রবিউল আউয়াল ১৪৪০   ||   ডিসেম্বর ২০১৮

প্রতিবেশী : রাহুগ্রস্ত জাতি

আব্দুল্লাহ মুযাক্কির

পেশিশক্তির দ্বারা যে সত্য ও বাস্তবতাকে চাপা দেওয়া যায় না, তার একটি ছোট্ট উদাহরণ দেখা গেল উত্তর প্রদেশের এক মন্ত্রীর সাম্প্রতিক একটি উক্তিতে। ওই মন্ত্রীর নাম ওমপ্রকাশ রাজবর। তিনি ইউপির মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্য নাথের মন্ত্রীসভার একজন সদস্য। রাজবর বলেছেন, ‘মুসলিমরা আমাদের দেশে যা দিয়েছে তা অন্য কেউ দেয়নি’।

মুঘল আমলের স্মৃতি মুছে ফেলার সাম্প্রতিক প্রয়াস সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘আমরা কি জিটি রোড ছুড়ে ফেলে দেব? লালকেল্লা কে বানিয়েছে? তাজমহল  কে বানিয়েছে?’

মন্ত্রী রাজবর এই কথাগুলো এমন এক সময় বললেন, যখন উত্তর প্রদেশে যোগী আদিত্য নাথের নেতৃত্বে চলছে প্রদেশ জুড়ে নাম পরিবর্তনের উৎসব। যোগীর বিতর্কিত কর্মকা-ে ক্ষুব্ধ তারই মন্ত্রীসভার এই মন্ত্রী। এই ক্ষুব্ধতা থেকে তিনি যে সত্যটি উচ্চারণ করেছেন তা এক ঐতিহাসিক সত্য। মন্ত্রী তার বক্তব্যের পক্ষে নজির হিসেবে তুলে ধরেছেন জিটি রোড, লালকেল্লা ও তাজমহলকে। নিঃসন্দেহে এগুলো ভারতবর্ষে মুসলিম-শাসনামলের কিছু নিদর্শন, যা এখনো ভারতবাসীর আগ্রহের বস্তু।

কে না জানে যে, ভারতবর্ষে মুসলমানদের আগমন ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির মতো ছিল না। ইংরেজ  বেনিয়ারা কখনো ভারতবর্ষকে নিজেদের ভূমি মনে করেনি। তারা এসেছিল ভারতবর্ষকে শোষণ করার জন্য । তারা তা করেছেও; ভারতবর্ষের সম্পদ শুষে নিয়ে তারা তাদের আদি ও আসল ভূখ-কেই সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু মুসলিমরা ভারতবর্ষকেই গ্রহণ করেছিলেন তাদের আবাস ভূমি হিসেবে। কারণ তারা ছিলেন ‘রাব্বুুকুমুল্লাহ ওয়া আবূ-কুম আদাম’-এর শিক্ষাপ্রাপ্ত। ‘তোমাদের রব আল্লাহ আর তোমাদের বাবা আদম’- এই চেতনায় উজ্জীবিত মুসলমানদের কাছে তাই গোটা বিশ্বই নিজেদের ভূমি। সমগ্র মানবতাই তাদের পরিবার। তাই ভারতবর্ষের ও ভারতীয় জাতির উন্নয়নে তারা কোনো কসুর করেননি। তাদের শিল্প-মানসের দৃষ্টান্তসমূহও শোভা পাচ্ছে ভারতবর্ষের বুকেই। এখানেই তারা বসবাস করেছেন এবং এখানেই সমাহিত হয়েছেন। তাই বর্তমান ভারতীয় সভ্যতার বিনির্মাণে তাদের অশেষ অবদানকে চাপা দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

মন্ত্রী ওমপ্রকাশ যে দু-তিনটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন এরকম দৃষ্টান্ত গোটা ভারতে আরো আছে। তবে এইসবের সাথে এমন একটি দৃষ্টান্তও গোটা ভারত জুড়ে রয়েছে, যা সাধারণত আলোচনায় আসে না। সেটি হচ্ছে স্বয়ং হিন্দু সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব। আট শত বছর ভারতবর্ষে মুসলিমশাসনের পরেও ভারতের কোটি কোটি হিন্দুর অস্তিত্ব কী প্রমাণ করছে, তা কি যোগী আদিত্য নাথের মত ব্যক্তিরা চিন্তা করেছেন? তারা তো ক্ষমতায় এলেন এই মাত্র সেদিন। ক্ষমতায় এসেই গোটা ভারত থেকে মুসলমানদের নাম-নিশানা মুছে ফেলার যে দিবাস্বপ্ন  দেখবার ও দেখাবার চেষ্টায় তারা লিপ্ত হয়েছেন, এর সাথে কি এই কথাটা তারা ভেবে দেখেছেন, এই পন্থাটা যদি মুসলিমেরা তাদের  আট শত বছরের শাসনামলে অনুসরণ করতেন তাহলে আজ ভারতের হিন্দু-মুসলিম অনুপাত কী হতো? স্বয়ং যোগী আদিত্য নাথের সত্তাও কি মুসলিম শাসনামলের উদারতার ঋণে ঋণী নয়?

আমরা মনে করি, ভারতবর্ষের মুসলিম শাসনামলের বড় দৃষ্টান্ত হচ্ছে ভারতজুড়ে বসবাসকারী কোটি কোটি হিন্দু। যোগী আদিত্য নাথ কি পারবেন এই দৃষ্টান্তটি ভারতের বুক থেকে মুছে ফেলতে?

মন্ত্রী ওমপ্রকাশ রাজবর আরেকটি ঠিক কথাও বলেছেন। তিনি বলেন, ‘অনগ্রসর ও পিছিয়ে থাকা মানুষ যাতে উন্নয়নের দাবিতে আওয়াজ তুলতে না পারে সেই কারণেই শহরের নাম বদল করছে বিজেপি। একমাত্র এই উপায়েই মানুষকে মূল সমস্যা থেকে ভুলিয়ে রাখা যায়।’

তিনি নিজেও একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়ায় সমকালীন রাজনীতির গলি পথগুলো সম্পর্কে তারও খুব ভালো জানা আছে। মানুষের মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধান না করেও ক্ষমতা ধরে রাখার প্রচলিত ও রাজনীতিকদের কাছে অতি উপাদেয় উপায়টি তিনি এখানে উল্লেখ করেছেন, যার সারমর্ম হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের বিস্তার এবং সাম্প্রদায়িক জাতিগোষ্ঠীর জিঘাংসা চরিতার্থ করার সুযোগ প্রদান। মানুষের মৌলিক সমস্যা- ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, নৈতিক অবক্ষয় প্রভৃতির সমাধানের পরিবর্তে যখন কোনো শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতার স্বার্থে উগ্র-জনতার পাশবিকতা চরিতার্থ করার সুযোগ করে দেয় তখন বুঝতে হবে- এই জাতি রাহুগ্রাসে পতিত হয়েছে।

একটি জাতির এক অনিবার্য প্রয়োজনের নাম নেতৃত্ব। কিন্তু কোন্ নেতৃত্ব? কল্যাণ নেতৃত্ব। যে নেতৃত্ব জাতির প্রয়োজনসমূহ পূরণে এবং সমস্যাসমূহের সমাধানে সচেষ্ট হবে। জাতির জাগতিক প্রয়োজন পূরণের পাশাপাশি তার নৈতিকতার নির্মাণ ও বিকাশে তৎপর হবে। শিষ্টের লালন ও দুষ্টের দমনে সক্ষম হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে কোনো জাতি যখন এ ধরনের নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয় তখন তারা ব্যাপক শাস্তি রূপে অশান্তি-অবক্ষয়ের শিকার হয়ে পড়ে।

আজ দেশে দেশে ন্যায়নিষ্ঠ সাহসী নেতৃত্বের ভয়াবহ সংকট শুধু জনগণই উপলব্ধি করছেন না, নেতৃত্বে থাকা লোকেরাও উপলব্ধি করছেন। বিজেপির মন্ত্রী ওমপ্রকাশ রাজবরের উক্তিটি সম্ভবত সেই উপলব্ধিরই অতি সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত।

 

 

advertisement