শাবান-রমযান ১৪৪০   ||   এপ্রিল-মে ২০১৯

খাদ্য : ইতিবাচক উদ্যোগ

ইবনে নসীব

গত ৬ ও ৭ মার্চ রাজধানীর হোটেল লা-মেরিডিয়ানে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল আন্তর্জাতিক পোল্ট্রি সেমিনার। ১১ তম এই আন্তর্জাতিক সেমিনারের শ্লোগান ছিল ‘পোল্ট্রি ফর হেলথ লিভিং’। ওয়ার্ল্ড পোল্ট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ ব্রাঞ্চ (ওয়াপসা বিবি) সেমিনারটির আয়োজন করে। এতে অংশগ্রহণ করেন  দেশ-বিদেশের বিখ্যাত স্কলারগণ। পোল্ট্রি-শিল্পের সঙ্কট ও সম্ভাবনা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ- মতামত আসে সেমিনারটিতে। এ ধরনের ইতিবাচক তৎপরতা নিঃসন্দেহে সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।

পোল্ট্রি-শিল্পটি অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি শিল্প। পুষ্টির সহজলভ্যতা ও দারিদ্র্য বিমোচনে এ শিল্পের অবদান স্বীকৃত। বিশেষজ্ঞদের মতে মুরগীর গোশতে কোলেস্টরেলের মাত্রা নেই বললেই চলে। পাশাপাশি এর পুষ্টিগুণও অন্যান্য গোশতের চেয়ে বেশি। পোল্ট্রি-শিল্পের বিকাশের কারণে আমাদের দেশে পোল্ট্রি সহজলভ্য ও সস্তা, কিন্তু একশ্রেণির পোল্ট্রি-ব্যবসায়ী ও পোল্ট্রি-ফিড প্রস্তুতকারীর অসাধুতার কারণে গোটা শিল্পটিই এখন প্রশ্নের মুখে। খামারের মাছ-মুরগীর ব্যাপারে সঙ্গত কারণেই জনমনে আছে শঙ্কা-সংশয়।

কিছু অতিমুনাফা লোভী অসাধু ব্যবসায়ী কর্তৃক ট্যানারির বিষাক্ত বর্জ দিয়ে পোল্ট্রি-ফিড তৈরির বিষয়টি সচেতন মহলের অজানা নয়। হাইকোর্টের রায়ে ট্যানারির বর্জ্য দ্বারা পোল্ট্রি-ফিড তৈরি নিষিদ্ধ হলেও তা বন্ধ হয়নি। এবছরের জানুয়ারিতে সাভারের ভাকুর্তা ইউনিয়নের মোগড়কান্দা এলাকায় ট্যানারির বর্জ দিয়ে মাছ ও মুরগীর খাদ্য তৈরির তিনটি কারখানায় অভিযান চালিয়েছিল র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এসময় প্রায় ৫ হাজার টন ট্যানারি বর্জ আগুনে পোড়ানো হয়। আটক করা হয় ৮ কর্মচারীকে, যাদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ট্যানারিগুলোতে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বহু ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হল ‘ক্রোমিয়াম’।

ক্রোমিয়াম সাধারণ তাপমাত্রায় নষ্ট হয় না। এ বিষয়ে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ড. রাশেদ নূর বলেন, খাদ্য উপাদানের মাধ্যমে মুরগির শরীরে যে পরিমাণ ক্রোমিয়াম প্রবেশ করে তার তাপ সহনীয় ক্ষমতা ২৯০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। আর রান্না করা হয়ে থাকে ১০০-১৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপে। ফলে রান্না করার পরও গোশতে ক্রোমিয়ামের উপস্থিতি থাকে শতভাগ। ফলে এ বিষাক্ত ক্রোমিয়াম মানবদেহে প্রবেশ করে স্থায়ীভাবে কিডনি, লিভার, মস্তিষ্কসহ শরীরের এমন কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেই, যার ক্ষতি করে না। এছাড়া এই বিষাক্ত ক্রোমিয়াম দেহের কোষ নষ্ট করে দেয়, যা পরে ক্যান্সার সৃষ্টি করে। তার মতে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ দৈনিক খাবারের সাথে ৩৫ মাইক্রোগ্রাম ক্রোমিয়াম খেতে পারে, অথচ সেখানে আমরা গড়ে ৯০ থেকে ৯৭ মাইক্রোগ্রাম খাচ্ছি, যা আমাদের মৃত্যুরও কারণ হতে পারে। (দৈনিক নয়া দিগন্ত, পৃষ্ঠা ১৩, ৫ মার্চ ২০১৯)

এছাড়া মুরগীর বাচ্চা বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োগ করা হয় অনেক বেশি অ্যান্টিবায়োটিক, যা মানুষের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

এদিকে পোল্ট্রির অপরিশোধিত বর্জ্য ব্যবহার করা হয় মাছের খাদ্য হিসেবে। ব্যবহার করা হয় সবজি চাষের জমিতে সার হিসেবে। ফলে খামারের মাছ ও শাক-সবজিতেও বিষ ছড়িয়ে পড়ছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর নগদ মুনাফার লোভ এভাবে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে মানুষের জীবন ও সুস্থতাকে।

পোল্ট্রি-শিল্পের মতো একটি অতি প্রয়োজনীয় শিল্পে এ ধরনের অসাধুতার সংবাদের মাঝে সততা, দায়িত্বশীলতা ও ইতিবাচক উন্নতির পথে এগিয়ে যাওয়ার কিছু দৃষ্টান্ত যখন সামনে আসে তখন সেটা নিঃসন্দেহে সুখের বিষয়। আলোচিত সেমিনারে বক্তারা বলেছেন, মানসম্মত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়ানোর যথেষ্ট সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে এবং বাড়াতে হবে উপযুক্ত গবেষণা। গবেষণা বৃদ্ধি ও বায়োসিকিউরিটি বাড়িয়ে মানসম্মত উৎপাদনের উপর গুরুত্ব দিতে হবে।

আমরা সংশ্লিষ্ট সবাইকে সাধুবাদ দিচ্ছি এবং উন্নতির পথে তাদের গতি স্বচ্ছন্দ হোক- এই কামনা করছি।

দেশের পোল্ট্রি-ব্যবসায়ীদেরও সচেতন হওয়া কর্তব্য। আমাদের দেশে যেমন মারাত্মক ক্ষতিকর পোল্ট্রি ফিড পাওয়া যায় তেমনি পাওয়া যায় মানসম্মত পোল্ট্রি-ফিডও। কাজেই সস্তার প্রলোভনে না পড়ে ব্যবসায়ীদের কর্তব্য মানসম্মত পোল্ট্রি-ফিড ব্যবহার করা। এতে তাদের ব্যবসাও যেমন লাভজনক হবে তেমনি আখিরাতের কঠিন জবাবদিহিতা থেকেও মুক্তি পাবেন। ভোক্তা সাধারণেরও সচেতন হওয়া কর্তব্য। নিজের ও পরিবার-পরিজনের সুস্থতা ও নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতন হওয়া ইসলামের শিক্ষা। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন।

 

 

advertisement