রবিউল আখির ১৪৪০   ||   জানুয়ারি ২০১৯

তাবলীগ জামাতের বর্তমান সংকট ও আমাদের করণীয়

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

ভূমিকা : তাবলীগ জামাতের বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের সবার জন্যই বড় পেরেশানী ও কষ্টের। বাস্তবেই এটি এক বড় মুসীবত, যা মূলত আমাদের জন্য পরীক্ষা। আল্লাহ করুন, আমরা এই পরীক্ষায় যেন উত্তীর্ণ হতে পারি এবং এখান থেকে উপযুক্ত নসীহতও হাসিল করতে পারি। কিন্তু সেজন্য শর্ত হল, যথাযথভাবে এই পরিস্থিতির হাকীকত ও বাস্তবতা অনুধাবন করতে পারা এবং এক্ষেত্রে হক ও বাতিলের পার্থক্য নির্ণয় করতে পারা। পাশাপাশি এ অবস্থায় কার কী দায়িত্ব তাও জেনে নেওয়া।

আল্লাহ তাআলার শোকর যে, উলামায়ে কেরাম একান্তভাবে এবং সম্মিলিত মজলিসে লোকজনকে এ বিষয়ে বোঝানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। এর ধারাবাহিকতায় দেশে বিভিন্ন জায়গায় ওয়াজাহাতী জোড়ও অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আলহামদু লিল্লাহ, এইসব জোড়ের কিছু ফায়েদাও পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর ফায়েদা আরো বেশি হত যদি তাতে আলোচকবৃন্দের সকলে সতর্কতার সাথে কথা বলতেন এবং আলোচনার মধ্যে ইকরাম ও শারাফাতের পূর্ণ খেয়াল রাখতেন। কিন্তু যতটুকু দেখা যাচ্ছে, কোনো কোনো আলোচকের আলোচনায় এই দুই শর্তের যথাযথ গুরুত্ব প্রকাশ পাচ্ছে না।

মাসিক আলকাউসারের তত্ত্বাবধায়ক মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক সাহেবও বর্তমান পরিস্থিতির নাযুকতা অনুভব করে মুরব্বিদের হুকুমে বিভিন্ন ওয়াজাহাতী মজলিসে শরিক হয়েছেন। যদিও অধিকাংশ মজলিসে তার আলোচনা হয়েছে খুবই সংক্ষিপ্ত, তবে কয়েকটি মজলিসের আলোচনা বেশ দীর্ঘ ও বিস্তারিত হয়েছে এবং মাশাআল্লাহ খুবই সহজ ও হৃদয়স্পর্শী হয়েছে। সবচে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে গত ৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪০ হিজরী মোতাবেক ১৩ নভেম্বর ২০১৮ ঈসায়ী তারিখে মুন্সিগঞ্জের নয়াগাঁও বড় মসজিদে।

মাসিক আলকাউসারের পাঠকবৃন্দের ফায়েদার কথা চিন্তা করে আলোচনাটি এখানে প্রকাশ করা হচ্ছে। এটি তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব ও মুহাম্মাদুল্লাহ মাসুম মুসাজ্জিলা থেকে পত্রস্থ করেছে। এরপর আলোচক নিজেই আলোচনাটির নযরে সানী ও জরুরি সম্পাদনা করে দিয়েছেন। কোথাও কোথাও আরো কিছু জরুরি কথাও যুক্ত করেছেন। আল্লাহ তাআলা এই মেহনতকে কবুল করুন। এ থেকে আমাদের সবাইকে ফায়েদা দান করুন- আমীন।

আলোচনাটি পাঠ করার সময় খেয়াল রাখতে হবে যে, এটি কোনো মাকালা বা প্রবন্ধ নয়; বরং এটি একটি বয়ান। এতে বয়ানের উপস্থাপন অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে। এজন্য পড়ার সময় বিষয়টি যেহেনে রাখলে পড়তে সুবিধা হবে। -সম্পাদক

 

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

 

তাঁর আরেক প্রকারের মৌলিক ভুল হল- (সময় নেই, শুধু শিরোনাম বলব,)

১. দলীলবিহীন গায়বী কথা বলা।

২. বিদআত আবিষ্কার করা।

আপনারা জানেন, দ্বীনের বিষয়ে কেউ কোনো কথা বলতে হলে দলীলভিত্তিক বলতে হয়। আন্দাযে কথা বলা, ধারণাভিত্তিক কথা বলা, অনুমান করে কথা বলা জায়েয নেই। গায়বী কথা, যেটা জানার সূত্র হল একমাত্র অহী। আল্লাহ তাআলা নবীদেরকে অহীর মাধ্যমে অনেক গায়বী কথা জানিয়েছেন। এখন তো অহী বাকি নেই। তাহলে এখন যদি গায়বী কথা বলে, সেটা অনুমান ভিত্তিক হবে না?

মাওলানা সা‘দ সাহেবের বড় এক মসীবত হল গায়বী কথা বলা, গায়বী কথা মানেই তো দলীলবিহীন কথা। গায়বী কথা মানেই তো যার কোনো দলীল নেই। যে গায়বী বিষয়গুলোর আলোচনা কুরআন-হাদীসে এসে গেছে সেগুলো তো কুরআন-হাদীসে আছেই এবং সেগুলো অহীর মাধ্যমে এসেছে। কিন্তু এর বাইরে তিনি অনেক গায়বী এবং আন্দাযে কথা বলেন। এটা ছোট ভুল না বড় ভুল? বড় ভুল। এটা কি সগীরা গোনাহ না কবীরা গোনাহ? কবীরা গোনাহ। মাওলানা সা‘দ সাহেবের বড় মসীবত এবং একটি বড় ভুল হল এই গায়বী কথা বলা।

২. মাওলানা সা‘দ সাহেবের আরেকটি বড় ভুল হল, তিনি দলীল পরিপন্থী এমন অনেক গলত মাসআলা এবং গলত মতবাদ আবিষ্কার করতে থাকেন, কোনো সাহাবী, কোনো তাবিয়ী এবং কোনো মুজতাহিদ এমন কথা বলেননি; বরং তা সম্পূর্ণ তার নিজের আবিষ্কার। এ বিষয়গুলোকে বিদআত বলে। এক তো হল অন্য কেউ বিদআত আবিষ্কার করেছে আর কিছু লোক না বুঝে সে বিদআতে লিপ্ত হচ্ছে। এটাও গোনাহ। কিন্তু বিদআত আবিষ্কার আরো বড় গোনাহ। অনেক বড় গোনাহ। মাওলানা সা‘দ সাহেব এ কাজটাও করেছেন। কোনো ধরনের দলীল ছাড়া বরং শরীয়তের দলীলের বিপরীতে কেবল নিজের বোধ এবং অনুমান থেকে নতুন নতুন কথা এবং নতুন নতুন মতবাদ আবিষ্কার করে যাচ্ছেন। এই দুই প্রকারের দৃষ্টান্ত পেশ করার এখন আর সময় নেই। তাছাড়া ভুলের প্রকারও কিন্তু এখনো শেষ হয়নি। প্রকার আরো আছে। এখন যে দুই প্রকার বললাম এই দুই প্রকারের বিশ্লেষণ ছাড়া সংক্ষেপে দু-একটি কথা বলছি। আপনারা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করুন।

 

গায়বী কথার কিছু নমুনা

তার একটি গায়বী কথা হল নিযামুদ্দীন মারকায সম্পর্কে। তার আশা, তিনি যতই গলত কথা বলেন না কেন সবাইকে তার সাথে নিযামুদ্দীনে থাকতে হবে। এই আশা পূরণের জন্য তো দরকার তার আকীদা ও চিন্তা-চেতনা সব দুরস্ত থাকা। কিন্তু সেই ফিকির না করে তিনি উল্টা মারকায নিযামুদ্দীনের ব্যাপারে গায়বী ঘোষণা শুরু করেছেন। তিনি বলেছেন,

یہ دو چیزیں الگ الگ نہیں ہیں، کہ عالمی مشورہ الگ ہے اور مرکز الگ ہے، یہ ممکن نہیں ہے، یہ ممکن نہیں ، قیامت تک ممکن نہیں ، ایک عالمی مشورہ ہو اور ایک عالمی مرکز ہو یہ نہیں ہوگا، کیونکہ "یہ مرکز ہے اور تاقیامت مرکز ہے "۔

এ দুটি বিষয় ভিন্ন ভিন্ন নয় যে, আলমী মাশওয়ারা ভিন্ন হবে এবং মারকায ভিন্ন হবে। এটা সম্ভব নয়, সম্ভব নয়, কিয়ামত পর্যন্ত সম্ভব নয়- একটা হবে আলমী মশওয়ারা আর একটা হবে আলমী মারকায। এটা হতে পারে না। কারণ, এটিই (নিজামুদ্দিন) মারকায এবং কিয়ামত পর্যন্ত এটিই মারকায।

তিনি আরো বলেন,

شیطان نے ان لوگوں کو بڑی شکوک میں ڈالا ہوا ہے بڑی شکوک میں ڈالا ہوا ہے "سارے عالم کا یہ مرکز ہے اور سارےعالم کو یہاں سے رجوع کرنا ہے یہ اللہ کی طرف سے طئے شدہ بات ہے"۔

শয়তান এই লোকগুলোকে বড় সন্দেহে নিপতিত করেছে, বড় সন্দেহে নিপতিত করেছে; এটিই সারা বিশে^র মারকায এবং সারা বিশ্বকে এখানেই রুজু করতে হবে- এটি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে চূড়ান্ত কথা!!

‘কিয়ামত পর্যন্ত নিযামুদ্দীনই মারকায’ আপনি দুআ করতে পারেন, আল্লাহ! আমাদের এই মসজিদকে কিয়ামত পর্যন্ত  বাকি রাখো। আল্লাহ! এই মসজিদের মিম্বর থেকে যেন কিয়ামত পর্যন্ত হেদায়েতের কথা আসে। কিয়ামত পর্যন্ত যেন এখান থেকে কোনো গোমরাহীর কথা না আসে। এই দুআ করা যায়। কিন্তু আপনি এমন ঘোষণা কি দিতে পারেন যে, এটা কিয়ামত পর্যন্ত হেদায়েতের মারকায?  এটা সবসময় বাকি থাকবে! এখানে কোনো বিদআতী হুজুর আসবে না। বলেন এটা গায়বী কথা কি না? আপনি মারকাযের জন্য দুআ করতে পারেন, হে আল্লাহ! আপনি এই মারকাযকে গলতী থেকে রক্ষা করুন। ছোট-বড় সব ধরনের গোমরাহী থেকে হেফাযত করুন। বেশির চেয়ে বেশি আশা পোষণ করতে পারেন, ইনশাআল্লাহ, এটি কিয়ামত পর্যন্ত মারকায থাকবে আশা করি। কিন্তু তা না করে আপনি ঘোষণা দিচ্ছেন, এটা কিয়ামত পর্যন্ত মারকায থাকবে।

শুধু তাই নয়, আরেক ধাপ এগিয়ে বলেছেন-

یہ اللہ کی طرف سے طئے شدہ بات ہے

 এটি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে চূড়ান্ত কথা!!

ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। কীভাবে বলে মানুষ এমন গায়েবী কথা!!

এটা গায়বের কথা কি না?

আচ্ছা, আপনারা জানেন হাদীস শরীফে শুধু তিন মসজিদের ব্যাপারে বিশেষ ফযিলতের কথা বলা হয়েছে। মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী এবং বাইতুল মাকদিস। এক হাদীসে এই তিন মসজিদের কথা, আর ভিন্ন হাদীসে কুবা মসজিদের ফযিলতের কথাও আছে। এছাড়া আপনি জোর জবরদস্তি করে কোনো মসজিদের ব্যাপারে কি বলতে পারবেন যে, এটার বিশেষ ফযিলত আছে? বা আরো এক ধাপ এগিয়ে কি বলতে পারেন যে, এটার ইতাআত করতেই হবে? এটার মিম্বার থেকে যা যা বলা হবে সবই মানতে হবে? এভাবে বলা কি জায়েয আছে? কারণ মিম্বারে কখন কে আসে, তার কি নিশ্চয়তা আছে? বাইতুল মুকাররমের মিম্বারে খতীব উবাইদুল হক ছাহেব হুজুর ছিলেন। তার আগে মুফতী আবদুল মুঈজ ছাহেব রাহ. ছিলেন। উনারা সহীহ বলতেন। পরে বাইতুল মুকাররমের মিম্বারে এমন এক লোকও তো এসেছে, যার আকিদা সহীহ ছিল না। আটরশির মুরীদের মত ছিল। অনেকদিন খতীব ছিল কি না? যাদের জানা আছে, এ লোক আটরশির মুরীদ, তারা কি তখন তার পিছনে নামায পড়ত? নাকি বলবে যে, বাইতুল মুকাররম তো আমাদের জাতীয় মসজিদ। কাজেই এ মসজিদে যে-ই খতীব হয়ে আসুক, এর মিম্বার থেকে যা-ই বলা হোক, আমরা এখানে নামায পড়তেই থাকব। এ মিম্বার থেকে যা-ই বলা হবে, সব সঠিক কথা হবে। হেদায়েতের কথা হবে। এরকম যদি কেউ বাড়াবাড়ি করে তাহলে কি জায়েয হবে? বিলকুল নাজায়েয।  তো এ নিযামুদ্দীনও তো একটা মসজিদ। এখানে অনেক বছর যাবৎ হেদায়েতের কথা হয়েছিল। এ যমীনে আল্লাহর নেক বান্দারা সিজদা করেছেন। খুব ভালো! সেটাও আমরা অস্বীকার করি না। যেখানে দ্বীনের নুসরত ও মেহনত যত বেশি হয় সেখানে তার নূর ও বরকতও পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু  তাই বলে আপনি কি এ গায়েবী কথা বলতে পারেন যে,

ساری دنیا کا حال يہ ہے کہ مکہ مدینہ کے بعد اگر کوئی جگہ قابل احترام اور قابل اقتداء اور قابل اطاعت اور قابل عظمت ہیں تو وہ مسجد نظام الدین ہے اور یہ آپ سب حضرات کے لئے نئے پرانے، .... ، ہمیشہ کے لئے، ساری دنیا کے لئے ، سارے امور کا مرجع اور سارے امور کا مرکز وہ نظام الدین ہے۔

সারা দুনিয়ার অবস্থা হল, ‘মক্কা-মদীনার পরে যদি কোনো ইহতেরাম ও আজমতের জায়গা থাকে, যদি কোনো অনুসরণ ও এতাআতের জায়গা থাকে, সেটা হল- মসজিদ নিযামুদ্দীন। পুরো দুনিয়ার জন্য, সব সময়ের জন্য; সকল বিষয়ে এটাই মারকায, সকল বিষয়ে এটাই কেন্দ্রস্থল।’

নাউযু বিল্লাহ! এ গায়েবী কথা বলার কারো  অধিকার আছে? বিলকুল নেই! দলীলছাড়া কীভাবে এমন কথা বলে মানুষ!! আচ্ছা তাহলে কি বাইতুল মুকাদ্দাস থেকেও নিযামুদ্দীনের ফযিলত বেশি?! ইন্না লিল্লাহ!

এগুলো কিন্তু নিছক গায়বী কথা না; বরং এগুলো যেকোনো বেদআতী ফেরকার জন্য রাস্তা খুলে দেওয়ার মতো নতুন বিদআতী উসূল। ব্যস আল্লাহই রক্ষা করার মালিক।

কথা শেষ হয়নি। এরকম গায়বী কথা আরো বলেছেন। এটা এক প্রকার।

 

বিদআত আবিষ্কার

আরেক প্রকার হল, শরীয়তের বিষয়ে। দ্বীনের বিষয়ে কোনো দলীল ছাড়াই কথা বলে ফেলেন? আরে, দ্বীনের বিষয়ে তো কথা হবে দ্বীন এবং শরীয়তের দলীলের ভিত্তিতে। কিন্তু তিনি দলীলের বিপরীত কথা শরীয়তের মাসআলা হিসেবে বলে যাচ্ছেন। শরীয়তের মাসআলা নয়- এমন কিছুকে কেউ যদি মাসআলা হিসেবে আবিষ্কার করে এবং মাসআলা হওয়ার দাবি করে, সে যদি এটার ওপর আবার দলীল দিতে যায়, তাহলে নিশ্চয়ই সে বিকৃতি করছে। হয়ত মওযু হাদীস দিয়ে দলীল দিচ্ছে, না হয় সহীহ হাদীসের গলত ব্যাখ্যা করছে। না হয় সংশ্লিষ্ট বিষয়ের একটা হাদীস নিয়েছে, আরেকটা নেয়নি। সব হাদীসকে সামনে না রেখে এক-দু’টো থেকে ভুল বুঝে ভুল মাসআলা বলছে। আর এ ভুলকে দ্বীন এবং শরীয়ত বানাচ্ছে। ইতাআতী ভাইদের মুখে একটা কথা শুনেননি যে, তিনি কাজকে সীরাতের ওপর আনতে চান? এই হল ওটার হাকীকত। অর্থাৎ সীরাতের অসম্পূর্ণ অধ্যয়ন এবং সীরাতের ত্রুটিযুক্ত পড়াশুনার ভিত্তিতে নতুন নতুন উসূল আবিষ্কার করেন আর বলেন, কাজকে সীরাতের উপর উঠাচ্ছেন!!

তো এই ধরনের দলীলবিহীন ও দলীল পরিপন্থী আবিষ্কৃত কথাও অনেক, সেটা আজকে আর একটাও বলব না। কারণ সময় শেষ।

তাহলে কত প্রকারের ভুল, সব প্রকারের শিরোনামও বলতে পারিনি। তিন প্রকার বলেছি। এক প্রকারের তিনটা মেছাল দিয়েছি। আরেক প্রকারের দুটো দিয়েছি। আরেক প্রকারের শুধু শিরোনাম বলেছি, কোনো দৃষ্টান্ত পেশ করিনি। কিন্তু যদ্দুর আলোচনা হয়েছে, তাতেও বিষয়টি কিছুটা হলেও স্পষ্ট হয়েছে বলে মনে করছি।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে আমরা দুআ করি, আল্লাহ পাক তাঁকে হেদায়েত দান করুন- আমীন। ইসলাহ করে দিন। যেন আগের মত, আমাদের অন্য দশ মুরুব্বীর মত তিনিও আমাদের মুরুব্বী হয়ে থাকতে পারেন সে তাওফীক  আল্লাহ তাঁকে দান করুন- আমীন। ইসলাহ হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে দাওয়াত দেওয়া এবং তার ইতাআত করার নাম নেওয়া কি উচিত? বিলকুল নয়; বরং তাবলীগী কাজের আগের মুরুব্বী যারা, তারা যে আলেমদেরকে তৈরি করে দিয়ে গেছেন, সে আলেমদের তত্ত্বাবধানে আমরা দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করতে থাকি। আল্লাহ  তাআলা আমাদেরকে ভরপুর তাওফীক নসীব করুন- আমীন।

সবশেষে আমরা হযরত মাওলানা সা‘দ সাহেবের ব্যাপারে দারুল উলূম দেওবন্দের সর্বশেষ বক্তব্য পেশ করছি, যা ‘জরুরি ওয়াজাহাত’ শিরোনামে দারুল উলূম দেওবন্দের ওয়েবসাইটে রয়েছে।

নিযামুদ্দিন ও কাকরাইলে যখন মাওলানা সা‘দ সাহেব হযরত মূসা আলাইহিস সালামের ঘটনা বিষয়ক ভুল থেকে মৌখিক রুজু করলেন তখন দারুল উলূম এই ‘জরুরি ওয়াজাহাত’ প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, মাওলানা সা‘দ সাহেবের ‘ফিকরি বে-রাহরাবী’ সম্পর্কে।

দারুল উলূম দেওবন্দের এই জরুরী ওয়াযাহাত খুব খেয়াল করার মতো। একটু বিস্তারিতভাবে বলি : ২ ডিসেম্বর ২০১৭ ঈসায়ী তারিখে নিযামুদ্দীনে হায়াতুস সাহাবার তালীমের মজলিসে এবং জানুয়ারী ২০১৮ ঈসায়ীতে কাকরাইল মসজিদে হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ সা‘দ সাহেব দামাত বারাকাতুহুম-এর রুজুর ভাষা যদিও তাঁর শান মুতাবেক ছিল না, কারণ উভয় জায়গায় তাঁর রুজুর যে ভাষা ছিল তাতে একথার উল্লেখই ছিল না যে, হযরত মূসা আলাইহিস সালামের ব্যাপারে তিনি কোন্ ভুল কথাটা বলেছিলেন যে কথা থেকে এখন তিনি রুজু করছেন, এমনকি উভয় রুজুর মধ্যে সুস্পষ্ট ভাষায় ভুলের স্বীকারোক্তিও ছিল না, তারপরও যেহেতু উভয় মসজিদে তিনি হযরত মূসা আলাইহিস সালামের ঘটনা প্রসঙ্গে বারবার রুজুর কথা উল্লেখ করেছেন, এতে কমপক্ষে একথা তো স্পষ্ট হয়েছে যে, তিনি হযরত মূসা আলাইহিস সালামের ব্যাপারে আপত্তিকর যে কথা বলেছেন সেকথা থেকে এখন তিনি রুজু করছেন। যদিও তিনি এই ভুল কথাগুলো বিভিন্ন জায়গায় এবং বড় বড় ইজতিমায় বলেছিলেন। আর রুজু করেছেন মসজিদের ছোট্ট পরিসরের মজলিশে। তবুও এটা প্রাইভেট ধরনের লিখিত রুজুর চেয়ে ভালো। এজন্য দারুল উলূম দেওবন্দ লিখেছে যে, হযরত মূসা আলাইহিস সালামের ঘটনার ব্যাপারে তার রুজু ইতমিনানযোগ্য ধরা যেতে পারে। কারণ উভয় দেশের কেন্দ্রীয় দুই মসজিদে মজমার সামনে প্রকাশ্যে রুজু করেছেন। তাই আশা করা যায় যে, উনি হযরত মূসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে এইসব গলত কথা আর কোনো মজলিশে পুনরাবৃত্তি করবেন না।

কিন্তু আপত্তি কেবল তার এই একটি গলত কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তার ভয়ংকর ভুলগুলোর তালিকা অনেক দীর্ঘ। উদাহরণস্বরূপ হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম সম্পর্কে তিনি যা কিছু বলেছেন সেটা উল্লেখ করা যেতে পারে। কিন্তু তা থেকে মৌখিক বা লিখিত রুজু তিনি কোথায় করেছেন?

২ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে নিযামুদ্দীন মসজিদে কৃত রুজু হল তাঁর পঞ্চম রুজু। এই রুজুর পরও তিনি তাঁর বিভিন্ন বয়ানে পূর্বের অনেক ভয়ংকর ভুলসমূহের পুনরাবৃত্তি করেছেন। এছাড়াও তিনি আরো নতুন নতুন ভুল আবিষ্কার করেছেন। যার কিছু নমুনা নির্দিষ্টভাবে তারিখ ও স্থান উল্লেখ করে দারুল উলূম দেওবন্দের ফাযেল, দাওয়াত ও তাবলীগের বিশেষ সাথী মুফতী খাযির মাহমূদ কাসেমী সাহেব দামাত বারাকাতুহুমের রিসালা ‘রুজু কে বাদ মাওলানা মুহাম্মাদ সাদ সাহেব কে চান্দ বায়ানাত কা ইলমী জায়েযা’-এ দেখা যেতে পারে।

এইসব হালাত দারুল উলূম দেওবন্দের সামনে আছে। এজন্য দারুল উলূম এই ‘জরুরী ওয়াযাহাত’-এ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে সতর্ক করেছেন যা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। দারুল উলূম দেওবন্দ লিখেছে-

لیکن  دار العلوم کے موقف میں اصلا مولانا کی جس فکری بے راہ روی پر تشویش کا اظہار کیا گیا تھا، اس سے صرف نظر نہیں کیا جاسکتا؛  اس  لئے کہ کئی بار رجوع کے بعد بھی وقتا فوقتا مولانا کے ایسے نئے بیانات موصول ہو رہے ہیں، جن میں وہی مجتہدانہ انداز، غلط استدلالات اور دعوت سے متعلق اپنی ایک مخصوص فکر پر نصوص شرعیہ کا غلط انطباق نمایاں ہے، جس کی وجہ سے خدام دار العلوم ہی نہیں؛ بلکہ دیگر علمائے حق کو بھی مولانا کی مجموعی فکر سے سخت قسم کی بے اطمینانی ہے۔

 

তরজমা : ...কিন্তু দারুল উলূম দেওবন্দের মাওকিফে মূলত মাওলানার চিন্তাগত যে বিপথগামিতার ব্যাপারে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হয়েছিল তা উপেক্ষা করা যায় না। কারণ কয়েকবার রুজু করার পরও বিভিন্ন সময় মাওলানার এমন সব নতুন নতুন বয়ান পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে তার সেই মুজতাহিদসুলভ উপস্থাপন, দলীল-প্রমাণের ভুল প্রয়োগ এবং দাওয়াত সম্পর্কে তার নিজস্ব বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি প্রমাণের জন্য শরয়ী নুসূসের অপপ্রয়োগের বিষয়গুলো স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে। যার কারণে শুধু দারুল উলূমের যিম্মাদারগণই নন, অন্যান্য হক্কানী উলামায়ে কেরামেরও মাওলানার সামগ্রিক ফিকিরের ব্যাপারে কঠিন ধরনের অনাস্থা রয়েছে।

দারুল উলূমের এই বক্তব্যে উল্লেখিত ‘ফিকরী বে-রাহরাবী’ (চিন্তাগত বিপথগামিতা) শব্দটি খুবই অর্থবহ। উদ্দেশ্য হল, কেবল দুয়েকটি ভুলের মধ্যে তার কথাবার্তা সীমাবদ্ধ নয় যে, সেগুলো থেকে উনি রুজু করে ফেললেন, আর বিষয়টা সমাধান হয়ে গেল। এখানে বিষয় হল তার মেযাজ ও দৃষ্টিভঙ্গির। তার মেযাজই পরিবর্তন হয়ে গেছে। তার দৃষ্টিভঙ্গিই ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। এজন্য কেবল খণ্ডিত কোনো রুজুর বিশেষ কোনো ফায়েদা নেই। প্রয়োজন হল, সালাফে সালিহীনের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির সাথে নিজের মেযাজকে মিলিয়ে নেওয়া। এটা যদি হয়ে যায় তাহলে একবারের রুজুই নির্ভরযোগ্য এবং আস্থাযোগ্য সাব্যস্ত হবে। আর যদি এটা না হয় তাহলে বারবার রুজু করলেও আস্থা অর্জন হবে না। তাছাড়া স্পষ্ট কথা যে, বারবার রুজু করার প্রয়োজন দেখা দেওয়া মূলত রুজুর প্রাণকেই খতম করে দেয়।

যাইহোক, দারুল উলূমের বে-ইতমিনানীর বাস্তবতা ও সত্যতা এখন দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। দারুল উলূম দেওবন্দের এই ‘জরুরি ওয়াযাহাত’ ৩১ জানুয়ারি ২০১৮ ঈসায়ী তারিখে স্বাক্ষরিত। এই তারিখের পর থেকে আজ পর্যন্ত হযরত মাওলানা সা‘দ সাহেবের হিন্দুস্তান ও হিন্দুস্তানের বাইরের বয়ানগুলোতে স্পষ্ট  যেসব ভয়ংকর ভুল প্রকাশ পেয়েছে সচেতন উলামায়ে কেরাম যদি সেগুলো শোনেন হয়রান হয়ে যাবেন।

আল্লাহ তাআলা তাঁকে সঠিক চিন্তা ও ভারসাম্যপূর্ণ মেযাজ দান করুন। তাঁকে সালাফে সালিহীন এবং তার পূর্ববর্তী সালিহ ও মুসলিহ মনীষীদের মত ও পথের উপর কায়েম ও দায়েম থাকার তাওফীক নসীব করুন- আমীন।

 

***

 

[আলহামদু লিল্লাহ, বয়ান সমাপ্ত হল। মাওলানা সা‘দ সাহেব হাফিযাহুল্লাহ-এর সব ভ্রান্তির আলোচনা এ বয়ানে আসেনি। প্রশ্নোত্তরের পর্ব সমাপ্ত হওয়ার পর প্রয়োজন হলে সেগুলো নিয়ে ভিন্ন কোনো লেখা হতে পারে।

প্রশ্নোত্তরের প্রথম পর্ব এই সংখ্যায় ‘একটি মুযাকারা মজলিস : কিছু জিজ্ঞাসা ও জবাব’ শিরোনামে পেশ করা হল। -সহ সম্পাদক]

 

 

advertisement