ইসলাম ও কাদিয়ানিয়াত দুটি আলাদা ধর্ম
[বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধটি মূলত দারুল উলূম দেওবন্দের প্রবীণ উস্তায ও মুহাক্কিক হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইদরীস কান্ধলবী রাহ.-এর উর্দু রিসালা ‘ইসলাম আওর মিরযাঈয়্যত কা উসূলী ইখতেলাফ’-এর সাবলীল সংস্করণের বঙ্গানুবাদ। হযরত মাওলানা কান্ধলবী রাহ. বিগত শতকের (মৃত্যু : ১৩৯৪হি./১৯৭৪ঈ.) একজন বিখ্যাত আলেমে দ্বীন এবং উঁচু মাপের বুযুর্গ ছিলেন। তাফসীর, হাদীস, আকীদা, কালাম এবং সীরাতের মতো ইসলামের প্রধান শাস্ত্রগুলোতে তাঁর মৌলিক ও কালজয়ী রচনাসম্ভার বিদ্যমান।
কাদিয়ানী মতবাদের খ-নেও হযরতের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। সে ধারারই এক মূল্যবান সংযোজন হচ্ছে এ পুস্তিকা। এতে তিনি ইসলাম ও কাদিয়ানিয়াতের মাঝে বেশ কয়েকটি মৌলিক পার্থক্য তুলে ধরেছেন। সাধারণ মুসলমানদেরকে কাদিয়ানী ফেতনার ব্যাপারে সচেতন ও সতর্ক করার লক্ষ্যে তিনি মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী এবং তার অনুসারীদের এমন সব বক্তব্য-বিশ্বাস স্বয়ং তাদের বইপত্রের উদ্ধৃতিতে সংক্ষেপে মেলে ধরেছেন, যা থেকে একজন সাধারণ মুসলিমও বুঝতে পারবেন যে, কাদিয়ানিয়াত ইসলাম বহির্ভূত একটি মতবাদ। এ সম্প্রদায় আর যাই হোক, ইসলাম ধর্মের অনুসারী হতে পারে না। ইসলাম ও কাদিয়ানিয়াত দুটি আলাদা ধর্ম। দুটোর মধ্যে আকাশ-পাতাল প্রভেদ। অথচ এরা প্রতারণামূলকভাবে ইসলামের নাম ও পরিভাষাগুলো ব্যবহার করে চলেছে।
মূল কিতাবের উপস্থাপনা কিছুটা ইলমী ধাঁচের ছিল। ১৪২৫হিজরীর জুমাদাল আখিরায় ভারতের হায়দারাবাদের ইদারায়ে আশরাফুল উলূমের নাযেম মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল কওয়ী ছাহেব সর্বসাধারণের উপযোগী করে একে সাবলীল ও সুবিন্যস্ত করেন। যা পরবর্তীতে তাহাফ্ফুযে খতমে নবুওত অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে ১৪২৬হিজরী/২০০৫ঈসাব্দে প্রকাশিত হয়। বক্ষ্যমাণ অনুবাদে এ সাবলীল সংস্করণকে সামনে রাখা হয়েছে। আর প্রয়োজনবোধে মূল কিতাবের উপস্থাপন অনুসরণ করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও বক্তব্য সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে।
হাওয়ালা ও তথ্যসূত্রের ক্ষেত্রে শুধু মূল উর্দু রিসালার উপরই নির্ভর করা হয়নি, সরাসরি কাদিয়ানীদের মূল বইপত্র থেকে উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। কয়েক স্থানে এদেশীয় কাদিয়ানীদের অনূদিত বাংলা গ্রন্থের পৃষ্ঠা নম্বরও সংযুক্ত করা হয়েছে। উদ্ধৃত গ্রন্থ ও পত্রিকার পিডিএফ কপির সঙ্গেও মিলিয়ে দেখা হয়েছে। এই সব কাজে আমি অন্তরের অন্তস্তল থেকে উস্তাযে মুহতারাম মাওলানা হুসাইন আহমদ ছাহেবের প্রতি কৃতজ্ঞ। উদ্ধৃতি ও হাওয়ালা পরীক্ষার পুরো কাজটি তাঁরই রাহনুমায়ীতে সম্পন্ন হয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাঁকে জাযায়ে খায়ের দান করুন, আমীন।
প্রকৃতপক্ষে যদি কোনো ব্যক্তি সত্যান্বেষণের নিয়তে এই একটি লেখাই পড়ে নেয়, তবে তার নিশ্চিত জানা হয়ে যাবে যে, কাদিয়ানিয়াত কুফুরী মতবাদ এবং ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের এক জঘন্য ধৃষ্টতাপূর্ণ অপচেষ্টা। -অনুবাদক]
بسم الله الرحمن الرحيم
الحمد لله رب العالمين، والعاقبة للمتقين، والصلاة والسلام علي سيدنا ومولانا محمد خاتم الأنبياء والمرسلين، وعلى آله وأزواجه وذرياته أجمعين. أما بعد :
কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের ব্যাপারে অনেকেই এ ভুল ধারণার শিকার যে, ‘তারাও ইসলামেরই (?) একটি দল। শুধু শাখাগত কিছু ছোট-খাটো মাসআলায় তাদের সঙ্গে সামান্য বিরোধ আছে। যেরূপ আরো বিভিন্ন ইসলামী ফেরকা ও জামাত মুসলমানদের ভেতর দেখা যায়।’ এজন্যই এ মনোভাব পোষণকারীরা কাদিয়ানীদেরকে ‘মুরতাদ, ইসলাম থেকে খারিজ এবং কাফের’ বিশ্বাস করা ও বলা থেকে এড়িয়ে চলেন।
অথচ কাদিয়ানীদেরকে ইসলামের মধ্যকার কোনো ফেরকা বা জামাত মনে করা মারাত্মক ভুল। এ ভুল ধারণার জন্য দায়ী হচ্ছে ইসলাম ও তার বুনিয়াদি শিক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞতা ও জানাশোনার অভাব। আর এটা সত্যি আফসোসের বিষয় যে, অনেক মুসলমানেরই ইসলামের মৌলিক বিধি-বিধান সম্পর্কে সঠিক অর্থে কোনো ধারণাই নেই।
এটি একটি স্বীকৃত বাস্তবতা যে, প্রত্যেক ধর্মের নিজস্ব কিছু মূলনীতি ও বিশ্বাস রয়েছে, যা সেই ধর্মের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য। সেসব মৌলিক আদর্শের কারণে উক্ত ধর্ম অন্যান্য ধর্ম থেকে পৃথকভাবে পরিচিতি লাভ করে। তেমনি ইসলামেরও কিছু বুনিয়াদি বিধি-বিধান, নীতিমালা এবং বিশ্বাস রয়েছে। ‘জরুরিয়াতে দ্বীনে’র পর্যায়ের সেই নীতি ও বিশ্বাসের গ-িতে থেকে কোনো মতপার্থক্য ঘটলে তা ব্যক্তির ইসলামের উপর প্রভাব ফেলে না। এমন মতভেদকারী ব্যক্তি ইসলামের গ-িতেই থাকে এবং তাকে মুসলমানই বলে। কিন্তু যদি কারো সেই বুনিয়াদী আকীদা ও মূলনীতিগুলোর সঙ্গেই বিরোধ থাকে এবং উক্ত বিশ্বাস ও আদর্শকেই মানতে না চায়, তবে সে আর মুসলমান থাকে না। তাকে মুরতাদ ও ইসলাম ত্যাগকারী বলে।
কাদিয়ানী আর মুসলমানদের মধ্যে এধরনেরই মৌলিক ও বিশ্বাসগত বিরোধ বিদ্যমান। এ কারণেই কাদিয়ানী ফেরকা মুরতাদ এবং ইসলাম থেকে খারিজ। এ মতপার্থক্যের কিছুটা বিশ্লেষণ বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে করা হচ্ছে, যেন মুসলমানগণ বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হয়ে সঠিক বিষয়টি জানতে পারেন।
এক. ইসলাম এবং মুসলমানদের সঙ্গে কাদিয়ানীদের মৌলিক ও বিশ্বাসগত মতবিরোধের দাবি কেবল আমরা মুসলমানরাই করি এমন নয়, স্বয়ং তাদেরই বক্তব্য হচ্ছে, মুসলমানদের সঙ্গে তাদের মতবিরোধ শাখাগত নয়, মৌলিক।
তাদের বই ‘মজমুআয়ে ফাতাওয়ায়ে আহমদিয়া’র এ উদ্ধৃতি লক্ষ্য করুন-
یہ بات تو بالکل غلط ہے کہ ہمارے اور غیر احمدیوں کے درمیان کوئی فروعی اختلاف ہے کسی مامور من اللہ کا انکار کفر ہو جاتا ہے، ہمارے مخالف حضرات مرزا صاحب کی ماموریت کے منکر ہیں، بتاؤ یہ فروعی اختلاف کیونکر ہوا؟ (نہج المصلی فتاوی احمدیہ ২৭৪/১)
অর্থ : এটা তো সম্পূর্ণ ভুল কথা যে, আমাদের আর অ-আহমদীদের (অর্থাৎ মুসলমানদের) মধ্যে কোনো শাখাগত মতভেদ আছে। (কেননা,) কোনো মামুর মিনাল্লাহ (তথা আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট)-কে অস্বীকার করা কুফর হয়ে যায়। আমাদের বিরোধীগণ (মুসলমানগণ) মির্যা সাহেবের মামুরিয়্যত (অর্থাৎ আল্লাহ কর্তৃক আদিষ্ট হওয়াকে) অস্বীকার করেন। বলো, এটা শাখাগত মতপার্থক্য কী করে হয়? (নাহজুল মুসল্লা ফাতাওয়া আহমদিয়া ১/২৭৪)
কাদিয়ানীদের দ্বিতীয় খলিফা মির্যাপুত্র বশিরুদ্দীন মাহমুদের এ বক্তব্যটি দেখুন-
حضرت مسیح موعود علیہ السلام کے منہ سے نکلے ہوئے الفاظ میرے کانوں میں گونج رہے ہیں، آپ نے فرمایا یہ غلط ہے کہ دوسرے لوگ سے ہمارا اختلاف صرف وفات مسیح یا اور جند مسائل میں ہے، آپ نے فرمایا: اللہ تعالی کی ذات رسول کریم صلی اللہ علیہ وسلم قرآن نماز روزہ حج زکوۃ غرض کہ آپ نے تفصیل سے بتایا کہ ایک ایک چیز میں ہمیں ان سے اختلاف ہے۔( خطبہ جمعہ میاں محمود احمد صاحب خلیفہ قادیان ، مندرجہ اخبار ‘الفضل، قادیان ৩০ جولائی ১৯৩১م ص: ৭، کالم: ১)
অর্থ : হযরত মাসীহে মাওউদ আ.-এর মুখ থেকে শোনা শব্দগুলো এখনো আমার কানে ধ্বনিত হচ্ছে। তিনি বলেছেন, এটা ভুল কথা যে, অন্যদের (মুসলমানদের) সঙ্গে আমাদের বিরোধ শুধু ঈসা আ.-এর মৃত্যু বা আরো কিছু শাখাগত মাসআলায়। হযরত বলেছেন, আল্লাহর তাআলার সত্তা, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, কুরআন, নামায, রোযা, হজ¦, যাকাত তিনি বিস্তারিত বলেছেন, মোটকথা প্রত্যেকটি বিষয়ে তাদের সঙ্গে আমাদের বিরোধ রয়েছে। (মির্যা মাহমুদের জুমার খুতবা, সূত্র: কাদিয়ান থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক আলফযল’ ৩০ জুলাই ১৯৩১ ঈ. পৃষ্ঠা ৭, কলাম ১)
যাইহোক, আমাদের মুসলমানদের নিকটও ইসলাম ও মুসলমানদের সঙ্গে কাদিয়ানীদের মতভেদ মৌলিক, শাখাগত নয়। আর খোদ কাদিয়ানীদের বক্তব্যও এটি যে, তাদের ও আমাদের মধ্যে পার্থক্য মৌলিক, শাখাগত নয়। অতএব, পরিষ্কার হয়ে গেল যে, ইসলাম ও কাদিয়ানিয়াত দুটি আলাদা ধর্ম।
দুই. একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নবী ভিন্ন হলেই উম্মত আলাদা আলাদা বিবেচিত হয়। মুসলিম উম্মত ইহুদি-খ্রিস্টানদের থেকে একারণে আলাদা যে, তাদের প্রত্যেকের নবী ভিন্ন। যদিও মুসলমানরা হযরত মূসা ও হযরত ঈসা আ.সহ আল্লাহর সকল নবীর প্রতিও ঈমান রাখে। কিন্তু আখেরি নবী শুধু হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিশ্বাস করে এবং একমাত্র তাঁর শরীয়তকে আমলযোগ্য মনে করে।
কোন ব্যক্তি শুধু হযরত ঈসা আ.-এর উপর ঈমান রাখলে সে হলো খ্রিস্টান। আর যে শুধু হযরত মূসা আ.-এর উপর ঈমান রাখে, তাকে বলে ইহুদি। মুসলমান বলার উপযুক্ত নয় তারা। কিন্তু কোন ইহুদি অথবা খ্রিস্টান যখন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ঈমান এনে তাঁকে শেষনবী মেনে নেয়, তখন তাকে আর ইহুদি বা খ্রিস্টান বলে না; সে তখন মুসলমান হয়ে যায়।
ঠিক একইভাবে কেউ মির্যা গোলাম আহমদকে নবী বিশ্বাস করলেও সে আর মুসলমান থাকবে না। কেননা, নতুন নবীর প্রতি ঈমান আনার কারণে পূর্বের নবীর উম্মত থেকে সে বের হয়ে নতুন নবীর উম্মতে দাখিল হয়ে যাবে। স্বয়ং মির্যা কাদিয়ানীরও একই বক্তব্য। তিনি বলেছেন-
انبیاءاس لئے آتے ہیں کہ تا ایک دین سے دوسرے دین میں داخل کریں۔ ( آئینہ کمالات اسلام ، روحانی خزائن৩৩৯/৫)
অর্থ : নবীগণ এক দ্বীন থেকে অন্য দ্বীনে দাখিল করানোর উদ্দেশ্যে আগমন করেন। (কাদিয়ানীর রচিত ‘আয়নায়ে কামালাতে ইসলাম’, রূহানী খাযায়েন ৫/৩৩৯)
অতএব, গোটা কাদিয়ানী সম্প্রদায় মির্যা গোলাম আহমদকে নবী মানার কারণে ইসলাম ধর্ম থেকে খারিজ হয়ে গেছে। তাদেরকে মুসলমান, মুহাম্মদী বা আহমদী বলা জায়েয নেই। তাদেরকে মির্যাঈ, গোলামী ও কাদিয়ানী বলা হবে। তাদের ধর্মের নাম কাদিয়ানী ধর্ম। ইসলাম ধর্ম নয়। এ প্রসঙ্গে কাদিয়ানীর প্রথম খলীফা হাকীম নূরুদ্দীনের এক ঐতিহাসিক বক্তব্য লক্ষ্য করুন-
انکا ( مسلمانوں کا) اسلام اور ہمارا (قادیانوں کا) اسلام اور ہے۔ (اخبار الفضل قادیان جلد ২ ، نمبر ৮৫، ص৬، مورخہ ৩১ دسمبر ১৯১৪م)
অর্থ: তাদের (মুসলমানদের) ইসলাম এবং আমাদের (কাদিয়ানীদের) ইসলাম দুটো আলাদা। (পাঞ্জাবের কাদিয়ান থেকে প্রকাশিত দৈনিক আলফযল, খ- ২, সংখ্যা ৮৫, পৃ: ৬, তারিখ- ৩১/১২/১৯১৪ ঈসাব্দ।)
তিন. সমস্ত মুসলমানের বুনিয়াদি ও সর্বসম্মত আকীদা হল, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ নবী, যার পর কিয়ামত পর্যন্ত আর কোনো নতুন নবী প্রেরিত হবে না। কুরআনে কারীমের আয়াত-
مَا كَانَ مُحَمَّدٌ اَبَاۤ اَحَدٍ مِّنْ رِّجَالِكُمْ وَ لٰكِنْ رَّسُوْلَ اللهِ وَ خَاتَمَ النَّبِیّٖنَ.
মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যে কোনো পুরুষের পিতা নন। কিন্তু তিনি আল্লাহর রাসূল এবং নবীগণের মধ্যে সর্বশেষ। -সূরা আহযাব (৩৩) : ৪০
এছাড়া অসংখ্য হাদীসের আলোকে সাহাবায়ে কেরাম রা., তাবেঈন এবং সমগ্র মুসলিম জাতির এটিই আকীদা। এ বিষয়ে সকলে একমত যে, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষনবী। নবুওতের ধারাবাহিকতা তাঁর মাধ্যমে সমাপ্ত হয়ে গেছে। এখন কোনো নতুন নবী আসবেন না।
এটা ইসলামের এমন বুনিয়াদি ও মৌলিক বিশ্বাস, যার ব্যাপারে কোনও ইসলামী দল বা জামাতের দ্বিমত নেই। (পক্ষান্তরে হযরত ঈসা আ.-এর বিষয়টি ভিন্ন। তিনি আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্বের নবী। তাঁর যুগেই তাঁকে আকাশে তুলে নেয়া হয়। কিয়ামতের পূর্বে যখন তিনি তাশরীফ আনবেন, আমাদের নবীর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে তাশরীফ আনবেন। নতুন কোনো নবুওত নিয়ে আসবেন না। এজন্য তাঁর আগমনে আমাদের নবীর শেষ নবী হওয়াতে কোনো প্রভাব পড়ে না।)
সকল মুসলমানের বিপরীতে কাদিয়ানীদের আকীদা হল, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর নবুওতের ধারাবাহিকতা শেষ হয়ে যায়নি।
এজন্য আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের তের শ বছর পর এসে মির্যা কাদিয়ানী বিংশ শতাব্দীর মানুষদের লক্ষ্য করে বলছেন-
میں کوئی نیا نبی نہیں مجھ سے پہلے سیکڑوں نبی آچکے ہیں۔ (الحکم ১০ اپریل ص: ২، کالم: ২، ১৯০৮)
অর্থ : আমি কোনো নতুন নবী নই। আমার পূর্বে শত শত নবী আগমন করেছেন। (কাদিয়ানীদের সাবেক পত্রিকা ‘দৈনিক আলহাকাম’, ১০ এপ্রিল ১৯০৮ঈ., পৃ: ২, কলাম: ২.)
গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর আরো কিছু বক্তব্য-
پس تم بغیر نبیوں اور رسولوں کےذریعہ کے
وہ نعمتیں کیوں کر پا سکتے ہو، لہاذا ضروری ہوا کہ تمہیں یقین اور محبت کے مرتبہ تک پہونچانے کے لئے خدا کے انبیاء وقتا فوقتا آتے رہیں، جن سے تم وہ نعمتیں پاؤ۔ (لیکچر سیالکوٹ ، روحانی خزائن ২২৭/২০)
অর্থ : সুতরাং তোমরা নবী এবং রাসূলদের মধ্যস্থতা ব্যতীত সেসব নিয়ামত কীভাবে পেতে পারো! অতএব এটা অপরিহার্য যে, তোমাদেরকে ইয়াকীন ও মুহাব্বতের স্তর পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য আল্লাহর নবীগণ সময়ে সময়ে আসতে থাকবেন। যাদের মাধ্যমে তোমরা সেই নিআমতরাজি লাভ করবে। (লেকচার শিয়ালকোট, রূহানী খাযায়েন ২০/২২৭.)
میں اس خدا کی قسم کھا کر کہتا ہوں جس کے ہاتھ میں میری جان ہے اسی نے مجھے بھیجا ہے اور اسی نے میرا نام نبی رکھا ہے۔ (تتمۂ حقیقۃ الوحی ، روحانی خزائن ৫০৩/২২)
অর্থ : আমি ঐ খোদার শপথ করে বলছি, যার হাতে আমার প্রাণ, তিনিই আমাকে প্রেরণ করেছেন এবং তিনিই আমার নাম ‘নবী’ রেখেছেন। (হাকীকতুল ওহীর পরিশিষ্ট, খাযায়েন ২২/৫০৩)
سچا خدا وہی ہے جس نے قادیان میں اپنا رسول بھیجا۔ (دافع البلاء، روحانی خزائن ২৩১/১৮)
অর্থ : প্রকৃত সত্য খোদা তিনিই, যিনি কাদিয়ানে তাঁর রসূল পাঠিয়েছেন। (দাফেউল বালা, রূহানী খাযায়েন ১৮/২৩১; বাংলা ‘দাফেউল বালা’ পৃ: ১২, ঢাকা বকশী বাজারস্থ আহমদিয়া মুসলিম (?) জামাত কর্তৃক জুলাই ২০১০ ঈসাব্দে প্রকশিত।)
ہمارا دعوی ہے کہ ہم رسول اور نبی ہیں۔ (الحکم ৫ مارچ ১৯০৮)
অর্থ : আমার দাবি হল, আমি রাসূল এবং নবী। (দৈনিক আলহাকাম, ৫ মার্চ ১৯০৮ঈ.; মির্যা কাদিয়ানীর ‘মালফুযাত’ ১০/১২৭, পুরাতন সংস্করণ)
এভাবে গোলাম আহমদ কাদিয়ানী আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর নবুওতের সিলসিলা জারি সম্পর্কে নিজের ভিন্ন মনগড়া আকীদা তৈরি করে নবুয়তের মিথ্যা দাবি করে। আর তার অনুসারীরা তাকে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর নিজেদের নবী হিসেবে গ্রহণ করে নেয় এবং খতমে নবুওত সংক্রান্ত কুরআনের স্পষ্ট আয়াতের অর্থে অপব্যাখ্যা করে। তারা আমাদের এ সর্বসম্মত আকীদার অপব্যাখ্যা এভাবে করে থাকে-
اللہ جلّ شانہ آنحضرت صلی اللہ علیہ وسلم کو صاحب خاتم بنایا، یعنی آپ کو افاضہ کمال کے لئے مہر دی، جو کسی اور نبی کو ہر گز نہیں دی گئی اسی وجہ سے آپ کا نام خاتم النبیین ٹھرا۔ (حاشیۂ حقیقۃ الوحی، روحانی خزائن: ১০০/২২)
অর্থ : মহা প্রতাপশালী আল্লাহ আঁ হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে খাতামের অধিকারী বানাইয়াছেন। অর্থাৎ তাঁহাকে পরিপূর্ণ আশিসের জন্য মোহর দেওয়া হয় যাহা আর কোন নবীকে কখনো দেওয়া হয় নাই। এই কারণেই তাঁহার নাম খাতামুন্নাবীয়্যীন সাব্যস্ত করা হইয়াছে। (অর্থাৎ তাঁহার পরিপূর্ণ অনুবর্তিতা নবুওয়ত দান করে এবং তাঁহার আধ্যাত্মিক মনোনিবেশ নবী সৃষ্টিকারী হয়।) (হাশিয়ায়ে হাকীকাতুল ওহী, রূহানী খাযায়েন ২২/১০০; বাংলা ‘হাকীকাতুল ওহী’র টীকা, পৃ: ৭৫. বইটি ঢাকা বকশী বাজারস্থ মজলিসে আনসারুল্লাহ বাংলাদেশ কর্তৃক ১৯৯৯ঈসাব্দে প্রকাশিত।)
এরূপ আরো বিভিন্ন অপব্যাখ্যার মাধ্যমে মির্যা ও তার অনুসারীরা এটা বলে যে, আলোচ্য আয়াতে ‘খাতাম’ শব্দের অর্থ ‘শেষ’ নয়; বরং এমন সীলমোহর (!) বিশেষ যা ব্যবহার করে করে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ উম্মতকে নবী বানাতে থাকেন।
অথচ একমাত্র কাদিয়ানীরা ছাড়া গোটা মুসলিম উম্মত এ বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ যে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার আখেরি নবী। সহীহ হাদীসের ভা-ারে এর পরিষ্কার উল্লেখ বিদ্যমান।
একথা স্বতঃসিদ্ধ, সর্বপ্রথম এ বিষয়ে উম্মতে মুসলিমার ইজমা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে নবুওতের দাবি করবে, সে মিথ্যাবাদী। তাকে মুরতাদ হিসেবে হত্যা করা মুসলিম শাসকের দায়িত্ব। এজন্য স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় যখন আসওয়াদ আনাসী নামের লোক নবুওতের দাবি করে, তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈক সাহাবীকে তাকে হত্যা করতে আদেশ দেন। সে মোতাবেক লোকটির শিরোñেদ করা হয়।
সিদ্দীকে আকবার রা. খালেদ বিন ওয়ালিদ রা.-এর নেতৃত্বে ঐ সময়ের নবুওতের মিথ্যা দাবিদার মুসায়লামা কাযযাব ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে জিহাদের জন্য সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। এ জিহাদে এ ভ- দাবিদার ও তার অনুসারী বিশাল জনগোষ্ঠী নিহত হয়। একইভাবে তুলায়হা আসাদী নবুওতের দাবি করলে সিদ্দীকে আকবার রা. তাকেও হত্যার নির্দেশ দেন। সেও নিহত হয়। এভাবে হারেস নামে এক ব্যক্তি যখন নবী দাবি করে, তখন খলীফা আবদুল মালিক সাহাবা ও তাবেঈন রা.-এর সর্বসম্মত ফতোয়ার ভিত্তিতে তাকে হত্যা করে শূলিতে চড়িয়ে দেন। খলীফা হারুনুর রশীদের যুগেও এক ব্যক্তির নবুওতের দাবির কারণে আদালতের রায় অনুযায়ী তার মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়।
এসবের অর্থ একটাই, ইসলাম ও মুসলমানদের নিকট হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ নবী। তাঁর পরে কোনো ধরনের কোনো নতুন নবী আসবে না। যে তাঁর পরে নবী দাবি করবে সে মুরতাদ। আর যে তাকে নবী মানবে সেও মুরতাদ। আর জানা থাকা উচিত, ইসলামে মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদ-। যা প্রয়োগ করা মুসলিম শাসকের দায়িত্ব। এমনকি স্বয়ং কাদিয়ানী ধর্মেও তাদের নবী বরং খলীফাকে অমান্যকারীর শাস্তিও এমন। যেমন তাদের প্রথম খলীফা হাকীম নূরুদ্দীনের বক্তব্য-
مجھے خدا نے خلیفہ بنادیا ہے اور اب نہ تمہارے کہنے سے معزول ہو سکتا ہوں نہ کسی میں طاقت ہے کہ وہ معزول کرے، اگر تم زیادہ زور دوگے تو یاد رکھو میرے پاس ایسے خالد بن ولید ہیں جو تمہیں مرتدوں کی طرح سزا دیں گے۔ ( تشحیذ الاذھان جلد ৯ شمارہ: ১১ صفحہ :১৪)
অর্থ : আমাকে আল্লাহ খলীফা বানিয়ে দিয়েছেন। এখন না তোমাদের কথায় আমার হটা সম্ভব; না আমাকে সরিয়ে দেবার ক্ষমতা কারো আছে। যদি তোমরা বেশি বাড়াবাড়ি কর, তাহলে মনে রেখো, আমার কাছে এমন খালেদ বিন ওয়ালিদ আছে, যে তোমাদেরকে মুরতাদদের মতো শায়েস্তা করবে।
(তাশহীযুল আযহান, খ- ৯, সংখ্যা : ১১, পৃ : ১৪, নভেম্বর ১৯১৪)
চার. সমস্ত মুসলমান এ বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ যে, পরকালীন নাজাতের জন্য হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওতের ওপর ঈমান এবং তাঁর অনুসরণই যথেষ্ট। কিন্তু কাদিয়ানীদের নিকট এটুকু যথেষ্ট নয়। বরং যতক্ষণ না কোনো ব্যক্তি মির্যা গোলাম আহমদের নবুওতের ওপর ঈমান আনবে, সে চিরস্থায়ী কাফের এবং জাহান্নামী হবে। তার সঙ্গে বিবাহ বন্ধন জায়েয নেই। তার জানাযার নামায পড়াও বৈধ নয়। কাদিয়ানীর বক্তব্য লক্ষ্য করুন-
اور جو میرے مخالف تھے انکا نام عیسایئ اور یہودی اور مشرک رکھا گیا (نزول المسیح، روحانی خزائن: ৩৮২/১৮)
অর্থ : আর যারা আমার বিরোধী ছিল, তাদের নাম খ্রিস্টান, ইহুদী এবং মুশরিক রাখা হয়েছে। (নুযূলুল মাসীহ, রূহানী খাযায়েন ১৮/৩৮২.)
মির্যা কাদিয়ানী বলেছেন-
ہر ایک شخص جسکو میری دعوت پہونچی ہے اور اس نے مجھے قبول نہیں کیا وہ مسلمان نہیں ہے۔ (حقیقتہ الوحی ، روحانی خزائن ১৬৭/২২؛ تذکرۃ : ৫১৯ چہارم ایڈیشن২০০৪م)
অর্থ : যাহাদের নিকট আমার দাওয়াত পৌঁছা সত্ত্বেও আমাকে গ্রহণ করে নাই, তাহারা মুসলমান নহে। (হাকীকাতুল ওহী ২২/১৬৭; বাংলা ‘হাকীকাতুল ওহী’, পৃ : ১৩০; তাযকিরা পৃ : ৫১৯. ৪র্থ সংস্করণ, ২০০৪ ঈ.)
তিনি আরো বলেছেন-
دشمن ہمارے بیابانوں کے خنزیر ہو گئے اور انکی عورتیں کتیوں سے بڑھ گئی ہیں۔ (نجم الہدی، روحانی خزائن ৫৩/১৪)
অর্থ : শত্রুরা আমাদের জঙ্গলের শূকরে পরিণত হয়েছে। আর তাদের স্ত্রীরা কুকুরনীর চেয়েও নিকৃষ্ট। (নাজমুল হুদা, রূহানী খাযায়েন ১৪/৫৩)
কাদিয়ানীদের দ্বিতীয় খলিফা মির্যাপুত্র বশীরুদ্দীন মাহমুদের বক্তব্য দেখুন-
کل مسلمان جو حضرت مسیح موعود کی بیعت میں شامل نہیں ہوئے خواہ انہوں نے حضرت مسیح موعود کا نام بھی نہیں سنا وہ کافر اور اسلام سے خارج ہیں۔ (آئینہ صداقت در انوار العلوم ১১০/৬)
অর্থ : সকল মুসলমান, যারা হযরত মাসীহে মাওউদ (মির্যা গোলাম আহমদ)-এর বাইআতে শামিল হয়নি, চাই তারা হযরত মাসীহে মাওউদের নামও না শুনে থাকুক, সবাই কাফের এবং ইসলাম থেকে খারিজ। (আয়নায়ে সাদাকাত, আনওয়ারুল উলূম ৬/১১০)
এসব কথার অর্থ হল, সারা পৃথিবীর কোটি কোটি মুসলমান, যারা মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে নবী মানে না, তারা সবাই কাদিয়ানীদের নিকট কাফের, মুশরিক এবং জাহান্নামী। মুসলমান (!) একমাত্র তারাই! (নাউযুবিল্লাহ)
পাঁচ. মুসলমান কুরআনে কারীমকে আল্লাহ তাআলার আখেরি কিতাব বিশ্বাস করে। তাদের ঈমান হল, এরপর আর কোনো বাণী বা কিতাব আল্লাহ তাআলা কিয়ামত পর্যন্ত নাযিল করবেন না। কিন্তু কাদিয়ানীদের নিকট মির্যার তথাকথিত ওহী-ইলহামও কুরআনের সমতুল্য। সেসবের প্রতি ঈমান আনা তাদের মতে এতটাই জরুরি, যতটা কুরআনের ওপর ঈমান রাখা জরুরি। আর মির্যার মনগড়া ইলহামী বাণীগুলোর তিলাওয়াতও নাকি কুরআন তিলাওয়াতের মতো ইবাদত। মির্যা সাহেবের ওহীও ঠিক তেমন মু‘জেযা যেমন কুরআনে কারীম মু‘জেযা।
মির্যা কাদিয়ানীর বক্তব্য লক্ষ্য করুন-
اور خدا کا کلام اس قدر مجھ پر نازل ہوا ہے کہ اگر وہ تمام لکھا جائےۓ تو بیس جزو سے کم نہیں ہوگا۔ (حقیقۃ الوحی، روحانی خزائن ৪০৭/২২)
অর্থ : খোদার কালাম এত বিপুল পরিমাণে আমার উপর অবতীর্ণ হইয়াছে যে, যদি ঐগুলির সব কয়টি লেখা হয় তবে ২০ (বিশ) খ-ের চাইতে কম গ্রন্থ হইবে না। (হাকীকাতুল ওহী, রূহানী খাযায়েন ২২/৪০৭; কাদিয়ানীদের অনূদিত বাংলা ‘হাকীকাতুল ওহী’, পৃ : ৩৩১)
মির্যাপুত্র বশীরুদ্দীন মাহমুদ ২৪শে মার্চ ১৯২৮ঈসাব্দে ঈদুল ফিতরের খোতবায় একথা বলেছিলেন-
جو سرور ویقین قرآن شریف سے پیدا ہوتا ہے وہ کسی اور (کتاب ) سے نہیں ہوتا اسی طرح وہ سرور و لذت جو حضرت مسیح موعود علیہ السلام کے الہاموں کی پڑھنے سے حاصل ہوتی ہے اور کسی کتاب کو پڑھنے سے نہیں ہو سکتی۔ حضرت مسیح موعود علیہ السلام اپنی وحی اپنی جماعت کو سنانے پر مامور ہیں، جماعت احمدیہ کو اس وحی پر ایمان لانا اور اس پر عمل کرنا فرض ہے۔ (الفضل ৩/اپریل ১৯২৮م ص: ৬ کالم: ৩)
অর্থ : যে আনন্দ এবং ইয়াকীন কুরআন শরীফ থেকে অর্জিত হয়, তা অন্য কোনো কিতাব থেকে হয় না। এমনিভাবে যে আনন্দ এবং স্বাদ হযরত মাসীহে মাওউদ আ.-এর ইলহামসমূহ পড়লে হাসিল হয়, তা অন্য কোনো কিতাব পড়ার দ্বারা হতে পারে না। হযরত মাসীহে মাওউদ আ. নিজ ওহী নিজ জামাতকে শোনাতে আদিষ্ট। আহমদিয়া জামাতের উপর এ ওহীর প্রতি ঈমান আনা এবং সে মোতাবেক আমল করা ফরয। (দৈনিক আলফযল, ৩রা এপ্রিল ১৯২৮ঈ. পৃ : ৬, কলাম : ৩)
ছয়. ইসলামী আকীদা মতে জিহাদ একটি ফরয ইবাদত। এর বিধান ততদিন বাকি থাকবে, যতদিন ইসলাম আছে। কুরআন ও হাদীসের অসংখ্য জায়গায় এ বিধানের উল্লেখ আছে। এর প্রতি উৎসাহ প্রদান এবং এর শর্ত-শরায়েত ও নিয়মকানুন বিদ্যমান আছে। কিন্তু মির্যা সাহেবের দাবি হল, আমার আগমনের দ্বারা জিহাদের হুকুম রহিত হয়ে গেছে। বিশেষত ইংরেজদের সঙ্গে জিহাদ করা অকাট্য হারাম। দেখুন তার বক্তব্য-
سو اب میرے ظہور کے بعد تلوار کا کوئی جہاد نہیں ہے ہماری طرف سے امن اور صلح کاری کا سفید جھنڈا بلند کیا گیا۔(مجموعۂ اشتہارات ২৯৫/৩)
অর্থ : সুতরাং এখন আমার আবির্ভাবের পর তরবারির কোনো জিহাদ নেই। আমাদের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা ও সন্ধির সাদা পতাকা উত্তোলন করা হল। (মজমুআয়ে ইশতিহারাত ৩/২৯৫)
মির্যা কাদিয়ানী আরো বলেছেন-
اب چھوڑ دو جہاد کا اے دوستو خیال/ دین کے لئے حرام ہے اب جنگ و قتال،
دشمن ہے وہ خدا کا جو کرتا ہے جہاد/ منکر نبی کا ہے جو یہ رکھتا ہے اعتقاد۔
(ضمیمۂ تحفۂ گولڑویہ، روحانی خزائن ৭৭-৭৮/১৭)
অর্থ : এখন বন্ধুরা বাদ দাও জিহাদের চিন্তা। দ্বীনের জন্য এখন যুদ্ধ-জিহাদ করা হারাম।
খোদার দুশমন সে, যে জিহাদ করে। নবীকে অস্বীকার করে সে, যে এ বিশ্বাস (অর্থাৎ জিহাদ বাকি থাকার বিশ্বাস) রাখে। (‘তোহফায়ে গোলড়বিয়া’র পরিশিষ্ট, রূহানী খাযায়েন ১৭/৭৭-৭৮)
এ সম্পর্কে তার আরো কয়েকটি বক্তব্য পড়–ন-
مسیح موعود کے وقت قطعا جہاد کا حکم موقوف کر دیا گیا۔ ( اربعین، خزائن ৪৪৩/১৭)
অর্থ : মাসীহে মাওউদ (মির্যা গোলাম আহমদ)-এর আমলে জিহাদের বিধান সম্পূর্ণ মওকুফ করে দেয়া হয়েছে। (আরবাঈন, রূহানী খাযায়েন ১৭/৪৪৩)
آج سے دین کے لئے لڑنا حرام کیا گیا (خطبہ الہامیہ، روحانی خزائن ১৭/১৬)
অর্থ : আজ থেকে দ্বীনের জন্য যুদ্ধ হারাম করা হলো। (খোতবায়ে ইলহামিয়া, রূহানী খাযায়েন ১৬/১৭)
یہ بات تو بہت اچھی ہے کہ گورنمنٹ برطانیہ کی مدد کی جائےۓ اور جہاد کے خراب مسئلہ کے خیال کو دلوں سے مٹا دیا جائے۔ (اعجاز احمدی ، روحانی خزائن ১৯/ ১৪৪)
অর্থ : এ তো খুবই ভালো কথা যে, বৃটিশ সরকারের সহযোগিতা করা হবে এবং জিহাদ করার মন্দ চিন্তা মানুষের মন থেকে দূর করা হবে। (ই‘জাযে আহমদী, রূহানী খাযায়েন ১৯/১৪৪.)
সাত. ইসলাম ও মুসলমানদের আকীদা হল, আম্বিয়ায়ে কেরাম আ. সকল মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। বিশেষ করে আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল নবীর চেয়েও মর্যাদাবান। কোনো ব্যক্তি যতই নেককার এবং মুত্তাকী হয়ে যাক, নবীর সমতুল্য সে হতে পারবে না। পক্ষান্তরে কাদিয়ানী সম্প্রদায় এবং মির্যা গোলাম আহমদের আকীদা হল, মির্যা নিজে সকল নবী বরং হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেও শ্রেষ্ঠ। দেখুন নিজের ব্যাপারে তিনি কী বলেছেন-
ابن مریم کے ذکر کو چھوڑو/ اس سے بہتر غلام احمد ہے۔ (دافع البلاء، روحانی خزائن ২৪০/১৮)
অর্থ : মরিয়ম পুত্র (ঈসা আ.)-এর আলোচনা বাদ দাও। তাঁর চেয়ে উত্তম গোলাম আহমদ। (দাফেউল বালা, রূহানী খাযায়েন ১৮/২৪০)
একবার কাদিয়ানীর জনৈক মুরিদ কাযী যহুরুদ্দীন আকমাল মির্যা কাদিয়ানী সম্পর্কে একটি প্রশংসামূলক কবিতা রচনা করে। মির্যার সামনে যখন সেই কবিতা আবৃত্তি করা হয়, তখন তিনি খুশি হয়ে এর রচয়িতাকে ‘জাযাকাল্লাহ’ (আল্লাহ তোমাকে উত্তম প্রতিদান দিন) বলেছিলেন। দেখুন সেই ধৃষ্টতাপূর্ণ কবিতা-
محمد پھر اتر آئےۓ ہیں ہم میں/ اور آگے سے بڑھ کر ہیں اپنی شان میں،
محمد دیکھنے ہوں جس نے اکمل / غلام احمد کو دیکھے قادیان میں۔ ( اخبار بدرقادیان، ২৫ اکتوبر ১৯০৬)
অর্থ : মুহাম্মাদ আবার নেমে এসেছেন আমাদের মাঝে/ এবং পূর্বের চেয়ে অধিক শান-সম্মানের সঙ্গে।
যে ব্যক্তি পূর্ণতম মুহাম্মাদকে দেখতে চাও/ গোলাম আহমদকে এসে দেখো কাদিয়ানে। (আখবারে বদর কাদিয়ান, ২৫ অক্টোবর ১৯০৬ঈ.)
অর্থাৎ গোলাম আহমদ হচ্ছে নাউযুবিল্লাহ হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পুনর্জন্মরূপ। আর এ দ্বিতীয় জন্মে নাকি প্রথমবারের চেয়ে অধিকতর কামেল যোগ্যতাসহ তার আবির্ভাব ঘটেছে। (কবিতাটি শুনে মির্যার জাযাকাল্লাহ বলার সংবাদ ২২ আগস্ট ১৯৪৪ ঈসাব্দে কাদিয়ানী পত্রিকা ‘আলফযলে’ ৪র্থ পৃষ্ঠার প্রথম কলামে ছেপেছিল।)
আট. হযরত ঈসা আ. আল্লাহ তাআলার অতি মর্যাদাসম্পন্ন নবী। কুরআনে কারীম তাঁর প্রশংসা ও সচ্চরিত্রের ঘোষণা দিয়েছে। তাঁর মাকে সিদ্দীকা ও সতী-সাধ্বী আখ্যা দিয়েছে। তাঁর ব্যাপারে সমস্ত মুসলমানের আকীদা এটাই। কিন্তু মির্যা গোলাম আহমদ তাঁর সম্পর্কে যেই নাপাক আকীদা পোষণ করে এবং তাঁর শানে যে জঘন্য বেয়াদবি করে, তা উল্লেখ করা তো দূরের কথা, ভাবলেও গা শিউরে উঠে। কিন্তু কাদিয়ানীদের আকীদা বোঝার জন্য এরও দুয়েকটি উদাহরণ দেখে নিন। মির্যা কাদিয়ানী বলেছেন-
مجھے قسم ہے اس ذات کی جس کے ہاتھ میں میری جان ہے کہ اگر مسیح ابن مریم مرے زمانے میں ہوتا تو وہ کام جو میں کر سکتا ہوں وہ ہرگز نہ کر سکتا اور وہ نشان جو مجھ سےظاہر ہو رہے ہیں وہ ہرگز دکھلا نہ سکتا۔ (حقیقۃ الوحی، روحانی خزائن ১৫৩/২২)
অর্থ : আমি কসম করছি সেই সত্তার, যার হাতে আমার প্রাণ, যদি মাসীহ ইবনে মারইয়াম আমার যুগে থাকত, তাহলে যেসব কাজ আমি করতে পারছি, কখনোই সে করতে পারত না। আর যেসব নিদর্শন আমার থেকে প্রকাশ পাচ্ছে, সে কখনোই তা দেখাতে পারত না। (হাকীকতুল ওহী, রূহানী খাযায়েন ২২/১৫৩)
এক জায়গায় তিনি বলেছেন-
تین دادیاں اورنانیاں آپ کی زناکار اور کسبی عورتیں تھیں جن کے خون سے آپ کا وجود ظہور پذیر ہوا۔ (ضمیمۂ انجام آتھم، روحانی خزائن ২৯১/১১)
অর্থ : হযরত মাসীহের তিন জন দাদী ও নানী ব্যভিচারিণী-দেহপসারিণী ছিলেন, যাদের রক্তে তার জন্ম। (আনজামে আথম-এর পরিশিষ্ট, রূহানী খাযায়েন ১১/২৯১)
তার আরেক বেআদবিমূলক বক্তব্য হলো-
یہ بھی یاد رہے کہ آپ کو کسی قدر جھوٹ بولنے کی بھی عادت تھی۔ (ضمیمۂ انجام آتھم ، روحانی خزائن ২৮৯/১১)
অর্থ : এটাও স্মর্তব্য যে, তিনি (হযরত মাসীহ) কিছুটা মিথ্যা বলতেও অভ্যস্ত ছিলেন। (আনজামে আথম-এর পরিশিষ্ট, রূহানী খাযায়েন ১১/২৮৯)
(উল্লেখ্য, মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর নিকট আল্লাহর নবী হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এবং খ্রিস্টানদের যিশুখৃস্ট একই ব্যক্তি। তার বিভিন্ন বক্তব্যে এ বিষয়ের উল্লেখ আছে। এক জায়গায় তিনি বলেছেন- ‘মূর্খ খ্রিস্টানরা হযরত ঈসাকে খোদা সাব্যস্ত করে রেখেছে।’ [হাকীকতুল ওহী, রূহানী খাযায়েন ২২/৮৯] আরেক জায়গায় স্পষ্ট লিখেছেন- ‘বাইবেল এবং আমাদের হাদীসের কিতাবাদীর আলোকে যেসব নবীর স্বশরীরে আকাশে গমনের ধারণা করা হয়, তারা দু’জন নবী। একজন ইউহান্না, যার নাম ইলিয়া এবং ইদরীস। অন্যজন মরিয়ম পুত্র মাসীহ, যাকে ঈসা এবং যিশুও বলে।’ [তাওযীহুল মারাম, রূহানী খাযায়েন ৩/৫২; আরো দেখুন, নুসরতুল হক, রূহানী খাযায়েন ২১/৪৩]
সুতরাং হযরত ঈসা আ. সম্পর্কে মির্যা কাদিয়ানীর বেয়াদবিমূলক বক্তব্যগুলোকে ‘খ্রিস্টানদের খ-নে বা প্রতিউত্তরে বলা হয়েছে’ বলে মিথ্যা অজুহাত দেখানোর অবকাশ নেই। কেননা, কাদিয়ানীর নিকট খ্রিস্টানদের যিশু আর মুসলমানদের ঈসা আ. একই ব্যক্তি। বিধায় সর্বাবস্থায় তার ঐসব বক্তব্য হযরত ঈসা আ.-এর শানে চরম বেয়াদবিরূপে বিবেচিত। -অনুবাদক।)
নয়. এছাড়া মির্যা সাহেব কুরআনে কারীমের অজ¯্র আয়াত, যা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে নাযিল হয়েছে, যেমন-
اِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحًا مُّبِیْنًا. اِنَّاۤ اَعْطَیْنٰكَ الْكَوْثَرَ. قُلْ اِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّوْنَ اللهَ فَاتَّبِعُوْنِیْ .
ইত্যাদি অসংখ্য আয়াতের উদ্দেশ্য নিজেকে সাব্যস্ত করেছেন। (দেখুন, হাকীকতুল ওহী, রূহানী খাযায়েন ২২/৯৭; তাযকিরাহ ৫১৪, ৬৩১ ও ১৪৬ নং পৃষ্ঠা।) অথচ এসকল আয়াতের উদ্দিষ্ট ব্যক্তি মুসলিম উম্মাহর সর্বসম্মতিক্রমে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
এমনিভাবে কাদিয়ানীদের নিকট-
* কাদিয়ানের ভূমি মক্কা-মদীনার মতো পবিত্র। (আনওয়ারুল উলূম ৬/৩৮)
* কাদিয়ান এলাকায় মির্যা কাদিয়ানীর নির্মিত মসজিদই কুরআনে বর্ণিত মসজিদে আকসা। (খোতবায়ে ইলহামিয়া, রূহানী খাযায়েন ১৬/২১,২৫)
* কাদিয়ানের জলসা হজে¦র সমান। (খোতবাতে মাহমুদ ৪/২৫৪-২৫৬)
* মির্যাকে যারা দেখেছে তারা সাহাবায়ে কেরামের মতো। (খোতবায়ে ইলহামিয়া, রূহানী খাযায়েন ১৬/২৫৮-২৫৯)
* মির্যার পরিবার নবী পরিবার। তার স্ত্রী উম্মুল মুমিনীন (মুমিনদের মা)। (সীরাতুল মাহদী ২/১১৭)
* কাদিয়ানের কবরস্থান সারা ভারতের সকল কবরস্থান থেকে শ্রেষ্ঠ। (তাযকিরাহ- পৃ : ৬০০, ৪র্থ সংস্করণ।)
অথচ মুসলিম মাত্রই জানে- এসব বিশ্বাস ইসলাম ও মুসলমানের আকীদা-বিশ্বাসের সম্পূর্ণ বিরোধী।
যাইহোক, এ ছিল কিছু উদাহরণ, যা দ্বারা একথা আমরা মুসলমানদের সামনে প্রমাণ করতে চাই যে, মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী এবং তার অনুসারীরা ইসলাম ছাড়া ভিন্ন কোনো ধর্মের লোক এবং তারা একটি স্বতন্ত্র ধর্মের প্রবক্তা। তাই কোনোভাবেই তারা মুসলিম হতে পারে না। তারা নিজেদেরকে মুসলমান বলার অর্থ প্রকৃত মুসলমানদের সঙ্গে প্রতারণা করা।
কাদিয়ানীদের উচিত, স্পষ্টভাবে একথা স্বীকার করে নেয়া যে, তারা মুসলিম নয়। তাদের কিতাবও আলাদা, নবীও আলাদা, ধর্মও আলাদা। আর নিজেদের মিথ্যা নবী, মিথ্যা কিতাব এবং মিথ্যা ধর্মকে ইসলাম বা প্রকৃত ইসলাম দাবি করা থেকে বিরত থাকা।
মুসলমানদেরও কর্তব্য, কাদিয়ানীদের মিথ্যাচার, প্রোপাগান্ডা এবং বাতিল অপব্যাখ্যায় প্রতারিত না হওয়া। তাদেরকে কাফের মনে করা এবং আপন সত্য দ্বীনের উপর দৃঢ়ভাবে অবিচল থাকা। কেননা, তারা মুসলমান নয়। ইসলাম ও তার মূল আকীদার সঙ্গে তাদের ন্যূনতম সম্পর্ক নেই।
আল্লাহ তাআলা সকল মুসলমানের ঈমান-আকীদার হেফাযত করুন এবং সব ধরনের প্রতারণা ও ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করুন- আমীন। ষ
وصلى الله على خاتم الأنبياء والمرسلين.
ভাষান্তর : মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম