প্রতিবেশী : গণতান্ত্রিক ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি
ভারত-অধিকৃত কাশ্মিরের পুলওয়ামার আত্মঘাতী গাড়ি হামলা ও তৎপরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ এখন একটি আলোচিত প্রসঙ্গ। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা স্বভাবতই উৎকণ্ঠিত করে তুলেছে এ অঞ্চলের শান্তিপ্রিয় মানুষকে। ঘটনা ও পরিস্থিতির নানামুখী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থেকে সবকিছু ছাপিয়ে যে বিষয়টি নাকে এসে লাগছে তা হচ্ছে অপরাজনীতি আর ক্ষমতালিপ্সার দুর্গন্ধ।
‘পুলওয়ামা’ শহরটি ভারত-অধিকৃত কাশ্মীরের একটি জেলা শহর। এটি রাজধানী শ্রীনগর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি এখানে একটি হাইওয়েতে ঘটে বহুলআলোচিত আত্মঘাতী গাড়ি-বোমা হামলার ঘটনা। এতে সিপিআরএফ সদস্যদের বহনকারী একটি বাস ভস্মিভূত হয় এবং মারা যায় ৪০ জন সিপিআরএফ সদস্য।
মিডিয়াসূত্রে জানা যায়, সিপিআরএফ বা সেন্ট্রাল পুলিশ রিজার্ভ ফোর্স হচ্ছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের অধীন এক বিশেষ বাহিনী। অনেকটা আমাদের র্যাবের মতো। সত্তরের দশকে ইন্দিরা গান্ধির সরকার এই বাহিনী প্রতিষ্ঠা করে। ঐ সময় ভারতে নকশাল আন্দোলন প্রবল হয়ে উঠলে পশ্চিমবঙ্গের মতো আক্রান্ত রাজ্যগুলোকে সহায়তা প্রদান করতে বিশেষ ট্রেনিং দিয়ে এই বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা হয়। কোনো রাজ্যসরকার কেন্দ্রের কাছে নিজের পুলিশ বাহিনীর বাইরে অতিরিক্ত ফোর্সের সহায়তা চাইলে কেন্দ্রীয় সরকার কাছাকাছি কোনো আঞ্চলিক স্থায়ী ক্যাম্প থেকে এই বাহিনী পাঠায়। এ কারণে প্রায় সময়ই চলাচলের মধ্যে থাকে এই বাহিনী।
বিগত ১৪ ফেব্রুয়ারি ৮০ টি বাসভর্তি প্রায় আড়াই হাজার সিপিআরএফ সদস্য পুলওয়ামা জেলা পার হওয়ার সময় একটি জিপ সেই গাড়িবহরে ঢুকে পড়ে এবং বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে একটি বাস ভস্মিভূত হয় এবং ৪০ জন সিপিআরএস সদস্য মারা যায়।
এর পরের ঘটনা সবারই জানা। ঘটনার সাথে সাথে পাকিস্তানকে দায়ী করে বক্তব্য দিতে থাকে ভারত। মাঠে নেমে পড়ে বিজেপি, আরএসএসের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বজরং দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ইত্যাদি সংঘঠনগুলো।
ঘটনার সময়টি ছিল পাকিস্তানে সৌদী যুবরাজ বিন সালমানের সফরের সময়। বিন সালমান সফর শেষে ফিরে যাওয়ার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ভারতের অভিযোগের জবাব দেন এবং এই হামলায় পাকিস্তানের জড়িত থাকার উপযুক্ত প্রমাণ দেয়ার আহ্বান জানান। যথাযথ প্রমাণ দেখাতে পারলে দায়ী ব্যক্তিদের ব্যাপারে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণেরও প্রতিশ্রুতি দেন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই ঘটনায় কথিত হামলাকারী আদিল আহমেদ দার ভারত-অধিকৃত কাশ্মীরের পুলওয়ামারই বাসিন্দা। হামলায় ব্যবহৃত গাড়িটিও ভারতীয়। তবে যে সংগঠনের ভারতীয় শাখার হয়ে তিনি কাজটি করেছেন বলে বলা হচ্ছে সে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা একজন পাকিস্তানী। শুধু এইটুকু অভিযোগের ভিত্তিতে কোনো দেশকে সরাসরি দায়ী করে যুদ্ধাবস্থা তৈরি করে ফেলা যায় কি না তা একটি প্রশ্ন।
এছাড়া খোদ ভারতীয় রাজনীতিক ও রাজনীতি-বিশ্লেষকেরাই যেসব প্রশ্ন সামনে এনেছেন তাতে মোদী সরকারের হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা-দুষ্ট অপরাজনীতির দুর্গন্ধই তীব্র হয়ে উঠেছে।
পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি প্রশ্ন তুলেছেন, ভোটের আগে ভারতজুড়ে দাঙ্গা লাগানো হতে পারে বলে মার্কিন গোয়েন্দা রিপোর্টে যে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল তা কি সঠিক? আগাম খবর থাকা সত্ত্বেও কেন সেনা সরানোর উদ্যোগ নেয়া হয়নি? কেন সিআরপিএফের অনুরোধ সত্ত্বেও এয়ারলিফট দেয়া হল না? এত বড় ব্যর্থতার পরও কেন উচ্চ পর্যায়ের কোনো তদন্ত হল না?
এই প্রশ্নগুলোকে আরো শাণিত করছে যে বিষয়টি তা হচ্ছে, যে হাইওয়েতে গাড়িবহরে হামলা হয়েছে সেখানে কয়েকশ গজ পর পর চেকপোষ্ট আছে বলা হচ্ছে। তাহলে ৩৫০ কেজি বোমা নিয়ে একটি গাড়ি কীভাবে সিআরপিএফের গাড়িবহরে ঢুকে পড়তে পারল? কংগ্রেস প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে- ‘মোদি ৩৫০ গ্রাম গরুর গোশত দেখতে পান, কিন্তু ৩৫০ কেজি আরডিএক্স দেখতে পান না?
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ও রাজনীতি-বিশ্লেষকদের এইসব প্রকাশ্য মন্তব্য থেকে অনুমিত হয় যে, পুলওয়ামার ঘটনাটি থেকে বিজেপি খুব বেশি রাজনৈতিক ফায়দা ঘরে তুলতে পারবে বলে মনে হয় না। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহও বিজেপির জন্য খুব বেশি সুখকর হচ্ছে না। গত বুধবার ভারতের দুটি জঙ্গি বিমান ভূপাতিত হয় এবং একজন পাইলট পাকিস্তানে বন্দী হয়। এরপর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ঘোষণা অনুযায়ী শান্তির নিদর্শন হিসেবে তাকে মুক্তি দেয়া হয়।
এর আগে কাশ্মিরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সীমানা অতিক্রম করে আজাদ কাশ্মিরের অভ্যন্তরে একটি বৃহৎ সন্ত্রাসী ঘাটি ধ্বংসের এবং ৩০০ জনেরও বেশি ‘জঙ্গি’ হত্যার যে দাবি ভারত করেছিল সে সম্পর্কেও নির্ভরযোগ্য কোনো দলীল-প্রমাণ পাওয়া যায়নি; বরং বেরিয়ে আসছে এ দাবির নানা অসঙ্গতি।
লন্ডন ভিত্তিক প্রতিরক্ষা বিষয়ে মনিটরিং ও নজরদারির একটি বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠান জেনস ইনফরমেশন গ্রুপ ভারতের ঐ দাবির উপর প্রশ্ন তুলেছে। এই প্রতিষ্ঠানের একজন গবেষক ও বিশেষজ্ঞ রাহুল বেদি নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ভারত বলছে যে, তারা পাকিস্তানের অভ্যন্তরে একটি সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে। কিন্তু নির্ভরযোগ্য বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সূত্রের মতে, পাকিস্তানের ভেতরে থাকা ঐসব সন্ত্রাসী ঘাঁটি সাম্প্রতিক সময়ে উচ্ছেদ করা হয়েছিল।
রাহুল বেদি আরো বলেন, ‘এই হামলার প্রচারণা ও হতাহতের খবর প্রকাশ রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর ছাড়া আর কিছুই নয়। ভারতের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজের ও দলের সুবিধার জন্য দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কিছু কাজ করা বা প্রচারণা চালানোর প্রয়োজন ছিল।’
পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হামলার এই দাবির বিষয়ে বিবিসিও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে হামলাস্থল আজাদ কাশ্মীরের বালাকোট জেলার জাব্বা এলাকার বাসিন্দাদের সাক্ষাতকার প্রকাশিত হয়। তাতে ঐ এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ‘তারা গভীর রাতে পাঁচটি বড় বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন। হামলায় কয়েকটি কুড়ে ঘর ধ্বংস হয়েছে এবং কয়েকটি গাছ উপড়ে পড়েছে। কিন্তু এই হামলায় কেউ নিহত হয়নি।’
এপির লাহোর সংবাদদাতা ও পাকিস্তানের সিনিয়র সাংবাদিক বাবর ডোগার এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, এত মানুষ মারা গেল, কিন্তু কেউ ডেড বডি দেখল না- এ কেমন কথা? তিনি বলেন, বালাকোটে ভারতীয় বিমান একটি জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি এলাকায় বোমাবর্ষণ করেছে এটাই সত্য। তিনি বলেন, বালাকোট ইসলামাবাদ থেকে সড়ক পথে মাত্র ২ঘন্টার পথ। অনেক সাংবাদিক ইতিমধ্যে ঐ এলাকায় গেছেন। সেখানে একটি লাশও কেউ খুঁজে পাননি।
যাইহোক, এইসব হচ্ছে বর্তমান সময়ের প্রচলিত রাজনীতির মিথ্যাচার, সাম্প্রদায়িকতা, ক্ষমতালিপ্সা এবং ক্ষমতার স্বার্থে জনগণের জান-মাল এমনকি দেশকে হুমকির মুখে ফেলার মতো জঘন্য বিষয়গুলোর কিছু দৃষ্টান্ত। সমস্যার প্রকৃত সমাধানের পথে না গিয়ে সমস্যা জিইয়ে রাখা এবং মিথ্যাচার ও স্বার্থবাদই এখন রাজনীতির প্রধান অনুষঙ্গ। গণতন্ত্র, দেশপ্রেম, জনগণের সেবা ইত্যাদি বিষয় মুখে মুখে থাকলেও প্রকৃত চর্চাটা ক্ষমতা লিপ্সার।
ভারতের ক্ষমতাসীনেরা এ সত্য নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেন যে, কাশ্মীর সমস্যার সমাধান উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ও প্রতিবেশীর দিকে আঙ্গুল তাক করার মধ্যে নয়। এই সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে। কাশ্মীরী মুসলমানের প্রতি তাদের জুলুম-অবিচারের ইতিহাসও অতি প্রাচীন। বলপ্রয়োগ ও জুলুম অবিচারের ধারা বন্ধ না করলে এই সমস্যার কিছু মাত্র সমাধানও হবে না। সর্বহারা মাজলুমের মনে প্রতিশোধ ও প্রতিরোধের আগুন ধিকি ধিকি জ¦লতেই থাকবে। এই অবস্থাটাকে নানা সময় নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের অপচেষ্টার মাধ্যমে যে রাজনীতির চর্চা তারা করে চলেছেন তাকে আর যা কিছুই বলা হোক দেশপ্রেম ও মনুষ্যত্ব বলা যায় না।