিয়েও সারা বিশে^র মুসলিম এ পানির বরকত ও কল্যাণ লাভে ধন্য হচ্ছে।
এ পানির যে গুণ-বৈশিষ্ট্য এবং বরকত ও কল্যাণ হাজার বছর আগে ছিল ঠিক সেই গুণ-বৈশিষ্ট্য ও বরকত আজ হাজার বছর পরও বিদ্যমান। যুগ যুগ ধরে আল্লাহর কুদরতের মহা নিদর্শনরূপে স্থায়ী হয়ে আছে যমযম কূপ।
যমযম : পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পানি
হযরত ইবনে আব্বাস রা. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন-
خَيْرُ مَاءٍ عَلَى وَجْهِ الْأَرْضِ مَاءُ زَمْزَمَ فِيهِ طَعَامٌ مِنَ الطُّعْمِ وَشِفَاءٌ مِنَ السّقْمِ .
যমযম ভূপৃষ্ঠের শ্রেষ্ঠ পানি। এতে রয়েছে খাদ্যের বৈশিষ্ট্য ও রোগ থেকে মুক্তি। -আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ১১১৬৭; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ৫৭১২
যমযম ধারণ করে আছে ত্যাগ ও বিসর্জনের এক ইতিহাস
যমযম ধারণ করে আছে ত্যাগ ও বিসর্জনের এক ইতিহাস। এ পানি যেন পানি নয়; বরং হাজেরা-ইবরাহীম-ইসমাঈলের (আলাইহিমুস সালাম) ত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহর রহমতের ঝর্ণাধারা।
আল্লাহ তাআলার হুকুমে হযরত ইবরাহীম রা. স্বীয় পুত্র ইসমাঈল আ. ও স্ত্রী হাজেরা রা.-কে জনমানবহীন মক্কায় রেখে রওয়ানা হলেন। ইবরাহীম আ. যখন সেখান থেকে চলে আসতে লাগলেন, তখন হাজেরা রা. তাকে বারবার বলতে লাগলেন- এমন জনমানবহীন মরু প্রান্তরে আমাদের একাকী রেখে আপনি চলে যাচ্ছেন?! কিন্তু তিনি কোনো সাড়া দিচ্ছিলেন না। অবশেষে হাজেরা রা. বললেন-
آللهُ الّذِي أَمَرَكَ بِهَذَا؟ قَالَ نَعَمْ، قَالَتْ: إِذَنْ لاَ يُضَيِّعُنَا!
আল্লাহই কী আপনাকে আমাদের এখানে রেখে যেতে বলেছেন? তিনি উত্তরে বললেন, হাঁ। হাজেরা রা. তখন (ঈমানদিপ্ত কণ্ঠে বললেন,) তাহলে আল্লাহ আমাদের ধ্বংস করবেন না।
‘তাহলে আল্লাহ আমাদের ধ্বংস করবেন না।’ এ উত্তরের মাধ্যমে হাজেরা রা. যেন বলতে চাইলেন, এ যখন আল্লাহর হুকুম তখন তা শিরোধার্য। যে কোনো ত্যাগ-বিসর্জনের বিনিময়ে তা আমি শিরোধার্য করছি। আর আল্লাহর হুকুমের সামনে যে নতশির হয় তাকে কি আল্লাহ ভুলে যাবেন? আপনার উপস্থিতি ছাড়াই তিনি আমাদের ভালো রাখবেন, তিনিই হবেন আমাদের সহায়।
ইবরাহীম আ. চলে গেলেন। তার কি মন চাচ্ছিল- এ নির্জন মরুভ‚মিতে স্ত্রী-পুত্র রেখে যেতে? না, তিনিও উৎকণ্ঠিত হচ্ছিলেন। অজানা উৎকণ্ঠা তাকে বিচলিত করে ফিরছিল। তাই তো যখন তিনি তাদের দৃষ্টিসীমার আড়াল হলেন কাবা অভিমুখি হয়ে দুআ করলেন, স্ত্রী-পূত্রকে আল্লাহর হাওয়ালা করলেন; তিনি বললেন-
رَبَّنَاۤ اِنِّیْۤ اَسْكَنْتُ مِنْ ذُرِّیَّتِیْ بِوَادٍ غَیْرِ ذِیْ زَرْعٍ عِنْدَ بَیْتِكَ الْمُحَرَّمِ
হে আমাদের প্রতিপালক! আমি আমার বংশধরের কতককে বসবাস করালাম অনুর্বর উপত্যকায় তোমার গৃহের নিকটে!... -সূরা ইবরাহীম (১৪) : ৩৭
চারিদিকে ধূ ধূ মরুভ‚মি। নির্জন প্রান্তর। কোনো লোকজন নেই। দৃষ্টির শেষ সীমা পর্যন্ত শুধু বালুর ঢেউ। কেমন ভয় ও একাকীত্ব, উৎকণ্ঠা ও অস্থিরতা তখন ছিল হাজেরা রা.-এর মনে- তা কল্পনা করাও সম্ভব নয়। তবুও তিনি সন্তুষ্ট মনে বরণ করে নিয়েছেন সবকিছু। সমর্পিত হয়েছেন আল্লাহর হুকুমের সামনে।
রেখে যাওয়া সামান্য খাদ্য ও পানীয় শেষ হয়ে গেলে দুগ্ধপোষ্য শিশু ইসমাঈল আ. তৃষ্ণায় ছটফট করছিলেন। এমতাবস্থায় হাজেরা রা. পানির সন্ধানে ব্যাকুল হয়ে দৌড়াতে থাকেন। একবার সাফায় যান আবার মারওয়ায়। নাহ! পানির কোনো চিহ্ন নেই, কোনো মানুষও দেখা যাচ্ছে না। আবার সাফায় যান। এভাবে সাফা-মারওয়া পাহাড়দ্বয়ে সাত বার দৌড়াদৌড়ি করেন। এরপরও পানি না পেয়ে অস্থির হয়ে পড়েন। পানির কোনো সন্ধান নেই। কোনো উপায় নেই। এখন আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আল্লাহর রহমতই এখন একমাত্র ভরসা। ঠিক তখনই যমযম রূপে নেমে আসে আল্লাহর রহমত। আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ফেরেশতার পাখার আঘাতে সৃষ্টি হয় এক অলৌকিক কূপ। বের হয়ে আসতে লাগল পানির ফোয়ারা!
হাজেরা রা. তখন পানির ¯্রােতধারা আটকানোর জন্য চারদিকে বাঁধ তৈরি করতে লাগলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
يَرْحَمُ اللهُ أُمّ إِسْمَاعِيلَ، لَوْ تَرَكَتْ زَمْزَمَ - أَوْ قَالَ: لَوْ لَمْ تَغْرِفْ مِنَ المَاءِ -، لَكَانَتْ زَمْزَمُ عَيْنًا مَعِينًا.
আল্লাহ তাআলা উম্মে ইসমাঈলের উপর রহম করুন। তিনি যদি যমযমকে এভাবে ছেড়ে রাখতেন তাহলে তা প্রবহমান ঝর্ণায় পরিণত হত। (দ্র. সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৩৬৪)
যমযম আমাদেরকে ত্যাগ ও বিসর্জনের শিক্ষা দেয়। আল্লাহর হুকুম পালনার্থে পৃথিবীর সমস্ত সুখ ও আনন্দ এবং নিজের ইচ্ছা ও চাহিদাকে কুরবান করে আল্লাহর জন্য পুরোপুরি সমর্পিত হওয়ার চেতনায় উজ্জীবিত করে তোলে।
আল্লাহর রহমতের প্রত্যক্ষ সাক্ষী এ যমযম
হাজেরা রা. যখন শিশু ইসমাঈল আ.-এর জন্য উৎকণ্ঠিত, একটুখানি পানির আশায় এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছেন, পৃথিবী যখন অন্ধকার হয়ে আসছিল চোখের সামনে, আশার কোনো আলো দেখা যাচ্ছিল না, সমাধানের কোনো উপায় বুঝে আসছিল না, তখনই নেমে আসে রহমতের বারিধারা। আবে যমযম।
বান্দা যদি আল্লাহর ফয়সালা মেনে নেয়, আল্লাহমুখি হয়, আল্লাহর উপর ভরসা রাখে তাহলে আল্লাহর রহমত তার শামিলে হাল হয়- এ যমযম তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। যমযম আমাদেরকে আল্লাহর রহমতের আশাবাদী হতে উদ্বুদ্ধ করে। বিপদের ঝঞ্ঝাবায়ুর মাঝেও মুক্তি লাভের আশায় বুক বেধে রাখার প্রেরণা যোগায়। আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশী করে।
যমযমে রয়েছে খাদ্যের বৈশিষ্ট্য ও রোগ থেকে মুক্তি
হাদীস শরীফে যমযমের অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস রা. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন-
خَيْرُ مَاءٍ عَلَى وَجْهِ الْأَرْضِ مَاءُ زَمْزَمَ، فِيهِ طَعَامٌ مِنَ الطّعْمِ وَشِفَاءٌ مِنَ السُّقْمِ.
যমযম ভূপৃষ্ঠের শ্রেষ্ঠ পানি। এতে রয়েছে খাদ্যের বৈশিষ্ট্য ও রোগ থেকে মুক্তি। -আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ১১১৬৭; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ৫৭১২
এ হাদীসে যমযমের পানির দুটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে।
১. এতে রয়েছে খাবারের বৈশিষ্ট্য।
২. এ পানি পান করে সুস্থতা লাভ হয়।
মানুষ জীবন বাঁচানোর তাগিদে খাদ্য গ্রহণ করে। খাবারের মাধ্যমে দেহে শক্তি সঞ্চার হয়। কর্মপ্রেরণা সৃষ্টি হয়। জীবনের পথে মানুষ এগিয়ে চলে। খাদ্যের এই বৈশিষ্ট্য আল্লাহ তাআলা যমযম পানির মধ্যেও রেখেছেন। যমযম পান করেও ক্ষুধা নিবারণ হয়। মানুষ কর্মশক্তি লাভ করে। হযরত আবু যর গিফারি রা. ইসলাম গ্রহণের পূর্বে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্যতা যাচাই করার জন্য মক্কা এসে ত্রিশ দিন পর্যন্ত অবস্থান করেন। এ পুরোটা সময় তিনি শুধু যমযম পান করে কাটিয়েছেন। (দীর্ঘ হাদীসের একাংশে) আবু যর রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করেন। এরপর তিনি ও তার সাথী তাওয়াফ করে নামায আদায় করেন। নবীজী নামায শেষ করলে আমি তাকে সালাম দিই। নবীজী জিজ্ঞাসা করেন, কে তুমি?
: গিফার বংশের লোক আমি।
: কোথায় ছিলে?
: ত্রিশ দিন পর্যন্ত এখানেই ছিলাম।
: কে তোমাকে খাবার খাইয়েছে।
: উত্তরে তিনি বললেন-
مَا كَانَ لِي طَعَامٌ إِلّا مَاءُ زَمْزَمَ فَسَمِنْتُ حَتّى تَكَسَّرَتْ عُكَنُ بَطْنِي، وَمَا أَجِدُ عَلَى كَبِدِي سُخْفَةَ جُوعٍ.
যমযম ছাড়া আমার আর কোনো খাবার ছিল না। শুধু এ পানি পান করেই দিন কাটিয়েছি। এমনকি মোটা হয়ে গেছি। (এ দীর্ঘ সময়ে) আমি কখনো ক্ষুধা অনুভব করিনি।
নবীজী তখন বলেন-
إِنّهَا مُبَارَكَةٌ، إِنّهَا طَعَامُ طُعْمٍ
এটা বরকতময় পানি। এতে রয়েছে খাদ্যের বৈশিষ্ট্য। (দ্র. সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৪৭৩)
ইমাম ইবনুল কায়্যিম রাহ. বলেন, আমি এমন মানুষও দেখেছি, যিনি অর্ধ মাস কিংবা তারও বেশি সময় শুধু যমযম পান করেই কাটিয়েছেন। কখনো ক্ষুধা অনুভব করেননি। অন্যান্যদের সাথে খুব স্বাভাবিকভাবেই তাওয়াফ করতেন। তিনি আমায় বলেছেন, একবার তো শুধু যমযম পান করেই চল্লিশ দিন কাটিয়েছেন। -যাদুল মাআদ ৪/৩৯৩
এ তো কিতাবের পাতায় উল্লেখিত কয়েকটি ঘটনা মাত্র। জানা নেই, যুগে যুগে কত শত আল্লাহর বান্দা শুধু যমযম পান করেই দিনের পর দিন কাটিয়েছেন এবং ঈমানী শক্তিতে উজ্জীবিত হয়েছেন।
উপরোক্ত হাদীসে যমযমের দ্বিতীয় যে বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে তা হল রোগ থেকে মুক্তিলাভ।
রোগমুক্তি লাভে আবে যমযম
আল্লাহ তাআলা যমযমের পানিতে রোগ থেকে মুক্তি লাভের বিশেষ বৈশিষ্ট্য রেখেছেন। হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
خَيْرُ مَاءٍ عَلَى وَجْهِ الْأَرْضِ مَاءُ زَمْزَمَ، فِيهِ طَعَامٌ مِنَ الطُّعْمِ وَشِفَاءٌ مِنَ السُّقْمِ.
যমযম ভূপৃষ্ঠের শ্রেষ্ঠ পানি। এতে রয়েছে খাদ্যের বৈশিষ্ট্য ও রোগ থেকে মুক্তি। -আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ১১১৬৭; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ৫৭১২
অন্য হাদীসে ইরশাদ হয়েছে হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
مَاءُ زَمْزَمَ لِمَا شُرِبَ لَهُ، فَإِنْ شَرِبْتَهُ تَسْتَشْفِي بِهِ شَفَاكَ اللهُ.
যে উদ্দেশ্যে যমযম পান করা হবে তা পূরণ হয়। যদি তুমি রোগমুক্তির জন্য তা পান কর আল্লাহ তোমাকে সুস্থ করে দেবেন। -মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ১৭৩৯
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোগীদের উপর যমযমের পানি ছিটাতেন এবং তাদেরকে তা পান করতে দিতেন। হযরত ইবনে আব্বাস রা. নিজেও রোগমুক্তির জন্য যমযম পান করতেন এবং এ দুআ পড়তেন-
اللّهُمَّ أَسْأَلُكَ عِلْمًا نَافِعًا، وَرِزْقًا وَاسِعًا، وَشِفَاءً مِنْ كُلِّ دَاءٍ.
হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে উপকারী ইলম, প্রশস্ত রিযিক ও সব রোগ থেকে মুক্তি চাই। -মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ১৭৩৯
সালাফে সালেহীন থেকে রোগমুক্তির জন্য যমযম পান করার অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। রোগাক্রান্ত হলে তারা চিকিৎসা হিসেবে যমযম পান করতেন এবং সুস্থ হয়ে যেতেন। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের ছেলে নিজ পিতার ব্যাপারে বলেন, আমি বাবাকে রোগ থেকে মুক্তি লাভের জন্য যমযম পান করতে দেখেছি। সেইসাথে তিনি পানি দিয়ে হাত ও মুখ মাসাহ করতেন। -সিয়ারু আলামিন নুবালা ১১/২১২
ইবনুল কায়্যিম রাহ. বলেন, রোগমুক্তির জন্য যমযম ব্যবহার করে আমি অনেক রোগ থেকে মুক্ত হয়েছি। -যাদুল মাআদ ৪/৩৯৩
তিনি নিজের একটি ঘটনা বলেন, একবার আমি মক্কা শরীফে অসুস্থ হয়ে পড়ি। তখন যমযমের পানি নিয়ে তাতে কয়েকবার اِیَّاكَ نَعْبُدُ وَ اِیَّاكَ نَسْتَعِیْنُ পড়ে দম করে পান করি। এ অসিলায় আমি পূর্ণ সুস্থতা লাভ করি। অন্যান্য ব্যথা বেদনার জন্যও আমি এ আমলটি করেছি এবং অনেক উপকার পেয়েছি। -যাদুল মাআদ ৪/১৭৮
ইমাম তাকীউদ্দীন আলফাসী বলেন, আহমাদ ইবনে আবদুল্লাহ আশশারিফী অন্ধত্ব থেকে মুক্তি লাভের জন্য যমযম পান করেন এবং এ উসীলায় পূর্ণ সুস্থ হয়ে যান। -শেফাউল গারাম ১/২৫৫
মা-উ যামযাম লিমা শুরিবা লাহু
মনোবাসনা পূরণে আবে যমযম
মানুষের মনে কত ধরনের স্বপ্নই তো থাকে। কত ধরনের তামান্না মানুষ হৃদয়ে পোষণ করে। তবে মানুষের সব স্বপ্ন সব সময় পূরণ হয় না। সব তামান্না বাস্তবতার আলো দেখতে পায় না। এরপরও মানুষ দিলে তামান্না রাখে। হৃদয়ে স্বপ্ন পোষে। মনের বাসনা ও জীবনের স্বপ্ন পূরণের ক্ষেত্রে যমযম পানের আলাদা বরকত রয়েছে। হযরত জাবের রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-
مَاءُ زَمْزَمَ لِمَا شُرِبَ لَهُ.
যে উদ্দেশ্যে যমযম পান করা হবে তা পূর্ণ হবে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৪৮৪৯
হাকীম তিরমিযী রাহ. এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লেখেন, কেউ যদি ক্ষুধা নিবারণের জন্য এ পবিত্র পানি পান করে আল্লাহ তার ক্ষুধা দূর করেন। পিপাসা নিবারণের জন্য পান করলে আল্লাহ তার পিপাসা নিবারণ করেন। সুস্থতার জন্য পান করলে আল্লাহ সুস্থ করে দেন। চারিত্রিক সৌন্দর্য অর্জনের জন্য পান করলে আল্লাহ তাকে সচ্চরিত্রবান করেন। হৃদয়ের সংকীর্ণতা দূর করার জন্য পান করলে আল্লাহ হৃদয় প্রশস্ত করে দেন। কলবের অন্ধকার দূর করার জন্য পান করলে আল্লাহ তা আলো-উদ্ভাসিত করে দেন।...
মোটকথা, যে কোনো ভালো ও কল্যাণের নিয়তে এ পানি পান করুক, আল্লাহ তার মাকছাদ ও উদ্দেশ্য পূরণ করে দেন। -নাওয়াদিরুল উসূল, পৃ. ৩৪১
যমযমের পানি যে যে উদ্দেশ্যে পান করবে আল্লাহ তার সে নিয়ত পুরা করেন। একারণে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, বরেণ্য ওলামায়ে কেরাম ও আল্লাহভীরু মুমিনগণ যমযম পানের সময় বিভিন্ন নিয়ত করতেন, যা পূরণ হওয়ার অসংখ্য ঘটনা ইতিহাসের পাতায় বিদ্যমান।
হযরত ওমর রা.-এর ব্যাপারে বর্ণিত আছে, তিনি যমযম পানের সময় এ দুআ পড়তেন-
اللهم إني أشربه لظمأ يوم القيامة.
হে আল্লাহ কিয়ামতের দিনের পিপাসা নিবারণের উদ্দেশ্যে আমি এ পানি পান করছি। -আলজাওহারুল মুনায্যাম, পৃ. ৪২ (ফাদলু মায়ি যামযামের সূত্রে, পৃ. ১৩৫)
হযরত ইবনে আব্বাস রা. যমযম পানের সময় এ দুআ পড়তেন-
اللّهُمَّ أَسْأَلُكَ عِلْمًا نَافِعًا، وَرِزْقًا وَاسِعًا، وَشِفَاءً مِنْ كُلِّ دَاءٍ.
হে আল্লাহ আমি আপনার কাছে উপকারী ইলম, প্রশস্ত রিযিক ও সবধরনের রোগ থেকে সুস্থতা চাই। -মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ১৭৩৯
আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক রাহ. একবার যমযম পানি নিয়ে কাবামুখি হয়ে বলেন, হে আল্লাহ! ইবনে আবীল মাওয়াল আমাকে মুহাম্মাদ ইবনে মুনকাদিরের সূত্রে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন-
مَاءُ زَمْزَمَ لِمَا شُرِبَ لَهُ.
(যে উদ্দেশ্যে যমযম পান করা হবে তা পূর্ণ হবে।) এরপর এ দুআ করেন-
أشربه لعطش يَوْم الْقِيَامَة.
হে আল্লাহ! কিয়ামতের দিন তুমি আমার পিপাসা নিবারণ করবে- এজন্য আমি তা পান করছি।
এরপর তিনি যমযম পান করেন। -আত্তারগীব ওয়াততারহীব, ২/২১০, হাদীস ১৮১৭; তারীখে বাগদাদ, ১০/১১
ইমাম শাফেয়ী রাহ. বলেন, আমি তিনটি নিয়তে যমযম পান করেছি। ১. আমি যেন নিপুণভাবে তীর নিক্ষেপ করতে পারি। (আমার এ উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে) ফলে কখনো আমি দশটার মধ্যে দশটা আবার কখনো দশটার মধ্যে নয়টা লক্ষ্য ভেদ করতে পারি। ২. ইলমের জন্য। আর এতে আমার অবস্থা তো তোমরা দেখছই। ৩. জান্নাতে প্রবেশের জন্য। আশা করি আমার এ উদ্দেশ্যও পূরণ হবে। (নাশরুল আস-এর সূত্রে, ফাদলু মায়ি যামযাম, পৃ. ১৩৭)
একবার ইমাম ইবনে খুযায়মাকে জিজ্ঞেস করা হল আপনি কীভাবে এত ইলম অর্জন করলেন? তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
مَاءُ زَمْزَمَ لِمَا شُرِبَ لَهُ.
(যে উদ্দেশ্যে যমযম পান করা হবে তা পূর্ণ হবে।) তাই যমযম পানের সময় আমি আল্লাহর কাছে ইলমে নাফে চেয়েছি। -সিয়ারু আলামিন নুবালা ১৪/৩৭০; তাযকিরাতুল হুফ্ফায, ২/৭২১
হাফেয ইবনে হাজার রাহ. বলেন, হাদীস অন্বেষণের প্রাথমিক অবস্থায় একবার যমযম পানের সময় নিয়ত করেছিলাম, আল্লাহ যেন আমাকে যাহাবী রাহ.-এর মত হাদীস মুখস্থ করার শক্তি দেন। এর বিশ বছর পর আমি হজ্বে যাই। তখন আমার মনে হয়েছিল হয়ত এর চেয়ে উঁচু স্তর আমি অর্জন করেছি। আমি আল্লাহর কাছে (পুনরায়) দুআ করলাম, আরো উঁচু থেকে উঁচু মরতবা তিনি যেন আমাকে দান করেন। আশা করি, আমার এ তামান্নাও পূরণ হবে।
হাফেয সাখাবী রাহ. বলেন, আল্লাহ তাআলা তার এ আশাও পূরণ করেছেন। -আলজাওয়াহির ওয়াদদুরার ১/১৬৬
যমযমে রয়েছে নববী বরকতের স্পর্শ
যুগযুগ ধরে যমযম নিজের মাঝে ধারণ করে আছে নববী বরকতের এক স্পর্শ। নবীজীর মুখের পানি মিশে আছে এ পবিত্র ক‚পে। হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, একবার নবীজী যমযম ক‚পের কাছে আসেন। আমরা তখন সেখান থেকে এক পেয়ালা পানি তাকে দিই। তিনি পানি পান করে কিছু পানি পেয়ালায় কুলি করেন। আমরা তখন পেয়ালার সে পানি যমযম ক‚পে ঢেলে দেই। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৩৫২৭
এ হাদীসের প্রেক্ষাপটে যফর আহমদ উসমানী রাহ. বলেন, ‘যমযম ক‚পে নবীজীর মুখের পানি মেশার দরুণ এ পানির স্বাদ ও বরকত এবং নূর ও পবিত্রতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। নবীজী তাঁর উম্মতের প্রতি কতটা দয়ালু যে, কিয়ামত পর্যন্ত আগত উম্মতকে তিনি তার বরকত থেকে বঞ্চিত করতে চাননি।’
বরকতের সেই স্পর্শে আমাদেরও ধন্য কর হে আল্লাহ! আজ হাজার বছর পরও নবীপ্রেমিক বান্দা যমযম পানের সময় সে বরকত প্রত্যাশা করে।
যমযমের পানি পান করার আদব
যমযমের পানি পান করার কয়েকটি আদব রয়েছে। যমযম পান করার সময় সে আদবগুলোর প্রতি সবার যতœশীল হওয়া উচিত।
১. কিবলামুখী হয়ে পান করা।
২. তিন শ্বাসে পান করা।
৩. প্রত্যেকবার বিসমিল্লাহ পড়া।
৪. প্রতি শ্বাসের পর আলহামদু লিল্লাহ বলা।
৫. ডান হাতে পান করা।
৬. পান করার সময় দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ লাভের দুআ করা।
৭. পেট ভরে পরিতৃপ্ত হয়ে বেশি বেশি পান করা। -ফাদলু মায়ী যামযাম পৃ. ১৯২-১৯৪
শেষ আদবটির প্রতি হজ্ব ও উমরাকারীদের বিশেষ খেয়াল রাখা দরকার। মনে রাখতে হবে, যমযম পেট ভরে পান করা কাম্য। আল্লাহ তাআলা আমাদের যমযমের যাবতীয় কল্যাণ দান করুন।