তার দুঃখটা কোথায় তা আমরা বুঝতে পারছি!
বামপন্থি রাজনীতিবিদদের নিয়ে আলকাউসারের পাতায় লেখা হয়েছে কয়েক বছর হয়ে গেল। এর কারণ সুস্পষ্ট। বামদলগুলোর অনেক বড় নেতা তাদের দল-বলসহ ক্ষমতাসীন জোটের অংশ হয়ে এমপি ও মন্ত্রিত্বের ‘গুরু দায়িত্ব’ পালন করে আসছেন বিগত কয়েক বছর থেকেই। তাই ঐসব নেতার মূল পুঁজি এতদিন অনেকটা ব্যবহার ছাড়াই অলস পড়েছিল। পাঠক মহল নিশ্চয়ই ধারণা করে ফেলেছেন কোন পুঁজিটির দিকে আমি ইশারা করতে চাচ্ছি। তাদের মূল পুঁজিই তো হল ইসলাম, ইসলামী শিক্ষা এবং এ শিক্ষায় শিক্ষিতদের সম্পর্কে কটূক্তি করা, ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলোকে হেয় প্রতিপন্ন করা। এ নিয়মিত ডিউটিতে তাদের অনেকে অনিয়মিত হয়ে পড়েছিলেন মূলত উপরোক্ত কারণে।
আর আমরা যারা দ্বীনী উদ্দেশ্যে দু-চার কলম লিখি তারাও একেবারে প্রয়োজন হয়ে না পড়লে সাধারণত কারো সম্পর্কে নেতিবাচক কথা বলতে চাই না- আমাদের পেশাগত নীতি-আদর্শের কারণেই। না হয় এজাতের রাজনীতিকদের আদর্শ নিয়ে বলার থাকে অনেক কিছু।
কিন্তু এত বছর পর আবারো তাদের সম্পর্কে কিছু বলার এবং তাদের মূল পরিচয়টা মুসলমানদের একটু স্মরণ করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ২০১৯ সালে গঠিত নতুন মন্ত্রীসভায় এদের ঠাঁই না হওয়ায় তাদের কেউ কেউ আবার ফেরত যাচ্ছেন তাদের পুরোনো চরিত্রে। বাজানো শুরু করেছেন তাদের ভাঙ্গা বাঁশিগুলো।
পাঠকবৃন্দ ইতিমধ্যে ভালোভাবেই জেনেছেন যে, একজন প্রবীণ বাম নেতা জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে ইসলামী শিক্ষা ও দেশের একজন শীর্ষ আলেমের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছেন। অতীতেও তাকে এমন করতে দেখা গেছে। তিনি তার বক্তব্যে আল্লামা আহমদ শফীকে ‘তেঁতুল হুজুর’, দেশে ইসলাম ও মুসলমানের দ্বীনী কার্যক্রমকে মোল্লাতন্ত্র, হেফাজতে ইসলামকে মোল্লাতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষক আখ্যা দেন এবং কওমী মাদরাসার শিক্ষাসনদের স্বীকৃতিকে বিষবৃক্ষ রোপণের সাথে তুলনা করেন। প্রশ্ন জাগতে পারে যে, এত বছর একরকম চুপচাপ থাকার পর এখন আবার কী হল?
রাশেদ খান মেনন সম্পর্কে একটু বলে নেই। তার বাবা আবদুল জব্বার খান মুসলিমলীগ নেতা ও প্রাদেশিক পরিষদের স্পিকার ছিলেন। ঐতিহ্যগতভাবে তার পরিবারটি ছিল সুবিধাভোগী। এর তুলনা করতে পারি, ১৯৭১ সালের ঐসকল পরিবারের সাথে, যাদের কেউ ছিলেন পিস কমিটির সদস্য আবার কেউ নাম লিখিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে।
রাশেদ খান মেনন বামধারার রাজনীতি করেন এবং আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ। তার বোন বিএনপির সর্বোচ্চ স্তরের একজন নেত্রী। আমি কথাটি বললাম তাদের সময়ে সময়ে নানা উপায়ে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করার বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য।
তিনি এখন যা করছেন, তাও রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্যই করছেন। এই দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আওয়ামী লীগের প্রধান শত্রু ছিল বামরাই। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ যোগ্যতা যে, তিনি বাম নেতাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন। নতুবা বামরা তার বাবাকে একটা দিনও স্বস্তির সাথে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে দেয়নি। এখন তারা প্রধানমন্ত্রীর অনুগত। আনুগত্যের বিনিময়ে তারা মন্ত্রিত্ব লাভ করেছেন।
আমি তাকে খাঁটো করার জন্য বলছি না। বলছি এজন্য যে, এদেশের নাগরিকদের প্রশ্ন আছে, তিনি নিজ যোগ্যতায় এমপি বা মন্ত্রী হতে পারেন কি না? এই প্রশ্ন শুধু সাধারণ মানুষের নয়। এই প্রশ্ন ক্ষমতাসীন দলের সিনিয়র অনেক নেতাই তুলেছেন। যেমন ধরুন, মহাজোটের অপর অংশিদার হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বলেছিলেন, ‘কমিউনিস্টদের লজ্জা থাকতে নেই। কারণ, তাদের লজ্জা থাকলে অভির (গোলাম ফারুক অভি। এরশাদের ছাত্রদলের তৎকালীন নেতা) কাছে হেরে যাওয়া নেতারা এত বড় বড় কথা বলত না।’
সম্প্রতি অপর একজন বাম নেতা সম্পর্কে ক্ষমতাসীন দলের নেতা আমির হোসেন আমু বলেছেন, এরা তো নিজেরা নির্বাচন করলে একটা ইউনিয়ন পরিষদেও পাস করতে পারবে না।
এদেরকে যারা ক্ষমতাসীন করেছেন, তারাই বলছেন এসব বাম নেতারা গণবিচ্ছিন্ন। তাদের তেমন কোনো গণ ভিত্তি নেই। তাহলে তারা মন্ত্রী হন কিসের জোরে?
কিছুদিন আগে আরেক বামনেতা হাসানুল হক ইনু এমন এক মন্তব্য করার পর তাকেও অনেক কথা শুনতে হয়েছিল। কিন্তু তারা এর কোনো উত্তর দেননি। এখন আমুর কথার উত্তরও সাবেক শিল্পমন্ত্রী দেননি।
তাদের এই কোথাও কথা বলা আর কোথাও না বলা দেখে একটি ফার্সি প্রবাদ মনে পড়ল। ফার্সিতে বলা হয়, ‘দিওয়ানা বকারে খোদ হুঁশিয়ার’-পাগলও নিজের কাজের ব্যাপারে সতর্ক। অর্থাৎ তাদের ভেতর একটি ন্যূনতম সতর্কতা কাজ করে। এজন্য আমরা পাগলকে আগুনে ঝাঁপ দিতে দেখি না, পানিতেও ডুবে মরতে দেখি না।
বামরাও নিজের স্বার্থের ব্যাপারে হুঁশিয়ার। নতুবা অপমানজনক কথার প্রতিবাদ করবেন না কেন?
গত সরকারের সময়ে -তারা যখন মন্ত্রী ছিলেন- সে সময়েই হেফাজতে ইসলামসহ অনেক আলেমের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ বাড়ে, ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। শুরুতে কয়েকজন বাম নেতা একটু শব্দ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী প্রেসক্লাবের এক অনুষ্ঠানে বললেন, ‘তারা সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার আগে ইস্তফা দেওয়া উচিত ছিল।’ কারণ, প্রধানমন্ত্রী যখন কোনো রাষ্ট্রীয় নীতি গ্রহণ করেন, তখন তার বিরোধিতা করে তার অধীনে কীভাবে মন্ত্রী থাকবেন?
তারা কিন্তু ইস্তফা দিলেন না; বরং নিজেরা সংশোধিত হলেন, সংযত হলেন।
সরকারের সঙ্গে আলেমদের ঘনিষ্ঠতার যতদিক এখন আলোচনায় তার সবই নির্বাচনের আগেই হয়েছে। নির্বাচনের পর নতুন করে কিছু হয়নি। তাহলে এতদিন পর কেন তারা সরব হলেন? আমার মনে হয়, এর কারণ তাদের এতদিন চাকরি ছিল। এখন তাদের চাকরি নেই।
আমাদের দেশে মন্ত্রিত্বকে চাকরি না বললেও ইউরোপ-আমেরিকায় মন্ত্রিত্ব একপ্রকার চাকরি। আমেরিকায় মন্ত্রীকে সেক্রেটারি বলা হয়। যেমন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্টেট সেক্রেটারি বলা হয়। মন্ত্রীদের বেতনভাতা সব নির্ধারিত। প্রধানমন্ত্রী যতদিন চান ততদিন একজন লোক এই চাকরি করতে পারেন।
নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনের কিছুদিন পর পর্যন্ত তারা এই চাকরি আবার পাবেন এই আশায় ছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের অন্যান্য সিনিয়র নেতাদের কথায় তাদের মোহভঙ্গ হয়। তাদেরকে বলা হল নিজের পায়ে দাঁড়াতে। এখন তারা তাদের ‘পুরাতন চাকরি’তে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
‘পুরাতন চাকরি’র বিষয়টা একটু স্পষ্ট করি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর এবং চীন থেকে সমাজতন্ত্র বিদায় নেয়ার পর বামদের মূল পুঁজিতে পরিণত হয়েছে ধর্মের বিরোধিতা। নিন্দুকেরা বলেন, এতে নাকি তাদের বিদেশি প্রভুরা খুশি হয় এবং তাদের পকেটও নাকি ভরে যায়। তারা এখন সেই চাকরি ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছেন। এজন্য দেখবেন, তারা সাধারণত মসজিদের পক্ষে কথা বলবেন না, কিন্তু তারা কাদিয়ানীদের আস্তানায় যাবেন এবং তাদের পক্ষে কথা বলবেন। কারণ, এদের ব্যাপারে কথা বললে যাদের এসব নেতা খুশি করতে চান তারা খুশি হন।
আমি বলছি না, তারা কাদিয়ানী আস্তানা বা মন্দিরে যেতে পারবেন না। একজন রাজনীতিক ও সরকারের দায়িত্বশীল হিসেবে তারা প্রয়োজনে সেখানে যেতে পারেন। কিন্তু এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের দিকে তাকানোটাও কি তাদের দায়িত্ব নয়? হিসাবে নয়টা মসজিদে যাওয়ার পর একটা মন্দিরে গেলে সমস্যা ছিল না। কিন্তু তাদের তো কখনও মুসলমানের পক্ষে বলতে শোনা যায় না।
তবে হাঁ, সংসদে ঐ আজেবাজে কথা বলার পর এক জুমায় তাকে ঢাকার একটি মসজিদে গিয়ে বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। যাইহোক, আমি এইগুলোকে অস্বাভাবিকভাবে দেখছি না। নিজেদের কথিত অবস্থান তৈরির জন্য তাদের যা যা করার কথা তারা তাই করছেন। তাই এসবের খুব জোরালো প্রতিবাদ করারও দরকার মনে করছি না। বরং আমার মনে হয়, বেশি গুরুত্ব দিলে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যাবে।
অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, তাদেরকে থামানোর উপায় হল মন্ত্রী করে দেওয়া। এতে সরকার ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলো এদের কট‚ক্তি ও সমালোচনা থেকে কিছুটা নিরাপদ থাকবে।
পাঠকের মনে থাকবে, নবম জাতীয় সংসদের কয়েকজন নেতা -যাদের একজন গত হয়েছেন এবং একজন গুরুতর অসুস্থ- সরকারের তুমুল সমালোচনা শুরু করলেন। প্রধানমন্ত্রী তাদের মন্ত্রী বানিয়ে দিলেন। ব্যস! সব ঠাণ্ডা। তখন তাদের কাউকে কাউকে হজ¦ও করতে দেখা গেছে। তাই আমরা বরং প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ করতে পারি; এদের আবার মন্ত্রী করুন। এদের সামলান।
তারা যদি সত্যিই এই নীতিতে বিশ্বাস করত যে, আমাদের ধর্মের বিরুদ্ধে বলতে হবে এবং কাজ করতে হবে, তাহলে তাদেরকে আমি ভিন্ন মতাবলম্বী ধরে নিতাম। কিন্তু যিনি মন্ত্রী থাকলে এক ভাষায় কথা বলেন আর মন্ত্রিত্ব গেলে অন্য ভাষায় কথা বলেন সেটাকে তো আর নীতি বলা যায় না।
বামেরা বিভিন্নভাবে নিজেদের শিক্ষিত ও সুশীল বলে পরিচিত করতে পছন্দ করেন। প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো সভ্য ও শিক্ষিত লোক কি গোটা একটি শিক্ষা-পদ্ধতিকে কটাক্ষ ও হেয় প্রতিপন্ন করতে পারে, যে শিক্ষা-পদ্ধতিতে পড়াশোনা করে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী যুগ যুগ ধরে সমাজের ভক্তি-শ্রদ্ধা ও আস্থা-ভালোবাসার জায়গায় আছেন? দেশ-জাতি ও দ্বীন-ধর্মের যে কোনো প্রয়োজনে যাদের ডাকে সাড়া দিয়ে থাকেন এদেশের কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ জনতা?
তারা মাদরাসা-শিক্ষা সম্পর্কে কত সহজে কট‚ক্তি করে ফেলেন অথচ তারা গোটা সাধারণ শিক্ষা-ব্যবস্থা নয়, একটি বড় কলেজ বা ভার্সিটি সম্পর্কে এরকম কোনো কট‚ক্তি করার কি সাহস রাখেন?
দেশের প্রায় ৯০% নাগরিকের ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের যারা কটাক্ষ করে কথা বলেন তারা কি পারবেন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ১% নাগরিকের ধর্ম-গুরু সম্পর্কে এমন অশালীন কথা বলতে?
এটা এজন্যেই তারা করতে পারেন। কারণ আলেম-উলামা ও ধর্মপ্রাণ মানুষ স্বভাবতঃ শান্তিপ্রিয়। তারা গালমন্দের জবাব গালমন্দ বা আক্রমণের মাধ্যমে দিতে জানেন না। এটা তারা শেখেননি।
এ লেখা যখন ছাপাখানায় যাবে তখন দেখলাম দেশের একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকে একই দিনে দুই বামনেতার সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে। সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী ব্যক্তিটিও একই। ঠিক যখন মেনন সাহেবের সংসদে প্রদত্ত বক্তব্য নিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছিল সে মুহূর্তে এধরনের একপেশে সাক্ষাৎকার ভিন্ন ইঙ্গিতই বহন করে। সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী চিহ্নিত লোকটির প্রশ্নের মধ্যেই ছিল শীর্ষ আলেম সম্পর্কে বিদ্রূপাত্মক উচ্চারণ। পাঠকবৃন্দের হয়ত মনে থাকবে, এ লোকটিই সে ব্যক্তি, যিনি আইন নিয়ে অতি কাবিলিয়তী দেখাতে গিয়ে শুধু নিজেই আদালতে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হননি বরং তার পত্রিকার সম্পাদককেও আদালতে নিয়ে ছেড়েছেন।
তো যাদের কাজকর্ম, কথা-বার্তা সবকিছুই আবর্তিত হয় শুধু ডাণ্ডার ভয় আর স্বার্থ হাসিলের ভিত্তিতে তারা আর যা-ই হোক শিক্ষা, সভ্যতা, আদর্শ এসবের দাবি করতে পারেন না।
যাই হোক, মেনন সাহেব মনের ব্যথাটা গোপন রাখেননি। সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে বলেছেন। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হলে স্পেস দিতে হবে।
এতদিন পর তার স্পেস নেই- এই অনুভূতি জাগল! দেশের আর দশজন রাজনীতিক বললে তাদের মুখে কথাটা মানাতো। উনি যে আসনের প্রতিনিধিত্ব করেন সেখানে যদি একটি জনসভা করতে চান এবং আওয়ামী লীগের লোক অংশ না নেয়, তাহলে এক হাজার লোক একত্র করার ক্ষমতা কি তার আছে? তাহলে তিনি স্পেস কোথা থেকে পাবেন? সংসদে দাঁড়িয়ে এই কথা কীভাবে বলেন? একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিক হিসাবে এমন দাবি বিগত ৫ বছরে কোনো দিন কি তিনি করেছেন?