জুমাদাল আখিরাহ-রজব ১৪৪০   ||   মার্চ ২০১৯

মদীনা মুনাওয়ারার একটি মজলিস : সীরাতের আলোকে কাজের সংস্কার : দাবি ও স্বরূপ

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

[গত রবিউল আখিরের শেষদিকে মুহতারাম মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন ছাহেব এই অধমকে তাঁর সাথে হারামাইনের সফরে নিয়ে গেলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। জুমাদাল উলার শুরুর দিকে আমরা মদীনা মুনাওয়ারায় হাজির হলাম। যে রাতে আমরা দেশে ফিরলাম সেই রাতে মসজিদে নববী সংলগ্ন ‘দারে তাইবা’র ১৪তম তলায় ঘনিষ্ঠ কয়েকজন শায়েখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ্ রাহ. ও হযরত নুমানী রাহ.-এর সঙ্গে নিসবতের কারণে ‘الأوائل السنبلية’-এর (আংশিক) কিরাআত-পাঠ ও ইজাযতের উদ্দেশ্যে একটি মজলিসের আয়োজন করলেন। সেই মজলিসের শেষদিকে কয়েকজন সাথী অন্যান্য প্রশ্নের সঙ্গে এই প্রশ্নও উত্থাপন করলেন যে, হযরত মাওলানা সা‘দ ছাহেব হাফিযাহুল্লাহু তাআলা-এর পক্ষ থেকে যে দাবি করা হচ্ছে, তিনি দাওয়াত ও তাবলীগের কাজকে সীরাতের উপর উঠাতে চাচ্ছেন- এর হাকীকত কী? তাছাড়া মাওলানা সা‘দ সাহেবের আসল বিচ্ছিন্নতা কী?

বর্তমান পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে মনে হল, এই প্রশ্নের উত্তর একটু বিস্তারিতভাবে দেওয়া দরকার। তাই এশার নামাযের পর আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ফযল ও করমে শুধু এই একটি প্রশ্নের বিষয়েই আলোচনা করা হয়েছে।

فاللّهُمّ مَا أَمسى بِي مِنْ نِعْمَةٍ، أَوْ بِأَحَدٍ مِنْ خَلْقِكَ، فَمِنْكَ وَحْدَكَ لَا شَرِيكَ لَكَ، فَلَكَ الْحَمْدُ وَلَكَ الشّكْرُ.

আশ্চর্যের বিষয় হল, হিন্দুস্তানের এক আল্লাহর বান্দা যার নামটিও আমি জানতে পারিনি, তিনি উর্দু এ বয়ানটিকে পত্রস্থ করে তাঁর একজন উস্তাযের মাধ্যমে আমার কাছে পাঠিয়েছেন, যেন আমি সেটির নযরে সানী করে দিই। লিখিত আকারে বয়ানটি পড়ার পর মনে হয়েছে, এটি সংরক্ষণ হয়ে গেলে ইনশাআল্লাহ ফায়েদা থেকে খালি হবে না। তাই সেটিকে দ্বিতীয়বার পড়ে কিছু সংযোজন-বিয়োজন ও পরিমার্জনের পর নতুন করে প্রস্তুত করি। পাঠকের সামনে এখন তার বাংলা অনুবাদ পেশ করা হচ্ছে। আল্লাহ তাআলা একে কবুল করুন এবং এর মাধ্যমে তাঁর বান্দাদের উপকৃত করুন। আমীন ইয়া রাব্বাল আলামীন।

هذا، وصلى الله تعالى وبارك وسلم على سيدنا ومولانا محمد وعلى آله وصحبه أجمعين، والحمد لله رب العالمين.

-মুহাম্মাদ আবদুল মালেক গুফিরা লাহু

৩০ জুমাদাল উলা ১৪৪০ হি.]

 

বিচ্ছিন্ন চিন্তা-চেতনা, মতাদর্শ বা বক্তব্যের পর্যালোচনা কি গীবতের অন্তর্ভুক্ত?

দাওয়াত ও তাবলীগের চলমান সংকট সম্পর্কে একজন প্রশ্ন করেছেন, কারো শুযূয বা বিচ্ছিন্ন চিন্তা চেতনা, মতাদর্শ ও বক্তব্যের পর্যালোচনা করা গীবতের অন্তর্ভুক্ত কি না।

বিষয়টি তো স্পষ্ট যে, এক হল দ্বীনী জামাআতের দ্বীনী যিম্মাদার। আরেক হল দ্বীনী জামাআতের ইনতিযামি যিম্মাদার। দুটি ভিন্ন বিষয়। ইনতিযামি যিম্মাদারের দায়িত্ব হল ব্যবস্থাপনাগত বিষয়ের দেখাশোনা করা। যেমন কাউকে বিদেশী মেহমানদের মেহমানদারির যিম্মাদারি দেয়া হল। তার দায়িত্ব হল মেহমানদারি সংক্রান্ত কাজগুলো আঞ্জাম দেয়া। পক্ষান্তরে দ্বীনী জামাআতের দ্বীনী যিম্মাদারের বিষয়টি ভিন্ন। তার দায়িত্ব দ্বীনী বিষয়ে দিকনির্দেশনা প্রদান করা। মূল বয়ানগুলো ও হায়াতুস সাহাবার তালীম সাধারণত তার যিম্মায়ই থাকে। প্রশ্ন হল, এমন যিম্মাদার যদি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে (দ্বীনী বিষয়ে) নতুন নতুন চিন্তা ও মতাদর্শ আবিষ্কার করেন তাহলে কী করণীয়? তখন কি সবাই নীরব থাকবে- একথা ভেবে যে, কথা বললে বিশৃঙ্খলা হবে, তাই চুপ থাকি?! সুবহানাল্লাহিল আযীম!

শরীয়তে এ ধরনের নীরবতার অনুমতি নেই; বরং এক্ষেত্রে শাযকে শায এবং মুনকারকে মুনকার বলা উলামায়ে কেরামের ওপর ফরয। যদি তাঁরা উসূল ও আদাবের সঙ্গে এই ফরয দায়িত্ব পালন করেন তাহলে একে গীবত নাম দেয়াটাও বিকৃতি। এটা তো নসীহত। গীবত এক জিনিস আর নসীহত আরেক জিনিস। النصيحة لله ولرسوله ولكتابه وللمؤمنينএর মধ্যে এই বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত যে, কোনো ব্যক্তি দ্বীনের নামে মুনকার কথা বললে বা শুযূয অবলম্বন করলে, দলীলের আলোকে সেই শুযূয ও মুনকারের হাকীকত স্পষ্ট করে দেয়া- এটিও নসীহতের অংশ। আর যদ্দুর জানি, সারা বিশে^ আহলে হক উলামায়ে কেরাম কমবেশি এই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

মাওলানার একটি মৌলিক বিচ্ছিন্নতা : নতুন নতুন উসূল আবিষ্কার

এখন প্রশ্ন হল, বর্তমানে নিযামুদ্দীনে যিনি এ কাজের যিম্মাদার হয়ে বসে আছেন এবং নিযামুদ্দীন মসজিদে, আম ইজতিমা ও জোড়গুলোতে বয়ান করে যাচ্ছেন, তার কথাবার্তা ও কর্মকাণ্ডে কী কী শুযূয এবং কী কী মুনকার বিষয় আছে? এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ইলমী প্রশ্ন। উলামায়ে কেরামের কর্তব্য, দলীলের আলোকে ভারসাম্যপূর্ণভাবে এ বিষয়ে পর্যালোচনা করা আর সব ধরনের উসকানিমূলক বক্তব্য এবং দলীল পরিপন্থী ও ভিত্তিহীন কথা থেকে বেঁচে থাকা। হয়ত বলবেন, ‘মুখ খুললে বিশৃঙ্খলা হবে, তাই নীরব থাক। কিন্তু সবাই নীরব থাকলে তো হক-বাতিল একসঙ্গে মিশে যাবে। এটা জায়েয নয়। আর শরীয়তে এমন ঐক্য ও সম্প্রীতিও কাম্য নয়, যার কারণে হক-বাতিলের পার্থক্য মুছে যায়। অথচ হক-বাতিলের মাঝে পার্থক্য হওয়া জরুরি।  ভালো ও মন্দ এক হয়ে যাওয়া বা মিশে যাওয়া শরীয়তের দৃষ্টিতে কখনো জায়েয নয়। আর উলামায়ে কেরাম এ দৃষ্টিকোণ থেকেই কথা বলছেন।

হযরত মাওলানা সা‘দ সাহেব (আল্লাহ তাআলা তাকে হেফাযত করুন এবং সঠিক পথে নিয়ে আসুন)-এর শুযূয ও ফিকরী বে-রাহরবী তথা বিচ্ছিন্নতা ও চিন্তাগত বিপথগামিতার মধ্যে খতরনাক বিষয় তো অনেক। যেমন এক হল গায়বী কথা বানানো। গায়বী কথা বলে বিদআতীদের জন্য রাস্তা খুলে দেয়া- এটা ভয়াবহ ফেতনা। আরেক হল ইহদাস-নবআবিষ্কার। তিনি নতুন নতুন উসূল বানাচ্ছেন! নতুন নতুন মাসআলা আবিষ্কার করছেন! কিছু তিনি করছেন, কিছু তার পক্ষে অন্যরা আবিষ্কার করছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে তার পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি পাওয়া যাচ্ছে না।

কোনো ব্যক্তি যখন নতুন নতুন উসূল ও মাসআলা আবিষ্কার করে, তখন অবশ্যই তাকে দলীলের বিকৃতি করতে হয়। আর এ ধরনের বিকৃতিই আজ চলছে। কেউ বিচ্ছিন্ন মত অবলম্বন করলে তার সমর্থনে সহীহ কথা কোথায় পাবে?

বিচ্ছিন্ন মত ও বক্তব্যের সমর্থনের জন্য বিচ্ছিন্ন পন্থাই অবলম্বন করতে হয়

বিচ্ছিন্ন মত ও বক্তব্যের সমর্থনে যে-ই অগ্রসর হবে তাকে শুযূযই অবলম্বন করতে হবে। সায়্যেদ আবুল আ‘লা মওদুদীর চিন্তা-চেতনা ও মতাদর্শের ব্যাপারে উলামায়ে কেরাম বিভিন্ন আপত্তি করেছিলেন। সেগুলোর খ-নে তার সমর্থক ও মতাদর্শের লোকেরা যে পন্থা অবলম্বন করেছিলেন, আজ মাওলানা সা‘দ সাহেবের ভুল বক্তব্যগুলোর ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে গিয়ে হুবহু সেই পন্থাই অবলম্বন করা হচ্ছে। অর্থাৎ শায বক্তব্যকে শায বক্তব্য দ্বারা, মুনকার কথাকে মুনকার কথা দ্বারা এবং শায বক্তব্যকে যাল্লাত তথা কারো অনিচ্ছাকৃত হয়ে যাওয়া ভুলের দ্বারা প্রমাণ করার ধারা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে! এটা অনেক বড় মুসিবত!

তারতীব পরিবর্তনেও মশওয়ারা জরুরি

কথা শুধু এতটুকু নয় যে, পূর্ববর্তী তিন আকাবিরের যুগে যে তারতীব ছিল মাওলানা সা‘দ সাহেব সেই তারতীবে কোনো পরিবর্তন আনতে চেয়েছেন। কথা শুধু এতটুকু হলে বিষয়টা কখনো এত কঠিন হত না। কেননা তারতীব এক জিনিস আর উসূল আরেক জিনিস। তারতীব মশওয়ারার মাধ্যমে পরিবর্তন হতে পারে। লক্ষ করুন, বলেছি- ‘মশওয়ারার মাধ্যমে পরিবর্তন হতে পারে’। এই নয় যে, জোর খাটিয়ে নিজের মতের ওপর ভিত্তি করে তারতীব পরিবর্তন করে ফেলবে। তারতীব মশওয়ারার মাধ্যমে পরিবর্তন হতে পারে। কারণ তারতীব পরিবর্তনযোগ্য।

তারতীবের অর্থ কী- বোঝেন? তারতীব হল ইনতিযামি বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেসব ইনতিযামি বিষয়ে একাধিক মুবাহ পদ্ধতি রয়েছে সেগুলোতে চলে আসা তারতীবের জায়গায় নতুন কোনো মুবাহ তারতীব বানাতে শরীয়তে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে তা হতে হবে মশওয়ারার মাধ্যমে। মশওয়ারার শর্ত কেন? বিভিন্ন কারণে। একটি কারণ হল, যে তারতীবে ফায়দা পরিলক্ষিত হচ্ছে, বিনা কারণে তা পরিবর্তন করা শরীয়তের মেযাজ নয় এবং পছন্দও নয়। কারণ যখন উভয় তারতীবই মুবাহ বা বৈধ, তখন আগের তারতীব কেন পরিবর্তন করা হবে? সেটা তো পরীক্ষিত তারতীব। তাতে বরকত ও ফায়দা পরিলক্ষিত হচ্ছে। খামোখা তা কেন পরিবর্তন করা হবে? হাঁ, যদি মশওয়ারার মাধ্যমে পরিবর্তন করা হয় তাহলে বাস্তব অবস্থা সামনে আসবে। বোঝা যাবে, এখন ইনশাআল্লাহ নতুন তারতীবেই ফায়দা হবে। কারণ সময় ও অবস্থার বিবেচনায় এতদিন এই তারতীব মুনাসিব ছিল; এখন অন্য তারতীব মুনাসিব হবে। তাছাড়া মশওয়ারার মাধ্যমে নতুন তারতীব গ্রহণ করলে তা চিন্তাভাবনা করেই গ্রহণ করা হবে এবং খাহেশাতের অনুগামী হওয়া থেকেও বেঁচে থাকবে। উপযুক্ত কোনো তারতীব হবে (ইনশাআল্লাহ)। মূলত এজন্যই মশওয়ারার শর্ত।

তিনি উসূলও পরিবর্তন করা শুরু করেছেন

মোটকথা, তারতীব যেহেতু পরিবর্তনযোগ্য তাই মশওয়ারার মাধ্যমে তা পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু উসূল ও মানহাজ এবং নীতি ও আদর্শ কীভাবে পরিবর্তন হবে? সেটা তো পরিবর্তনযোগ্য নয়। অথচ মাওলানা সা‘দ সাহেব তারতীবেই শুধু হাত দেননি; উসূলও পরিবর্তন করা শুরু করেছেন। কখনো ঘোষণা দিয়ে, কখনো কাজের মধ্য দিয়ে উসূল পরিবর্তন করছেন। উল্লেখযোগ্য কোনো মশওয়ারা ছাড়া তারতীবও পরিবর্তন করছেন। আরে ভাই! উসূল কেন পরিবর্তন করছেন? কিসের ভিত্তিতে উসূল পরিবর্তন করছেন? নতুন নতুন উসূল বানাচ্ছেন? তিনি তো এখন এমন এমন উসূল ও নীতি বানাচ্ছেন, যেগুলো শরীয়তের উসূল ও কাওয়ায়েদ এবং মেযাজ ও রুচির পরিপন্থী।

একটি বিদআতী উসূল : দাওয়াতের কাজে কোনো মশওয়ারা নেই

উদাহরণস্বরূপ একটি কায়দা দেখুন! মাওলানা সা‘দ সাহেব যীদা মাজদুহুম বলেন-

کام اور انتظام دو چیزیں ہیں الگ الگ، کام اور انتظام، کام تو سیرت کے تابع ہے، انتظام مشورے کے تابع ہے...، مشورے والے کام کے تابع ہیں، اور انتظامی امور مشورے کے تابع ہیں۔

অর্থ : কাজ আর ইনতিযাম (ব্যবস্থাপনা) দুটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়। কাজ তো সীরাতের তাবে‘। আর ইনতেযাম মশওয়রার তাবে..., মশওয়ারাওয়ালা কাজের তাবে‘। আর ইনতিযামি বা ব্যবস্থাপনাগত বিষয় মশওয়ারার তাবে।

এটা নতুন নীতি; পুরনো নীতি নয়। একদম  বিদআতি এবং নব আবিষ্কৃত নীতি। এই নীতি-

من أحدث في أمرنا هذا ما  ليس منه فهو رد.

(অর্থাৎ যে আমাদের দ্বীন-শরীয়তে এমন কোনো বিষয় উদ্ভাবন করবে, যা তার অংশ নয়- তা প্রত্যাখ্যাত।)-এর অন্তর্ভুক্ত। নব আবিষ্কৃত তার এ নীতিতে খুব আপত্তিকর দুটি বিষয় রয়েছে।

এক. এই দাবি যে, দাওয়াতের কাজে ও শরঈ বিষয়ে কোনো মশওয়ারা নেই।

দুই. কাজকে সীরাতের তাবে‘ বলে নিজের রায় বা মতের তাবে‘ বানিয়ে দেয়া।

প্রথম আপত্তিকর বিষয়

তিনি বলেন, কাজের বিষয়ে কোনো মশওয়ারা নেই। তা তো  সীরাতের তাবে‘। আরেক মজলিসে তিনি বলেন-

مشورہ ہوتا ہے نظم کے لئے ، صحابہ نے مشورہ کئے نظم کے لئے، کام کے لئے نہیں مشورے کئے، کام تو منصوص ہے، منصوصات کا مشورہ نہیں ہوتاہے۔

অর্থ : মশওয়ারা হয় নযমের জন্য। সাহাবায়ে কেরাম নযমের জন্য মশওয়ারা করেছেন। কাজের জন্য মশওয়ারা করেননি। কাজ তো মানসূস১। আর

মানসূস  বিষয়ে মশওয়ারা হয় না।’ কাজ দ্বারা উদ্দেশ্য হল, দাওয়াতের কাজ। তিনি বলতে চাচ্ছেন, এতে মশওয়ারা নেই। মশওয়ারা হয় ব্যবস্থাপনাগত বিষয়ে। অথচ বাস্তবতা হল, দাওয়াতের কাজসমূহ ও শরয়ী বিষয়াবলীর ক্ষেত্রে মশওয়ারা করাও শরীয়তের বিধান। সীরাতের ফায়সালাও তা। হাদীসের কিতাবসমূহে কত মাসআলা আছে, যেগুলোর সমাধানে খুলাফায়ে রাশেদীন মুরুব্বী সাহাবীদের সমবেত করেছেন, বদরী সাহাবীদের একত্র করেছেন। কখনো ধারাবাহিকভাবে মশওয়ারা করেছেন। বলেছেন, মুহাজিরগণ আসুন। তারপর বলেছেন, আনসারগণ আসুন...। বিশেষত হযরত আবু বকর রা. ও হযরত ওমর রা. দ্বীনী বিষয় ও মাসআলার ক্ষেত্রে কত গুরুত্বের সঙ্গে মশওয়ারা করতেন।

সুতরাং এসব বিষয়ে মশওয়ারা খুলাফায়ে রাশেদীন, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনের যুগে ধারাবাহিকভাবে হয়ে এসেছে। ইমাম আবু হানীফা রাহ. ফিকহ শাস্ত্র সংকলন করেছেন। বহু মাসআলা ‘ইসতিম্বাত’ করেছেন। সেজন্যে তাঁর একটি মজলিসে শূরা ছিল। অথচ মাওলানা সা‘দ সাহেব বলছেন, শুধু ব্যবস্থাপনাগত বিষয়ে মশওয়ারা হয়; শরয়ী বিষয়ে ও দাওয়াতের কাজে মশওয়ারা নেই! এটা নতুন মাসআলা; নতুন নীতি এবং দলীলবিহীন নীতি। শুধু দলীলবিহীন নয়; বরং দলীল পরিপন্থী।

খুলাফায়ে রাশেদীন ও আকাবির আসলাফের তাআমুল ও অবিচ্ছিন্ন কর্মধারা ছাড়াও সরাসরি হাদীস শরীফে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। হযরত আলী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-

قُلْتُ: يَارَسُول اللهِ، إِنْ نَزَلَ بِنَا أَمْرٌ لَيْس فِيهِ بَيَانُ أَمْرٍ وَلَا نَهْيٍ، فَمَا تَأْمُرُنَا؟ قَالَ: تُشَاوِرُونَ الْفُقَهَاءَ وَالْعَابِدِينَ، وَلَاتُمْضُوا فِيهِ رَأْيَ خَاصّةٍ. (رواه الطبراني في المعجم الأوسط (১৬৪১)، قال الهيثمي في مجمع الزوائد (১: ১৭৮) : رجاله موثقون من أهل الصحيح . وصححه السيوطي في مفتاح الجنة ص ৪০)

অর্থ : আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! যদি আমরা এমন কোনো বিষয়ের সম্মুখীন হই, যে বিষয়ে (কুরআন ও সুন্নাহয়) সুস্পষ্ট আদেশ বা নিষেধ নেই তাহলে আপনি আমাদের কী আদেশ করেন (অর্থাৎ তখন আমাদের কী করণীয়)? তিনি বলেছেন, তোমরা সেক্ষেত্রে ফকীহ ও আবেদদের সঙ্গে মশওয়ারা করবে; ব্যক্তি বিশেষের মতকে চালিয়ে দিবে না। -আলমুজামুল আওসাত, তবারানী, হাদীস ১৬৪১

দ্বিতীয় আপত্তিকর বিষয় :

এবার আমরা দ্বিতীয় আপত্তিকর বিষয়টি বুঝার চেষ্টা করি। তিনি বলেছেন-

کام تو سیرت کے  تابع ہے، مشورہ والے کام کے تابع ہیں.

অর্থ : কাজ তো সীরাতের অধীন। আর মশওয়ারাওয়ালারা কাজের অধীন।

সীরাত থেকে দাওয়াতের উসূল ও আদাব আহরণ করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়

নিঃসন্দেহে দাওয়াতের কাজ সীরাতের অধীন। আর সীরাতের অধীন হওয়ার কারণে এ বিষয়ে মশওয়ারা করা আরো বেশি জরুরি। কারণ দাওয়াতের কাজের রূপরেখা, উসূল ও আদাব এবং দাওয়াত সংক্রান্ত যেসব নতুন নতুন সমস্যা বিভিন্ন সময়ে আসতে থাকবে সেগুলোর সমাধান- এই সবকিছু সীরাত থেকে গ্রহণ করতে হবে। প্রশ্ন হল, সীরাত থেকে এসব বিষয় কে গ্রহণ করবে? আপনি তো এ যুগের লোকদের উদ্দেশে বলছেন, আপনার অধীনস্তদের বলছেন এবং এ যুগের তালাবা ও আম উলামার উদ্দেশে বলছেন। এরা কি এই কঠিন ও নাযুক কাজ আঞ্জাম দিতে সক্ষম? আর খোদ হযরত মাওলানা সা‘দ সাহেবের মধ্যেও কি তাজদীদ ও ইজতিহাদের এই কাজ আঞ্জাম দেয়ার শর্তগুলো ন্যূনতম পর্যায়েও বিদ্যমান আছে?

দেখুন, হাদীস তো আমলেরই জন্য। হাদীস ফিকহের উৎস। কিন্তু হাদীস থেকে ফিক্হ গ্রহণের জন্য কি যে কেউ হাদীসের কিতাব খুলে ইজতিহাদ শুরু করে দেবে? হাদীস থেকে মাসআলা ইসতিম্বাত করতে থাকবে?

‘ফিকহ’ হল হাদীস ও সুন্নাহর অধীন। কিন্তু তার অর্থ কি এই যে, হাদীস থেকে ফিক্হ গ্রহণের জন্য মশওয়ারার দরকার নেই; হাদীসের কথা বলে যে  কেউ যা কিছু বলবে সবার জন্য তা মানা আবশ্যক? কখনো না। তেমনিভাবে দাওয়াতের কাজ সীরাতের অধীন হওয়ার অর্থ কখনো এই নয় যে, তাতে মশওয়ারা নেই। এ তো আজীব নীতি হল। যে কারো জন্যই এখন দরজা খুলে গেল সীরাতের নামে যা ইচ্ছা আবিষ্কার করার। সীরাতের নাম নিয়ে যার মনে যা আসে তাই বলার সুযোগ পেয়ে গেল। ধরুন, কেউ সীরাত থেকে জিহাদের অধ্যায় খুলে বলল : এখনই নিযামুদ্দীনের মিম্বার থেকে সকল কুফরের বিরুদ্ধে জিহাদের ঘোষণা করতে হবে, আপনি তাকে কী বলবেন? আপনি তো একথাই বলবেন যে, দেখুন ভাই! এসব বিধান প্রয়োগের জন্যে শর্ত আছে; উসূল ও আদাব আছে। সেগুলো রক্ষা করা জরুরি। তো এসব শর্ত, উসূল ও আদাব আমরা কোত্থেকে গ্রহণ করব? ফুকাহায়ে কেরাম থেকেই তো? সুতরাং দাওয়াতের কাজ যেহেতু সীরাতের অধীন সেহেতু সীরাতের রেওয়ায়েতসমূহের আলোকে দাওয়াত সংক্রান্ত মাসআলাসমূহের সমাধানের জন্য আপনাকে ফকীহ ও আলেম দায়ীগণের শরণাপন্ন হতে হবে। ফুকাহায়ে কেরামের দ্বারস্থ হতে হবে। বর্তমানে যেসকল ফকীহ ও দায়ী আছেন তাঁদের সঙ্গে মশওয়ারা করতে হবে।

সীরাত থেকে দাওয়াতের উসূল ও আদাব আহরণের মৌলিক নীতিমালা

কারণ সীরাত থেকে দাওয়াত সংক্রান্ত দিক-নির্দেশনা গ্রহণ করতে হলে আপনাকে কমপক্ষে তিনটি ধাপ অতিক্রম করতে হবে।

প্রথম ধাপ : সংশ্লিষ্ট বর্ণনাসমূহ একত্র করা

সীরাতের বর্ণনাসমূহকে একত্র করা। অর্থাৎ কোনো বিষয়ে সীরাতের আদর্শ ও নির্দেশনা গ্রহণ করতে হলে প্রথমে আপনাকে সীরাত থেকে সে বিষয়ে বর্ণিত সকল রেওয়ায়েত জমা করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হল, সীরাতের সকল রেওয়ায়েত কি ‘হায়াতুস সাহাবাতে’ আছে? হযরত মাওলানা ইউসুফ (রাহ.)-এর বয়ানসমূহে আছে? কিছুতেই না।

দ্বিতীয় প্রশ্ন, সীরাতের কিতাব কোনগুলো? সীরাত শিরোনামে যেসব কিতাব আছে কেবল সেগুলোই কি সীরাতের কিতাব? হাদীসের কিতাবসমূহ কি সীরাতের কিতাব নয়? অবশ্যই। এ ছাড়া তারীখ ও ইতিহাস সম্পর্কে মুতাকাদ্দিমীনের যেসকল কিতাব আছে সব সীরাতের কিতাব; বিশেষত খায়রুল কুরূনের তারীখ বিষয়ক কিতাবসমূহ। তাই  এক বিষয়ে সীরাতে কী কী তথ্য আছে তা কি শুধু ‘হায়াতুস সাহাবা’ পড়ে ও তালীম করে জানা যাবে? না; বরং বিষয়টি অনেক কিতাবে দেখতে হবে।  এক ব্যক্তির তো  সকল রেওয়ায়েত জানা থাকা জরুরি নয়। তবে অন্যদের সঙ্গে মশওয়ারা করলে এবং আহলে ফন ও শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তিদের শরণাপন্ন হলে অন্যান্য রেওয়ায়েতও সামনে আসবে।

 কিন্তু আপনি তো উসূল বানাচ্ছেন যে, কোনো মশওয়ারা নেই! বলছেন, আমরা সীরাত থেকে নেব! আরে, সীরাতের বিস্তৃতি সম্পর্কে আপনার খবর আছে?

সীরাত তো অনেক বিস্তৃত বিষয়। পুরো সীরাতের বিষয়ে কি আপনার জানাশোনা আছে? যখন শাস্ত্রজ্ঞদের শরণাপন্ন হবেন এবং বিজ্ঞ ব্যক্তিদের সঙ্গে মশওয়ারা করবেন তখন তা জানতে পারবেন। কিন্তু আপনি তো মশওয়ারার দরজাই বন্ধ করে দিচ্ছেন- এ কথা বলে যে, মশওয়ারা হয় ইনতিযামী বিষয়ে; দাওয়াতের কাজে কোনো মশওয়ারা নেই!

তো প্রথম কাজ হল, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সকল বর্ণনা এবং সকল শিক্ষা একত্র করা। আর এ কাজটি করতে হবে শাস্ত্রজ্ঞদের শরণাপন্ন হয়ে এবং বিজ্ঞ ব্যক্তিদের সঙ্গে পরামর্শ করে। নতুবা তা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ফলে ভুল ফলাফল বের হবে। সকল রেওয়ায়েত একত্র করলে এক রকম নতিজা হবে। আর এক বিষয়ের দু-তিন বর্ণনা নিয়ে বাকিগুলো ছেড়ে দিলে বা সেগুলো জানা না থাকলে ভিন্ন রকম নতিজা হবে।

দ্বিতীয় ধাপ : সংশ্লিষ্ট বর্ণনা যাচাই বাছাই করা

দ্বিতীয় যে কাজটি করতে হবে তা হল, যেসব বর্ণনা একত্র করা হয়েছে সেগুলোর তাহকীক ও তানকীহ। অর্থাৎ রেওয়ায়েতগুলোর মধ্যে কোন্ কোন্ রেওয়ায়েত দলীল ও আমলের যোগ্য তা নির্বাচন করা; সহীহ, যয়ীফ, যয়ীফ জিদ্দান, মাতরূহ, ওয়াহী, মাওযূ- এসব চিহ্নিত করা। কারণ সীরাতের কিতাবসমূহে সাধারণত সব ধরনের রেওয়ায়েত থাকে। ‘হায়াতুস সাহাবাতে’ (সহীহ, হাসানের পাশাপাশি) মুনকার ও যয়ীফ জিদ্দান পর্যায়ের রেওয়ায়েতও প্রচুর পরিমাণে আছে। আর হযরত মাওলানা ইউসুফ (রাহ.)-ও বলেননি যে, এ কিতাবের সকল রেওয়ায়েত সহীহ।

তাই আপনি যদি সীরাতের বর্ণনাসমূহ থেকে দাওয়াতের কাজের উসূল-আদাব ও রূপরেখা গ্রহণ করতে চান, আপনাকে প্রথমে তাহকীক করতে হবে যে, এই বর্ণনাটি সহীহ বা হাসান কি না! কিংবা কমপক্ষে সালিহ লিল আমাল বা আমলযোগ্য কি না? কারণ বর্ণনাটি মুনকারুল মতন, ওয়াহী, মাতরূহ বা মাওযূ হলে তা থেকে কোনো হেদায়েত গ্রহণ করা যাবে না। কারণ এ ধরনের বর্ণনা রাসূলুল্লাহর সীরাতের অংশ নয়।

এই উসূল রক্ষিত না হওয়ার একটি উদাহরণ

যেমন বলা হয়েছিল, ব্যভিচারীরা কুরআনের ছামান (ثمن) গ্রহণকারীদের আগে জান্নাতে চলে যাবে। কোত্থেকে বলা হল এমন কথা? জিজ্ঞাসা করলে বলা হল, এ কথা তো উমর রা. বলেছেন। আরে! কোথায় বলেছেন উমর রা.? কীভাবে আপনি জানলেন- তিনি এমন কথা বলেছেন? বলা হল, হায়াতুস সাহাবাতে একটি বর্ণনা আছে। ঠিক আছে; খুলুন হায়াতুস সাহাবা! সেখানে কানযুল উম্মালের উদ্ধৃতি আছে। কানযুল উম্মালে খতীবে বাগদাদী (রাহ.)-এর কিতাব ‘আলজামে‘ লিআখলাকির রাবী ওয়া আদাবিস সামে’-এর হাওয়ালা আছে। তাহলে বর্ণনাটি সেখানে দেখুন। তার মতন ও সনদ লক্ষ্য করুন। দেখবেন, সেখানে دناة ‘দুনাত’ আছে;  زناة ‘যুনাত’ নয়। (দুনাত অর্থ নিকৃষ্ট লোকেরা। আর যুনাত অর্থ যিনাকারীরা।) এমনকি অন্য কোনো কিতাবের মুদ্রিত কপিতে ‘যুনাত’ শব্দ থাকলেও তার পা-ুলিপি গভীর দৃষ্টিতে পড়লে দেখা যাবে সেখানেও ‘দুনাত’ আছে।

 এ তো হল শব্দের অবস্থা। আর সনদ বা বর্ণনাসূত্রের হালত হল, তাতে ‘মুআল্লা ইবনে হেলাল’ রয়েছে, যে মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত এবং মিথ্যাবাদী হিসেবে পরিচিত। সুতরাং সনদে এমন মিথ্যাবাদী রাবী থাকাবস্থায় বর্ণনাটিকে হযরত ওমর রা.-এর দিকে নিসবত করা কি জায়েয আছে? কখনো নয়। কিন্তু এই মুনকার মওযু রেওয়ায়েতকে সহীহ মনে করে আপনি প্রকাশ্যে মজমাগুলোতে শোনাচ্ছেন! অথচ এটা সীরাতের অংশই নয়। বরং এটা একটা জাল বর্ণনা। মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত এক ব্যক্তির বর্ণনা।

 সুতরাং রেওয়ায়েতের শুদ্ধাশুদ্ধি নির্ণয় করা না হলে মানুষ সীরাতের নামে মুনকার মওযু রেওয়ায়েত শুনিয়ে দেবে, মুনকার মওযু রেওয়ায়েত থেকে দাওয়াতের উসূল, আদাব ও বিধি-বিধান বের করতে থাকবে আর বলতে থাকবে, ভাই! আমি তো কাজকে সীরাতের ওপর আনতে চাচ্ছি! অতএব আপনি যদি কাজকে সীরাতের ওপর আনতে চান, প্রথমে আপনাকে উসূলুল জারহি ওয়াত তা‘দীল এবং উসূলুত তাসহীহ ওয়াত তাযয়ীফের আলোকে রেওয়ায়েতসমূহের শুদ্ধাশুদ্ধি নির্ণয় করতে হবে। আর আপনি যেহেতু এই শাস্ত্রের লোক নন সেহেতু আপনাকে অবশ্যই শাস্ত্রজ্ঞদের শরণাপন্ন হতে হবে। তাছাড়া  যদি আপনি এই শাস্ত্রের লোক হতেন তবু আপনার একার মত গোটা উম্মতের ওপর চাপিয়ে দেয়া যেত না। শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তিও অন্যান্য আহলে ইলমের সঙ্গে মশওয়ারা করে থাকেন। কিন্তু আপনি তো মশওয়ারার রাস্তাই বন্ধ করে দিয়েছেন এই বলে যে, এসব বিষয়ে মশওয়ারা নেই; মশওয়ারা হয় শুধু ব্যবস্থাপনাগত বিষয়ে!

তৃতীয় ধাপ : রেওয়ায়েত যাচাইয়ের পর উসূল মোতাবেক তার মর্ম উদ্ধার করা 

তৃতীয় যে কাজটি করতে হবে তা হল, সীরাতের-সংশ্লিষ্ট ঘটনা বা বর্ণনাটির মর্ম উদ্ঘাটন করা। অর্থাৎ রেওয়ায়েতের গ্রহণযোগ্যতা যাচাইয়ের পর (চাই তা সহীহ হোক বা হাসান কিংবা এমন যয়ীফ, যা শর্তসাপেক্ষে আমলযোগ্য। অর্থাৎ তা আহকাম আহরণের উপযুক্ত হোক বা আদব গ্রহণের- যে পর্যায়েরই হোক) প্রথমে দেখার বিষয় হল, এই রেওয়ায়েতে আমাদের মাসআলার সমাধান আছে কি না? আমাদের সমস্যার প্রতি এই রেওয়ায়েত আলোকপাত করে কি না? এই রেওয়ায়েতের আলোকে কী মাসআলা ‘ইসতিম্বাত’ হয়?  এ তো ফিকহুস সীরাহর মাসআলা। ফিকহুল হাদীসের জন্য যেমন ফকীহগণের দ্বারস্থ হতে হয় তেমনি ফিকহুস সীরাহর জন্যও ফুকাহায়ে কেরাম, আলেম ও ফকীহ দায়ী এবং সালেহ ব্যক্তিদের শরণাপন্ন হতে হবে। তাদের সঙ্গে মশওয়ারা করতে হবে।

সুতরাং সীরাত থেকে দাওয়াতের কাজ ও তার রূপরেখা গ্রহণের জন্যে আপনাকে কমপক্ষে তিনটি ধাপ অতিক্রম করতে হবে। কিন্তু এই তিনটি ধাপ এমন, যেগুলো অতিক্রম করতে হলে আহলে ফনের দ্বারস্থ হওয়া এবং আহলে ইলমের সঙ্গে মশওয়ারা করা একান্ত জরুরি। অন্যথায়  কোনো ব্যক্তি যদি শাস্ত্রীয় দক্ষতা ও বিশেষজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও এসব কাজ একাকী আঞ্জাম দিতে যায় তাহলে তো সর্বনাশ! আর পারদর্শী হলেও সেটা হবে তার ব্যক্তিগত মত বা ইজতিহাদ। আর কারো ব্যক্তিগত মত বা  ইজতিহাদকে কি আপনি সরাসরি সীরাত নাম দিয়ে দেবেন?

সীরাত সম্পর্কে ব্যক্তিমতামত কিংবা ব্যক্তিবিশেষের অনুধাবন আর সরাসরি সীরাত এক কথা নয়

 দেখুন, فهم فلان في السيرة (সীরাত বিষয়ে কারো  বুঝ) এক জিনিস আর أسوة السيرة بعينها (সরাসরি সীরাতের আদর্শ) আরেক জিনিস। ইমাম তাহাবী ও ইমাম জাস্সাস (রাহ.)সহ অনেকেই বহু স্থানে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। কোনো কিছুকে সরাসরি সীরাত (عين سيرت) বলতে হলে তা সরাসরি قطعي الثبوتقطعي الدلالة শ্রেণীর বর্ণনায় উদ্ধৃত থাকতে হবে। যেসব বর্ণনায় ফাহম ও ইসতিম্বাতের বিভিন্নতার অবকাশ রয়েছে সেসব রেওয়ায়েতের ক্ষেত্রে ব্যক্তি বিশেষের ফাহমকে আইনে সীরাত বলার অবকাশ নেই। ইমাম তাহাবী রাহ. শরহু মাআনিল আসার কিতাবে এ বিষয়ে অত্যন্ত মূল্যবান কথা  বলেছেন। তিনি বলেন-

وَإِنّمَا وَقَعَ الْخِلَاف بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ فِي التّأْوِيلِ لَافِي نَفْسِ الْحَدِيثِ، لِأَنّا قَدْ صَرَفْنَا الْحَدِيثَ إِلَى وَجْهٍ يَحْتَمِلُهُ فَاعْرِفُوا مَوْضِعَ خِلَافِ التّأْوِيلِ مِنْ مَوْضِعِ خِلَافِ الْحَدِيثِ، فَإِنّهُمَا مُخْتَلِفَانِ وَلَاتُوجِبُوا عَلَى مَنْ خَالَفَ تَأْوِيلَكُمْ خِلَافًا لِذَلِكَ الْحَدِيثِ.

(শরহু মাআনিল আসার; খ- : ২, পৃষ্ঠা : ২৭৪, প্রকাশনা : শারিকাতুল কুদ্স; অধ্যায় : বাবু মা ইয়ালবাসুল মুহরিমু মিনাস সিয়াব)

ইমাম তাহাবী রাহ.-এর বক্তব্যের সারকথা হল, এক হল আপনার বুঝ, যা আপনি এই হাদীস থেকে বুঝেছেন, আরেক হল সরাসরি হাদীস। এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য করুন! কারণ এক প্রকারের হাদীস এমন, যা একেবারে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন। সেটা তো সরাসরি রাসূলুল্লাহর বাণী। আরেক প্রকারের হাদীস এমন, যা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ এবং যার মধ্যে একাধিক অর্থের সম্ভাবনা থাকে। যার ফলে তার মর্মোদ্ঘাটনে আহ্লে ইলমের মাঝে ইখতেলাফ হওয়ার সুযোগ আছে।

এক্ষেত্রে আপনি যে মর্ম উদ্ঘাটন করেছেন সেটা আপনার ইজতিহাদ- যদি আপনি ইজতিহাদের যোগ্য হন। সে ইজতিহাদের ভিত্তি নিঃসন্দেহে হাদীস;  কিন্তু তা তো সরাসরি হাদীস বা সরাসরি সীরাত নয়। এ ধরনের ইজতিহাদকে সরাসরি সীরাত বলে দাবি করা বাড়াবাড়ি। সীরাতের উপর ভিত্তি করে করা ইজতিহাদকে ইজতিহাদই বলা উচিত- সরাসরি সীরাত  নয়।

দাওয়াতের কাজ কার তাবে‘? সীরাতের, না সাদ সাহেবের?

মশওয়ারা করার দ্বারা কমপক্ষে এইটুকু উপকার তো হবে যে, এ ধরনের বাড়াবাড়ি থেকে বেঁচে যাবে। সীরাত থেকে নেয়া নিজের মতকে সরাসরি সীরাত বলে দেয়ার বাড়াবাড়ি থেকে ইনশাআল্লাহ বেঁচে যাবে। কিন্তু যদি আপনি মশওয়ারা না করে একাকী সব কাজ আঞ্জাম দেন, আর বলেন, কাজ সীরাতের অধীন, তাহলে এর অর্থ হবে, সীরাতের রেওয়ায়েতসমূহ একত্র করার কাজও আপনার, নির্বাচনের কাজও আপনার আর এসবের পরিধি ততটুকই যতটুকু আপনার জানার পরিধি। এবং সেগুলোর মর্মও তা, যা আপনি বুঝেছেন! ফলে যা ভুল তাও সীরাতের দিকে সম্বন্ধ করা হবে এবং যেটা ব্যক্তিগত ইজতিহাদ সেটাকেও সরাসরি সীরাত নাম দিয়ে দেয়া হবে। বলুন, এটা কি ইনসাফ? সব বিষয়ের স্তর তারতম্য সঠিক হওয়া জরুরি।

তো দাবি কী করা হল? কাজ সীরাতের অধীন। কিন্তু আহলে ফনের শরণাপন্ন হননি। মশওয়ারাযোগ্য বিষয়গুলোতে মশওয়ারা করেননি, বরং সবকিছুকে নিজের জানাশোনার গ-িতে সীমাবদ্ধ রেখে দিয়েছেন। ফল কী হল? ফল তো এটাই যে, বলা হবে, কাজ সীরাতের তাবে‘ (অধীন), কিন্তু বাস্তবে তার অর্থ হবে সাদের তাবে‘! সা‘দের ইনতিখাব (নির্বাচন), সা‘দের ইজতিহাদ, সা‘দের ফাহাম (বুঝ) এবং সা‘দের ইলমের তাবে‘! নাম হল সীরাতের তাবে‘ কিন্তু বাস্তবে সা‘দের তাবে‘!!!

ইনসাফের সঙ্গে শুনুন, ইনসাফের সঙ্গে ভাবুন! দাওয়াতের কাজে এবং শরয়ী বিষয়ে যদি মশওয়ারার প্রয়োজন না হয় তাহলে এসব বিষয়ে মাওলানা সা‘দের প্রয়োজন কেন হবে? যদি এসকল বিষয়ে মাওলানা সা‘দের প্রয়োজন হয় তাহলে এসব বিষয়ে মশওয়ারারও প্রয়োজন হবে। তিনি এ কী নতুন নীতি আবিষ্কার করলেন যে, যিম্মাদারের প্রয়োজন আছে, কিন্তু মশওয়ারার প্রয়োজন নেই!!

সময় নেই, নতুবা আরো বিস্তারিত আলোচনা করতাম যে, কাজকে সীরাতের উপর নিয়ে আসার নামে যা কিছু নতুন যুক্ত করা হয়েছে বা পরিবর্তন করা হয়েছে সবকিছুর সারকথা এটাই যে, সংশ্লিষ্ট অন্যান্য রেওয়ায়েত সম্পর্কে অজ্ঞতা কিংবা মুনকার ও মা‘লুল (আপত্তিকর ও ত্রুটিযুক্ত) রেওয়ায়েতকে সহীহ মনে করা অথবা উসূলে ফিকহে পারদর্শী না হওয়ায় গলত ইসতিম্বাত করে কোনো মুবাহ বা বৈধ বিষয়কে খেলাফে সীরাত বলে দেয়া আবার অন্য কোনো মুবাহকে ফরয বা আইনে সীরাত বানিয়ে দেয়া। আমার জানা নেই, সীরাতের নামে তিনি যেসব বিতর্কিত তাজদীদ করেছেন সেগুলোর কোনোটা এই প্রকারগুলোর বাইরে কি না। কারো জানা থাকলে বলতে পারেন।

 উপরন্তু এ বিষয়টিও ভাবা উচিত যে, তিনি কাদের বিপরীতে তাজদীদের দাবি করছেন এবং এ দাবির অন্তরালে বুঝে বা না বুঝে কাদের প্রতি সীরাত বিষয়ে অজ্ঞতার কিংবা সীরাত অনুসরণে অবহেলার অপবাদ আরোপ করছেন?!

 আমরা দুআ করি, আল্লাহ তাআলা হযরত মাওলানা সা‘দ সাহেবকে ‘ফিকরি বে-রাহরাবী’ -চিন্তাগত বিপথগামিতা- থেকে হেফাজত করুন! ‘ফিকরি বে-রাহ রাবী’ এটা আমার শব্দ নয়। আপনারা জানেন, দারুল উলূম দেওবন্দের সর্বশেষ ওয়াযাহাতি লেখায় এ শব্দটি আছে। এই ফিকরি বে-রাহরাবীর শিকার হয়ে পড়েছেন মাওলানা সা‘দ সাহেব। তিনি এ থেকে ফিরে আসলেই তার প্রতি আকাবিরের ইতমিনান ফিরে আসা সম্ভব। আল্লাহ তাআলা তাকে ফিকরি বে-রাহরাবী থেকে ফিরিয়ে আনুন!

ইতাআত ও এতাআতী

আমরা তাঁর জন্য দুআ করি এবং যেসব লোক তার ইতাআতের নামে..., আপনাদের এখানে কী পরিভাষা জানি না, আমাদের ওখানে তো এই পরিভাষা বানিয়ে ফেলা হয়েছে- ‘এতাআতী’! যতদিন আগের তিন আকাবির ছিলেন এবং কাজ সঠিক পন্থায় ছিল ততদিন এই নাম ছিল না। এখন যখন কাজ ভুল পথে যেতে শুরু করেছে তখন এই ‘এতাআতী’ নাম চলে এসেছে। অর্থাৎ যতদিন ইতাআতের উসূল ও মাপকাঠি বিদ্যমান ছিল ততদিন এ নাম ছিল না। কিন্তু যখন মাপকাঠি শেষ হয়ে গেল তখন জোর দেয়া হচ্ছে ব্যক্তির ইতাআতের, জায়গার ইতাআতের! ইন্নালিল্লাহ!!

ইতাআত ও আনুগত্যের ক্ষেত্রে শরীয়তের বিধান

অথচ শরীয়তের বিধান হল-إنما الطاعة في المعروف অর্থাৎ আনুগত্য শুধু বৈধ বিষয়ের  ক্ষেত্রে। এই নয় যে, গাইরে মুজতাহিদ ইজতিহাদ শুরু করে দিবে, চিন্তাগত বিপথগামিতার শিকার হয়ে একের পর এক নতুন নতুন কথা বলতে থাকবে আর সবাই নীরব থাকবে; বলবে, ভাই! আমীরের ইতাআত ওয়াজিব! মনে রাখবেন, এ ধরনের চিন্তা ও কর্মপন্থা একেবারে শরীয়ত পরিপন্থী।

‘খুরূজ আলাল আমীর’-এর হাকীকত

এখন এই লোকেরা বলতে শুরু করেছে, ‘কুফরে বাওয়াহ’ বা স্পষ্ট কুফরের আগে ‘খুরুজ আলাল আমীর’ জায়েয নেই। জানি না, এই মাসআলার হাকীকত তাদের জানা আছে কি না।

প্রথম কথা, এই মাসআলা কোন্ আমীরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? এটা তো আমীরুল মুমিনীনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

দ্বিতীয় কথা,

خروج على الأمير (খুরুজ আলাল আমীর) এবং

خروج من عند الأمير إظهارا للبراءة من منكراته وأهوائه

(খুরুজ মিন ‘ইনদিল আমীর ইযহারান লিলবারাআতি মিন মুনকারাতিহি ওয়া আহওয়াইহি)- দুটি এক বিষয় নয় এবং দুটির হুকুমও এক নয়।

তৃতীয় কথা, শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ জায়েয না হলেও সামর্থ্য থাকার শর্তে  মৌখিকভাবে তার শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপের বিরোধিতা করা ওয়াজিবأفضل الجهاد كلمة حق عند سلطان جائر

(অর্থ : সর্বোত্তম জিহাদ হল যালেম শাসকের সম্মুখে হক কথা বলা।)

এই হাদীস কে না জানে? আর ইতাআতের বিষয়ে কথা হল, শরীয়তের যে মৌলিক নীতি- إنما الطاعة في المعروف   তা বড় বড় খলীফাতুল মুসলিমীনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মোটকথা এই লোকেরা বিষয়টাকে গুলিয়ে ফেলেছে।

কোন্ আমীরের বিপক্ষে ‘খুরূজ’ নিষিদ্ধ?

আমাদের জানা থাকা উচিত, শুরুহে হাদীস ও ফিকহের কিতাবাদিতে খুরুজ করা বা না করার মাসআলাটি আলোচিত হয়েছে আমীরুল মুমিনীন বা খলীফাতুল মুসলিমীনের প্রসঙ্গে, কোনো তাহরীকের আমীরের প্রসঙ্গে নয়। কারণ কোনো তাহরীক বা জামাআতের আমীরের ক্ষেত্রে খুরুজ আলাল আইম্মার মাসআলাই নেই। দেখুন, কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে লাগিয়েছে! আমীরুল মুমিনীন ও খলীফাতুল মুসলিমীনের বিরুদ্ধে খুরুজের মাসআলাকে নিয়ে এসেছে দ্বীনী জামাআতের দ্বীনী যিম্মাদারের ক্ষেত্রে।

উপরন্তু বিকৃতির আরো এক ধাপ আগে বেড়ে খুরুজের নিষিদ্ধতাকে চাপিয়ে দিয়েছে নাহি আনিল মুনকার বরং ইনকারুল মুনকারের উপর। অর্থাৎ আমীরের বিরুদ্ধে খুরুজ করা যেহেতু নিষিদ্ধ তাই তার অন্যসব মুনকার ও শুযূযের প্রতিবাদ করাও নিষিদ্ধ! কোনো দ্বীনী জামাআতের দ্বীনী যিম্মাদারের ক্ষেত্রে তো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর তরিকার বাইরে সামান্য কিছু বললেও সে বিষয়ে সতর্ক করে দেয়া জরুরি। নতুবা শরীয়ত বিকৃত হয়ে যাবে।

এখানে প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, ‘খিলাফত আলা মিনহাজিন নবুওয়াহ’ এবং ‘ইমারাতে আদেলা’ অর্থাৎ খুলাফায়ে রাশিদীন ও দ্বীনদার ন্যায়পরায়ণ শাসকদের ধারা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পর রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের আসল কাজ আর দ্বীনী রাহবরি থাকেনি। মানুষ বুঝে গিয়েছে, এরা দ্বীনী রাহবরির যোগ্য নয়। তাই তারা দ্বীনী রাহবরি গ্রহণ করে শুধু আইম্মায়ে কেরাম ও উলামা মাশায়েখ থেকে। ফলে শুধু ব্যবস্থাপনাগত বিষয়গুলোই হয়ে যায় রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের মূল কাজ। যেমন রাষ্ট্রের জাগতিক ও বৈষয়িক বিষয়গুলোর দেখাশোনা করা, রাস্তা-পোল তৈরি করা, জুলুম অত্যাচার রোধ করা ইত্যাদি। এগুলো হল এখন তাদের আসল কাজ। এজন্য বলা হয়, তারা যেসব কাজ করছে সেগুলো যেহেতু জরুরি তাই তাদের বিরুদ্ধে খুরুজ করো না! বাকি রইল আনুগত্যের মাসআলা। সে বিষয়ে শরীয়তের বিধান হল- إنما الطاعة في المعروف অর্থাৎ শুধু বৈধ বিষয়ের ক্ষেত্রে তাদের আনুগত্য কর। আর দ্বীনী বিষয়, শরয়ী হুকুম ও দ্বীনী রাহবরি- এসব গ্রহণ কর উলামা-মাশায়েখ থেকে।

সারকথা হল, যেহেতু রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের দ্বারা ব্যবস্থাপনাগত বিষয়ে উপকার হচ্ছে সেহেতু তাদের বিরুদ্ধে খুরুজ করো না, যতক্ষণ না তারা ‘কুফরে বাওয়াহ’ বা স্পষ্ট কুফুরিতে লিপ্ত হয়। বোঝাই যাচ্ছে, এই মাসআলা আমীরুল মুমিনীন ও খলীফাতুল মুসলিমীনের ক্ষেত্রে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, তারা এই মাসআলাকে নিয়ে  এসেছে দ্বীনী তাহরীকের দ্বীনী যিম্মাদারের ক্ষেত্রে। এটা বিকৃতি।

‘কুফরে বাওয়াহ’ পর্যন্ত নীরব থাকার ভয়াবহতা

এর চেয়েও আরো ভয়ংকর হল, তাদের কেউ কেউ দ্বীনী জামাআতের দ্বীনী যিম্মাদারের আনুগত্যকেও নিঃশর্ত বলে রেখেছে! উপরন্তু তারা আমীরের মুনকার ও শুযূযের উপর শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে আপত্তি উত্থাপনকেও নিষিদ্ধ ভেবে বসে আছে। কী কী নতুন মাসআলা বানাচ্ছে তারা! অথচ বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট। কারণ কুফরে বাওয়াহ বা স্পষ্ট কুফর পর্যন্ত নীরব থাকলে তো দ্বীনই বিকৃত করে ফেলবে। স্পষ্ট কুফরের আগ পর্যন্ত যত গোমরাহী আছে সব বলতে থাকবে। একেক বার একেক কথা আসতে থাকবে। কিন্তু সবাই চুপ; কারণ স্পষ্ট কুফরি এখনো হয়নি!! বলুন,  দ্বীন বিকৃতির এর চেয়ে ভয়াবহ প্রক্রিয়া আর কী হতে পারে!

আর এ প্রসঙ্গে এখন যাচ্ছি না যে, বর্তমানে যে যিম্মাদারের ব্যাপারে ‘এতাআতে’র নবআবিষ্কৃত এ নীতি প্রয়োগ করা হচ্ছে তার এমারত শরয়ী তরীকায় আদৌ সাব্যস্ত হয়েছে কি না।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন! আমি প্রথমেই বলেছি, উস্কানিমূলক কথা পরিহার করুন! অন্যায় সমালোচনা, গালিগালাজ, উপহাস, নামবিকৃতি, অপবাদ- এসব থেকে বেঁচে থাকুন! আবার হক কথা বলা থেকে খামোশও না থাকুন! হক কথা বলুন, তবে সঠিক পন্থায় বলুন। মানতে বাধ্য করা আমাদের কাজ নয়। আমাদের কাজ হল ভদ্রোচিত পন্থায় বলে যাওয়া এবং নিজে হকের উপর অবিচল থাকা।

দারুল উলূম দেওবন্দ-এর অনাস্থা প্রকাশ ও এর বাস্তবতা

কথা লম্বা হয়ে গেল, ‘দারুল উলূম দেওবন্দের’ সর্বশেষ ওয়াযাহাতী লেখায় বলা হয়েছে, ‘রুজুর পরও মাওলানা মুহাম্মাদ সা‘দ সাহেবের যে চিন্তাগত বিপথগামিতার বিষয়ে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছিল তা উপেক্ষা করা যায় না। কারণ, কয়েক বার রুজু করার পরও বিভিন্ন সময়ে তার এমনসব নতুন নতুন বয়ান পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে তার সেই (ক) মুজতাহিদসুলভ ভঙ্গি, (খ) দলীল-প্রমাণের ভুল প্রয়োগ এবং (গ) দাওয়াত সম্পর্কে তার নিজস্ব বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি প্রমাণে শরয়ী নুসূসের অপপ্রয়োগের বিষয়গুলো স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে। যার কারণে শুধু দারুল উলূমের যিম্মাদারগণই নন, অন্যান্য হক্কানী উলামায়ে কেরামেরও মাওলানার সামগ্রিক ফিকিরের ব্যাপারে কঠিন অনাস্থা রয়েছে।’

সামনে বলা হয়েছে, ‘আমাদের মানতে হবে, আকাবিরের চিন্তা-চেতনা ও মতাদর্শ থেকে সামান্য বিচ্যুতিও কঠিন ক্ষতির কারণ। তাই বয়ান-বক্তব্যের ক্ষেত্রে মাওলানার সতর্কতাপূর্ণ পন্থা অবলম্বন করা উচিত। সেইসঙ্গে আকাবির ও আসলাফের পথ ও পন্থার উপর অটল-অবিচল থেকে শরঈ নুসূস তথা কুরআন-হাদীস থেকে ব্যক্তিগত ইজতিহাদের ধারা বন্ধ করা উচিত। কেননা মাওলানার এজাতীয় অবান্তর ‘ইজতিহাদ’ থেকে এমন মনে হয়, আল্লাহ না করুন তিনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মতাদর্শ, বিশেষত স্বীয় আকাবিরের মাসলাক ও আদর্শ থেকে ভিন্ন কোনো নতুন জামাআতের রূপ দিতে যাচ্ছেন।’

দারুল উলূমের এ লেখাটি ১৩/৫/১৪৩৯ হিজরী মোতাবেক ৩১/০১/২০১৮ ঈসায়ী তারিখের। এ লেখার পর এ যাবৎ এক বছরই তো হল। যদি মাওলানা সা‘দ সাহেবের এই এক বছরের বয়ানগুলোই শোনা হয়, হয়রান হয়ে যেতে হবে এ কথা ভেবে যে, তার মুজতাহিদসুলভ ভঙ্গি সীমা ছাড়িয়ে কোথায় চলে গেছে! বেফাকে উলামায়ে হিন্দ কর্তৃক সংকলিত-

مولانا محمد سعد صاحب کے ২০১৮ ء کے چند بیانات علمائےۓ کرام کی خدمت میں

-পড়লে দারুল উলূমের চিহ্নিত করা সমস্যা তিনটির অনেক দৃষ্টান্ত একসঙ্গে পাওয়া যাবে।

মাওলানা সা‘দ সাহেবের বিচ্ছিন্নতার সারকথা

তো মাওলানা সা‘দ সাহেবের আসল শুযূয বা বিচ্ছিন্নতা কী- এ প্রশ্নের উত্তর উপরোক্ত আলোচনা এবং দারুল উলূমের সর্বশেষ লেখাসহ আগের লেখাগুলোতে আছে। বান্দার ভাষায় যার সারকথা হল- ইলমের স্বল্পতা সত্ত্বেও স্বাধীনচেতা মনোভাবের কারণে নিজের ইলম ও বোধ-বুদ্ধির গ-ির বাইরে দখলদারি করে তাজদীদ করতে যাওয়া এবং সেটাও মুজতাহিদসুলভ ভঙ্গিতে। এটাই হল সে শুযূয ও বিচ্ছিন্নতা, যাতে লিপ্ত হওয়ার কারণে বিচ্ছিন্ন ও আপত্তিকর মত ও বক্তব্য এবং ভুল ও গোমরাহীপূর্ণ চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি একের পর এক লোকসম্মুখে চলে আসছে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সালাফের পথে অবিচল রাখুন! সব ধরনের শুযূয ও বিচ্ছিন্নতা থেকে রক্ষা করুন! আর যারা বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করেছে তাদের জন্য আমরা দুআ করি, আল্লাহ তাআলা তাদের সঠিক পথে ফিরে আসার তাওফীক দান করুন! সবাইকে চিন্তাগত বিপথগামিতা থেকে সঠিক পথে নিয়ে আসুন!

ওয়া আখিরু দাওয়ানা আনিল হামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন! ষ

[কিছু জিজ্ঞাসা ও জবাবের পরবর্তী কিস্তি পড়–ন আগামী যিলকদ সংখ্যায়- ইনশাআল্লাহ]

 

 

advertisement