আল্লাহর রাস্তায় মৃত্যু!
হযরতপুরের বৌনাকান্দিতে মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা-এর প্রধান প্রাঙ্গণটি হওয়ার আগে দীর্ঘদিন পর্যন্ত মারকাযের সব বিভাগের কার্যক্রম পল্লবীর ভবনে পরিচালিত হত। ঐ সময় আমি পরিবার নিয়ে ইস্টার্ন হাউজিংয়ের সি-১৬০ নম্বর বাসায় ভাড়া থাকতাম। ২০০৫ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত প্রায় ৭ বছর বসবাসের সুবাদে বাড়িওয়ালা ও তাঁর পরিবার-পরিজনের সাথে আমাদের একটা গভীর মহব্বতের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বাড়িওয়ালা ইঞ্জিনিয়ার হোসাইন আহমাদ সাহেব শিক্ষা-দীক্ষায় একজন ইঞ্জিনিয়ার হলেও দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনতের বদৌলতে মোটামুটি দ্বীনদার ও সুন্নতী বেশ-ভূষার অধিকারী ছিলেন। মানুষ হিসেবেও ছিলেন সহজ-সরল ভালো মানুষ। গত ২৫. ১১. ২০১৮ রবিবার দিবাগত রাতে হঠাৎ সংবাদ পেলাম, তাঁর ইন্তিকাল হয়ে গেছে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে জান্নাত নসীব করুন। তাঁর পরিবার-পরিজনকে সবরে জামীলের তাওফীক নসীব করুন। পাঠকবৃন্দের কাছেও তাঁর জন্য মাগফিরাতের দুআ কামনা করছি।
তাঁর একটি বিশেষ গুণ ছিল জামাতে নামাযের পাবন্দী। বিশেষ কোনো ওজর না হলে সাধারণত ইস্টার্ন হাউজিং মসজিদেই নামায আদায় করতেন। ঐ মসজিদ ও মসজিদ-সংলগ্ন মাদরাসার ব্যবস্থাপনাগত খেদমতের সাথেও তিনি জড়িত ছিলেন। তাঁর ইন্তিকালও হয়েছে মসজিদে। ইশার নামায পড়তে গিয়েছিলেন। জামাতের সাথে নামায আদায় করে তালীমে বসা ছিলেন। এ অবস্থাতেই পাশের একজনের কাঁধে ঢলে পড়েন। ঐ ব্যক্তির বক্তব্য অনুসারে, তার কাঁধের উপরই কালেমা পড়তে পড়তে ইন্তিকাল হয়ে যায়। সুবহানাল্লাহ! জামাতে নামায পড়তে ঘর থেকে বের হয়ে আর ঘরে ফেরেননি। আল্লাহর রাস্তাতেই তাঁর মৃত্যু হয়ে গেল!
যে কোনো মহব্বতের মানুষের মৃত্যুই বেদনার। আর যে কোনো মৃত্যুই স্মরণ করিয়ে দেয় মৃত্যু-পরবর্তী মঞ্জিলসমূহের কথা, যা মুমিনমাত্রকেই শিহরিত করে তোলে। এই সব কিছুর সাথে সুন্দর মৃত্যুর দৃষ্টান্তসমূহ মনে যে অনির্বচনীয় আনন্দ ও প্রশান্তি এনে দেয় তার কোনো তুলনা নেই।
আল্লাহর রাস্তায় মৃত্যু কথাটি বিভিন্ন সময় মনে জাগে, কিন্তু সেই সুন্দর মৃত্যুর এত সহজ-স্বাভাবিক রূপটি যে-ই শুনবে তার মনেই একটু হলেও ঈর্ষা না জেগে পারে না। এরকম মৃত্যুর আরেকটি দৃষ্টান্তের কথাও শুনেছিলাম মাদানী নগর (বাঘমারা) বাইতুন নুর মসজিদের এক মুসল্লীর ব্যাপারে। তার ইন্তিকাল হয়েছিল সিজদার হালতে। সুবহানাল্লাহ!
মসজিদের সাথে মুমিনের সম্পর্ক হৃদয় ও আত্মার। হাদীস শরীফে তো ঐ মুমিন সম্পর্কে কিয়ামতের দিন আল্লাহর বিশেষ ছায়ায় স্থান পাওয়ার সুসংবাদ রয়েছে, যার অন্তর মসজিদের সাথে যুক্ত থাকে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।
জীবনের শেষ দিনগুলোতে তাঁর একটি সুন্দর মগ্নতা ছিল। আমরা যখন মিরপুর থেকে বৌনাকান্দি চলে আসি তখনও দুই পরিবারের মধ্যে একটি মহব্বতের সম্পর্ক ছিল। আমরাও ওই বাসায় বেড়াতে যেতাম, তাঁরাও আমাদের বাসায় বেড়াতে আসতেন। মরহুমের একটি আগ্রহের বিষয় ছিল কুরআন ও বিজ্ঞান। বিভিন্ন সময় এ বিষয়ে আমার সাথে কিছু আলোচনাও করেছিলেন। একবার আমি তাকে বললাম, ‘আপনি এ কথাগুলো সুন্দর করে লিখুন। এরপর কোনো বিজ্ঞ আলিম যদি সম্পাদনা করে দেন তাহলে একটি ভালো জিনিস হতে পারে।’ এরপর থেকে তিনি লেখায় মগ্ন হয়ে পড়েন। মাঝে মাঝেই আমাকে বলতেন, ‘আপনার কথামতো আমি লেখা শুরু করেছি আপনাকেই তা দেখে দিতে হবে। এই লেখাগুলো ঠিক আছে কি না, আখিরাতের ফায়েদার জিনিস হচ্ছে কি না- সেটা আমার জানার দরকার। বিজ্ঞানের বিষয়গুলো আমার জানাশোনা আছে, কিন্তু কুরআনের সাথে এর সম্পর্ক ঠিক আছে কি না তা আমার জানা দরকার।’
গত শুক্রবারও জুমার পর মিরপুর হয়ে আসার সময় তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে। সেই সময় বলেছেন, ‘হুজুর, আমি কুরআন ও বিজ্ঞানের উপর লেখাটি শেষ করেছি। কুরআনে তো বিজ্ঞানের কথা খুব পরিষ্কার। এটা লেখার সময় আমার মনের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ঈমান অনেক বেড়ে গেছে আমি আপনার বাসায় আসব। আমাকে আপনার সময় দেিতই হবে।’ লেখাটির শিরোনামগুলোও একটি কাগজে লিখে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন।
এই দিনের মুলাকাতই ছিল তাঁর সাথে আমার শেষ মুলাকাত। এর দু’দিন পর তাঁর ইন্তিকালের সংবাদ পেলাম।
আল্লাহ তাআলা তাঁর ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে দিন এবং তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন। তাঁর আহলিয়া মুহতারামা, সন্তান-সন্ততি ও স্বজন-প্রিয়জনদের সকলকে সবর করার তাওফীক দান করুন এবং দ্বীন ও ঈমানের পথে অটল-অবিচল রাখুন- আমীন।