সকল মুসলিমের প্রতি উদাত্ত আহ্বান - ‘ফেসবুক বর্জন করে পশ্চিমাদের সমুচিত জবাব দিন’
হযরত মাওলানা মুফতি তকী উছমানী
আপনাদের সামনে সূরা হুমাযা তেলাওয়াত করেছি। প্রথমে এর তরজমা করছি। এরপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা বলেন, (তরজমা) ‘দুর্ভোগ প্রত্যেকের, যে পশ্চাতে ও সম্মুখে লোকের নিন্দা করে। যে অর্থ জমায় ও তা বার বার গণনা করে। সে ধারণা করে যে, তার অর্থ তাকে অমর করবে। কখনো না। সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে ‘হুতামায়’। তুমি কি জান হুতামা কী? তা আল্লাহর প্রজ্জ্বলিত হুতাশন, যা হৃদয়কে গ্রাস করবে। নিশ্চয়ই তা পরিবেষ্টন করে রাখবে তাদেরকে। দীর্ঘায়িত স্তম্ভসমূহে।’
এই আয়াতগুলি মক্কার মুশরিকদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। সূরাটি নাযিল হওয়ার প্রেক্ষাপট হল, নবীয়ে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মুশরিকদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিলেন তখন তারা বিভিন্নভাবে তাঁকে কষ্ট দিতে আরম্ভ করল। কটুকথা, নিন্দা-ভৎর্সনা, কুৎসা-রটনা, এমনকি তাঁর নাম মোবারক বিকৃত করে বিদ্বেষ চরিতার্থ করার চেষ্টা করত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র নাম ‘মুহাম্মাদ’। যার অর্থ সর্ব-প্রশংসিত। খালিকের নিকটেও প্রশংসিত, মাখলুকের নিকটেও প্রশংসিত। এই মহিমান্বিত নাম তাঁকে আল্লাহ তাআলাই দান করেছেন। তো মক্কার ঐ হতভাগারা তাঁর নাম বিকৃত করে বলত ‘মুযাম্মাম’। যা ‘মুহাম্মাদে’র সম্পূর্ণ বিপরীত। নাউযুবিল্লাহ! মূর্খ মুশরিকগোষ্ঠী যখন তাঁকে কটাক্ষ করে, তাঁর প্রতি অভিশম্পাৎ করে মনের জ্বালা জুড়ানোর চেষ্টা করত তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, দেখ, ঐসব মুর্খের লানত-অভিশম্পাত থেকে আল্লাহ কীভাবে আমাকে রক্ষা করেছেন। তারা অভিশম্পাৎ করতে গিয়ে বলে, ‘মুযাম্মামের উপর অভিশাপ!’ অথচ আমি তো ‘মুহাম্মাদ’। আল্লাহ আমাকে সর্বপ্রশংসিত করেছেন। অতএব তাদের লানত-অভিশম্পাৎ আমাকে স্পর্শও করে না। পক্ষান্তরে তারা নিজেরাই হচ্ছে নিন্দিত ও ধিকৃত। কারণ তারা শিরকের মতো ভয়াবহ অপকর্মে লিপ্ত। ফলে তাদের সকল অভিশাপ তাদেরই উপর পতিত হয়।
এইসব বর্বর মুশরিকদের সম্পর্কেই সূরাটি নাযিল হয়েছে। আল্লাহ তাআলা অত্যন্ত কঠিন ভাষায় তাদের শেষ পরিণাম জানিয়ে দিয়েছেন।
মক্কার মুশরিকরা এই অসভ্য আচরণ কেন করত?
তারা চাইত এভাবে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নীচু করবে এবং নিজেদেরকে উচু করবে।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন পৌত্তলিকতার অসারতা ঘোষণা করলেন এবং এর যুক্তিহীনতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন তখন তারা জোনো জবাব খুঁজে পেল না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে তাওহীদের দিকে আহ্বান করলেন। পৌত্তলিকা ও মুর্তিপূজার মতো জঘন্য কুসংস্কার ত্যাগ করতে বললেন, যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই মূর্খতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুললেন যে, তোমরা নিজের হাতে মুর্তি বানাও, এরপর তার উপাসনা কর, আর মনে কর যে, এই মুর্তিই তোমাদের রিযক দেয়, আওলাদ দেয়, হাজত পুরা করে, মুসীবত থেকে নাজাত দেয়-এর চেয়ে বড় মুর্খতা আর কী হতে পারে? মক্কার মুশরিকদের কাছে এই প্রশ্নের কোনো জবাব ছিল না। ফলে যুক্তি-প্রমাণে পরাস্ত হয়ে তারা নিন্দা-সমালোচনা এবং কটুকথা ও গালমন্দের দ্বারা জয়ী হওয়ার চেষ্টা করতে আরম্ভ করল। আর এটা শুধু সে যুগের কথা নয়, সর্বযুগের বাতিলপন্থী এই পথেই বিজয়ী হওয়ার চেষ্টা করে। দলীল-প্রমাণে পেরে না উঠলে গালিগালাজের আশ্রয় নেয়।
আজ যারা সভ্যতা ও ভদ্রতার দাবিদার তারাও নির্লজ্জভাবে এই পন্থা অবলম্বন করে। ফেসবুকের ন্যাক্কারজনক ঘটনাটি এর আরেকটি দৃষ্টান্ত। এটা পাশ্চাত্যের তথাকথিত সভ্য-সমপ্রদায়ের চরম দীনতা ও হীনতার প্রমাণ।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র জীবন ও আদর্শকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা তাদের নেই। ইসলামের অব্যাহত জয়যাত্রাকে রুখতে পারে এমন কোনো নীতি ও আদর্শ থেকেও তারা রিক্তহস্ত। ফলে তারা ঐ পথই বেছে নিয়েছে, যা জাহেলী যুগের পৌত্তলিকতা-নিমজ্জিত অজ্ঞ লোকেরা বেছে নিয়েছিল। চিন্তা করে দেখুন, গোটা বিশ্বে যারা সভ্যতা ফেরি করে এবং মানবাধিকারের আপ্তবাক্য প্রচার করে, কী অসভ্য ও বর্বর এদের আচরণ!
আমি মনে করি, এটা মুসলমানদের গায়রত ও আত্মমর্যাদার প্রতি চ্যালেঞ্জ! শত্রুরা দেখতে চায়, খাতামুন্নাবিয়ীন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে মুসলমানদের গায়রত কতটুকু। নবীর জন্য জান-মাল কোরবান করার চেতনা এখনো মুসলমানদের আছে, না বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
আমি তো মনে করি, একজন সামান্য ঈমানদার, যার অন্তরে যাররা পরিমাণ ঈমান আছে সেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মর্যাদার প্রশ্নে আপোষ করতে পারে না। প্রয়োজনে প্রাণ বিসর্জন দিতে পারে, কিন্তু নবীর মর্যাদায় হস্তক্ষেপ বরদাশত করতে পারে না।
দেখুন, হাদীস শরীফে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিষ্কার ঘোষণা করেছেন, তোমরা কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না আমি তোমাদের নিকট তোমাদের পিতা-মাতার চেয়ে, সন্তান-সন্ততির চেয়ে, সকল মানুষের চেয়ে, এমনকি নিজের প্রাণের চেয়েও অধিক প্রিয় না হই।’
হাদীসের কিতাবে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এই হাদীস বললেন তখন হযরত উমর ফারূক রা. আরজ করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, আপনি আমার নিকট আমার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি এবং সকল আত্মীয়-স্বজনের চেয়ে প্রিয়, কিন্তু আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় কি না-এ বিষয়ে আমার মনে কিছুটা দ্বিধা আছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন উমর ফারূকের বুকে হাত রাখলেন। তাঁর মোবারক হাতের স্পর্শে উমরে ফারূকের মাঝে যেন বিপ্লব ঘটে গেল। তিনি বলে উঠলেন, ‘আল্লাহর রাসূল! আপনি আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়!’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এখন (তুমি পূর্ণ হলে) হে ওমর!’
সাহাবায়ে কেরামের জীবনে নবীপ্রেমের অসংখ্য ঘটনা বিদ্যমান রয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য তাঁরা জান-মাল সবকিছু কোরবান করেছেন। প্রেম ও ভালবাসার এমন ইতিহাস তারা রচনা করেছেন যার নযির পৃথিবীর অন্য কোনো জাতি দেখাতে পারেনি। বলাবাহুল্য যে, একজন খাঁটি ঈমানদারের শান এমনই হওয়া উচিত।
আমি শুনেছি, পাকিস্তানী কতৃপক্ষ ঐ সাইট বন্ধ করে দিয়েছে। জানি না, কতদিন পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। (কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, এ লেখাটি তৈরি হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার ঐ সাইট নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে বলে আমরা শুনিনি! তদ্রূপ এদেশের মানবাধিকারের সোল এজেন্টরাও সম্পূর্ণ নিশ্চুপ। এদের গোত্র-পরিচয় সম্পর্কে এরপরও কি কোনো দ্বিধা থাকে?) আমি মুসলমানদের উদাত্ত আহ্বান জানাই, আপনারা প্রত্যেকে ঐ সাইট বয়কট করুন। পশ্চিমারা হচ্ছে অর্থের দাস। অর্থের ক্ষতি হলে তাদের প্রাণ বেরিয়ে যায়। তাই পৃথিবীর কোটি কোটি মুসলমান যদি ঐ সাইট বয়কট করে তাহলেই দেখবেন, ওদের অবস্থা কী দাঁড়ায়। আমি শুনেছি, ফেসবুকের মাধ্যমে তরুণ-তরুণীরা একে অপরের সাথে সম্পর্ক করে। আমি যুবক ভাইদের বলব, এটা বর্জন করা মোটেই কঠিন নয়। আমি আপনাদেরকে জান দিতে বলিনি, মাল দিতে বলিনি, শুধু বলেছি, নবীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে আপনার সামান্য একটি চাহিদাকে কোরবানী দিন। এটুকুও যদি করতে পারেন তাহলে ইনশাআল্লাহ নবীর আশিকদের কাতারে আপনার স্থান হবে।
জেনে রাখুন, পেয়ারা নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বয়ং আল্লাহ যে মর্যাদা দান করেছেন, এরপর আমাদের কিছু করা বা না-করায় তাঁর কিছুই যায় আসে না।
আল্লাহ তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, (তরজমা) আমি আপনার নামকে সমুন্নত করেছি। (সূরা আলাম নাশরাহ : ৪)
গোটা দুনিয়ায়, মাশরিক থেকে মাগরিব পর্যন্ত, নবীর নাম মিনারে মিনারে ঘোষিত হয়। দৈনিক পাঁচ বার মুয়াযযিন ঘোষণা করে, আশহাদু আননা মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ! পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রিসালাতের সাক্ষ্য ঘোষিত হতে থাকে। দিনে রাতে একটি মুহূর্তও এমন যায় না, যখন পৃথিবীর কোথাও না কোথাও তাঁর নাম ঘোষিত হয় না। আর শুধু কি মানুষ, কুল মাখলুক তাঁর জন্য দোয়া করে, ফেরেশতারা তাঁর প্রতি দরূদ পড়ে, এমনকি স্বয়ং আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন যে, তিনি নবীর প্রতি রহমত বর্ষণ করেন। তো আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যাঁকে সম্মান দান করেছেন, যাঁর নাম ও মহিমাকে সমুন্নত করেছেন, আমাদের প্রশংসা-অপ্রশংসায় তাঁর কী আসে যায়? এ তো আমাদের সৌভাগ্য, তাঁর নাম নিতে পারা, তাঁর আশিকানের কাতারে শামিল হতে পারা এবং তাঁর জন্য কোরবানী পেশ করতে পারা। এই পরম সৌভাগ্য যেন আল্লাহ আমাদের সবাইকে দান করেন। আমীন।