দ্বীনী-শিক্ষা : স্কুল-কলেজে ইসলাম শিক্ষা
স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা দ্বীন কোথায় শিখবে, কীভাবে শিখবে- এটি এখন আমাদের মুসলিমসমাজের এক জ¦লন্ত জিজ্ঞাসা। এই জিজ্ঞাসাই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থার অবক্ষয় প্রমাণ করছে। একটি মুসলিম-সমাজের এই অবস্থাটা কি স্বাভাবিক যে, এর অধিকাংশ শিক্ষার্থীর জন্যেই ইসলাম শিক্ষার মানসম্মত কোনো ব্যবস্থা নেই? এই আরোপিত ও অস্বাভাবিক অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার উপায় কী? আর যে পর্যন্ত এ অবস্থা থেকে মুক্তি না ঘটছে ঐ পর্যন্ত কি দ্বীন শেখার কোনো উপায়ই তাদের হবে না? এ বিষয়গুলো ভাবা দরকার।
উন্নতি ও উত্তরণের জন্য সবার আগে প্রয়োজন দুর্দশার উপলব্ধি। ইসলামী শিক্ষার অভাবে আমাদের সমাজ আজ অল্পে অল্পে কোথায় নেমে এসেছে তা চিন্তা করলেও শিহরিত হতে হয়। শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থ-বাণিজ্য, নৈতিকতা-রাজনীতির কোন্ ক্ষেত্রটি এমন আছে, যা ভেতরে বাইরে চূড়ান্ত অবক্ষয়ের শিকার হয়নি? এই অবক্ষয়-অস্বাভাবিকতা থেকে উত্তরণের জন্য ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের কোনোই বিকল্প নেই- এই উপলব্ধি অতি প্রয়োজন।
কিন্তু এই উপলব্ধির পথেও আছে বাধা-বিপত্তি। ব্যাপক প্রচার-প্রপাগান্ডা ও চিন্তাগত বিভ্রান্তির কারণে এই সঠিক উপলব্ধিও অনেকের মনে জাগছে না, জাগলেও তা এড়িয়ে যাওয়ারই তাড়না বোধ করছে।
কারো চিন্তা- ‘সবাই কি মাওলানা সাহেব হয়ে যাবে? সমাজে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারেরও তো প্রয়োজন আছে!’ কিন্তু কে না জানে যে, এখানে সবাইকে মাওলানা সাহেব হওয়ার কথা বলা হচ্ছে না, বলা হচ্ছে মুসলমান হওয়ার কথা, ভালো মানুষ হওয়ার কথা। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার যারা হবেন তাদেরও কি সত্যিকারের মুসলমান হতে হবে না, ভালো মানুষ হতে হবে না?
সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির ইসলামী শাস্ত্র-বিশারদ হওয়া ফরয নয়, ফরয হচ্ছে যথাযথ মুসলমান হওয়া এবং মুসলিম হিসেবে জীবনযাপনের জন্য যতটুকু জ্ঞান দরকার ততটুকু অর্জন করা।
কেউ হয়তো বলবেন, ধর্ম-শিক্ষার একটা ব্যাপার তো আমাদের জাতীয় শিক্ষাক্রমেও আছে। ধর্ম ও নৈতিকতার মৌলিক জ্ঞান অর্জনের জন্য কি তা যথেষ্ট নয়?
এই প্রশ্নের জবাবটা আমি নিজে না দিয়ে ঐ অঙ্গনের একজনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরা সমীচীন মনে করছি।
১১ জানুয়ারি ২০১৯ শুক্রবার দৈনিক কালের কণ্ঠের ‘ইসলামী জীবন’ পাতায় কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজের ইসলামিক স্টাডিজের বিভাগীয় প্রধান জনাব মো. আলী এরশাদ হোসেন আজাদ এ বিষয়ে কিছু কথা বলেছেন। ‘স্কুল-কলেজে ইসলামি শিক্ষার গুরুত্ব কমছে’ শীর্ষক নিবন্ধে এক জায়গায় তিনি লেখেন-
“অজ্ঞাত কারণে স্কুল-কলেজ পর্যায়ে ‘ইসলাম শিক্ষা’ অযত্ন-অবহেলার শিকার। স্কুলে ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ বইটি ‘ইসলাম ধর্ম শিক্ষা’ নামে প্রচলন করা গেলে হয়তো শিশু-কিশোর মননে ‘ধর্মচিন্তা’ স্পষ্টতর হবে। স্কুলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লাস্ট পিরিয়ডে থাকে ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ ক্লাস। শুধু এ কারণেই অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় ‘এ প্লাস’ পায় না। এর ফলে অনেকে ‘গোল্ডেন’ থেকে বঞ্চিত হয়। এমন অবহেলায় নতুন প্রজন্মের কাছে অপরিচিত থেকে যায় ধর্মীয় চেতনাবোধ।”
“কলেজ পর্যায়েও ইসলাম শিক্ষার অবস্থা ভালো নেই। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বিষয়বিন্যাস আরো হতাশাজনক। নীতিমালা অনুযায়ী ‘ইসলাম শিক্ষা’ ¯্রফে ঐচ্ছিক। এতে আশঙ্কাজনক হারে সব কলেজেই ইসলাম শিক্ষায় ছাত্রসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে! বোর্ডগুলোতে ২০১৩/২০১৪ এবং ২০১৫/২০১৬-এর পরীক্ষার্থীসংখ্যা দেখলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ২০১২-২০১৩ শিক্ষাবর্ষেও বিষয়টি তৃতীয় বা চতুর্থ হিসেবে নেওয়ার সুযোগ ছিল (‘ক’, ‘খ’ গুচ্ছবিন্যাস অনুসারে)। আমি অধ্যাপনার ২৬ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, আগে সব গ্রুপের সবাই বিষয়টি নিত। বিশেষত, ১৯৯৮ বা আরো আগে বিষয়টি আবশ্যিকের গুরুত্ব রাখত। ডিগ্রি পর্যায়েও নানা নিয়মের প্রতিবন্ধকতা ও সুযোগ সংকুচিত হওয়ার ফলে ইচ্ছা থাকলেও অনেকেই ‘ইসলামিক স্টাডিজ’ নিতে পারে না।”
এ কথাগুলোর সাথে স্কুল-কলেজের পরিবেশ-পরিস্থিতি ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে আরো অনেক কথাই বলা যায়। সচেতন ব্যক্তিদের তা অজানাও নয়। এ অবস্থায় কি দাবি করা যায়, আমাদের জাতীয় শিক্ষা-ব্যবস্থায় সত্যিই ইসলাম-শিক্ষার ব্যবস্থা আছে? প্রশ্নটি আরেকটু স্পষ্ট করে করা হলে জবাব দিতে হয়তো কারোই অসুবিধা হবে না। আমাদের জাতীয় শিক্ষা-ব্যবস্থায় কি মুসলিম শিক্ষার্থীদের মুসলিম হওয়ার ও মুসলিম থাকার ব্যবস্থা আছে?
এই প্রশ্নের উত্তরেও যদি অস্পষ্টতা বোধ হয় তাহলে সেটাও কি আসলে ইসলামী শিক্ষার বিস্তৃতি সম্পর্কে অজ্ঞতাজনিতই হবে না?
যাই হোক, সমস্যা মোটামুটি পরিষ্কার। এখন উত্তরণের চেষ্টা কীভাবে হতে পারে সেই চিন্তা প্রয়োজন। আর এক্ষেত্রে ব্যক্তি থেকে সমাজ প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু করণীয় আছে।
আমাদের প্রত্যেককেই মুসলিম হিসেবে জীবন যাপনের জন্য যতটুকু শেখা দরকার তা শিখতে হবে এবং নিজেকে ইসলামের বিধান মোতাবেক চালানোর চেষ্টা করে যেতে হবে। তা আমরা যে পেশার বা যে বয়সেরই হই না কেন।
এরপর নিজের সন্তান-সন্ততি ও পরিবার-পরিজনের দ্বীন শিক্ষার উপায় অনুসন্ধান করতে হবে। সন্তানের পার্থিব শিক্ষার জন্য আমাদের অনেকেই কত উদ্বিগ্ন ও তৎপর। সেই তুলনায় তার দ্বীন ও ঈমান শিক্ষার বিষয়ে আমাদের উদ্যোগ-আয়োজন কতটুকু?
সামাজিকভাবেও আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের মসজিদগুলোতে শিশু ও বয়স্কদের দ্বীন শিক্ষার যে আয়োজন আছে তা মানসম্পন্ন ও জোরদার করার চেষ্টা করতে হবে। যেখানে নেই সেখানে এ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এর বাইরেও মহল্লায় মহল্লায় সর্বস্তরের মানুষের প্রয়োজনীয় দ্বীন শিক্ষার ছোট ছোট কেন্দ্র গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। এর পাঠ-ক্রম ও প্রয়োজনীয় বই-পুস্তক রচনায় আমাদের যোগ্য ও উদ্যমী আলিমদের এগিয়ে আসার পাশাপাশি এইসকল কেন্দ্রে শিক্ষকতা ও প্রশিক্ষণের জন্যেও প্রস্তুত হতে হবে একদল ত্যাগী, নিবেদিতপ্রাণ আলিমকে।
বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় অনেক ছোট ছোট মাদরাসা বা দ্বীনী প্রতিষ্ঠান আছে, সেগুলো মূলত আলিম হওয়ার লক্ষ্যে যে শিশুরা মাদরাসায় আসে তাদের জন্য। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে যদি স্কুলগামী শিশুদের জন্য একটি এবং নানা পেশার বয়স্ক মানুষের জন্য একটি- অন্তত এই দুইটি বিভাগ খোলা হয় এবং প্রতিষ্ঠানের মৌলিক বিভাগের মতো গুরুত্ব দিয়ে যোগ্য শিক্ষক ও প্রশিক্ষকের মাধ্যমে পরিচালিত করা হয় তাহলেও কিছু সুফল আশা করা যায়।
তবে একথা বলাই বাহুল্য যে, শুধু এই ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকাই যথেষ্ট নয়, জাতীয় শিক্ষা-ব্যবস্থা ও সমাজ-ব্যবস্থা থেকেও অধর্মের অপচ্ছায়া অপসারিত করবার জন্য বিস্তৃত দাওয়াতী কার্যক্রমও প্রয়োজন।
আসুন, নিজেও মুসলিম হই, সন্তান-সন্ততিকেও মুসলিম বানাই, সকলে হাতে হাত ধরে আল্লাহর সন্তুষ্টির দিকে এগিয়ে যাই। পাক কুরআনের বাণী-
وَ لَا تَمُوْتُنَّ اِلَّا وَ اَنْتُمْ مُّسْلِمُوْنَ.
তোমাদের মৃত্যু যেন এমন অবস্থায়ই আসে যে, তোমরা মুসলমান।