শাবান-রমযান ১৪৪০   ||   এপ্রিল-মে ২০১৯

সম্মানিত উলামা-খুতাবার খেদমতে

মাওলানা ইউসুফ লুধিয়ানভী

উলামায়ে কেরাম হচ্ছেন দ্বীনের ধারক-বাহক এবং জাতির কর্ণধার। এ কারণে তাদের উপর অর্পিত হয় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। সেসকল দায়িত্বের গুরুত্ব ও মর্যাদা যথাযথভাবে উপলব্ধি করে তা পালনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা আমাদের কর্তব্য। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওাসাল্লামের পক্ষ থেকে যে আমানত আমাদের হাতে সোর্পদ করা হয়েছে তা রক্ষা করা এবং উম্মতকে নবীজীর পথে পরিচালিত করার জন্য সর্বাত্মক মেহনত করা আমাদের অপরিহার্য জিম্মাদারী।

যেসকল উলামায়ে কেরাম ইমামত ও খেতাবাতের দায়িত্ব আঞ্জাম দিচ্ছেন তাদের মাধ্যমে যেন এলাকার লোকদের বেশি থেকে বেশি দ্বীনী উপকার হয় এবং মসজিদের সাথে মানুষের গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠে এ বিষয়ে তাদের মনোযোগী হওয়া উচিত। এজন্য নি¤œলিখিত পন্থাগুলো অবলম্বন করা যেতে পারে :

* গুরুত্বের সাথে নিয়মিত কুরআনে কারীম, হাদীসে নববী ও মাসআলা-মাসায়েলের দরস প্রদান করা এবং এর জন্য উপযোগী সময় নির্ধারণ করা।

* যেসকল মসজিদে মকতব নেই সেখানে মকতব প্রতিষ্ঠা করা। আর যেখানে আছে সেগুলোর নেগরানী করা। উৎসাহ দিয়ে বাচ্চাদেরকে মকতবে নিয়ে আসা। যেন এলাকার একটি শিশুও কমপক্ষে কুরআন শরীফ সহীহশুদ্ধভাবে নাযেরা পড়ার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত না হয়। এমনিভাবে বাচ্চাদেরকে কুরআনের হাফেয বানানোর জন্য অভিভাবকদের উদ্বুদ্ধ করা।

* প্রাপ্তবয়স্কদের দ্বীন শিক্ষা ও কুরআন শিক্ষার প্রতি উৎসাহিত করা এবং নিজে এর জন্য সময় বের করা।

* দ্বীনের সাথে যুবকদের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তোলার ফিকির করা এবং তাদের দ্বীনী তালিম ও তারবিয়াতের জন্য সময় দেয়া।

* জুমার খুৎবাপূর্ব আলোচনাটি দায়সারাভাবে  না করে গুরুত্বপূর্ণ দ্বীনী বিষয়ে সুন্দরভাবে গুছিয়ে আকর্ষণীয়ভাবে আলোচনা করা। এর জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি নেয়া এবং যথাসাধ্য আলোচনার হক আদায় করার চেষ্টা করা। আলোচনা যেন তারগীবী ও উৎসাহমূলক হয় এবং এর দ্বারা শ্রোতাদের ফিকরী ও আমলী ইসলাহ হয় এদিকে সবিশেষ খেয়াল রাখা।

* যেসকল মসজিদে তাবলীগের মেহনত আছে সেখানকার তাবলীগের সাথীদের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তোলা। যথাসম্ভব তাদের সাহায্য করা এবং যুবকদের তাশকীল করে তাবলীগ জামাতের সাথে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করা।

* বিভিন্ন ফেরাকে বাতেলা ও নতুন-পুরাতন নাস্তিক্যবাদের ফেতনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা অনেকেই এগুলোর ভয়াবহতা উপলব্ধি করি। কিন্তু এর প্রতিরোধ এবং সংশোধনের কোনো চেষ্টাই করি না। কিংবা এমনভাবে করি, যার দ্বারা মানুষের সংশয় দূর হয় না।

এজন্য সকল ভ্রান্ত মতবাদ (যেমন, খ্রিস্টবাদ, কাদিয়ানিয়াত, শিয়া মতবাদ, হাদীস অস্বীকার, সাহাবায়ে কেরামের সুমহান মর্যাদা অস্বীকার, পুঁজিবাদ, কমিউনিজম, ধর্মনিরপেক্ষতা, ধর্মহীনতা ইত্যাদি) সম্পর্কে বিস্তৃত ও গভীর পড়াশোনা করা এবং ইতিবাচক পন্থায় চিন্তা ও মন-মানসিকতার সংশোধনের চেষ্টা করা। আলোচনার মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট দল বা মতবাদের নাম না নিয়ে মাঝে মাঝেই তাদের ভুল চিন্তাধারাগুলো সংশোধন করা। উদাহরণ স্বরূপ, যদি হাদীস অস্বীকারের ফেতনার ইসলাহ মাকসাদ হয় তাহলে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র বাণীর মর্যাদা এমন হৃদয়গ্রাহী করে উপস্থাপন করা, যেন হাদীস অস্বীকারকারীদের বালুর প্রাসাদ এমনিই গুড়িয়ে যায়। শিয়া মতবাদের খণ্ডন করা উদ্দেশ্য হলে সাহাবায়ে কেরামের ফযীলত ও মর্যাদা বর্ণনা করা। কাদিয়ানী মতবাদ খণ্ডন করতে চাইলে খতমে নবুওতের প্রমাণ ও এর দাবিগুলো মানুষকে বুঝানোর চেষ্টা করা। গাইরে মুকাল্লিদিয়্যাতের ইসলাহ করতে চাইলে মুজতাহিদ ইমামগণের মর্যাদা ও আমাদের উপর তাদের ইহসানসমূহ হৃদয়গ্রাহী করে উপস্থাপন করা। অন্যান্য মতবাদের ক্ষেত্রেও এ ধরনের পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে।

জুমার বয়ানের পাশাপাশি ঘরোয়া মাহফিল ও পরিবেশেও এ ধরনের ফেরাকে বাতেলার খণ্ডন করা চাই। বিশেষ করে কেউ যদি এ ধরনের ভ্রান্ত চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয় তাহলে অনেক হেকমত ও প্রজ্ঞার সাথে আন্তরিক ও সহমর্মী হয়ে তার চিন্তার সংশোধন করার চেষ্টা করা উচিত।

* বয়ানের মধ্যে এবং একান্ত মজলিসে সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম এবং বুযুর্গানে দ্বীন রাহিমাহুমুল্লাহ, বিশেষত আকাবিরে দেওবন্দের বিভিন্ন অবস্থা, ঘটনা ও মালফুযাত-ইরশাদাত গুরুত্বের সাথে বয়ান করা উচিত। এ সকল ঘটনা বর্ণনা করার দ্বারা আকাবিরের প্রতি মুহাব্বত ও ভালোবাসা সৃষ্টি হয়, যা সমস্ত বিদআত এবং ফেতনা থেকে বাঁচার মহৌষধ।

যেসকল উলামায়ে কেরাম ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে সম্পৃক্ত তাদের উচিত এটাকে শুধু উপার্জনের মাধ্যম মনে না করে দাওয়াত ও তাবলীগের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম মনে করা। এক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো লক্ষণীয় :

* ক্রয়-বিক্রয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত শরয়ী বিধি-বিধান ভালোভাবে জানা এবং সে অনুযায়ী আমল করার চেষ্টা করা।

* দোকানে যে গ্রাহক আসবে কিংবা যার সাথে লেন-দেনের প্রয়োজন পড়বে কথার মাঝে মাঝে তার সাথে শরীয়তের বিধি-বিধান নিয়ে আলোচনা করা।

* আশেপাশের দোকানদারদের সাথে  সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং ঈমানী মুযাকারা করার চেষ্টা করা। এর জন্য কিছু সময় বরাদ্দ রাখা।

* বাজারে যেহেতু ব্যাপকহারে মানুষ আল্লাহর যিকির থেকে উদাসীন থাকে এজন্য সেখানে যিকিরের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই যবানে যিকির, তাসবীহ, দরূদ শরীফ ইত্যাদি জারি রাখা এবং তাতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার চেষ্টা করা।

* দুনিয়াবি কাজকর্ম ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সময় সাধারণত নামাযের ব্যাপারে উদাসীনতা দেখা যায়। তাই আযান হওয়া মাত্রই জামাতের সাথে নামায পড়ার খুব ইহতেমাম করা।

* সাহাবায়ে কেরাম রা. বুযুর্গানে দ্বীন এবং আকাবিরের জীবনী ও ঘটনা মুতালাআ অব্যাহত রাখা এবং অন্যদের সাথে এ সংক্রান্ত মুযাকারা করা।

যেসকল উলামায়ে কেরাম স্কুল, কলেজ ও ভার্সিটিতে শিক্ষাদানে নিয়োজিত আছেন তাদেরকে আল্লাহ তাআলা দ্বীনী দাওয়াতের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রশস্ত ময়দান দান করেছেন। নিজেদের আলেমসুলভ গাম্ভীর্যের মাধ্যমে দ্বীনের অনেক বড় খেদমত তারা আঞ্জাম দিতে পারেন। বর্তমান সময়ে আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবেশ অনেকটাই ধর্মহীন। উলামায়ে কেরাম যখন এমন ধর্মহীন পরিবেশে পা রাখেন তখন কারো কারো অবস্থা এমন হয় যে, পরিবেশকে প্রভাবিত করার পরিবর্তে নিজেই পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যান। মানসিক হীনম্মন্যতার শিকার হন। ফলে সে পরিবেশে দ্বীনী খেদমত করার আর সুযোগ হয়ে ওঠে না। পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হওয়া আলিমের শান নয়; বরং ভাবা উচিত, আল্লাহ তাআলা দ্বীনের দৌলত এবং সুন্নতে নববীর মহা নিআমত দান করে এ পরিবেশে তাকে আলোর মশালরূপে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা তার হৃদয়ে যে দৌলত গচ্ছিত রেখেছেন, তার হাতে আলোর যে মশাল দান করেছেন তা এ পরিবেশের অন্ধকার দূর করে একে কল্যাণের আলোয় উদ্ভাসিত করে তুলবে। তাই পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে বরং পরিবেশকে প্রভাবিত করা উচিত।

নিজের অন্যান্য শিক্ষকবন্ধুদেরকে দ্বীনের প্রতি উৎসাহিত করা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দ্বীনের নির্দেশাবলী উন্নত করার চিন্তা করা কর্তব্য। যেসকল ছাত্রের শিক্ষাদানে নিয়োজিত আছেন তাদেরকে দ্বীনের রঙে রঙিন করার চেষ্টা করতে হবে। কুরআন ও হাদীসের দিকনির্দেশনাগুলো সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। মাঝে মাঝে বুযুর্গানে দ্বীনের ঘটনাবলী শুনিয়ে নেক কাজে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। চারিত্রিক সৌন্দর্যে সুশোভিত হওয়ার পাশাপাশি দ্বীনী দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে পালন করার চেতনা হৃদয়ে জাগ্রত করতে হবে। একইসাথে যুবক ছেলেদেরকে তাবলীগ জামাতে সময় দেয়ার প্রতি উৎসাহিত করা যায় এবং দাওয়াতের মেহনতের সাথে জুড়ে রাখার চেষ্টা করা যায়। মোটকথা, উলামায়ে কেরাম জীবনের যে অঙ্গনেই কর্মব্যস্ত থাকুন না কেন, নিজেকে সবসময় দ্বীনের মুবাল্লিগ ভাবা উচিত এবং অন্যান্যদেরকে বেশি থেকে  বেশি দ্বীনী ফায়েদা পৌছানোর চেষ্টা, ফিকির ও মেহনত করা  উচিত।

অন্যের ফিকির করার পাশাপাশি নিজের ইলমী-আমলী এবং ফিকরী তারাক্কির প্রতিও যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া উচিত। এজন্য নিম্নোক্ত কাজগুলো করা যেতে পারে :

* ইলমী তারাক্কির জন্য কুরআনে কারীম, হাদীসে নববী, ফিকহ ও ফতোয়া সংক্রান্ত কিতাবাদির মুতালাআ অব্যাহত রাখা।

* তাফসীরের জন্য বয়ানুল কুরআন, ফাওয়ায়েদে উসমানী এবং মা‘আরেফুল কুরআন মুতালাআ করা।

* হাদীসের জন্য মেশকাত শরীফ, রিয়াযুস সালেহীন, জামউল ফাওয়াইদ, তরজমানুস সুন্নাহ, মাআরিফুল হাদীস, হায়াতুস সাহাবা ইত্যাদি মুতালাআ করা।

* ফিকহের জন্য বেহেশতি জেওর, উমদাতুল ফিকহ, ইমদাদুল ফাতাওয়া, ফাতাওয়া দারুল উলূম দেওবন্দ ইত্যাদি মুতালাআ করা।

* বুযুর্গানে দ্বীনের জীবনী ও ঘটনার জন্য নকশে হায়াত, আশরাফুস সাওয়ানেহ, উলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাযী, আরওয়াহে ছালাছা, তাযকিরাতুর রশীদ, তারীখে দাওয়াত ও আযীমত এবং এ ধরনের অন্যান্য কিতাব মুতালাআ করা।

ইলমী তারাক্কির জন্য হযরত থানবী রাহ.-এর মাওয়ায়েয ও মালফুযাত মুতালাআ করা।

উলামায়ে কেরাম যেহেতু উম্মতের মধ্যে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী তাই তাদের উন্নতি ও অবনতি দ্বারা গোটা সমাজ প্রভাবিত হয়। এজন্য নিজের ইসলাহ ও উন্নতি এবং তারবিয়াত ও আত্মসংশোধনের জন্য প্রত্যেক আলেমের কোনো শায়খে কামেলের সাথে সম্পৃক্ত থাকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। উলামায়ে কেরামের এ বিষয়টি খুব খেয়াল রাখা চাই।

 

(অনুবাদে : শাহাদাত সাকিব)

 

 

advertisement