তাহাফফুযে খতমে নবুওত ও কাদিয়ানী সম্প্রদায়
[গত ১৯ রজব ১৪৪০ হি./২৭ মার্চ ২০১৯ ঈ. রোজ বুধবার ঢাকার খিলগাঁও উচ্চবিদ্যালয় ময়দানে আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়াত বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে খতমে নবুওয়াত মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা পেশ করেন, দারুল উলূম দেওবন্দের মুহতামিম হযরত মাওলানা আবুল কাসেম নোমানী দামাত বারাকাতুহুম। বাংলাভাষী পাঠকদের জন্য কিছু ব্যাখ্যা ও পরিমার্জনসহ তাঁর উর্দু আলোচনার অনুবাদ পেশ করা হল। -সহ সম্পাদক]
الحمد لله نحمده ونستعينه ونستغفره ونؤمن به ونتوكل عليه،ونعوذ بالله من شرور أنفسنا ومن سيئات أعمالنا، من يهده الله فلا مضل له، ومن يضلل فلا هادي له، ونشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له، ونشهد أن سيدنا ومولانا محمدا عبده ورسوله، صلى الله تبارك وتعالى عليه وعلى آله وأصحابه وبارك وسلم، تسليما كثيرا كثيرا، أما بعد:
فأعوذ بالله من الشيطان الرجيم، بسم الله الرحمن الرحيم.
مَا كَانَ مُحَمَّدٌ اَبَاۤ اَحَدٍ مِّنْ رِّجَالِكُمْ وَ لٰكِنْ رّسُوْلَ اللّٰهِ وَ خَاتَمَ النَّبِیّٖنَ.
وقال النبي صلى الله عليه وسلم: أَنَا خَاتَمُ النّبِيِّينَ لَا نَبِيّ بَعْدِي.
মুহতারাম উলামায়ে কেরাম, বুযুর্গানে দ্বীন, হাযিরীনে মজলিস!
খতমে নবুওত শিরোনামে আজকের এই সমাবেশ আয়োজন করা হয়েছে। আমি আজ খতমে নবুওত-এর অর্থ এবং তাহাফফুজে খতমে নবুওত দ্বারা কী উদ্দেশ্য, তা আপনাদের সামনে আলোচনা করব। খতমে নবুওত-এর অর্থ হল, আল্লাহ তাআলা হযরত আদম আলাইহিস সালাম-এর মাধ্যমে নবুওত ও রিসালাতের যে পবিত্র ধারা শুরু করেছেন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পৃথিবীতে প্রেরণের মাধ্যমে সেই ধারাকে সমাপ্ত করেছেন।
প্রিয় ভাইয়েরা! আমরা যে কালিমা পড়ি তার দুটি অংশ। প্রথম অংশ-
أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلهَ إِلاّ اللهُ.
দ্বিতীয় অংশ-
وَأَشْهَدُ أَنّ مُحَمّدًا رَسُولُ اللهِ
أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلهَ إِلاّ اللهُ -এর অর্থ হল, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই। আর কালিমার দ্বিতীয় অংশ- وَأَشْهَدُ أَنّ مُحَمّدًا رَسُولُ اللهِ -এর অর্থ হল, আমি (মন থেকে) এ সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার রাসূল।
কালিমার প্রথম অংশে তাওহীদের আলোচনা রয়েছে। এর উদ্দেশ্য, এ স্বীকারোক্তি দেয়া যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর কুদরতের দিক থেকে, গুণাবলীর দিক থেকে, সৃষ্টি ও রিযিক দান-এর দিক থেকে, ইচ্ছা-অনিচ্ছার দিক থেকে তথা সকল গুণাবলীর ক্ষেত্রে এক ও অদ্বিতীয়। কুলমাখলুক তাঁর বান্দা ও দাস। এক্ষেত্রেও তিনি এক ও অদ্বিতীয়। আল্লাহ তাআলার প্রভুত্বের ক্ষেত্রে যে কোনোভাবে যে কাউকে শরীক করা শিরক। এর মাধ্যমে মানুষ ঈমান ও ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায়।
এটা হতে পারে না যে, কেউ বলবে, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তাআলাই প্রভু, কিন্তু তিনি তাঁর প্রভুত্বের সামান্য অংশ অন্যকে দান করেছেন। কিংবা এ বিশ্বাস করা যে, প্রকৃত খোদা তো আল্লাহ তাআলাই, তবে অমুক ব্যক্তি ছায়া-খোদা। যদি কেউ আল্লাহ তাআলার উলুহিয়াত ও প্রভুত্বে এক জাররা পরিমাণ অন্য কাউকে কোনোভাবে শরীক করে তাহলে সেটা হবে তাওহীদ ও আল্লাহর একত্ববাদ অস্বীকার করার নামান্তর। এর মাধ্যমে মানুষ ঈমান থেকে খারেজ হয়ে যায়।
কালিমার দ্বিতীয় অংশ- وَأَشْهَدُ أَنّ مُحَمّدًا رَسُولُ اللهِ যেমনিভাবে এর উদ্দেশ্য, একথার স্বীকারোক্তি ও সাক্ষ্য দেওয়া যে, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার রাসূল। ঠিক সে পরিমাণ মজবুতি ও তাকিদের সাথে, সে পরিমাণ আস্থা ও বিশ্বাসের সাথে একথারও সাক্ষ্য দেওয়া যে, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার প্রেরিত সর্বশেষ নবী।
কারণ তিনি শেষ নবী হওয়ার বিষয়টি হাদীস শরীফে অত্যন্ত স্পষ্টভাষায় বলে গেছেন, কুরআন মাজীদেও দ্ব্যর্থহীনভাবে তা বলা হয়েছে। কাজেই তাঁকে নবী হিসেবে স্বীকার করার পর তার শেষ নবী হওয়াকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। তাঁর পর কেউ নবী হতে পারবে না; কিয়ামত পর্যন্ত আর কেউ নবী হিসেবে আগমন করবে না। হাঁ, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম কিয়ামতের পূর্বে এ পৃথিবীতে আবার আগমন করবেন, কিন্তু তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পর নবুওত লাভ করেননি; তাকে তো নবী অবস্থায় আকাশে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। শেষ যামানায় তিনি এ পৃথিবীতে পুনরায় আগমন করবেন। পৃথিবীতে আগমন করে তিনি নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীয়তের আহকাম ও বিধি-বিধান জারি করবেন।
যাইহোক, যেমনিভাবে আল্লাহ তাআলার উলুহিয়াত এবং প্রভুত্বের ক্ষেত্রে অন্য কাউকে অংশীদার মনে করা শিরক; তা যে কোনোভাবে ও যে কোনো অর্থেই হোক না কেন; যে কোনো ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়েই এই শিরক করে থাকুক না কেন, এর কারণে তার তাওহীদের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাবে এবং সে মুশরিক সাব্যস্ত হবে। তেমনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পর যেকোনো ধরনের ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়ে যিল্লী নবী বা ছায়ানবী, বুরুযী নবী বা মাজহার বলে কাউকে নবী মনে করা- এটা স্পষ্ট কুফর। যে কোনো ধরনের ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়েই এমন করে থাকুক তার খতমে নবুওতের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাবে এবং সে কাফের সাব্যস্ত হবে।
কাদিয়ানীরা খুব জোরালো কণ্ঠে কালিমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ পড়ে। তাদের গাড়ি-বাড়ি এবং সবকিছুর মধ্যে খুব বড় করে কালিমা লিখে রাখে, যেন সাধারণ মুসলমানরা ধোঁকা খায় যে, এরাও তো আমাদের মতই কালিমা পড়ে এবং নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাসূল হিসেবে মানে। কিন্তু আমার ভাইয়েরা! এটা সম্পূর্ণ ধোঁকা ও প্রতারণা।
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাসূল হিসেবে স্বীকার করে নেয়ার পর কোনো ব্যক্তি যদি গোলাম আহমদ কাদিয়ানী বা অন্য কাউকে আল্লাহ তাআলার প্রেরিত নবী মনে করে, চাই যে অর্থেই নবী মনে করুক না কেন, তাহলে সে মূলত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাসূল হিসেবে অস্বীকার করছে। প্রভুত্বের ক্ষেত্রে অন্য কাউকে আল্লাহ তাআলার সাথে শরীক সাব্যস্ত করা সত্ত্বেও কেউ যদি মুখ দিয়ে কালিমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়ে তাকে যেমন কাফের বলা হবে, তেমনি রাসূলুল্লাহ-এর ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য যে, তাঁকে আল্লাহর রাসূল এবং সর্বশেষ নবী স্বীকার করার পর তাঁর পরের কোনো ব্যক্তিকে যদি কেউ নবী মেনে নেয়- তা যে কোনো ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়েই হোক না কেন, সে যতই মুখে محمد رسول الله বলুক না কেন- তাকে কাফের বলা হবে।
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর ঈমান আনার সর্বপ্রথম দাবি হল, নবীজীকে সত্য মনে করা এবং তিনি যা কিছু বলেছেন সবকিছুর ক্ষেত্রে তাঁকে সত্যবাদী মনে করা। সুতরাং তিনি যে বলেছেন- أنا خاتم النبيين ‘আমিই শেষনবী’- একথাও সত্য মনে করে মেনে নেওয়া।
একারণেই কেউ নবুওতের দাবি করলে তার থেকে এর দলীল-প্রমাণ জানতে চাওয়াও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওতের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করার নামান্তর। কেউ যদি দাঁড়িয়ে ঘোষণা দেয় যে, আমি প্রভু, আমি আল্লাহ; তাহলে আপনাদের কেউ কি তার দাবির পক্ষে দলীল-প্রমাণ জানতে চাইবেন যে, তুমি প্রভু হওয়ার দলীল কী- প্রমাণ দিয়ে তা সাব্যস্ত কর। কেউ জানতে চাইবে না। কেন? কারণ, আপনার এ ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস আছে যে, আল্লাহ একজন। তিনি ব্যতীত আর কেউ প্রভু হতে পারে না, ইলাহ হতে পারে না, মাবুদ হতে পারে না। তাই এ ব্যক্তি যতই প্রলাপ বকুক না কেন, এর দ্বারা আমাদের বিশ্বাসে সামান্য চিড় ধরবে না। আমাদের ঈমানে সামান্য সন্দেহ সৃষ্টি হবে না। এমনকি আমরা তার কাছ থেকে কোনো দলীল-প্রমাণও শুনতে চাইব না। ঠিক তেমনিভাবে কেউ যদি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পর নবুওতের দাবি করে, তা যে শিরোনামেই করুক- যিল্লী শিরোনামে হোক বা বুরূজী শিরোনামে- এক মুহূর্তের জন্যও আমাদের জন্য এটা জায়েয নয় যে, আমরা তার কাছে জানতে চাইব- তোমার নবুওতের পক্ষে দলীল কী? কারণ, তার মিথ্যাবাদী হওয়া তো এমনিতেই স্পষ্ট।
পৃথিবীর সমস্ত উলামায়ে কেরাম সর্বসম্মতিক্রমে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, যে ব্যক্তি গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে নবী বা রাসূল মনে করবে, তা সে যে অর্থেই মনে করুক, ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে।
প্রিয় ভাইয়েরা! আপনারা সূরা মুনাফিকূনের এ আয়াত পড়েছেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
اِذَا جَآءَكَ الْمُنٰفِقُوْنَ قَالُوْا نَشْهَدُ اِنَّكَ لَرَسُوْلُ اللهِ، وَ اللهُ یَعْلَمُ اِنَّكَ لَرَسُوْلُهٗ، وَ اللهُ یَشْهَدُ اِنَّ الْمُنٰفِقِیْنَ لَكٰذِبُوْنَ.
মুনাফিকরা যখন আপনার কাছে আসে তখন তারা বলে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, নিঃসন্দেহে আপনি আল্লাহর রাসূল। (এরপর আল্লাহ তাআলা বলেন,)
আল্লাহ জানেন, নিঃসন্দেহে আপনি আল্লাহর রাসূল। এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী। -সূরা মুনাফিকূন (৬৩) : ১
মুনাফিকরা বলছে, আমরা মন থেকে আপনাকে রাসূল হিসাবে স্বীকার করে নিচ্ছি; কিন্তু আল্লাহ তাআলা বলছেন যে, এরা মিথ্যা বলছে; এরা ধোঁকা দেয়ার জন্য শুধু মৌখিকভাবে কালেমা পড়ছে। মন থেকে তা স্বীকার করছে না। রাসূলের যামানায় যেসকল মুনাফিক ছিল তারাও রিসালাতের না‘রা ও শ্লোগান দিত, তাওহীদের না‘রা লাগাত। কিন্তু কুরআন তাদের ব্যাপারে কী ঘোষণা দিচ্ছে? কুরআন বলছে- মুনাফিকরা তো জাহান্নামের নিম্নতম স্তরে থাকবে।
এজন্য ভাইয়েরা আমার! মুসলমান হওয়ার জন্য কেবল মৌখিকভাবে কালিমা পড়া যথেষ্ট নয়। আল্লাহ তাআলার ক্ষেত্রে যেমন অন্য কাউকে শরীক করার অবকাশ নেই। কেউ এমন করলে সে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে। ঠিক তেমনিভাবে কেউ যদি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শেষনবী হওয়ার ব্যাপারে সামান্যতম সন্দেহ পোষণ করে, অন্য কাউকে নবী বলার চেষ্টা করে- সেও ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে।
তাহলে এ বিষয়টা নিয়ে কি আমাদের ভাবতে হবে না? আলহামদু লিল্লাহ, কাদিয়ানী ফিতনার শুরুর দিকেই আকাবিরে দেওবন্দ জনসাধারণকে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী যখন প্রথমে মাসীহে মাওউদ (প্রতিশ্রুত মাসীহ) হওয়ার দাবি করল, এরপর মাহদী হওয়ার দাবি করল -আল্লাহ তাআলা আমাদের আকাবিরগণের কবরকে নূর দিয়ে ভরপুর করে দিন। আল্লাহ তাআলা তাঁদেরকে এমন ঈমানী বসীরত এবং ইসলামের ব্যাপারে এমন সূক্ষ্ম অনুভূতি দান করেছেন যে, শুধু ঘ্রাণ শুনেও তারা উপলব্ধি করতে পারতেন যে, এখানে সমস্যা লুকিয়ে আছে- তখন উলামায়ে কেরাম মির্জা কাদিয়ানীর বিরুদ্ধে ঈমানের ঝা-া বুলন্দ করেন এবং জনসাধারণকে এ ফিতনার বিষয়ে সতর্ক করেন।
পরবর্তীতে যখন ধীরে ধীরে গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর নবুওত দাবির বিষয়সহ অন্যান্য কুফরী আকীদা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তখন সবাই সচেতন হয়ে যায় যে, উলামায়ে কেরাম যা বলেছেন সেটাই সঠিক; নিঃসন্দেহে সে ইসলাম থেকে খারিজ। হিন্দুস্তান-পাকিস্তান-বাংলাদেশ ও আশপাশের দেশ, যেমন আফগানিস্তান, বার্মা ইত্যাদি দেশের উলামায়ে কেরাম সর্বসম্মতিক্রমে মির্যা কাদিয়ানী কাফের হওয়ার সিদ্ধান্ত দেন।
সৌদি আরবে রাবেতাতুল আলামীল ইসলামী কর্তৃক আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সারা বিশ্বের বড় বড় উলামায়ে কেরাম অংশগ্রহণ করেন। সেখানে হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী, হাম্বলী সকল মাযহাবের বড় বড় উলামায়ে কেরাম উপস্থিত ছিলেন। তারাও সর্বসম্মতিক্রমে কাদিয়ানীদেরকে কাফের হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন।
শুধু তাই নয়, বরং সারা বিশ্বের সকল আলেম ও সকল মুফতী, সে যে ফেরকারই হোক না কেন বা যে মাযহাবেরই অনুসারী হোক না কেন- কাদিয়ানীদের অমুসলিম হওয়ার ব্যাপারে সকলে একমত। এতে না আছে কোনো ভিন্নমত, না আছে কোনো দ্বিধা-সংশয়।
আপনারা আপনাদের উলামায়ে কেরামের কাছে হয়ত শুনেছেন যে, একবার এক মহিলা ভাওয়ালপুর আদালতে মামলা দায়ের করে যে, তার স্বামী কাদিয়ানী হয়ে গেছে; ফলে সে কাফের হয়ে গেছে। সুতরাং বিবাহ ভেঙ্গে দেয়া হোক। তখন কাদিয়ানীরা চেষ্টা করছিল, তাদেরকে যেন মুসলমান হিসেবে মেনে নেওয়া হয় এবং বিবাহ বহাল থাকে।
তখন ছিল ইংরেজদের শাসনামল। ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার আগের ঘটনা। আল্লামা কাশ্মীরি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন একজন জীবন্ত কুতুবখানা। চব্বিশ ঘণ্টা তিনি কিতাব নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। পড়া ও পড়ানোই তাঁর মূল কাজ। কোথাও কোনো জলসা-সেমিনার ইত্যাদিতে যেতেন না। তাঁর সমস্ত জীবনজুড়ে ছিল শুধু কিতাব আর দরস-তাদরীস। যখন তাঁর কাছে এ সংবাদ পৌঁছল- আদালতে এ মামলার শুনানি চলছে এবং বিষয়টি এত স্পর্শকাতর ছিল যে, -আল্লাহ না করুন- আদালত যদি এ সিদ্ধান্ত দেয় যে, কাদিয়ানিরা মুসলমান; তাহলে মুসলমানদের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে।
আল্লামা কাশ্মীরি বুখারী শরীফ পড়াতেন। তিনি দরস বন্ধ করে নিজের সাথে কিছু ছাত্র নিয়ে দেওবন্দ থেকে ভাওয়ালপুর যান। সেখানে কিছুদিন থেকে আদালতে শক্তিশালী আলোচনা পেশ করেন। আদালতেও কাদিয়ানীরা একবার ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করেছিল। আমার উস্তাযগণের মুখে শুনেছি, কাদিয়ানী উকিল একবার ‘ফাওয়াতিহুর রহমূত শরহু মুসাল্লামিস সুবূত’ কিতাব থেকে একটি উদ্ধৃতি পড়ে শুনিয়ে বলে, দেখো এটা তো হানাফীদের কিতাব, তার মধ্যে ইবারত লেখা আছে এবং এ এবারত দ্বারা আমাদের আকীদা প্রমাণিত হয়। আল্লামা কাশ্মীরি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তখন জজ সাহেবকে বললেন, জজ সাহেব! কিছু কিতাব তো আমরাও পড়েছি। এ মুহূর্তে আমার কাছে ‘ফাওয়াতিহুর রহমূত শরহু মুসাল্লামিস সুবূত’ কিতাবটি নেই। তবে ৪০ বছর আগে আমি এ কিতাব পড়েছিলাম। সে আলোকে বলছি, আমার বিবাদী যে উদ্ধৃতি পড়ছে, এতে কিছু লুকোচুরি করছে। মাঝখানে মাঝখানে বাদ দিয়ে আগেপিছে থেকে পড়ছে। আমার কাছে কিতাব পেশ করা হোক। জজ তখন কিতাব চেয়ে পাঠান। কাশ্মীরি রহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর সামনে কিতাব পেশ করা হলে তিনি পুরো ইবারত দেখে বললেন, এ ব্যক্তি সবাইকে ধোঁকা দিচ্ছে। সে মাঝখান মাঝখান থেকে কিছু কিছু বাদ দিয়ে পড়ছে। জজ তখন বিষয়টি দেখলেন এবং তার সামনে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, এরা ধোঁকাবাজ!
মামলার কার্যক্রম শেষে আদালত এ রায় দেয় যে, কাদিয়ানী ধর্ম গ্রহণকারী ব্যক্তিটি ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে গেছে। সুতরাং মুসলিম মেয়েটি বিবাহ ভঙ্গের যে দাবি করেছে, তা সঠিক। অবশেষে আদালতের সিদ্ধান্তে সে বিবাহ বাতিল বলে ঘোষণা দেয়া হয় এবং কাদিয়ানীরা অমুসলিম বলে রায় প্রদান করা হয়।
কাশ্মীরি রাহ.-এর এ ভূমিকার পর আল্লাহর রহমতে কাদিয়ানী ফিতনা অনেকাংশে দমে যায়। ভারত ভাগের পর কাদিয়ানীরা পাকিস্তান চলে যায়। সেখানে তারা রাবওয়া নামক এলাকা আবাদ করে এবং সমস্ত কাদিয়ানীদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। এর পর থেকে আবার পুরোদমে তাদের কার্যক্রম শুরু হয়।
তখন পাকিস্তানে যেসকল আকাবির উলামায়ে দেওবন্দ ছিলেন- আল্লামা আতাউল্লাহ শাহ বুখারী, মনযূর আহমদ চিন্নৌঁটি, ইউসুফ বিন্নুরী, মুফতি শফী দেওবন্দী, মাওলানা আব্দুল হক, মাওলানা গোলাম রসূল খান তারাও সে কাজ শুরু করেন, যা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি করেছিলেন। এরা সবাই দেওবন্দের ছাত্র ছিলেন কিংবা দেওবন্দের ফয়েযধন্য ছিলেন। খানকা ছেড়ে তারাও ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। উলামায়ে কেরামের তীব্র আন্দোলনের ফলে অবশেষে পাকিস্তানের পার্লামেন্ট থেকে কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম সংখ্যালঘু হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়; যেমন আপনাদের দেশে যেসকল অমুসলিম আছে তাদেরকে সংখ্যালঘু স্বীকৃতি দেয়া হয়। হিন্দুস্তানেও যেখানে হিন্দুদের সংখ্যা বেশি সেখানে মুসলমানদেরকে সংখ্যালঘু বিবেচনা করা হয়। কিন্তু ইসলাম ও হিন্দু আলাদা ধর্ম। আপনাদের এখানে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ আর হিন্দুরা সংখ্যালঘু। হিন্দুস্তানে এর উল্টা; হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ আর মুসলমানরা সংখ্যালঘু। কিন্তু এটা তো হতে পারে না যে, একজন মানুষ মুসলমান হবে আবার হিন্দুও থাকবে। তেমনি এটাও সম্ভব নয় যে, একজন মানুষ কাদিয়ানী হবে আবার মুসলমানও থাকবে।
অনেকদিন পর্যন্ত এ ফেতনা একটি নির্দিষ্ট সীমায় আবদ্ধ ছিল কিন্তু যেহেতু তাদের ওপর পশ্চিমা শক্তির সাহায্য ও সমর্থন ছিল এবং পশ্চিমারাই খতমে নবুওতের বিরুদ্ধে গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে বীজরূপে বপন করেছিল ফলে তাদের ধন-সম্পদের সীমা-পরিসীমা নেই।
প্রত্যেক কাদিয়ানীর জন্য নিজের উপার্জনের নির্দিষ্ট অংশ তাদের ধর্মীয় ফান্ডে জমা দেয়া আবশ্যক। তারা নিজেদের ভ্রান্ত মতবাদ প্রচারের জন্য সেসকল অঞ্চলকেই বেছে নেয়, যেখানকার মুসলমানরা দরিদ্র এবং দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞ। কখনো সম্পদের লোভ দেখিয়ে, কখনো সন্তানদের শিক্ষা দেয়ার কথা বলে, কখনো চাকরি দেয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে, কখনো মেয়ের বিয়ের সমস্ত ব্যবস্থা করে দেয়ার কথা বলে, কখনো নগদ অর্থ দিয়ে সাধারণ মুসলমানদের তাদের শিকারে পরিণত করে চলেছে। যেসকল মুসলিম শিশু তাদের চক্রান্তের শিকার হয়, তাদের ব্যাপারে তারা বলে, আমরা তাদেরকে শিক্ষিত করে আবার আপনাদের কাছে ফিরিয়ে দিব। অবশেষে তাদেরকে কাদিয়ানী বানিয়ে ফেলে।
প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! যখন এ ফেতনা ব্যাপক হতে লাগল তখন দারুল উলূম দেওবন্দে তাহাফফুযে খতমে নবুওত বিষয়ে আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন করা হল।
এতক্ষণ খতমে নবুওত নিয়ে আলোচনা করেছি এখন আমরা তাহাফফুযে খতমে নবুওত- তথা কীভাবে খতমে নুবওত-এর সংরক্ষণ করব এ সংক্রান্ত আলোচনা করব।
প্রিয় ভাইয়েরা! এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী? প্রথম কথা তো হল আমাদের অনেক ভাই জানে না যে, আকীদায়ে খতমে নবুওত কী? এর অর্থ কী? এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? মনে করে, মুসলমানদের মধ্যে যেমন অনেক দল আছে, বেরেলবী, মওদুদী, আহলে হাদীস; এদের সবার মাঝে কিছু মতপার্থক্য থাকলেও এরা সবাই মুসলমান। এমনিভাবে কাদিয়ানীরাও মুসলমানদের একটি দল। আর আশ্চর্য ব্যাপার হল, মুসলিমদের যত দল আছে, কেউ তাদের নামের সাথে ‘মুসলিম’ শব্দটি যোগ করে না, কেউ বলে না- দেওবন্দী মুসলিম, বেরেলবী মুসলিম, সালাফী মুসলিম। কারো এ শব্দ বলার প্রয়োজন পড়ে না, তাহলে কাদিয়ানীদের নামের মধ্যে কেন (আহমদীয়া মুসলিম জামাত) ‘মুসলিম’ টাইটেল লাগানোর প্রয়োজন পড়ল? আসল কথা হল, এরা প্রতারক। নইলে নিজেদেরকে আহমদিয়া ‘মুসলিম’ জামাত বলার কী প্রয়োজন!
মুসলিমদের মাঝে অনেক বড় বড় ফেরকা তৈরি হয়েছে। যেমন- খাওয়ারেজ, মুতাযেলা, জাহমিয়া, মুরজিয়া। দৃষ্টিভঙ্গি ও আকিদাগত মতপার্থক্যের ভিত্তিতে প্রত্যেক যুগেই মুসলমানদের মাঝে বিভিন্ন ফেরকা ও দল সৃষ্টি হয়েছে -আমরা তাদের সব বিষয়ের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করি না; বরং ভিন্নমত পোষণ করি- কিন্তু এদের কারোরই নিজেদের নামের সাথে ‘মুসলিম’ শব্দটি লাগানোর প্রয়োজন হয়নি। কারণ, এরা মুসলমানদেরই বিভিন্ন ফেরকা। সুতরাং কাদিয়ানীদের ‘আহমদীয়া মুসলিম জামাত’ নাম ধারণ করাটাই ইঙ্গিত করছে যে, এটি মিথ্যা নাম, যার মাধ্যমে এরা মুসলমানদের কাতারে ঢুকতে চাচ্ছে।
এজন্য সর্বপ্রথম জরুরি কাজ হল, আজ যেভাবে এ সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে তেমনি প্রত্যেক এলাকায় মুসলমানদের একত্রিত করে তাদেরকে আকীদায়ে খতমে নবুওত-এর মর্ম ও গুরুত্ব বোঝাতে হবে।
দ্বিতীয় কথা হল, বাচ্চাদের দ্বীনের মৌলিক শিক্ষাদানের ব্যাপারে আমাদেরকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে, যেমনিভাবে নেসাবের মধ্যে নামায-রোযা ও পাক-নাপাকের মাসায়েল শেখানো হয়, প্রাথমিক ছাত্রদেরকে তালীমুল ইসলাম পড়ানো হয়, তেমনি বাচ্চাদেরকেও আকীদার কিছু মৌলিক কিতাব পড়ানো উচিত। এ ব্যাপারে দারুল উলূম দেওবন্দ-এর পক্ষ থেকে একটি কাজ করা হয়েছে। মাওলানা শাহ আলম ছাহেব, যিনি ‘শো‘বায়ে তাহাফফুজে খতমে নবুওত’-এর শিক্ষক এবং এই শো‘বার নায়েবে নাজিম, তিনি ‘আকাইদুল ইসলাম’ নামে গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং মাওলানা রিয়াসাত আলী ছাহেব, মুফতী সাঈদ আহমদ পালনপুরী ছাহেবকে প্রতিটি শব্দ শব্দ দেখিয়ে সম্পাদনা করে এ কিতাব প্রকাশ করেছেন। এ কিতাবটির ব্যাপক প্রচার-প্রসার হওয়া দরকার এবং প্রত্যেক মাদরাসার মক্তবে এবং প্রাথমিক জামাতগুলোতে যেভাবে ছাত্রদেরকে নামায শেখানো হয়, রোযা শেখানো হয়, তেমনি মাহদী-এর পরিচয়, ঈসা আলাইহিস সালাম-এর পরিচয়, কিয়ামতের পূর্বে প্রকাশিত নিদর্শনাবলী এবং খতমে নবুওতের অর্থ ও মর্ম ইত্যাদি বিষয়গুলো শেখাতে হবে। যখন শিশুরা শৈশবেই এ বিষয়গুলো পড়বে তখন বড় হবার পর এর বিপরীত কোনো কথা কানে পৌঁছলে শৈশবেই যেহেতু এ বিশ্বাস হৃদয়ে গেঁথে গেছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পর কোনো নবী আসবে না- তখন সাথে সাথেই সে এই ভ্রান্ত আকীদাকে অস্বীকার করবে এবং এর হাত থেকে বেঁচে যাবে।
প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! তৃতীয় কথা হল, ঈমান আমাদের সবচেয়ে বড় পুঁজি। ঈমান বাঁচানোর জন্য যত বড় কোরবানী দেয়ার প্রয়োজন হোক না কেন মানুষ দিতে প্রস্তুত। দুঃখ, দারিদ্র্য, অসুস্থতা ইত্যাদি বিভিন্ন সমস্যা সাময়িক ব্যাপার। দুনিয়া থেকে যাওয়ার সাথে সাথেই এ সবকিছু শেষ হয়ে যাবে; কিন্তু ঈমান আমাদের সাথে যাবে। আখেরাতে সফলতা ও ব্যর্থতার সবকিছুই ঈমানের উপর নির্ভরশীল। তাই -আল্লাহ না করুন- যদি কেউ এ অবস্থার সম্মুখীন হয় যে, সে পেরেশানীর মধ্যে আছে। অভাব-অনটনে জর্জরিত। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো পথ তার সামনে খোলা নেই। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে কোনো ভ্রান্ত ফেরকা- চাই কাদিয়ানী হোক, কিংবা খ্রিস্টানমিশনারী তাকে লোভ দেখিয়ে ইসলাম ত্যাগ করতে প্ররোচিত করে তখন যেন সে ঈমানের উপর অটল-অবিচল থাকে এবং প্রত্যয়-দীপ্ত কণ্ঠে এ কথা বলতে পারে যে, জান দিয়ে দেব কিন্তু ঈমান বিক্রি করব না।
প্রিয় বন্ধুগণ! যেসকল প্রতিষ্ঠান ও মাদরাসা, যেসকল সংগঠন ও উলামায়ে কেরাম তাহাফফুজে খতমে নবুওতের কাজ করেন এবং এ মেহনত নিয়ে ভাবেন, আমাদের সবাইকে তাদের সাথে একাত্মতা পোষণ করতে হবে। তাদের সহমর্মী হতে হবে এবং সাধ্যানুযায়ী তাদেরকে সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করতে হবে। যখন যেখানে যে ধরনের কাজ ও কোরবানীর প্রয়োজন পড়বে তার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখতে হবে এবং আগে বেড়ে কোরবানী দিতে হবে। তাহলেই সম্ভব তাহাফফুযে খতমে নবুওত ও আকীদায়ে খতমে নবুওতের সংরক্ষণ।
আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি যখন ভাওয়ালপুর যান তখন তিনি বলেছিলেন, যদি হাশরের ময়দানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে জিজ্ঞাসা করেন যে, আমার নবুওতের ওপর হামলা হচ্ছিল আর তুমি দরসগাহে বসে বসে বুখারী পড়াচ্ছিলে? তখন আমি কী উত্তর দিব?
তিনি স্বীয় শাগরিদদের এ বিষয়ে ওসিয়ত করেছিলেন। আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, মাওলানা মানাযির আহসান গিলানি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, প্রমুখ পৃথিবী আলো করা ছাত্রদের তিনি ওসিয়ত করেছিলেন যে, তোমরা যেখানেই থাকো দ্বীনের যে কাজে সম্পৃক্ত থাক; মাদরাসায় পড়াও কিংবা ব্যবসা বা চাকরি কর, যাই কর না কেন, সর্বাবস্থায় তাহাফফুজে খতমে নবুওতকে নিজের প্রথম দায়িত্ব মনে করবে।
প্রিয় ভাইয়েরা! আমি সাআদাত হাসিলের জন্য আজ আপনাদের এই সমাবেশে উপস্থিত হয়েছি। আমি আপনাদের কাছে আবেদন করব, ওলামায়ে কেরাম এ ব্যাপারে যে আলোচনা করেছেন আপনারা সে আলোচনার গুরুত্ব অনুধাবন করুন এবং আরো যারা সামনে আলোচনা করবেন মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনুন। আপনারা নিজ সন্তানদেরকে একথা ভালোভাবে বুঝিয়ে বলুন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ নবী, তারপর কাউকে নবী মনে করা -তা যে অর্থেই হোক- কিংবা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ নবী হওয়ার ব্যাপারে সামান্যতম সন্দেহ পোষণ করা ইসলাম ও ঈমান থেকে বের হওয়ারই নামান্তর।
দারুল উলূম দেওবন্দে আলমী মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুওত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সমগ্র হিন্দুস্তানজুড়ে এর শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে আছে। আমাদের দেওবন্দী উলামায়ে কেরামের বিশেষ গুণ হল, নিজে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, অনেক বড় ব্যক্তিত্বের অধিকারী এবং অসংখ্য মুরিদ থাকা সত্ত্বেও নিজের মারকাযের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখেন এবং মাদারে ইলমী (দারুল উলূম দেওবন্দ) থেকে যখনই যে আহ্বান করা হয় সে ডাকে লাব্বাইক বলেন, সে ডাকে সাড়া দিয়ে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
বাংলাদেশে এমন কিছু বড় বড় প্রতিষ্ঠান আছে, ছাত্রসংখ্যার বিচারে তার কোনো কোনোটার ছাত্রসংখ্যা দারুল উলূম দেওবন্দের ছাত্রসংখ্যার সমান কিংবা তার চেয়েও বেশি, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা সবাই, দারুল উলূম দেওবন্দকে নিজেদের মারকায মনে করেন; মারকায মনে করার অর্থ শুধু এটুকুই নয় যে, সেখানকার নেসাব সেখানকার কিতাব পড়ানো হয় বা দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে কোনো শিক্ষক এখানে পড়াতে আসেন বা সেখান থেকে কোনো পরীক্ষক এসে এখানে পরীক্ষা নেন; বরং তারা দারুল উলূমকে এ হিসাবে মারকায মনে করেন যে, দ্বীনী জযবা, দ্বীনের বিশুদ্ধ আকীদা এবং দ্বীন হেফাযতের যে চেতনা দারুল উলূমের আকাবিরগণ নিজেদের মাঝে ধারণ করতেন তা নিজেদের মাঝে ধারণ করার চেষ্টা করেন এবং সবসময় প্রস্তুত থাকেন যে, আমাদের মারকায থেকে দ্বীনের হেফাযতের জন্য যখনই যে ডাক আসবে সে ডাকে আমরা সাড়া দেব। আজকের এই সমাবেশ এ ধারারই একটি অংশ।
আল্লাহ তাআলা এ মজলিশকে কামিয়াব করুন!
ভাই, আমি অসুস্থ। খুব বেশি কথা বলার মত অবস্থা আমার নেই; যা বলার সংক্ষেপে আপনাদের সামনে পেশ করেছি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে কবুল করুন এবং খতমে নবুওতের হেফাজতের জন্য আমাদের এই চেষ্টা ও মেহনতকে নাজাতের উসিলা বানিয়ে দিন- আমীন। ষ
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.
[মুসাজ্জিলা থেকে পত্রস্থকরণ : মুহাম্মাদুল্লাহ মাসুম
অনুবাদ : শাহাদাত সাকিব]