শাওয়াল ১৪৪০   ||   জুন ২০১৯

পল্লি-মাটির পিপাসা

মাওলানা আসলাম শেখুপুরি

তখন মাত্র দরসে নেযামীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করেছি। মনের মাঝে তাই একটি মাত্র ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছিল- এখন আমি কী করব? চিন্তাতরঙ্গে দোল খেতে খেতে পিতৃভূমির সবুজদ্বীপে এসে নোঙর ফেললাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, গ্রামের নির্মল ও নির্জন পরিবেশকেই বেছে নেব আমার কর্মস্থল হিসেবে। এখানের সবুজ মাটিতে ঘাম ঝরিয়ে, ভালোবাসার বীজ বপন করে একটি সবুজ সুন্দর দ্বীনের বাগান গড়ে তুলব।

আমাদের গ্রামের মসজিদটি বিরান পড়ে ছিল। ইমাম-খতীব কেউই নেই। ইমাম সাহেব চলে গেছেন বেশ কয়েকদিন হয়েছে। ইমাম যখন নেই তাই মসজিদও শূন্য পড়ে আছে। কারণ, গ্রামের মসজিদগুলোতে সাধারণত আলাদা খতীব ও মুআযযিনের ব্যবস্থা থাকে না। সব দায়িত্ব ইমাম সাহেবকেই পালন করতে হয়।

তখন যৌবন তরঙ্গ আমার ভেতর উথলে উঠছিল। চোখজুড়ে আলোকিত ভবিষ্যতের স্বপ্ন। দৃষ্টির শেষসীমা পর্যন্ত যার বিস্তৃতি। কিছু একটা করে দেখিয়ে দেয়ার ইস্পাত কঠিন প্রতিজ্ঞা করে সেই বিরান মসজিদেই গিয়ে বসলাম। আমার জীবন তখন ধীরে ধীরে বদলে যেতে লাগল। দিনের আলো, রাতের অন্ধকার, গ্রীষ্মের গরম, শীত ও বর্ষা সব যেন ভুলে গেলাম আমি। আমার সমগ্র জীবন জুড়ে রইল শুধু সেই মসজিদটি। মসজিদই আমার দফতর। মসজিদই আমার দরসগাহ।

সবাই আসত আমার কাছে। বড়রাও আসত। ছোটরাও আসত। কাউকে কালেমা শেখানো হত। কাউকে নামায শেখানো হত। কেউ কায়দা পড়ত। কেউ নাযেরার সবক নিত। কুরআন হিফযের জন্যও কয়েকজন প্রস্তুত হয়েছিল। এ সবকিছুই আমি একা করতাম। তবে এর কোনো পারিশ্রমিক ছিল না। আমি নিজেও আগে বেড়ে কিছু চাইতাম না। এতকিছুর পরও আমি কারো কারো চোখের কাঁটা হয়ে গেলাম। 

আমার গলায় সুরের বাঁশি ছিল না।  প্রচলিত ওয়ায আমি করতে পারতাম না। তাবীয-গণ্ডার রহস্যময় জগৎ আমার কাছে ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত। জান্নাত লাভের টিকেট কেটে দেয়ার সহজ কোনো মাধ্যমও আমার জানা ছিল না। প্রতিদিন ফজরের নামাযের পর লাউডস্পিকারে সহজ-সরল ভাষায় পবিত্র কুরআনের দরস দিতাম।  দূর-দূরান্তে সে আওয়ায পৌঁছে যেত। নির্মল ও পবিত্র হৃদয়ের অধিকারী মানুষেরা তা শুনে খুশি হত। তবে তাওহীদের স্বচ্ছবাণী ও রসম-বিদআতের  বিরোধিতা শুনে অনেকের মনেই শয়তানী কিলবিল করত।

গ্রামের চৌধুরিরা যখন দেখল,  কুরআনের বিশুদ্ধবাণীর প্রচারকের শান্তির ছায়াতলে দিন দিন লোক বৃদ্ধি পাচ্ছে তখন এর লাগাম টেনে ধরার সিদ্ধান্ত নিল তারা। এর জের ধরেই একদিন সকালে দুর্ঘটনার স্বীকার হয়ে রক্তাক্ত হতে হল আমার বাবাকে।  বাবার সেই রক্ত আমার ইস্পাত কঠিন প্রতিজ্ঞাকেও গলিয়ে দিল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও গ্রাম ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে হল আমাকে। 

আমার এখনও মনে আছে, যেদিন গ্রাম ছেড়ে যাচ্ছিলাম তখন প্রচ- বৃষ্টি হচ্ছিল। আকাশ থেকেও পানি পড়ছিল, আমার বাবা-মার চোখ থেকেও অশ্রু ঝরছিল। যাওয়ার সময় মনে আমার শুধু ব্যথা ছিল একটাই, আমার রাত-দিনের পারিশ্রমিকহীন মুখলেসানা মেহনতকে তারা সহ্য করতে পারেনি। অথচ তাদেরই সন্তানদের তালীম ও তারবিয়াতের জন্য আমার মেহনত উৎসর্গিত ছিল। 

আমি গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছি। কিন্তু গ্রামের ভালোবাসা এখনও আমাকে ছাড়েনি। আমার হৃদয়ের স্পন্দন এখনও আমাকে গ্রামীণ লোকদের সংশোধনের জন্য বিপ্লবী আন্দোলন শুরু করার জন্য উদ্ধুদ্ধ করে। এটা ঠিক যে, দ্বীন থেকে দূরত্ব, অন্যায় ও পাপাচার, পার্থিব লোভ-লালসা ও চারিত্রিক অধপতন কেবল গ্রাম ও দূরের পল্লীগুলোতেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং আলোঝলমলে শহর ও উন্নত নগরগুলোতেও  এ অন্ধকার ছেয়ে আছে। কিন্তু শহরগুলোতে যোগ্যতাসম্পন্ন উলামায়ে কেরাম, দরদে দিল ওয়ালা আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দা, ব্যাপক মাদরাসা ও দ্বীনী প্রতিষ্ঠান, কুরআন-হাদীসের মাহফিল আলো করে আছে। কিন্তু শতকরা  ৯০টি গ্রাম কল্যাণের এই ঝর্ণাধারা থেকে বঞ্চিত। গ্রামে মসজিদ অবশ্যই আছে। কিন্তু যেসকল ইমামদের হাতে সেগুলোর দেখা-শোনার দায়িত্ব, তারা নিজেরাই সংশোধনের মুহতাজ। এদের কারো কারো কয়েকটি মাত্র সুরাই শুধু মুখস্থ।  কারো তিলাওয়াতে নামায ভেঙ্গে যাওয়ার মত স্পষ্ট ভুল। কেউ শিরক-বিদআতের অন্ধকারে নিমজ্জিত। কেউ কেউ তো আবার ইমামতির দায়িত্বটা পেয়েছেন ওয়ারাসাত সূত্রে। নতুবা  তারা কখনো এমন নির্জীব ভূমিতে পা রাখত না। 

কিছুদিন আগে গ্রামের ইমামদের জন্য আয়োজিত চল্লিশ দিনের একটি কোর্সে অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। কোর্সের আয়োজকগণ আমাকে জানিয়েছেন- অধিকাংশ ইমামই সঠিক উচ্চারণে তাজবীদের সাথে কুরআন পাঠ করতে পারে না। কারো কারো দাড়ি এক মুষ্ঠিরও কম। কেউ কেউ তো নামাযের ফরয-ওয়াযিব পর্যন্ত জানে না। 

এটা তো স্পষ্ট কথা যে, মাদরাসা থেকে ফারেগ উলামায়ে কেরাম যখন গ্রামে যেতে চাইবে না, নিজের জন্য শহরের কোনো মাদরাসা বা মসজিদে খেদমতের জায়গা খুঁজবে তখন তো অযোগ্যরাই গ্রামের সেসকল স্থান দখল করে বসবে। 

আমি একথা বলছি না যে, কোনো আলেমই শহর ছেড়ে গ্রামে যেতে চান না। হাঁ, আল্লাহর এমন কিছু প্রিয় ও মুখলেস বান্দা অবশ্যই আছেন, যারা গ্রামের তৃষ্ণার্ত ভূমিকে আসমানী ইলমের পবিত্র বারিধারায় স্নাত করতে চান। তবে যখন ক্ষুধা-পিপাসার যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় তখন অনেকের জন্যই অবিচল থাকা কষ্টকর হয়ে যায়। কারণ, গ্রাম্য মানুষের বাৎসরিক দান, বছরের বিভিন্ন সময়ে মৌসুমি ফল-ফসলের নির্দিষ্ট কিছু অংশ ইত্যাদি দ্বারা ইমামের প্রয়োজন পুরা করতে হয়। মাসিক ওযীফার কল্পনাও সেখানে করা যায় না। তাই ইমাম সাহেব সবসময় চান, বিভিন্ন রুচি-অভিরুচির অধিকারী কোনো মুসল্লিই যেন তার উপর নারাজ না হয়।

যদি কোনো আল্লাহর বান্দা অমুখাপেক্ষিতার পথে  চলে তখন ক্ষুধা ও দারিদ্র্য হয় তার নিত্যসঙ্গী। এত শত মসিবতের উপর অবিচল থাকতে পারলে আল্লাহ তাআলা অবশ্যই ফুতুহাতের দরজা খুলে দেবেন। তবে নিজের ক্ষুধাক্লিষ্ট পরিবারের ভগ্ন চেহারা দেখে স্থির থাকার মত মজবুত ঈমান কয়জনের?

আমার খুব কাছের এক বন্ধু কয়েক বছর আগে হিম্মত করে নিজ গ্রামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছিল। সততা ও যোগ্যতা দুটোই তার মাঝে ছিল। জীবনসঙ্গিনীও ছিল সবরকারিনী মহিয়সী একজন নারী। কয়েকদিন আগে তার সাথে আমার দেখা হয়। তার রুগ্ন-ভগ্ন চেহারা দেখে খুব মায়া হচ্ছিল। তার অবস্থা শুনে মনে হল মাদরাসার ছাত্র-ছাত্রীদের চেয়ে সে নিজেই যাকাতের বেশি হকদার। তখন হযরত সাইদ ইবনে আমেরের ঘটনা আমার মনে পড়ল। হযরত ওমর রা. তাকে হেমসের গভর্নর নিযুক্ত করেছিলেন। একবার হেমস সফরকালে আমীরুল মুমিনীন সেখানকার দরিদ্র ও যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত লোকদের তালিকা প্রস্তুত করতে বলেন। যেন আর্থিকভাবে তাদের সাহায্য করা যায়। প্রস্তুতকৃত তালিকা দেখে ওমর রা. আশ্চর্য হন, যখন দেখেন সেখানকার গভর্নরের নাম সবার আগে। ওমর রা. বলেন, তাকে তো মাসিক ভাতা দেওয়া হয়। এরপরও তার আর্থিক অবস্থা এত দুর্বল কেন? উত্তরে বলা হল, বাইতুল মাল থেকে প্রদত্ত ভাতা তিনি ছুঁয়েও দেখেন না। পুরোটাই জনগণের জন্য ব্যয় করে দেন। তাই সবসময় তার ঘরে অভাব লেগেই থাকে। 

জানা কথা, সবাই তো আর হযরত সাইদ ইবনে আমের হতে পারবে না। তার মত গুণাবলীও সবাই অর্জন করতে পারবে না। তাই মূর্খতার অন্ধকারে নিমজ্জিত গ্রামগুলোতে ইলমের আলো বিতরণের জন্য  যদি সুউচ্চ মনোবলের অধিকারী কিছু যুবক প্রস্তুত হয় তাহলে তাদের বৈষয়িক প্রয়োজনাদী পূরণের জন্য এমন পন্থা ভাবা উচিত, যার দ্বারা তাদের আত্মসম্মানও বজায় থাকে এবং প্রশান্তমনে তারা দাওয়াত ও তাবলীগের কাজও আঞ্জাম দিতে পারে। 

একটা পদ্ধতি আমার মনে আসে। যদি শহরে অবস্থিত প্রতিটি বড় মাদরাসার তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন গ্রামে একাধিক মক্তব গড়ে উঠে এবং সে মাদরাসার কর্তৃপক্ষই কমপক্ষে একজন উস্তাযের খরচাদির ফিকির করেন তাহলে অন্ধকারে নিমজ্জিত অন্তত কিছু গ্রামে ইলম ও হেদায়েতের প্রদীপ আলো ছড়াতে পারে। 

আমার উপরের আলোচনা থেকে কেউ এটা বুঝবেন না যে, প্রতিটি গ্রামেই মূর্খতা ও ভ্রষ্টতার কালো মেঘ ছেয়ে আছে। না। কিছু কিছু গ্রাম এখনো বিভিন্ন ইলমী ও রূহানী ব্যক্তিদের উপস্থিতির কল্যাণে আলোকিত হয়ে আছে। তাবলীগ জামাতের সাথীরাও প্রতিটি গ্রামে ও জনপদে বিচরণ করে থাকেন। তাদের মেহনতের কিছু না কিছু প্রভাব গ্রামীণ মানুষদের উপর পড়ে। তবে অধিকাংশ গ্রামের কথা লক্ষ্য করেই উপরের কথাগুলো আরজ করা হয়েছে, যেগুলোতে মূর্খতার অন্ধকার তো ছিলই,  উপরন্তু চরিত্রবিধ্বংসী বিভিন্ন ছবি ও নগ্নতা-অশ্লীলতায়পূর্ণ বিভিন্ন টিভি প্রোগ্রাম শালীনতার শেষ স্তম্ভটিকেও ধ্বংস করে দিয়েছে।

গ্রামের নির্জন ও নিষ্কলুষ ভূমির তরুণ প্রজন্মের মাঝে একটা সময় সরলতা, ভালোবাসা, পরোপকার-এর যে চেতনা ছিল, ধীরে ধীরে তা বদলে যাচ্ছে।  এখন সেখানে এমন এক প্রজন্ম গড়ে উঠছে, যারা হানাহানি ও হত্যার মত জঘন্য অপরাধ করেও গর্ব করে বেড়ায়। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অভিশাপে নগ্নতা ও অশ্লীলতা চর্চার পাশাপাশি আরেকটি ভয়ংকর ফেতনা কিছু কিছু গ্রামে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে।  বিভিন্ন পথভ্রষ্ট  ফেরকা ও ভ্রান্তধর্মের লোকেরা গ্রামের সরল মানুষদেরকেই নিজেদের শিকার হিসেবে টার্গেট করছে। যারা লোভলালসা দেখিয়ে সাধারণ মুসলমানদের ঈমান ধ্বংস করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে।

আফসোস! শত আফসোস!! কুরআন-সুন্নাহ ও সঠিক দ্বীনী ইলমের জন্য পিপাসার্ত গ্রামগুলোতে অশ্লীলতা ও পথভ্রষ্টতার উপায়-উপকরণ ও এর ধারক-বাহকরা তো পৌঁছে গেছে, কিন্তু নববী মিরাসের উত্তরাধিকারী ও সত্যের প্রকৃত ধারক-বাহকগণ এখনো সেখানে পৌঁছেননি। 

হায়! তারা যদি অনুভব করতেন, প্রকৃতির সে সবুজ পিপাসার্ত ভূমি কত অধির আগ্রহে তাদের আগমনের অপেক্ষা করছে!

অনুবাদ : শাহাদাত সাকিব

 

 

 

advertisement