হায় এ কী দেখছি! আমরা কি ইনসানের পরিচয়ও হারিয়ে ফেলেছি?
ফেতনার সময় চোখ-কান ও যবানের হেফাযতে সমধিক যত্নবান হওয়া- এটাই রক্ষাকবচ নিজেকে ভুল সিদ্ধান্ত ও ভুল পরিণতি থেকে রক্ষার এবং এটাই উপায় অন্যদেরকে নিজের সম্ভাব্য কষ্টদান থেকে বাঁচিয়ে স্বস্তিতে রাখার।
দুর্যোগের মুহূর্তে আমাদের সামনে ছিল এবং রয়েছে আমাদের মুরব্বিদের দিকনির্দেশনা। সংকটময় ঘোলাটে পরিস্থিতিতে আমাদের কী করণীয় সে প্রসঙ্গে তাঁরা বলেছেন, ‘তোমাদের করণীয় চারটি। এক. আল্লাহর কাছে সার্বক্ষণিক দুআ ও রোনাযারি করা। যেন আল্লাহ এ হালত দূর করে দেন। দুই. নিজেকে শোধরানো। কারণ উম্মতের যা কিছু ‘বিগড়ে’ গেছে তার মধ্যে আমি নিজেও। তো নিজের ইসলাহের মাধ্যমে শুরু করি সংশোধন ও পরিবর্তনের ধারা...। তিন. নিজেকে যোগ্য করে তুলি। কেননা যেখানে যত বিশৃঙ্খলা ও অনিয়ম, সবই ‘না-আহল’দের অন্যায় অধিকার দাবি ও অযাচিত হস্তক্ষেপের ফল। চার. নিজের কর্মক্ষেত্র ত্যাগ না করি। ছাত্র হই কিংবা উস্তায- আমি যে পরিম-লে আছি তার যে স্বাভাবিক নেযাম ও যিম্মাদারি সেটা প্রভাবিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন সব তৎপরতা ও কর্মকা- থেকে নিজেকে দূরে রাখি। এতে করে নিজেদের আসল মাকছাদ ও মূল মাশগালাটা রক্ষা পেয়ে যাবে বিপর্যয়কবলিত হওয়া থেকে...।’
এই নসীহত স্মরণ রেখেই সবসময় এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করেছি ‘এদিক ওদিক তাকানো’। হাঁ, নামাযে যেমন মুসল্লি তার খুশূখুযূ ধরে রাখে, তালিবে ইলমের কাছেও তার পড়াশোনায় সেইভাবে ধ্যানমগ্নতা কাম্য।
সময়ের নির্দয়তা সামনে আনছে বহু করুণ চিত্র
এ শতাব্দীর শুরু থেকে বিশেষত এর শেষ অর্ধদশক জুড়ে মুসলিম উম্মাহর যে ক্রান্তিকাল চলছে এবং বিশ্বব্যাপী যে অস্থিরতা বিরাজ করছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে তালিবানে উলূমে নবুওতের কী করণীয়, তাদের কী ভূমিকা হওয়া উচিত এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে- তারই বিবরণ দিতে গিয়ে উপরের কথাগুলো বলেছিলেন আমাদের মুহতারাম আমীনুত তা‘লীম ছাহেব হুযুর। তাঁর এ নির্দেশনাই মেনে চলার চেষ্টা করছিলাম বর্তমানের অস্থির দিনগুলোতে, যতদূর সম্ভব।
কিন্তু সময় ও পরিস্থিতির এত দ্রুত এত পরিবর্তন ঘটে গেল এবং সময়ের বাস্তবতা এমন মর্মান্তিক ঘটনা সামনে নিয়ে এল, যা ‘দিল-কলিজা দিয়ে তৈরি’ যে কোনো মানুষকে নাড়া দিতে বাধ্য।
১ ডিসেম্বরের দুঃসহ দুপুরে কী ঘটনা ঘটেছে ইজতিমা প্রাঙ্গণে এবং কত বেদনাদায়কভাবে ঘটেছে, তার বিবরণ শোনার আগে আমরা তা আঁচ করলাম আমাদের মুহতারাম আসাতিযা কেরামের বেদনাক্লিষ্ট চেহারা ও ব্যথাতুর কণ্ঠস্বর থেকে...। বিকেলে তামরীনের কাজগুলো মুদীর ছাহেবের হাতে অর্পণ করতে গিয়ে দেখলাম, বসে আছেন বিমর্ষ, বিষণœ, মলিন...। ইশারায় বললেন ওগুলো রেখে যেতে। এ দিন ছিল মারকাযের প্রধান দফতর মিরপুরে মাসিক দ্বীনী মাহফিল। কিন্তু আজ আর তিনি গেলেন না উপরে, কথা রাখতে। তাঁর ভারাক্রান্ত হৃদয়ের বার্তাগুলো বুঝে নিতে কষ্ট হল না তার নীরব, নির্বিকার অভিব্যক্তি থেকে। হাঁ, ঘটনার আকস্মিকতায় যেমন তিনি হতবিহ্বল, তেমনি এর ভয়াবহতায় উৎকণ্ঠিত এবং তেমনি উদ্বিগ্ন এর পরিণাম চিন্তা করে। এ কী ঘটনা ঘটে গেল! কীভাবে ঘটতে পারল...! জানা নেই, কালের দুর্বিপাক আরো কী দৃশ্য সামনে নিয়ে আসে...!
সেদিন তো আর ‘শাপলা চত্বরে’ ছিলাম না!
সত্যি! এ এমন এক ঘটনা, যার কল্পনাও করতে পারেনি কেউ। অকল্পনীয় হওয়াতেই ব্যথাটা বেশি। আমরা তো আর সেদিন ‘শাপলা চত্বরে’ ছিলাম না! আমাদের ন্যায়সঙ্গত বিরোধটাও এবার খোদাদ্রোহী কোনো গোষ্ঠীর সাথে নয়। আমরা তো ছিলাম ইজতিমা ময়দানে। সেখানে যারা যায় সুন্নতি লেবাসে সবাই মুমিন-মুসলমান এবং দ্বীনী দাওয়াতের কর্মী ও খাদেম। তাহলে কীভাবে ঘটতে পারে সেখানে এমন অতর্কিত অমানুষিক হামলা?! ‘বন্ধুর’ বেশে এসে শত্রুতা ও অরাজকতা করে যাওয়ার এই নযীর ইতিহাসে হয়তবা খুব সামান্য। ‘মুসলিমের হাতে অপর মুসলমান নিরাপদ’- এই নববী বাণীর চর্চা তাহলে আর কোথায় দেখাব আমরা...!
‘উম্মাহর ঐক্য : পথ ও পন্থা’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ৬ ও ২২২-২২৩) পড়েছিলাম মনে আছে। সেখানে পারস্পরিক বিরোধের ক্ষেত্রে করণীয়র তালিকায় এই দিকটিকে খুব গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘কারো সঙ্গে কোনো বিষয়ে মতভেদ হলে ঈমানী ভ্রাতৃত্বের দাবি রক্ষায় আগের চেয়ে অধিক সতর্ক হই। কারণ এ দাবি রক্ষার এটিই প্রকৃত সময়।’ অর্থাৎ ঈমান ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের যা দাবি, তা রক্ষার সর্বোত্তম ও সবচে’ দরকারি ক্ষেত্র সেটাই, যখন ভাইয়ে ভাইয়ে কোনো বিষয়ে দ্বিমত বা দ্বন্দ্ব-বিরোধ সৃষ্টি হয়। একজন মুসলিম হিসেবে যে সম্মান ও নিরাপত্তা এবং যে বন্ধুত্ব ও সম্প্রীতি আমার কাছে তার প্রাপ্য- তা যেন দিতে কুণ্ঠা না করি। মতপার্থক্যের মাঝেও যেন ঐক্য ও বন্ধুত্বের অনুশীলন করি। শুধু মুসলিম হিসেবে; বরং একজন মানুষ হিসেবে তার যে হকগুলো বর্তায় এইটুকু কষ্ট স্বীকার যেন করি। আমীনুত তা‘লীম ছাহেব হুযূরের ভাষায়- বর্তমানের এই সঙ্কট ও গোলযোগের মুহূর্তে বিভিন্ন ‘জোড়’, বিভিন্ন মজমায়, যা তিনি বারবার বলে এসেছেন- ‘তৃতীয় অপরাধটি না করি’। হকের ভিত্তিতে আমরা এক হয়ে যাই। যদি না হই তাহলে তৃতীয় অপরাধ কমপক্ষে আমরা কেউ না করি। দুই ভাগ হয়ে যাওয়ার পরও উভয় দলই তো তাবলীগ। কেউ সঠিক রাস্তায় আছে আর কেউ গলত রাস্তায় গিয়েও দাবি করছে- তাদেরটা মূল ধারার তাবলীগ! সে যাইহোক, কিন্তু সবাই এই কথা স্বীকার করে যে, তাবলীগের একটা মূলনীতি হল ইকরামুল মুসলিমীন। এই মূলনীতিটা আমরা রক্ষা করি। বি. বাড়িয়ায় যা ঘটল, এটা কি ইকরামুল মুসলিমীন? কাকরাইলে যা ঘটছে সেটা কি ইকরামুল মুসলিমীন? এই মূলনীতিটা ধরে রাখি। এই মূলনীতি লঙ্ঘনের অপরাধ না করি। তাবলীগের ঐতিহ্য ধরে রাখি...।
মানা হল না দরদী বন্ধুর উপদেশ!
কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! তৃতীয় অপরাধটি যথারীতি আবারো সংঘটিত হল। যুগে যুগে এভাবেই বুঝি উপেক্ষা করেছে মানুষ الناصح الأمين (বিশ্বস্ত ও দরদী উপদেশদাতা)দের অনুরোধ ও সদুপদেশ এবং নসীহত ও পয়গাম! বি. বাড়িয়া ও কাকরাইলের পর এবার ইজতিমা ময়দানে আরো বড় আকারে। আরো ভয়াবহভাবে লঙ্ঘিত হল ইকরামুল মুসলিমীনের এই নীতিটি। যে ইজতিমা প্রাঙ্গণে এসে শতধা বিভক্ত জাতির সব শ্রেণি-পেশার মানুষ দলমত নির্বিশেষে এসে জমায়েত হতো, যে ‘ইজতিমা’কে ভাবা হচ্ছিল বিভক্ত জাতির ঐক্যছাউনী ও একতার মঞ্চ..., সেখানেই আজ চরমভাবে মাথাচারা দিয়ে উঠল নিজেদের ভিতরকার মতভিন্নতাজনিত কলহ এবং কলহের জেরে ঈমানী দাওয়াতের দাবিদারদেরই হাতে অপর মুমিন-মুসলমান ভাইদের রক্ত ঝরল!...
আরো অবাক হওয়ার বিষয়, ধারণা করা হয়েছিল, এই রক্তপাতের জন্য তারা হয়ত বা অনুতপ্ত... তাৎক্ষণিক ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে একটা ঘটনা ঘটে গেছে, কিন্তু পরে তারা বুঝতে পেরেছে, কতটা অমানবিক হয়েছে এই কর্ম। অন্তত এতে করে দ্বীনী কাজের সুনাম যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, দ্বীনের দাঈদের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে সেই কথা চিন্তা করে তারা লজ্জিত...।
দুঃখ পেলাম এবং হতাশ হলাম যখন জানতে পারলাম এই ঘটনায় তারা বরং উল্লসিত। নিজেদের ভাবছেন তারা রণাঙ্গণজয়ী বীরদের মতোই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন! মানবতা, ইনসানিয়াত তাহলে আর কোথায় কাদের কাছে আশ্রয় নিতে যাবে- তাকে ধারণের জন্য, চর্চার জন্য, বিতরণের জন্য এবং তার সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য?! কাদেরকে সে ভাববে তার রক্ষক, প্রচারক, শিক্ষক এবং অভিভাবক...?! যে যে মতেরই হই না কেন, যে পক্ষেই নিজেকে রাখি না কেন এই জিজ্ঞাসাটুকুর উত্তর আমরা মনে মনে খুঁজি...। বিবেক নামের একটি সম্পদ তো আল্লাহর রহমতে এখনো আমরা সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলিনি!...
كُلّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ، دَمُهُ، وَمَالُهُ، وَعِرْضُهُ.
প্রত্যেক মুসলিমের কাছে অপর মুসলিমের রক্ত, সম্পদ ও সম্ভ্রম সুরক্ষিত। এগুলোর ক্ষতিসাধন নিষিদ্ধ। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৬৪
নবীয়ে রহমতের এই দ্ব্যর্থহীন ঘোষণাটি আমরা আবার স্মরণ করি।
কেন উপেক্ষিত হল ইসলামের শাশ্বত শিক্ষা?
যতভাবে চিন্তা করি, কিছুতেই ভেবে পাই না- কী ব্যাখ্যা এই ঘটনার! কেন এমন হল? কোথায় খুঁত ছিল? এই বিশাল মজমা এত দীর্ঘ সময় ঐক্যবদ্ধ থাকার পর কেন হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়ল? একে অপরকে গালমন্দ করা, মুসলিম জামাতের সংহতি নষ্ট করা এবং আলিমদের প্রতি বিদ্বেষ ও আস্থাহীনতা- এসবের সঙ্গে এখন যোগ হল মুসলমানদের রক্তকে হালাল মনে করার অপরাধ। চিন্তা করা যায়, কী ভয়ানক! কী সাংঘাতিক!...
তালীমের হালকায় কিংবা বয়ানের মজমায় এ হাদীস কি তারা কখনো পড়েননি বা শোনেননি-
سِبَابُ المُسْلِمِ فُسُوقٌ، وَقِتَالُهُ كُفْرٌ
মুসলমানকে গালি দেওয়া ফাসেকি। তার সঙ্গে লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়া কুফুরি। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৮
না শোনার তো কোনো কারণ নেই। তাহলে ১ ডিসেম্বর দুপুরে ইজতিমা ময়দানে যে দৃশ্যের অবতারণা হল, যে লোমহর্ষক ঘটনা ঘটানো হল- এটা কীভাবে হতে পারল? তারপর কীভাবে একে বৈধতা দেয়া হল এবং এর সাথে জড়িতরা তুমুল বাহবা পেল?!
হাদীসের ঐ শিক্ষার সঙ্গে তাদের এ আচরণের কি কোনোই বিরোধ নেই? নাকি হাদীসের পাঠ শুধু দাওয়াতী কাজে ব্যবহারের জন্য; জীবনের বাস্তবতায় এবং তার প্রয়োগের সবচে’ দরকারি ক্ষেত্রেও তার উপেক্ষা ও লংঘনে কোনো দোষ নেই?!
নিজেদের মধ্যকার বিরোধ বিদ্বেষের রূপ নেয়ার পর একসময় এমন নিদারুণ পরিণতির দিকেও গড়াবে- ভাবা যায়নি। একে শুধু দুঃখজনক কিংবা মর্মান্তিক বলে শেষ করে দেয়ার উপায় নেই। কোনো মুসলমান ঈমান ও আখলাকের পরিবেশে দীর্ঘ সময় কাটানোর পরও তার এমন জিঘাংসু আচরণ কল্পনা করা যায়? কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে তাই। তাহলে কীসের ঘাটতি ছিল? যে কারণে ইকরামুল মুসলিমীনের নীতিটি খুব সহজেই তারা বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হয়ে গেল- সেই ইজতিমা প্রঙ্গণে, যেখানে জড়ো হয়ে যুগ যুগ ধরে তারা লক্ষ লক্ষ জনতাকে শুনিয়েছে- মুসলিমের সম্মান ও সম্ভ্রম রক্ষার মহান নীতিটির কথা! বিবদমান দুটো পক্ষই মুমিন-মুসলমান। তারা একে অপরের ভাই। যত বিতর্কই হোক- ভাই ভাইকে বুঝতে পারে ত্যাগ করতে পারে না। ত্যাগ করতে পারে আঘাত করতে পারে না। আঘাতও করতে পারে, যুক্তির ভাষায়, হাত তুলে বা হাতিয়ার উঁচিয়ে নয়...। হায়, যারা এতদিন নিজেদের পরিচয় দিয়েছে সত্য-ন্যায়ের দাওয়াতের পতাকাবাহীরূপে আজ তারাই খুলে দিল অন্যায়ের দ্বার! জাতির আশার শেষ ভরসাস্থল যে ওলামায়ে কেরাম। তাদের অপদস্থ ও হতাহত করে এই লাগামহীন অংশটি কী প্রমাণ করল? আলিম সমাজ তাদের কাছে আর মোটেই মান্যবর নন। অন্যকথায়, যারা তাদের মতকে মেনে নিয়ে তাদের প্লাটফর্মে গিয়ে না দাঁড়াবে তারাই হবে টার্গেট! হোক সে আলিম কিংবা আরো কিছু! এবং যত যুক্তি আর কুরআন-সুন্নাহর রেফারেন্সই থাকুক না কেন তার কথায়; তাদের মতের পরিপন্থী হওয়ায় তা হবে প্রত্যাখ্যাত এবং পরিণামে তাদের পিঠকেও রাখতে হবে প্রস্তুত!...
একেই বলে অন্ধ অনুকরণ এবং অন্যায় পক্ষপাত। ইসলামে যা সম্পূর্ণ হারাম।
আজ যারা নিরীহ মানুষের রক্ত ডিঙ্গিয়ে ময়দানের দখল নিতে লোমহর্ষক ঘটনার জন্ম দিল, তারা প্রমাণ করে গেল, এত দিনের চিল্লাকাশি, এতদিনের বয়ান ও নসীহত এবং গাশত ও দাওয়াতের মেহনত... সব কিছুর প্রভাব শুধু বদলাতে পেরেছে তাদের বাহিরকে। ভিতর রয়ে গেছে আগের মতোই। এ ঘটনায় প্রমাণিত হয়ে গেল, দাওয়াতের মেহনতের ব্যাপকতার পাশাপাশি তা‘লীম তথা দ্বীনী ইলমের পাঠ গ্রহণ এবং আল্লাহওয়ালাদের সোহবত অবলম্বন ছিল কত বেশি জরুরি! আসলে দাওয়াতের এই মেহনতটি হল শুদ্ধ তলব পয়দা করার ডাক, আর তা‘লীম হল সেই ডাকে সাড়া দিয়ে নিজেকে শুদ্ধ মানুষে পরিণত করার অনুশীলনের নাম। নিয়মিত পাঠগ্রহণের মাধ্যমে অর্জিত পূর্ণাঙ্গ ও পরিপক্ক জ্ঞান এবং আল্লাহওয়ালাদের সোহবতের মাধ্যমে তার বাস্তব চর্চা ও অনুশীলন ছাড়া শুধু কিছু মা‘লুমতি ও খণ্ডিত জ্ঞান দূর করতে পারে না অজ্ঞতার জমাট অন্ধকার। আমাদের এই সাথীরা যদি সত্যিকার অর্থেই ধরে রাখতেন তাবলীগ জামাতের সেই ঐতিহ্যটি, যার কথা তারা অহর্নিশ উচ্চারণ করে থাকেন- ‘ফাযায়েলের ইলম শিখব তালীমের হালকায়, আর মাসায়েলের ইলম শিখব আলেমদের কাছে’। যদি তারা অন্যসব মেহনতের পাশাপাশি আলেমদের কাছ থেকে জরুরিয়াতে দ্বীন তথা দ্বীন ও ঈমানের এবং আহকাম ও বিধিবিধানের অপরিহার্য বিষয়গুলো পর্যায়ক্রমে শিখে নেয়ার চেষ্টা করতেন এবং তা নিজের যিন্দেগীতে বাস্তবায়নের মেযাজ পয়দা করতেন তাহলে (আল্লাহ ভালো জানেন) হয়ত বা আজ এই সাথীদের ফিকির ও মেযাজ এবং স্বভাব ও চিন্তাচেতনা অন্যরকম হতো।
‘অন্যরা যেখানে শেষ করেছে এরা শুরুই করল সেখান থেকে!’
এখন এ ভাইদের জন্য শুধু এ দুআই করা যায়, ‘আল্লাহ ইসলাহ করে দেন’। আর সামনের দিনগুলোর জন্য উদ্যোগ নেয়া যায়, যেন আর এমন না হয়। কিন্তু যদি তারা নিজেরাও নিজেদের সংশোধনে কিছুমাত্র মনোযোগ না দেন সেক্ষেত্রে ভয় হয়...। এই ভয় আর আশঙ্কার কথাটাই বলছিলেন উস্তাযে মুহতারাম মাওলানা ইয়াহইয়া ছাহেব, মারকাযের মাসিক দ্বীনী মাহফিলে তার আলোচনায়। যে সন্ধ্যায় তিনি বক্তব্য রাখছেন সেদিন দুপুরেই ঘটেছে ঐ লোমহর্ষক ঘটনা। এ প্রসঙ্গের ভিতরে যেতে না চেয়েও কীভাবে যেন এসেই পড়ল এ বেদনাদায়ক অনুষঙ্গ! এমন অবস্থায় মানুষ কী করেই বা সামলাতে পারে তার দিলের ধরকন ও হৃদয়ের স্পন্দন?!... হুযূর তাই বললেন, আমার বড় ভয় হয়। ইসলামী ইতিহাসে বহু বাতিল ফিরকার উত্থান হয়েছে, আবার পতনও হয়েছে। তবে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে গিয়ে তাদের যে হালত হয়েছিল, তাদের যে ভাষা ও আচরণ প্রকাশ পেয়েছিল- দুঃখজনকভাবে বর্তমান ফিতনাকারী উপদলটি শুরুই করল সেই ভাষা ও আচরণ দিয়ে। অর্থাৎ
سب المؤمنين وبغض العلماء
(মুমিনদের গালমন্দ করা ও আলিমদের সাথে বিদ্বেষপোষণ করা)। এতদিন পর্যন্ত গোমরাহ ফিরকাগুলোর চূড়ান্ত পরিণতির লক্ষণ ছিল যা, এরা শুরুই করল তা দিয়ে। জানি না এর শেষ কোথায়...!
আলিমদের অবাধ্যতা ও তাদের অপদস্থ করা যে কত মারাত্মক অপরাধ এবং তার পরিণাম কত ভয়াবহ, সে প্রসঙ্গে বললেন-
العُلَمَاءَ وَرَثَةُ الأَنْبِيَاءِ.
আলিমগণ নবীগণের ওয়ারিস। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৮২
আর তো কোনো নবী আসবেন না। আলিমগণই তাঁদের স্থলাভিষিক্ত। তারাই এখন শরীয়ত ও মানুষের মাঝে যোগসূত্র। তো তাদের অবজ্ঞা, অশ্রদ্ধা, তাদের অবাধ্যতা এবং তাদের উপর থেকে আস্থা তুলে দেয়া... এরপর আর দ্বীনের কী বাকি থাকে...? স্বয়ং রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
فَضْلُ العَالِمِ عَلَى العَابِدِ كَفَضْلِي عَلَى أَدْنَاكُمْ.
একজন আবেদের উপর একজন আলিমের মর্যাদা ততখানি, তোমাদের কারো উপর আমার মর্যাদা যতখানি। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৮৫
এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলিমের মর্যাদাকে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কেন? এ শ্রেষ্ঠত্বের মূল কারণ, আম্বিয়া কেরামের যিম্মাদারি ছিল উম্মতের রাহনুমায়ী ও তাদের দিকনির্দেশনা প্রদান করা। তাঁদের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে উলামায়ে কেরামের উপরও এ যিম্মাদারী অর্পিত হয়েছে। আম্বিয়া কেরামের পর শরীয়ত তাদেরকেই রাহবর বানিয়েছে। এ গুরু দায়িত্ব পালনের সুবাদেই উম্মতের অন্যান্য সদস্যের চেয়ে তারা বেশি মর্যাদাবান।
দিশেহারা জাতিকে পথের দিশা দেয়া- এই তো কাজ ছিল আম্বিয়া কেরামের! যদিও তাদের প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, মিথ্যুক বলা হয়েছে। যুগে যুগে যে নবীগণ এসেছেন তারা দেখেননি, কওম তাঁদের কী জবাব দেবে। গ্রহণ করবে, না প্রত্যাখ্যান করবে। তাঁরা তাঁদের পয়গাম পৌঁছে দিয়েছেন। কওমের অবজ্ঞা ও অসদাচার এবং নিত্য-নতুন উপায়ে কষ্টদান সত্ত্বেও তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। কওম মানবে কি মানবে না সে অপেক্ষায় তাঁরা কখনো থাকেননি এবং সত্যের বাণী উচ্চারণ থেকেও পিছপা হননি। সুতরাং তাঁদের স্থলাভিষিক্ত যে উলামায়ে কেরাম তাদেরও নীতি তা-ই। স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের এ ছবক দিয়েছেন। কুরআনে কারীমে মূসা আ.-এর বক্তব্য-
اِنِّیْۤ اَخَافُ اَنْ یُّكَذِّبُوْنِ.
আমার ভয় হয়, তারা আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে।
এর উত্তরে আল্লাহ বলেছেন-
قَالَ سَنَشُدُّ عَضُدَكَ بِاَخِیْكَ وَ نَجْعَلُ لَكُمَا سُلْطٰنًا فَلَا یَصِلُوْنَ اِلَیْكُمَا بِاٰیٰتِنَاۤ، اَنْتُمَا وَ مَنِ اتَّبَعَكُمَا الْغٰلِبُوْن .
আমি তোমার ভাইয়ের দ্বারা তোমার বাহু শক্তিশালী করে দিচ্ছি এবং তোমাদের উভয়কে এমন প্রভাব দান করছি যে, তারা তোমাদের পর্যন্ত পৌঁছতেই পারবে না। আমার নিদর্শনাবলী নিয়ে যাও, তোমরা ও তোমাদের অনুসারীরাই জয়ী থাকবে। -সূরা কাসাস (২৭) : ৩৪-৩৫
সুতরাং তাদের কোনো ভয় নেই। তারাই জয়ী হবেন। এটা আল্লাহর ওয়াদা। সত্যের উপর অবিচল থাকার কারণে এবং নির্ভয়ে তা প্রচারের জন্য চূড়ান্ত বিজয় তাদেরই হবে। ‘ওরাছাতুল আম্বিয়া’-এর সাথে যারা লড়তে আসবে, হকের বিপক্ষে গিয়ে তাদের মোকাবিলায় অবতীর্ণ হবে তারাই পরাজিত হবে। এ পরাজয় দুনিয়ার বিচারে যদিও বা কখনো কিছুটা বিলম্বে হয়, কিন্তু আখিরাতে এদের পরাজয় সুনিশ্চিত। সেদিন তাদের কোনো রক্ষাকারী নেই...।
রাহবরি গ্রহণ করা উচিত নিঃস্বার্থভাবে
শরীয়ত যখন আলেমদেরকে রাহবরের ভূমিকা প্রদান করেছে তখন উম্মতের সুদিনে ও দুর্দিনে সবরকম পরিস্থিতিতে তারা যে রাহনুমায়ী ও দিকনির্দেশনা উম্মতকে দেন তা মানতে তাদের প্রস্তুত থাকা উচিত উল্লেখ করে হুযূর বললেন, নবীর ওয়ারিস হিসেবেই আলিমদেরকে মান্য করার কথা ছিল, এখন এই মান্যতা কি শুধু পছন্দের গ-ীতে সীমাবদ্ধ থাকবে? অর্থাৎ রাহবরি মনঃপুত হলে মানা হবে, নতুবা নয়। এটা কি মান্যতা? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে সংশোধন করেছেন- কখনো উপদেশ দিয়ে, কখনো শাসন করে। দু’ভাবেই। যেমন এক সাহাবীকে বললেন-
إِنّكَ امْرُؤٌ فِيكَ جَاهِلِيّةٌ.
(তোমার মধ্যে এখনো জাহেলী আচার-অভ্যাস রয়ে গেছে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩০)
নবীর এই শাসন সাহাবী সাদরে গ্রহণ করেছেন ও সংশোধিত হয়েছেন। তো আমাদের এ ভাইয়েরা উলামায়ে কেরামকে যদি রাহবর বলে স্বীকার করে থাকেন তাহলে চলমান সঙ্কটে তারা যে রাহবরি করছেন, যে পরামর্শ ও উপদেশ দিয়েছেন, করণীয় নির্ধারণ করেছেন তা মানতে বাধা কোথায়? হকের আনুগত্য করলে কি কেউ কখনো ছোট হয়? কিন্তু তা না করে যদি বলা হয়, ‘এতদিন যা মেনে এসেছি তার ব্যতিক্রম করা যাবে না। তার বিপরীত কোনো কিছু গ্রহণ করা হবে না...।’ তাহলে এটা তো হয়ে গেল তাদের কথার মত, যারা বলেছিল-
اِنَّا وَجَدْنَاۤ اٰبَآءَنَا عَلٰۤی اُمَّةٍ وَّ اِنَّا عَلٰۤی اٰثٰرِهِمْ مُّقْتَدُوْن.
[আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের একটি পথের উপর পেয়েছি এবং আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করছি। -সূরা যুখরুফ (৪৩) : ২৩]
এটা তো কোনো মুমিনের পথ হতে পারে না। মুমিন তো হকের অনুসরণ করবে। হক যেখানেই থাকুক।
কিন্তু দুখের বিষয়, তারা হক ও সত্য গ্রহণে আগ্রহ দেখাননি তা-ই নয়; বরং এমন অবস্থান গ্রহণ করেছেন, এমন সব কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছেন, যে কারণে আজ আলেম-ওলামা তাদের ব্যাপারে শঙ্কিত ও আতঙ্কিত।
সত্য হয়ে গেল সে আশঙ্কা!
কুরআনে কারীমে কাবিল কর্তৃক তার ভাইকে হত্যা করার যে কাহিনী বিবৃত হয়েছে তার উদ্ধৃতি দিয়ে হুযূর বললেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হাবিল-কাবিলের ঘটনা প্রসঙ্গে হাবিলের এ কথাগুলো উল্লেখ করেছেন-
لَىِٕنْۢ بَسَطْتَّ اِلَیَّ یَدَكَ لِتَقْتُلَنِیْ مَاۤ اَنَا بِبَاسِطٍ یَّدِیَ اِلَیْكَ لِاَقْتُلَكَ، اِنِّیْۤ اَخَافُ اللهَ رَبَّ الْعٰلَمِیْنَ. اِنِّیْۤ اُرِیْدُ اَنْ تَبُوْٓءَاۡ بِاِثْمِیْ وَ اِثْمِكَ فَتَكُوْنَ مِنْ اَصْحٰبِ النَّارِ، وَ ذٰلِكَ جَزٰٓؤُا الظّٰلِمِیْنَ.
তুমি যদি আমাকে হত্যার জন্য আমার দিকে তোমার হাত বাড়াও তবুও আমি তোমাকে হত্যার জন্য তোমার দিকে আমার হাত বাড়াবো না। আমি তো আল্লাহকে ভয় করি। যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক। আমি চাই যে, তুমি আমার গোনাহ ও তোমার গোনাহ বহন করে জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও। আর এটাই হচ্ছে জালিমদের শাস্তি। -সূরা মায়েদা (০৫) : ২৮-২৯
এ আয়াত থেকে পরিষ্কার, হত্যার জন্য প্রথমে যে হাত বাড়ায় তার ঠিকানা জাহান্নাম। অথচ আজ কত সহজে এরা এই রক্তপাতে অংশ নিল!...
হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-কে আল্লাহ তাআলা জান্নাতের উঁচু মাকাম নসীব করুন, হয়ত এ জামাতের এমনও দুর্দিন আসবে, এটা তিনি দিব্যচোখে দেখতে পেয়েছিলেন। সহীহ তরীকায় না হলে এই কাজ ও তার সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের পরিণতি কী হতে পারে তা ভেবে উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন, আর অশ্রুপাত করেছিলেন। মাওলানা তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম তাঁর পিতা মুফতী শফী রাহ.-এর বরাত দিয়ে লিখেছেন- শফী রাহ. বলেন, “ইলিয়াস রাহ. একবার ভীষণ অসুস্থ হন। তার সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে নিযামুদ্দীন গিয়ে জানতে পারি, ডাক্তার তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ বারণ করে দিয়েছেন। ফিরে যাচ্ছিলাম। তখন ইলিয়াস রাহ. খবর পেয়ে আমাকে ডেকে পাঠান এবং আমি যেন অবশ্যই তাঁর সঙ্গে দেখা করি- এ মর্মে জোর তাকিদ দেন। সুতরাং আমি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ভিতরে গেলাম। কুশল জিজ্ঞেস করলাম। তখন তিনি আমার হাতকে নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে অঝোরে কাঁদতে আরম্ভ করলেন। ভাবলাম, রোগযন্ত্রণার কারণে কাঁদছেন। তাই দুটো কথা বলে সান্ত¡না দিতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু তিনি জানালেন এ কান্না রোগযন্ত্রণার কারণে নয়; বরং দুটো বিষয় চিন্তা করে তিনি অস্থির। এ কান্না সে অস্থিরতার জন্যই। (প্রথমটির বিস্তারিত পড়–ন ‘ইসলাম ও আমাদের জীবন’ সিরিজের ২য় খ-ে, পৃষ্ঠা ৪৩৪-৪৩৫) তার অস্থিরতার দ্বিতীয় কারণ সম্পর্কে তিনি বললেন, তাবলীগ জামাতের কাজে সাধারণ মানুষ অধিকহারে যোগ দিচ্ছে। আলেমদের সংখ্যা কম। আমার আশঙ্কা হল, সাধারণ মানুষের হাতে যখন নেতৃত্ব আসে তখন পরবর্তীতে তা অনেক সময় কাজটিকে ভুল পথে পরিচালিত করে। তাই এমন না হয় যে, তাবলীগ জামাত কোনো ভুল পথে পরিচালিত হয়। আর তার অপবাদ আমার মাথার উপর আরোপিত হয়। সেজন্য আমার মন চায় আলিমগণ অধিকহারে এ কাজে যুক্ত হোন এবং তারা এর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। মুফতী শফী রাহ. বলেন, আমি তখন তাকে এই বলে আশ্বস্ত করি যে, আপনি তো নেক নিয়তে এবং সঠিক পদ্ধতিতে কাজ আরম্ভ করেছেন। পরবর্তীতে কেউ যদি তা নষ্ট করে তাহলে ইনশাআল্লাহ আপনার উপর তার দায় বর্তাবে না।” (ইসলাম ও আমাদের জীবন, খ-, ২ পৃষ্ঠা ৪৩৪-৪৩৬)
লক্ষণীয় বিষয়, সেদিন তিনি যে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন দিনে দিনে তা-ই বাস্তবে পরিণত হল। তার সে ধারণাই সত্য প্রমাণিত হল।
‘মজলুম বনো, জালিম না বনো’
বর্বরচিত ঐ হামলার শিকার আলিম ও তাবলীগী সাথীদের হতাহতের বিবরণ দিতে গিয়ে হুযূর বললেন, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে গিয়েছিলাম তাদের দেখতে। একের পর এক শুধু আসছেই হাফেয-আলেম। সকলেই মাথা ফাটা। সমানে রক্ত ঝরছে। আলেমদেরকেই ওরা টার্গেট বানিয়েছে...।
এখানে তিনি স্মরণ করলেন হযরত হাফেজ্জী হুযূর রাহ.-এর সেই অমর উক্তিটি-
مظلوم بنو ظالم نہ بنو
‘মজলুম হওয়াকে মেনে নাও, কিন্তু জালিমের ভূমিকায় যেয়ো না।’ আলহামদু লিল্লাহ, আলিম সমাজ এখন পর্যন্ত এ অবস্থানই ধরে রেখেছেন। চলমান সঙ্কটে তাদের যে পরিমাণ ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়েছে সেসব কিছুর পরও তারা নিজেদের সংযমের পরিচয়ই দিয়েছেন। সর্বশেষ সেদিনের ঘটনাতেও জাতি তাদের মজলুমের চেহারায় ফিরে যেতে দেখেছে, কিন্তু জালিমের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখেনি।
দ্বীনের এ সিপাহীরা সেদিন যে রক্ত বিলিয়েছেন সেজন্য তাদের তো সান্ত¡না রয়েছে আল্লাহর রাসূল হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাক যবানে উচ্চারিত এই পংক্তি দুটিতে-
هَلْ أَنْتِ إِلا إِصْبُعٌ دَمِيتِ وَفِي سَبِيلِ اللهِ مَا لَقِيتِ.
(তুমি তো সামান্য আঙুল, যা রক্তাক্ত হয়েছে। আল্লাহর পথেই তোমার এ রক্ত ঝরেছে! -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৮০২)... তারা তো সান্ত¡না খুঁজে পাবেন নবুওতের এ অমিয় বাণী থেকে এবং কুরআনে কারীমে নবীকে উদ্দেশ্য করে বলা এ ধরণের আয়াতগুলি থেকে-
وَ اصْبِرْ عَلٰی مَا یَقُوْلُوْنَ وَ اهْجُرْهُمْ هَجْرًا جَمِیْلًا.
আর ওরা যা কিছু বলছে তাতে ধৈর্য ধরুন এবং ওদেরকে ভদ্রভাবে পরিহার করুন। -সূরা মুযযাম্মিল (৭৩) : ১০-১৩
আল্লাহর এ আশ্বাসবাণী যথেষ্ট- তাদের সান্ত¡নার জন্য, কিন্তু যারা সেদিন জালিমের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নিরীহ নিরস্ত্র আলিম তালিবে ইলম ও দ্বীনদার মুমিন মুসলমানদের দিকে হাত বাড়ালো, তাদেরকে রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত করে ছাড়ল, তারা কী নিয়ে ফিরে গেল? তারা কীসের স্বাক্ষর রেখে গেল ইজতিমার ময়দানে এবং ইতিহাসের বিশালায়তন আঙিনায়?!
হকের চিরপরিচিত ধারা ও ধরন থেকে সরে গিয়েও!
لاَ طَاعَةَ لِمَخْلُوقٍ فِي مَعْصِيَةِ اللهِ عَزّ وَجَلّ
(আল্লাহর নাফরমানী হয় এমন ক্ষেত্রে মাখলুকের আনুগত্যের সুযোগ নেই) শরীয়তের এই প্রতিষ্ঠিত নীতির অনুসরণের কারণে যদি মুসলমানদের একদলকে ‘ঈমানের পরীক্ষা’ দিতে হয় তাহলে বিপরীতে যিনি আল্লাহর মর্জির খেলাফ করেও, হকের চিরপরিচিত ধারা ও ধরন থেকে সরে গিয়েও এবং বহু বক্রতা ও বিকৃতির আশ্রয় নেয়া সত্ত্বেও যিনি তার এতায়াত ও আনুগত্যকে শর্তহীন ও প্রশ্নাতীত করতে মরিয়া, জানি না তার কী হাশর হয়। শুধু বলতে পারি, ইসলামের সুদীর্ঘ ইতিহাসে যারা ছিলেন মুকতাদা ও ইমাম, যারা ছিলেন উম্মাহর অভিভাবক ও রাহবর কিংবা কোনো মুসলিম জামাতের আমীর বা যিম্মাদার- তাদের আচরণ ও চরিত্র এবং কর্ম ও তৎপরতার সাথে মিল নেই এই নতুন যিম্মাদার ও তাঁর কর্মতৎপরতার...।
ইসলামী উম্মাহর দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় সম্পূর্ণ অচেনা এক নতুন ও সংকীর্ণ গলিপথে নিজের যাত্রা অব্যাহত রেখে তবে কি তিনি সত্য করতে চলেছেন সেই আশঙ্কা, যার বিষয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে নিজের পরিষ্কার ও দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেছে মাদরে ইলম দারুল উলূম দেওবন্দ?!
তিনি কি সজাগ হবেন এবং যারা চলছেন তাঁর পিছন পিছন? আল্লাহই তাওফীক দেয়ার মালিক। তাঁর হাতেই রয়েছে হেদায়েত।
رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوْبَنَا بَعْدَ اِذْ هَدَیْتَنَا وَ هَبْ لَنَا مِنْ لَّدُنْكَ رَحْمَةً، اِنَّكَ اَنْتَ الْوَهَّابُ.
اَللّهُمّ اجْعَلْنَا مِمّنْ قُلْتَ فِيْهِم- اِنَّمَا یَخْشَی اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمٰٓؤُا.
اَللّهُمّ اجْعَلْنَا مِنْ عُدُوْلِ حَمَلَةِ الْعِلْمِ،الّذِينَ يَنْفُونَ عَنْهُ تَحْرِيفَ الْغَالِينَ، وَانْتِحَالَ الْمُبْطِلِينَ، وَتَأْوِيلَ الْجَاهِلِينَ.
اَللّهُمّ اجْعَلْنَا مِنْهُمْ بِمَنِّكَ وَكَرَمِكَ يَا رَبّ الْعَالَمِيْنَ!
-মাসউদুযযামান শহীদ
১৭ রবিউস সানি ১৪৪০হি.
২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ঈ.