নুসরামণির কাণ্ড
ছোট্ট মেয়ে নুসরা১। বয়স পাঁচ কি ছয়। মিষ্টি চেহারা। ভারি চটপটে আর হরিণছানার মতো চঞ্চল। কৌতূহলে দুই চোখ ভরা। কথা বলে দ্রুত।
আব্বুর হাত ধরে পথ চলছে । কোথায় যাচ্ছে ও জানে না। শুধু জানে বেড়াতে যাচ্ছে।
দামেশ্ক। সিরিয়ার রাজধানী। দামেশকেরই একটি কাঁচা রাস্তা। চারদিকে ধু-ধু মরুভূমি। থেকে থেকে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের সারি। সামনে যে পাহাড়, তার ঢালুতে বসে আছে বিকালের শান্ত সূর্য। মার্বেলের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে এখানে এসে হঠাৎ যেন আটকে গেছে। নুসরা হরিণছানার মতো ছুটোছুটি করে পথ চলছে। পায়ে নরম বালু উড়িয়ে। খুব আনন্দ লাগছে ওর। হঠাৎ কী মনে করে থমকে দাঁড়াল। এরপর অনর্গল বলে চলল, ‘আব্বু! আমরা কোথায় যাচ্ছি? খালামণির বাড়ি?’
উত্তরের অপেক্ষা না করেই জুড়ে দিল আরেক কথা। “আচ্ছা আব্বু! সেদিন আদিলের আব্বু বলল, ‘আমীরুল মুমিনীন অসুস্থ, দেখতে যাবে।’ আমিরুল মুমিনীন কে?”
: তুমি ওর আব্বুকে জিজ্ঞেস করনি?
: নুসরা মাথা নেড়ে বলল, উঁ-হুঁ।
: তাঁর নাম উমর বিন আবদুল আযীয। খুব ন্যায়পরায়ণ খলীফা এবং অত্যন্ত ভালো মানুষ তিনি। পৃথিবীর সবচে ভালো মানুষ এবং সবদিক থেকে একমাত্র সফল শাসক ছিলেন আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এরপর তাঁর সাহাবীদের মধ্যে চার খলীফা। হযরত আবু বকর, হযরত উমর, হযরত উসমান গনী এবং হযরত আলী রা.। খলীফাদেরকে লোকে সম্মান করে বলে ‘আমীরুল মুমিনীন’। মুসলমানদের শাসক। সাহাবীদের পর পৃথিবীতে সবচে যিনি ভালো এবং সফল শাসক, তিনি হলেন আমাদের এই আমীরুল মুমিনীন উমর বিন আবদুল আযীয। প্রায় অর্ধেক পৃথিবীর খলীফা। প্রসিদ্ধ তাবেয়ী। আল্লাহর অনেক বড় অলী। জন্ম ৬১ হিজরী সালে। মিশরের হালওয়ান নামক এলাকায়। তাঁর বাবা আব্দুল আযীয সে এলাকার আমীর (আঞ্চলিক শাসক) ছিলেন। এছাড়া তাঁর পূর্বে চাচাত ভাই সুলাইমান, চাচা আব্দুল মালিক এবং দাদা মারওয়ান সবাই ছিলেন একেকজন প্রসিদ্ধ খলীফা। উমর বিন আব্দুল আযীয এখন রাজধানী দামেশ্কেই থাকেন। বুঝেছো নুসরামণি?
মাথা একদিকে কাত করে নুসরা বলে, ‘হাঁ-বুঝেছি।’
বাজারের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা গেল এক বৃদ্ধ লোক। খাঁচায় ভরে পাখি বিক্রি করছে। আব্বুর একটি আঙ্গুল নুসরার ছোট্ট কচি হাতের মুঠোয় চেপে ধরা। সেটা নাড়িয়ে ঝাঁকিয়ে আরেক হাতে ইশারা করে বলে উঠল, ‘আব্বু দেখো দেখো, কত্তো সুন্দর সুন্দর পাখি!’
সত্যিই রংবেরঙের বিচিত্র পাখি নিয়ে বসেছে লোকটি। এমন লোক সাধারণত উশকোখুশকো নোংরা ধরনের হয়ে থাকে। কিন্তু এ লোকটি অন্যরকম। গায়ে বেশ পরিপাটি জুব্বা। মাথায় পাগড়ি। দাড়ির আড়ালে হাসিভরা মুখ। কী অমায়িক চেহারা। নুসরার দাদার মতো দেখতে।
নুসরামণি আবদার জুড়ে দিল, ‘আব্বু একটা পাখি কিনে দাও না!’
: পাখি! পাখি দিয়ে কী করবে তুমি?
: কেন, খেলব, কথা শেখাব, আর...। খানিক ভেবে নুসরা আবার বলল, ‘জান আব্বু! আদিলদের পাখিটা না- কী সুন্দর টিঁ টিঁ, ট্যাঁ ট্যাঁ করে ডাকে। কী যে ভালো লাগে।’
: চাচা, দেখি আপনার তোতা পাখিটি।
: দেখতে হবে না, একেবারে পোষা পাখি।
সাথে সাথে তোতাটি খাঁচার ভেতর থেকে নাকি সুরে বলে উঠল, ‘এঁকেবাঁরে পোঁষা পাঁখি।’
নুসরামণি খুুশিতে লাফিয়ে উঠে বলল, ‘পোষাপাখি! কী মজা, কী মজা, পোষা পাখি! হি হি...।’
পাখিওয়ালা দাদু মুখে দুষ্টুমির হাসি ঝুলিয়ে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে আদুরে গলায় বলল, ‘শুধু পোষা-ই না, একেবারে শিক্ষিত পাখি। ওকে অযুর চার ফরয জিজ্ঞেস করেই দেখ না, দেখবে হড়হড় করে বলে দিচ্ছে-মুখ ধোয়া, হাত ধোয়া, মাথা মাসাহ করা এবং পা ধোয়া- বলে লোকটা হাসতে লাগল।
আব্বু বললেন, তাই বুঝি? তাহলে দেখি একটু পরীক্ষা করে; ‘এই তোতা! পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের নাম বল তো!’
তোতা পাখি তার নাকি সুরে টেনে টেনে বলল, ‘রাঁত শেষের নাঁমায ফঁজর, দুঁপুরের নাঁমায যোঁহর, বিঁকালের নাঁমায আঁছর, সঁন্ধ্যার নাঁমায মাঁগরিব আঁর রাঁতের নাঁমায এঁশা।’
আব্বু নুসরামণিকে সেই পাখি কিনে দিলেন। পাখিটাকে পেয়ে নুসরামণি কী খুুশি! খুশিতে তিড়িংবিড়িং করে দৌড়াতে লাগল।
বেলা তখন অনেকটাই গড়িয়ে গেছে। একটা বাড়ির সামনে এসে থামল তারা। সূর্যের লাল আভা সেই বাড়ির দেয়ালে এসে ঝিলমিল ঝিলমিল করছে। আব্বু সালাম দিয়ে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন। নুসরামণি বলল, ‘আচ্ছা আব্বু! এটা কার বাড়ি’ ?
: তুমি না আদিলের আব্বুর কাছে খলীফা উমর বিন আব্দুল আযীযের নাম শুনেছ!
: হাঁ-, শুনেছি তো -!
: এটা হল তাঁর বাড়ি ।
শুনে নুসরামণি অবাক হল। আব্বুর দিকে তাকায় একবার, আবার তাকায় বাড়ির দিকে। এটা আবার কেমন খলীফার বাড়ি! ইয়া বড় প্রাসাদ নেই, রাজকীয় ফটক নেই। নুসরামণি ভেতরে ঢুকে দেখল খেজুরপাতার দড়ি দিয়ে বানানো পুরনো একটি খাট। তার উপর শুয়ে আছে একজন লোক। মিষ্টি চেহারার মানুষ। খাটের সাথে যেন একেবারে সেঁটে রয়েছেন লোকটি। তাঁর শুয়ে থাকার মধ্যে ভীষণ অসুস্থ অসুস্থ ভাব। পোশাক-আশাক দেখে নুসরার মনে হল-এ হয়ত খলীফার কোনো চাকর-বাকর হবে। কিন্তু কী আশ্চর্য! বাড়ির অন্যান্য লোকদের সাথে আব্বুর কথাবার্তা শুনে নুসরামণি ভারি অবাক হল। ইনিই নাকি খলীফা উমর বিন আব্দুল আযীয! গায়ে রাজার পোশাক নেই, মাথায় মণি-মানিক্যের তাজ নেই। একেবারে সাধারণ একটা জামা পরে কেমন শুয়ে আছেন! ভেবে নুসরামণি দারুণ অবাক হল। আব্বুকে বলল,
: আব্বু, কেমন খলীফা! এখানে তো রাজা রাজা ভাব নেই। কেমন সাধারণ মানুষের মতোই বাড়ি।
আব্বু বুঝতে পারলেন, নুসরার খটকা কোন জায়গায়। তাই তিনি মিষ্টি করে বললেন, ‘নুসরামণি জানো, রাজা আর খলীফা এককথা না। খলীফারা দেশ চালায় আল্লাহর নিয়মমতো। আর রাজারা চালায় ইচ্ছেমতো । একারণে অধিকাংশ রাজারা না, বিভিন্নভাবে প্রজাদের ওপর যুলুম-অত্যাচার করে। টাকা-পয়সা ছিনিয়ে আনে। আর বড় বড় প্রাসাদ বানায়।
কিন্তু আমাদের খলীফা না, খু-ব ভালো। তিনি খলীফা হওয়ার আগে কেমন ছিলেন জান? রাজার মতো দামী দামী খেতেন, পরতেন। কিন্তু খলীফা হওয়ার পর একমুহূর্তে কী আশ্চর্য রকম পাল্টে গেলেন তিনি! সমস্ত বড়লোকি শিকেয় তুলে রাখলেন। অতিরিক্ত সম্পদ বাইতুল মালে (রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ) জমা দিয়ে দিলেন। এমনকি নিজের স্ত্রীর গলার হার পর্যন্ত কাছে রাখলেন না। তাঁর ন্যায়বিচার আর মহানুভবতা এত্তো বেশি যে, প্রজাদেরকে সামান্য কষ্টে রেখে নিজে ভালো খাবেন, ভালো পরবেন এটা তিনি একটুও পছন্দ করেন না। প্রজাদের কান্নায় তিনি কাঁদেন। তাদের হাসিতে তিনি হাসেন। তিনি সবার প্রিয় খলীফা।
হঠাৎ তোতা পাখিটি বলে উঠল, ‘হাঁ, পি্রঁয় খঁলিফা, ভাঁলো খঁলিফা।’
নুসরা হি হি করে হেসে উঠল। আদর করে ডালিমের কয়েকটি দানা তোতার মুখের কাছে ধরতেই খাঁচার ভেতর থেকে ঠুকরে ঠুকরে মুখে নিল। এরপর কোৎ কোৎ করে গিলে খেয়ে ফেলল। পাখিটা দেখতে ভারি সুন্দর। বড়শির মতো লাল ঠোঁটটি ছাড়া সারা গা সবুজ পালকে মোড়ানো। নুসরার মনে হল, ‘পাখিওয়ালা দাদু দুষ্টুমি করে তার ঠোঁট লাল রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে। আর গায়ে ঢেলে দিয়েছে সবুজ রং। তারপর কোন্ খুকুমণির মালা এনে যেন ছাপ লাগিয়ে দিয়েছে তোতার গলায়। তাইতে বুঝি তার গলায় দেখা যাচ্ছে, মালার মতো কালচে রং মাখানো।’ পাখিটাকে পেয়ে নুসরামণি কী খুুশি। তার আনন্দ যেন আর ধরে না।
খলীফার স্ত্রীকে তার ভাই বকুনি দিচ্ছে। ‘এই ফাতেমা! তোমাকে না গতকাল বলেছি, গায়ের ময়লা জামা পাল্টে খলীফাকে পরিষ্কার আরেকটি জামা পরিয়ে দিতে। এখনো পরাওনি দেখছি! ব্যাপারটা কী শুনি?’
খলীফার স্ত্রী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। এরপর অপরাধীর মতো ভেজা নরম গলায় বলল, মাফ করবেন ভাইয়া, খলীফার এই একটিমাত্র জামা ছাড়া আর কোনো জামা নেই।
পর্দার আড়ালে তার কথা শুনে সবাই চমকে উঠল। কী এক চাপা কষ্টে হাহাকার করে উঠল সবাই। যিনি এত্ত বড় বাদশা, খলীফা। যিনি সমস্ত প্রজার ক্ষুধা নিয়ে ভাবেন। কাপড়ের কষ্ট নিয়ে ভাবেন। তাঁরই মাত্র একটি জামা! কী আশ্চর্য!
কষ্ট ও আবেগে সবার চোখ পানিতে টলমল হয়ে উপচে পড়তে লাগল। কাঁদতে লাগল সবাই। নিজের সব কিছু প্রজাদের দান করতে করতে এখন তার এই অবস্থা! কে বলবে ইনিই এক কালের রাজকুমার! কে বলবে ইনিই প্রতাপশালী খলীফা, উমর বিন আব্দুল আযীয! যাকে দেখে সারা বিশে^র বড় বড় রাজা-বাদশারা পর্যন্ত ভয়ে থরথরিয়ে কাঁপে। নুসরার ছোট্ট মন খলীফার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় ভরে উঠল।
যাওয়ার পথে নুসরামণি কেন জানি আশ্চর্য রকমের চুপচাপ। আব্বুর হাত ধরে হাঁটছে। দৌড়ায় না, হরিণছানার মতো তিড়িংবিড়িং করে ছুটোছুটি করে না। হঠাৎ আব্বুকে বলল,
: আব্বু!
: জী নুসরামণি, কিছু বলবে?
: খলীফার বাড়িতে এক আপুমণি বলল, খাঁচায় পাখিরা অনেক কষ্ট পায়। সত্যিই কষ্ট পায় আব্বু?
আব্বু হঠাৎ চমকে ওঠেন নুসরামণির কথা শুনে। এরপর হাসি হাসি মুখ করে বলেন, তোমার আপুমণি ঠিকই বলেছেন। খাঁচায় পাখিদের অনে-ক কষ্ট হয়। স্বাধীনভাবে উড়তে পারে না, যেখানে ইচ্ছা যেতে পারে না, খেতে পারে না। সারাদিন শুধু ছটফট করে।
নুসরামণি নরম গলায় বলল, ‘পাখিটাকে যদি ছেড়ে দেই তাহলে অনেক খুশি হবে, না?’
: হাঁ, অনে-ক খুশি হবে। তোমার জন্যে প্রাণ খুলে দুআ করবে।
: তাহলে পাখিটাকে ছেড়ে দেই, আর বলে দেই, খলীফার সুস্থতার জন্য যেন দুআ করে।
নুসরামণির কথা শুনে আব্বু খু-ব খুশি হলেন। বললেন, তুমি আবার পরে কাঁদবে না তো?
নুসরামণি তার ছোট্ট ঠোঁট দুটি গোল করে মাথা নেড়ে নেড়ে বলল, ‘ন্-না, কাঁদব না। একটুও কাঁদব না। হাসব। বলে, খাঁচার মুখটা খুট করে খুলে দিল। টিয়া পাখিটি বলল, ‘ধঁন্যবাঁদ নুঁসরামঁণি, তুমি খুঁ-ব ভাঁলো। যাঁ-ই যাঁ-ই, খোঁদা হাঁফে-য।’
বলে, সাথে সাথে ফুড়–ত করে উড়ে গেল শূন্যে। ‘কীঁ মঁজা টিঁ টিঁ, কীঁ মজা টিঁ টিঁ’- বলতে বলতে শূন্যে ঢেউ দিয়ে মিলিয়ে গেল দিগন্তে।
নুসরামণি খুশিতে হি হি করে হেসে উঠল। হাতে তার মুখখোলা খাঁচা। ভেতরে সেই পাখিটি নেই। হ
তথ্যসূত্র : সিয়ারু আলামিন নুবালা, যাহাবী; তারিখুল খুলাফা, সুয়ূতী; সীরাতে উমর ইবনে আবদুল আযীয, আবু মুহাম্মাদ আলমিসরী; উমর ইবনে আবদুল আজীজ রাহ., ইবনুল জাওযী