আমাদের ‘আবুল ফাতাহ ছাহেব হুজুর’
হুজুরকে প্রথম দেখি মালিবাগ জামিয়ার দাখেলা-ফরম নেয়ার সময়। দফতরে ইহতিমামের সামনে ভর্তিচ্ছু তালিবানে ইলমের ভিড়ের মাঝে ফরম নেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছি- পিছন থেকে একজন মধ্যবয়সী জুব্বাপরিহিত ব্যক্তি ‘সররে বাবারা!’ বলতে বলতে ভিড় ঠেলে দফতরে ইহতিমামে প্রবেশ করলেন। তাঁর স্নেহপূর্ণ সম্বোধন আমাকে বেশ সচকিত করল। পরবর্তী তিন বছর বারবার শুনেছি এই সম্বোধন। ‘তুই’ কথাটিও যে এত মধুর হতে পারে তা শুধু তারাই বুঝতেন, যারা তাঁর ঐ সম্বোধন শুনেছেন। ইনিই আমাদের প্রিয় উস্তায হযরত মাওলানা আবুল ফাতাহ ছাহেব হুজুর রাহমাতুল্লাহি আলাইহি।
মালিবাগ জামিয়ায় আমার তিন বছর পড়ার সুযোগ হয়েছে। জালালাইন, মিশকাত ও দাওরায়ে হাদীস। এই তিন বছর হুজুরকে খুব কাছে থেকে দেখেছি এবং তাঁর স্নিগ্ধ সাহচর্য পেয়েছি।
তিনি শুধু একজন ছাত্র-বৎসল ব্যক্তিই ছিলেন না, ছিলেন একজন পরিশ্রমী ও সাংগঠনিক দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। একজন সুলেখক হিসেবেও উলামা-তলাবা মহলে তাঁর একটি পরিচিতি আছে।
মালিবাগ জামিয়ায় দাখেলা নেয়ার পিছনে আমার একটি চিন্তা ছিল। আল্লাহ তাআলাই মেহেরবানী করে তা দান করেছিলেন। আমি এখনো তা ছাত্রদের সাথে আলোচনা করি।
আমার আব্বাজান -আল্লাহ তাআলা তাঁকে পূর্ণ সিহহাত ও পূর্ণ আফিয়াতের সাথে দীর্ঘ দিন বা-হায়াত রাখুন- চাকরি সূত্রে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে বদলী হয়ে গেলে আমরা সবাই চট্টগ্রামে চলে যাই এবং হাটহাজারি মাদরাসায় ভর্তি হই।
আব্বার অফিস ছিল কালুরঘাট। কিন্তু আমাদের সুবিধার জন্য তিনি হাটহাজারিতেই বাসা নিলেন। প্রতিদিন সকাল-বিকাল হাটহাজারি থেকে কালুরঘাট আসা-যাওয়া করতেন। তখন অতটা না বুঝলেও এখন কিছুটা বুঝি- এভাবে সকাল-বিকাল বাস-যাত্রা তাঁর জন্য কতই না ক্লান্তিকর ছিল।
رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّیٰنِیْ صَغِیْرًا
হাটহাজারি মাদরাসার অদূরে উত্তর দিকে মাকবারা-সংলগ্ন একটি মসজিদ আছে- নূর মসজিদ। ঐ মসজিদের সামান্য উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত ছোট্ট ঈদগাহটির সাথেই ছিল আমাদের বাসা। তাই বাসা থেকে আসা-যাওয়া করে পড়াশোনা করতে আমাদের কোনো অসুবিধা হয়নি। আল্লাহ তাআলার মেহেরবানী, হাটহাজারি মাদরাসায়ও বেশ ক’জন মুশফিক উস্তাযের সাহচর্য পেয়েছি, যাঁদের সম্পর্কে অন্য কোনো অবসরে কিছু লেখার প্রেরণা বোধ করি।
কয়েক বছর পর যখন আব্বা আবার ঢাকায় বদলী হয়ে আসেন তখন বিভিন্ন কারণে আমাদেরও ঢাকায় চলে আসার প্রয়োজন হল।
ঢাকায় এসে কোথায় ভর্তি হব- এ নিয়ে যখন ভাবছি তখন মনে হল, ঢাকার বড় বড় মাদরাসাগুলোর সবগুলোতেই আল্লাহর ফযলে আহলে ইলম, আহলে দিল ব্যক্তিত্ব আছেন। শীর্ষস্থানীয় মাদরাসাগুলোর পড়াশোনার মানেও খুব বেশি তারতম্য হবে না। কাজেই যেকোনো ভালো মাদরাসাতেই ভর্তি হওয়া যায়। তবে কোথাও প্রয়োজনীয় কোনো অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য যদি পাওয়া যায় ভালো হয়। সেই বৈশিষ্ট্য কী হতে পারে? মনে হল, দরসী কিতাবের তাকরীরের পাশাপাশি তরজমাও কোথাও বাংলায় হয় কি না জানা দরকার। এটি একান্ত শাস্ত্রীয় বিষয়গুলো মাতৃভাষায় বোঝা-বোঝানোর যোগ্যতা অর্জনে সহায়ক হতে পারে। এই চিন্তুা থেকে ঢাকার বিখ্যাত কয়েকটি মাদরাসায় ফোন করি। মালিবাগ মাদরাসায় ফোন করে জানতে পারলাম- হাঁ, এখানে দরসী তাকরীরের সাথে তরজমাও বাংলায় হয়। তাছাড়া বেফাকের ফলাফলেও এটি ছিল ঢাকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাদরাসা। আব্বাজানকে জানানোর পর তিনিও এখানে ভর্তি হওয়ার নির্দেশ দিলেন। আল্লাহর উপর ভরসা করে ভর্তি হয়ে গেলাম।
আলহামদু লিল্লাহ! আমার প্রত্যাশা ব্যর্থ হয়নি। এখানে আমি পেয়েছি বেশ কয়েকজন লেখক-গবেষক উস্তাযের স্নেহপূর্ণ-সাহচর্য। হযরত মাওলানা কাজী মু‘তাসিম বিল্লাহ রাহ. ছাড়াও হযরত মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম, হযরত মাওলানা মুফতী মাহমুদুল হাসান ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম, হযরত মাওলানা আবদুল মতীন ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম, হযরত মাওলানা আবদুল গাফফার ছাহেব দামাত বারাকাতুহুমসহ অন্যান্য আসাতিযায়ে কিরামের দরসী তরজমা ও তাকরীর দ্বারা আমি অনেক উপকৃত হয়েছি। আল্লাহ তাআলা তাঁদের সকলকে জাযায়ে খায়ের দান করুন এবং সিহহাত ও আফিয়াতের সাথে দীর্ঘ নেক হায়াত দান করুন- আমীন।
ঐ সময়ের মালিবাগ জামিয়ার সুবেশী-সুভাষী এবং সুলেখক-সুবক্তা উস্তাযগণের যে জামাতটি ছিল তাঁদের মধ্যে বিশিষ্ট একজন ছিলেন আমাদের ‘আবুল ফাতাহ ছাহেব হুজুর’ রাহ.।
দরসে তাঁর বিশেষ ভঙ্গিমার হাসিমুখ আলোচনা এখনো স্মৃতিপটে অম্লান। দরসী আলোচনার পাশাপাশি মাঝে মাঝেই আমাদের শোনাতেন তাঁর লেখালেখির বিভিন্ন অভিজ্ঞতা।
একদিন বললেন, ‘আমি তো অনেক দিন হিদায়া পড়িয়েছি, কিন্তু অর্থনীতির উপর কাজটি করতে গিয়ে এমন অনেক দিক সামনে এসেছে, যা আগে সামনে আসেনি।’
লেখালেখির এ এক বড় উপকার। কেউ যদি সত্যি সত্যি বিষয়বস্তুর প্রতি সুবিচার করে কিছু লিখতে চান তাহলে তাকে অবশ্যই ভালোভাবে বিষয়টি বুঝতে হবে, আত্মস্থ করতে হবে। ‘নিয়মনিষ্ঠ’ লেখালেখি তাই লেখককেও সমৃদ্ধ করে। ‘নিয়মনিষ্ঠ’ কথাটি এখানে আমি সচেতনভাবে ব্যবহার করেছি।
মুহতারাম উস্তায হযরত মাওলানা আবুল বাশার ছাহেব হুজুর দামাত বারাকাতুহুমের মুখে একাধিক বার শুনেছি যে, ‘পাঁচ পৃষ্ঠা লেখার জন্য কখনো কখনো পাঁচশ পৃষ্ঠাও পড়তে হয়।’ অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণই একথার মূল্য বুঝবেন।
তো হুজুরের কাছে আমরা দরসে ও দরসের বাইরে বিভিন্ন সময় লেখালেখির ‘কারগুজারি’ শুনতাম, যা বেশ উপভোগ্য হত।
একবার কিছুটা আফসোসের সুরে বললেন, ‘আমার অবস্থা হচ্ছে কোনো বিষয় লিখতে হলে প্রয়োজনীয় পড়া শোনার পর আমাকে দুই দিন বিশ্রাম নিতে হয়, এরপর লেখা শুরু করতে পারি, কিন্তু আমার বন্ধু (মাওলানা ইসহাক ফরীদী রাহ.) একেবারেই আলাদা; ও যদি দুই ঘণ্টা ইটা ভেঙ্গেও আসে তবুও সঙ্গে সঙ্গে কলম-কাগজ নিয়ে বসে পড়তে পারে!
আবুল ফাতাহ ছাহেব হুজুরের যেহেতু সাধারণ শিক্ষারও একটি অভিজ্ঞতা ছিল সেসব বিষয়েও কখনো কখনো গল্প করতেন। প্রফেসর এমাজউদ্দীন সাহেবসহ ঐ অঙ্গনের কোনো কোনো বিশিষ্ট শিক্ষাবিদের সাথে তাঁর আলাপচারিতা ও অভিজ্ঞতার কথাও তাঁর মুখে শুনেছি। এসব শুনতে ভালো লাগত।
কত কথাই তো মনে পড়ছে। কয়টা লিখব? মালিবাগ মসজিদে বিভিন্ন সময় আসাতিযায়ে কিরামের যে মজলিস হত ওখানেও বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতেন। তাঁর আলোচনাগুলো হত সাধারণত জীবন-ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন বিষয়ে।
একবারের আলোচনায় বললেন এক দম্পতির কথা, যাদের মধ্যে একবার সম্পর্কের বেশ টানাপোড়েন তৈরি হয়। আলাপ-আলোচনার পর স্ত্রীর বিরক্তি ও মনোকষ্টের যে কারণটি বের হয়ে আসে তা হচ্ছে, স্বামী গোসলের পর লুঙ্গিটা গোসলখানায় রেখে আসেন। ঐ ভেজা লুঙ্গি ধুতে তার খুব কষ্ট হয়!
স্বামী ভালো মানুষ ছিলেন। এটা জানার পর তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, এখন থেকে নিজের লুঙ্গি নিজেই ধুয়ে দিবেন।
সুবহানাল্লাহ! সমষ্টিগত জীবনে ছোট ছোট বিষয়েও কত সচেতনতা প্রয়োজন! ছোট ছোট বিরক্তিকর ব্যাপার নিয়মিত ঘটতে থাকলে সেটা যে একপর্যায়ে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো অসহনীয় হয়ে পড়ে তা কে না বোঝে? সুখী-দাম্পত্যের জন্য এই বোধ ও চেতনা খুবই জরুরি।
পরে মারকাযুদ দাওয়াহ’য় আমার উস্তায ও মুর্শিদ হযরত আমীনুত তা‘লীম ছাহেব হুজুর সম্পর্কেও শুনেছি, তিনি তাঁর এক বিবাহিত ছাত্রকে নসীহত করেছেন, ‘প্রতিদিন রাতে শোয়ার সময় মশারিটা তুমি টাঙ্গাবে।’ সুবহানাল্লাহিল আযিম! এ তো অনেকের চিন্তার ত্রিসীমানাতেও আসে না; এমনকি এই নসীহত শোনার পরও কারো মনে হতে পারে, এটা একটা নসীহত হল! কিন্তু সত্যিই কি এটা ছোট বিষয়? এ মশারি টানানো নিয়ে যে কত পরিবারে কুরুক্ষেত্র বেধে যায় তার প্রমাণ তো আমাদের গল্প-উপন্যাসেও আছে।
এই ধরনের একটি নসীহত উস্তাযে মুহতারামকে করেছিলেন তাঁর শায়খ হযরত আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ.। তিনি তাঁকে বলেছিলেন, ‘তুমি রাস্তা পার হওয়ার সময় ধীরেসুস্থে পার হবে।’ একাধিকবার লক্ষ্য করেছি, হুজুর কীভাবে তাঁর শায়খের নসীহত অক্ষরে অক্ষরে পালন করছেন।
বাস্তব জীবনের ছোট ছোট বিষয়েও দৃষ্টি আকর্ষণ আমাদের শফীক মুরব্বিগণের অনন্য বৈশিষ্ট্য। ছোট ছোট অনেক কিছু এমন আছে, যা আপাতদৃষ্টিতে ছোট মনে হলেও পরিণামের বিচারে মোটেও ছোট নয়। আমার অন্যান্য উস্তাযের মতো হযরত মাওলানা আবুল ফাতাহ ছাহেব হুজুরের কাছেও এরকম অনেক কথা শুনেছি। একবার এক দম্পতির কথা বললেন, যাদের সম্পর্কের অবনতি এই পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, এই ভাঙ্গল বলে! চূড়ান্ত মুহূর্তে এসে স্বামীর মনে পড়ে কুরআনের এই আয়াত-
فَاِنْ اَطَعْنَكُمْ فَلَا تَبْغُوْا عَلَیْهِنَّ سَبِیْلًا
অতপর তারা যদি তোমাদের কথা মানে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিওনা। -সূরা নিসা (৪) : ৩৪
স্বামী চিন্তা করলেন, সে তো আমার অনেক কথা মান্য করে। তিনি তালাক দেয়া থেকে নিবৃত্ত থাকলেন।
কুরআনে কারীম কীভাবে মানুষকে পথ দেখায়, জীবনের কঠিনতম মুহূর্তে, গভীর খাঁদের কিনারায় কীভাবে তার হাত ধরে- মুহতারাম উস্তাযের ঐ আলোচনায় এর এক জীবন্ত দৃষ্টান্ত দেখতে পেয়ে সেদিন আমরা অভিভূত হয়েছিলাম।
তাঁর বিভিন্ন আলোচনায় একটি সাধারণ বিষয় ছিল ‘জীবনবোধ’। একবার বললেন, ‘তোরা তো ‘মাকামাতে হারীরী’ কিতাবটি পড়িস শুধু আরবী সাহিত্যের কিতাব হিসাবে। আসলে এই কিতাবে জীবন ও বাস্তবতার যে চিত্রায়ন আছে সেই হিসাবেও তা পড়া দরকার।’
তাঁর কথাটি আমার মনে খুব রেখাপাত করেছিল, কিন্তু কী করা যাবে, আমাদের রুচিশীল ও চিন্তাশীল উস্তাযগণ পেয়েছেন আমাদের মতো অকর্মণ্য অলস শাগরিদ! তাঁদের চিন্তার পথ ধরে ইতিবাচক কাজের ধারা যদি আমরা শুরু করতে পারতাম তাহলে হয়তো আরো কিছু ভালো কাজ উম্মতের সামনে এসে যেত।
আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রিয় উস্তাযকে জাযায়ে খায়ের দান করুন। তাঁর সকল ভালো কাজকে কবুল করুন, ভুলত্রুটি ক্ষমা করে জান্নাতে উচ্চ মাকাম দান করুন এবং তাঁর সন্তান-সন্ততিকে তাদের সম্মানিত পিতার যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে কবুল ও মঞ্জুর করুন। আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন!