স্বদেশ : চকবাজারের অগ্নিকাণ্ড ও আমাদের দেশপ্রেম
গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাত দশটায় চকবাজারে যে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটল তাতে বেদনায় বাকরুদ্ধ হয়েছেন দেশের সর্বস্তরের মানুষ। পর দিনই দৈনিক পত্রিকাগুলোতে এসেছে ৬৭ জনের মৃত্যু-সংবাদ। পরে হাসপাতালে মারা গেছেন আরো দুইজন। মারাত্মকভাবে আহত প্রায় অর্ধ শতাধিক।
চকবাজারের এই মর্মান্তিক ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে ২০১০ সালের ৩ জুন ঘটে যাওয়া নিমতলী ট্রাজেডিকে। ঐ অগ্নিকা-েও আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গিয়েছিলেন ১২০ জনেরও বেশি মানুষ। নয় বছরের ব্যবধানে পুরান ঢাকায় আবারো ঘটল একই ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা।
এই ঘটনার পর মসজিদে মসজিদে দুআ-মুনাজাত হয়েছে। অগ্নিদগ্ধ আহত নিহত মানুষ ও তাদের স্বজন-পরিজনের প্রতি স্বভাবতই সবার মনে জেগেছে বেদনা ও সহানুভূতি। আমরা কায়মনোবাক্যে আল্লাহর দরবারে দুআ করি, আল্লাহ তাআলা এই অগ্নিকা-ে নিহত মুসলিম নারী-পুরুষকে শাহাদতের মর্যাদা দান করুন এবং আহতদের সুস্থতা দান করুন।
এইসকল ঘটনায় মানবিক বেদনা ও সহানুভূতি প্রকাশের পাশাপাশি আত্মসমালোচনারও কিছু বিষয় আছে, জাতি হিসেবে উন্নত হওয়ার জন্য যা আমাদের চর্চা করা প্রয়োজন।
পিছনের বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, অগ্নিকা-ের ঘটনা আমাদের দেশে অনেক বেশি। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের এক পরিসংখ্যান মতে, প্রতি বছর অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটছে গড়ে ১৯ হাজারটি। ২০১২ সালের পর থেকে আমাদের দেশে ৮৮ হাজার অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণহানি ঘটেছে ১ হাজার ৪০০ জনের। আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২৯ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সংঘটিত অগ্নিকা-ের প্রায় ৭০ শতাংশ ঘটেছে বৈদ্যুতিক ত্রুটির কারণে। (দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, পৃষ্ঠা ০৯)
এই পরিসংখ্যান জানাচ্ছে যে, এইসব দুর্ঘটনার পিছনে দায়ী অনিয়ম, অসাবধানতা, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা। চকবাজারের দুর্ঘটনায় এ বিষয়টি আবারো বড় হয়ে সামনে এসেছে।
পুরান ঢাকার চকবাজার রাজধানীর সবচেয়ে জনবহুল এলাকাগুলোর একটি। শুধু তা-ই নয়, এটি একটি অতি ব্যস্ত ব্যবসা-কেন্দ্র। অথচ এই এলাকার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সরু রাস্তা, অলিগলি, পুরনো ভবন আর ঘিঞ্জি বসতি। নিচে কারখানা, গুদাম, দোকানপাট আর ওপরে মানুষের বসবাস। গুদাম ও দোকানগুলো মালপত্রে ঠাসা, রাসায়নিক ও দাহ্য পর্দার্থে ভর্তি। অনেক ভবনে একদিকে মানুষের বাস অন্যদিকে কেমিক্যালের গোডাউন। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে অগ্নিকা-ের সূত্রপাত হওয়ার পর নিমিষেই তা ছড়িয়ে পড়ে। গুদামভর্তি দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে এসে আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। সম্পূর্ণ পুড়ে যাওয়া পাঁচটি ভবনের একটি ছিল ওয়াহেদ ম্যানশন, যার বেজমেন্টে ছিল ড্রাম ও বস্তা ভর্তি ১১ প্রকারের কেমিক্যালের মজুদ। যার পরিমাণ ২৮ ট্রাক। এগুলোয় আগুন ধরলে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হতে পারত ভাবতেও গা শিউরে ওঠে।
নিমতলী ট্রাজেডির পর পুরান ঢাকায় সবধরনের রাসায়নিক কারখানা স্থাপন, রাসায়নিক পদার্থের মজুদ ও বিপণন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। সে সময় নিমতলী এলাকায় ভ্রাম্যমান আদালত ১০৪টি মামলা দায়ের করেছিলেন এবং ৩৫ লাখ ১৮ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেছিলেন। কিন্তু এরপর যেই সেই। ৯ বছরের মাথায় ঘটল চকবাজারের ঘটনা।
দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনা যেন আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। তাৎক্ষণিক সুবিধা ও মুনাফার লোভ থেকেও আমাদের মুক্তি ঘটেনি। পত্র-পত্রিকার সংবাদে যেমন প্রশাসনের দুর্নীতির প্রসঙ্গ উঠে এসেছে তেমনি এসেছে নগদ মুনাফা-প্রীতির নানা দৃষ্টান্ত। কেমিক্যাল মজুদের জন্য গুদাম ভাড়া দিলে স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ বেশি ভাড়া পাওয়া যায় বলে বাড়ির মালিকেরা ঝুঁকি নিয়েও তা ভাড়া দিয়ে থাকেন- এমন তথ্যও মিডিয়ায় এসেছে।
এই সামগ্রিক বিষয়টি নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা প্রয়োজন। স্বাধীনতার মাসে আমাদের ভাবা প্রয়োজন দেশপ্রেমের চেতনা নিয়েও। আমাদের দেশপ্রেম শুধু আবেগ-সর্বস্ব ও অতীতমুখী না হয়ে কর্ম ও বাস্তবতামুখী হওয়া প্রয়োজন। নাগরিক জীবনের বড় বড় সমস্যার সমাধানে মনোযোগী হওয়া এবং চিন্তা ও নৈতিকতায় পরিপক্ক হওয়া প্রয়োজন। আমাদের মিডিয়ার কর্তব্য সস্তা আবেগ ও স্থূল বিনোদনের প্রচার-প্রসারের পরিবর্তে জনগণের মানসিকতা গঠনে ব্রতী হওয়া। দুর্নীতি, তাৎক্ষণিক মুনাফাপ্রীতি, অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা।
চকবাজারের অগ্নিকা-ের পর পুরান ঢাকায় ল্যান্ড রিডেভেলপমেন্ট প্রসঙ্গটিও নতুনভাবে আলোচিত হয়েছে। অগ্নিকা- ও ভবনধ্বস থেকে বাঁচার জন্য আরবান ল্যান্ড রিডেভেলপমেন্ট (ভূমি পুনঃউন্নয়ন) পদ্ধতির মাধ্যমে পুরান ঢাকাকে বদলে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল রাজউক। কিন্তু এলাকাবাসীর অনীহা আর রাজউকের দুর্বলচিত্তের কারণে তা থেমে গেছে। ল্যান্ড রিডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, ‘চকবাজারের অগ্নিকা-ের পর একটা অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়া যায়নি। দ্রুত ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। আগুন নেভানোর জন্য পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায়নি। ল্যান্ড রিডেভেলপমেন্ট করলে রাস্তাও প্রশস্ত হত, আগুন নেভানোর পানিও পাওয়া যেত, অ্যাম্বুলেন্সও দাঁড়াতে পারত।’
বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. ইশরাত ইসলাম বলেছেন, ‘ল্যান্ড রিডেভেলপমেন্ট ফর্মূলা অত্যন্ত ইতিবাচক। এ ফর্মুলা প্রয়োগ করে বিশে^র অনেক ঘিঞ্জি শহর ভেঙ্গে আধুনিক শহরে পরিণত করা হয়েছে। তবে এ কাজ করতে গেলে জনগণের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। জনগণ এগিয়ে এলে সহজেই এ ফর্মুলা বাস্তবায়ন করা যায়।’
প্রশ্ন হচ্ছে, বিশে^র বিভিন্ন দেশে ইতিমধ্যে যে ইতিবাচক ফর্মুলাটি বাস্তবায়িত হয়ে গেছে আমাদের দেশে তা বাস্তবায়নে জনগণকে সম্মত করা যাচ্ছে না কেন। এমনকি এতসব মারাত্মক দুর্ঘটনার পরও। এতে যেমন আমাদের চিন্তা-ভাবনার অপরিপক্কতা ও পশ্চাদপদতার পরিচয় পাওয়া যায় তেমনি পাওয়া যায় নানা যৌক্তিক কারণে দায়িত্বশীলদের প্রতি অনাস্থারও প্রমাণ। এই সবগুলো বিষয় সামনে রেখেই আমাদের একবার নিজেদের চিন্তা ও কর্মের দিকে তাকানো প্রয়োজন।
স্বাধীনতার এই মাসে কি আমরা আমাদের দেশপ্রেম নিয়েও একটু ভাবব?