রবিউল আউয়াল ১৪৪০   ||   ডিসেম্বর ২০১৮

হাদীস শরীফে নফল রোযা : কিছু ফযীলত ও আদব

মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ

ইসলামে ইবাদতের গুরুত্ব অনেক। ঈমানের পরই ইবাদতের স্থান। ইসলাম যেহেতু আসমানী দ্বীন, মানবজাতির জন্য আসমানী নির্দেশনা, একারণে তার অনেক বৈশিষ্ট্যের একটি হচ্ছে পূর্ণাঙ্গতা। ইসলাম যেমন মানুষের হক সম্পর্কে নির্দেশনা দান করেছে তেমনি দান করেছে আল্লাহর হক সম্পর্কে। শুধু নির্দেশনাই নয়, মানুষের হক ও আল্লাহর হকের বিস্তারিত বর্ণনাও দান করেছে। শুধু বর্ণনাই নয় সেই হক আদায়ের পন্থা ও পদ্ধতিও নির্দেশ করেছে।

বস্তুর মোহে আক্রান্ত মানবজাতিকে আল্লাহর হক সম্পর্কে এবং সেই হক আদায়ের সঠিক পন্থা সম্পর্কে ইসলামই সচেতন করে, যা পূরণ করার মাধ্যমে আল্লাহর বান্দা আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সক্ষম হয়।

এক অর্থে ইসলামের সকল বিধান পালন করা আল্লাহর হক। আল্লাহর আদেশ পালন বান্দার অপরিহার্য কর্তব্য। সেই সকল আদেশের মধ্যে যেমন রয়েছে ঈমান ও ইবাদত তেমনি রয়েছে মানুষের পারস্পরিক হক সংক্রান্ত বিধি-বিধান। এই উভয় প্রকারের বিধান পালন বান্দার উপর আল্লাহর হক হলেও বিশেষ তাৎপর্যের কারণে ঈমান, তাওহীদ, ইবাদত-বন্দেগীকে আল্লাহর হক শিরোনামে আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়।

ইসলামে ইবাদতের স্থান অতি উচ্চে। সহীহ বুখারীর বিখ্যাত হাদীসে ইসলামের যে পাঁচটি স্তম্ভের কথা বলা হয়েছে তন্মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে ঈমান আর পরের চারটি হচ্ছে চার ফরয ইবাদত- সালাত, যাকাত, সওম ও হজ¦। কাজেই ইবাদত-বন্দেগীর বিষয়ে যত্নবান হওয়া দ্বীনের অন্যতম মৌলিক চাহিদা।

ইবাদত-বন্দেগীর মধ্যেও দুটি প্রকার রয়েছে : এক. যা অবশ্য-পালনীয় আর দুই. যা ঐচ্ছিক। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অবশ্য-পালনীয় ইবাদতসমূহের গুরুত্ব ঐচ্ছিক ইবাদতসমূহের চেয়ে বেশি। হাদীস শরীফে পরিষ্কার বর্ণিত হয়েছে, ‘বান্দা আল্লাহ তাআলার সবচেয়ে বেশি নৈকট্য অর্জন করে ফরয ইবাদতের মাধ্যমে।’

তবে নফল ও ঐচ্ছিক ইবাদতের ফযীলতও এত বেশি যে, তা মুমিনকে উদ্দীপ্ত ও আগ্রহী করে তোলে। বর্তমান নিবন্ধে আমরা শুধু একটি ইবাদত- নফল রোযা সম্পর্কে কিছু আলোচনা করব।

হাদীস শরীফে নফল রোযার অনেক প্রকার ও অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও নফল রোযা রেখেছেন, উম্মতকেও এর ফযীলত শুনিয়েছেন। এখানে কিছু নফল রোযার বৃত্তান্ত তুলে ধরছি, যাতে যার পক্ষে যেটি সহজ হয়, আমল করতে পারেন।

 

১. শাওয়ালের ছয় রোযা।

হযরত আবু আইয়ূব আনসারী রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَنْ صَامَ رَمَضَانَ ثُمّ أَتْبَعَهُ سِتّا مِنْ شَوّالٍ، كَانَ كَصِيَامِ الدّهْرِ.

যে মাহে রমযানের রোযা রাখল এরপর শাওয়ালে ছয়টি রোযা রাখল এটি তার জন্য সারা বছর রোযা রাখার সমতুল্য হবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬৪

সহীহ মুসলিমের ভাষ্যকার ইমাম নববী রাহ. এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘আমাদের মনীষীদের মতে, উত্তম হচ্ছে ঈদুল ফিতরের পরের ছয় দিন পরপর রোযাগুলো রাখা। তবে যদি বিরতি দিয়ে দিয়ে রাখে বা মাসের শেষে রাখে তাহলেও ‘রমাযানের পরে’ রোযা রাখার ফযীলত পাওয়া যাবে। কারণ সব ছুরতেই বলা যায়, ‘রমযানের পরে শাওয়ালের ছয় রোযা রেখেছে।’ -শরহু সহীহ মুসলিম, নববী

 

২. যিলহজে¦র নয় দিনের রোযা, বিশেষত ইয়াওমে আরাফা বা নয় তারিখের রোযা

যিলহজে¦র নয় দিনের রোযার বিষয়ে হাদীস শরীফে এসেছে-

كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَصُومُ تِسْعَ ذِي الْحِجّةِ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিলহজে¦র নয় দিন রোযা রাখতেন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৪৩৭

আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ، إِنِّي أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السّنَةَ الّتِي قَبْلَهُ وَالسّنَةَ الّتِي بَعْدَهُ.

আরাফার দিনের রোযার বিষয়ে আমি আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা করি যে, (এর দ্বারা) বিগত বছরের এবং তার পরের বছরের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৪৯

সহীহ মুসলিমে হযরত আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত দীর্ঘ হাদীসেও এই ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। (দ্রষ্টব্য : সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬২)

 

৩. মুহাররম ও আশুরার রোযা

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

أَفْضَلُ الصِّيَامِ، بَعْدَ رَمَضَانَ، شَهْرُ اللهِ الْمُحَرّمُ، وَأَفْضَلُ الصّلَاةِ، بَعْدَ الْفَرِيضَةِ، صَلَاةُ اللّيْلِ.

রমযানের পর উত্তম রোযা হচ্ছে আল্লাহর মাস মুহাররমের রোযা। আর ফরয নামাযের পর উত্তম নামায হচ্ছে রাতের নামায। -সহীহ মুসলিম, হাদীস  ১১৬৩

হযরত আবু কাতাদা আনসারী রা. থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীসে আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আশুরার রোযা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছেন-

يُكَفِّرُ السّنَةَ الْمَاضِيَةَ.

এই রোযা বিগত বছরের কাফফারা হয়ে যায়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬২

আশুরার রোযার বিষয়ে উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা. বলেন-

كَانَتْ قُرَيْشٌ تَصُومُ عَاشُورَاءَ فِي الْجَاهِلِيّةِ، وَكَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَصُومُهُ، فَلَمّا هَاجَرَ إِلَى الْمَدِينَةِ، صَامَهُ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ، فَلَمّا فُرِضَ شَهْرُ رَمَضَانَ قَالَ: مَنْ شَاءَ صَامَهُ وَمَنْ شَاءَ تَرَكَهُ.

কুরাইশের লোকেরা জাহেলী যুগেও আশুরার রোযা রাখত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও রাখতেন। এরপর যখন হিজরত করে মদীনায় এলেন, তখন নিজেও এই রোযা রাখলেন অন্যদেরও রাখার আদেশ দিলেন। এরপর যখন রমযানের রোযা ফরয হল তখন বললেন-

مَنْ شَاءَ صَامَهُ وَمَنْ شَاءَ تَرَكَهُ

যার ইচ্ছে সে তা (আশুরার রোযা) রাখতে পারে, যার ইচ্ছে না-ও রাখতে পারে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৫২; সহীহ বুখারী, হাদীস ২০০২

৪. শা‘বান মাসে নফল রোযা

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন-

كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ  يَصُومُ حَتّى نَقُولَ: لاَ يُفْطِرُ، وَيُفْطِرُ حَتّى نَقُولَ: لاَ يَصُومُ، فَمَا رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ اسْتَكْمَلَ صِيَامَ شَهْرٍ إِلّا رَمَضَانَ، وَمَا رَأَيْتُهُ أَكْثَرَ صِيَامًا مِنْهُ فِي شَعْبَانَ.

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (অবিরাম) রোযা রাখতেন, যার কারণে আমরা বলতাম, আর বাদ দিবেন না। আবার (অবিরাম) রোযাহীনও থাকতেন, যার কারণে আমরা বলতাম, আর রাখবেন না। আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমযান ছাড়া অন্য কোনো মাসে পুরো মাস রোযা রাখতে দেখিনি। তেমনি দেখিনি শা‘বানের চেয়ে বেশি অন্য কোনো মাসে রোযা রাখতে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯৬৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৫৬

 

৫. সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখা

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেছেন-

كَانَ النبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَتَحَرّى صَوْمَ الِاثْنَيْنِ وَالخَمِيسِ.

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোমবার ও বৃহস্পতিবারে রোযা রাখার ইহতিমাম করতেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৪৫

হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

تُعْرَضُ الأَعْمَالُ يَوْمَ الِاثْنَيْنِ وَالخَمِيسِ، فَأُحِبّ أَنْ يُعْرَضَ عَمَلِي وَأَنَا صَائِمٌ.

সোমবার ও বৃহস্পতিবার আমলসমূহ পেশ করা হয়। তো আমার পছন্দ, আমার আমল যেন পেশ করা হয় আমি রোযাদার অবস্থায় । -জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৪৭

 

৬. মাসে তিন রোযা

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

شَهْرُ الصَبْرِ، وَثَلَاثَةُ أَيّامٍ مِنْ كُلِّ شَهْرٍ صَوْمُ الدّهْرِ.

সবরের মাস (রমযান) ও প্রতি মাসে তিন দিন সারা বছর রোযার সমতুল্য। -সুনানে নাসায়ী ৪/২১৮, হাদীস ২৪০৮; মুসনাদে আহমাদ ২/২৬৩, হাদীস ৭৫৭৭

হযরত আবু যর গিফারী রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

إِذَا صُمْتَ مِنْ شَهْرٍ ثَلَاثًا، فَصُمْ ثَلَاثَ عَشْرَةَ، وَأَرْبَعَ عَشْرَةَ، وَخَمْسَ عَشْرَة.

তুমি যদি মাসে তিন দিন রোযা রাখ তাহলে  তের তারিখ, চৌদ্দ তারিখ ও পনের তারিখ রোযা রেখো। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২১৪৩৭; জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৬১; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ২৪২৪

ইবনে মাজাহর বর্ণনায় আছে-

فَأَنْزَلَ اللهُ عَزّ وَجَلّ تَصْدِيقَ ذَلِكَ فِي كِتَابِهِ: مَنْ جَاءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا فَالْيَوْم بِعَشْرَةِ أَيّامٍ.

অর্থাৎ আল্লাহর কিতাবে এর সমর্থন রয়েছে, যে নেক কাজ করবে সে তার দশ গুণ পাবে। তো এক দিন সমান সমান দশ দিন। (দ্র. সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৭০৮)

 

৭. এক দিন পর পর রোযা

এই সওমকে হাদীস শরীফে ‘সওমে দাউদ’ বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা.-এর একটি চমৎকার ঘটনা হাদীসের কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। ঘটনাটি একদিকে যেমন ইসলামী শিক্ষার ব্যাপ্তি, সহজতা ও স্বাভাবিকতার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, তেমনি সাহাবায়ে কেরামের ইবাদত-প্রিয়তা ও আখিরাতমুখিতারও এক অনুপম নমুনা।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. তাঁর নিজের ঘটনা বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে এলেন এবং বললেন, আমি কি শুনিনি যে, তুমি রাতভর নামায পড় আর দিনে রোযা রাখ? আমি বললাম, জী হাঁ! তিনি বললেন, এমনটা করো না। (নামাযে) দাঁড়াবে এবং ঘুমাবে, রোযা রাখবে এবং রোযা ছাড়াও থাকবে। কারণ তোমার শরীরেরও তোমার উপর হক আছে, তোমার চোখেরও তোমার উপর হক আছে, তোমার অভ্যাগতেরও তোমার উপর হক আছে এবং তোমার স্ত্রীরও তোমার উপর হক আছে। আর সম্ভবত তোমার আয়ু দীর্ঘ হবে। তোমার পক্ষে এ-ই যথেষ্ট যে, প্রতি মাসে তিন দিন রোযা রাখবে, কারণ প্রত্যেক নেক আমলের পরিবর্তে আছে তার দশ গুণ। ফলে এটিই সারা বছরের রোযা হবে। তিনি বলেন, কিন্তু আমি কাঠিন্য অন্বেষণ করলাম, ফলে আমার উপরও কাঠিন্য বর্তাল। আমি বললাম, আমি  তো এতদ্ভিন্নেরও সামর্থ্য রাখি। তিনি বললেন, তাহলে প্রতি সপ্তাহে তিন রোযা রাখ। আমি আরো কাঠিন্য অন্বেষণ করলাম, ফলে আমার উপর আরো কাঠিন্য বর্তাল। আমি বললাম, আমি  তো এতদ্ভিন্নের সামর্থ্য রাখি। তিনি বললেন, তাহলে আল্লাহর নবী দাউদের (আলাইহি ওয়া আলা নাবিয়্যিনাস সালাতু ওয়াস সালাম) রোযা রাখ। আমি বললাম, আল্লাহর নবী দাউদের রোযা কী? তিনি বললেন, ‘নিসফুদ দাহর’। (অর্থাৎ একদিন পর একদিন রোযা রাখা।) -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬১৩৪

সহীহ বুখারীরই অন্য রেওয়ায়েতে আছে, আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. যখন বৃদ্ধ হলেন তখন বলতেন-

يَا لَيْتَنِي قَبِلْتُ رُخْصَةَ النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ.

হায়! যদি আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রুখসত গ্রহণ করতাম। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯৭৫

এই হাদীস শরীফে যেমন এক দিন পর এক দিন- এভাবে রোযা রাখার নিয়মটি পাওয়া যায় তেমনি অন্যান্য হক ও করণীয় সম্পর্কে সচেতনতার বিষয়টিও পাওয়া যায়। সকল বিষয়ে ভারসাম্য রক্ষা করে চলা কাম্য।

শারীরিক সুস্থতার দিকে মনোযোগী হওয়ার শিক্ষাও এই হাদীসের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। যখন নফল ইবাদতের ক্ষেত্রে শারীরিক সুস্থতা ও কর্মক্ষমতা রক্ষার নীতি অনুসরণীয় তাহলে অন্যায় ও গর্হিত কাজের মাধ্যমে সুস্থতা বিনষ্ট করার হুকুম কী হতে পারে তা খুব সহজেই অনুমেয়।

শারীরিক শক্তিও আল্লাহ তাআলার নিআমত এবং তা দুনিয়াতে মানুষকে অফুরন্ত পরিমাণে দেওয়া হয়নি। কাজেই এই নিআমতের ব্যাপারেও মানুষকে হিসেবী ও দায়িত্বশীল হতে হবে। একে সৎকর্মে ব্যয় করতে হবে এবং এর যত্ন নিতে হবে, যাতে যথাসম্ভব বেশি নেক আমলে একে ব্যয় করা যায়।

এই হাদীসে স্ত্রী-সন্তান ও অতিথি-অভ্যাগতদের হকের কথাও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদেরকেও সঠিক পন্থায় সময় দিতে হবে এবং তাদের হক আদায় করতে হবে।

এই হাদীসে দ্বীনী তা‘লীম-তারবিয়াতের ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মোবারক নীতিরও একটি দৃষ্টান্ত রয়েছে। তিনি উম্মতকে ভারসাম্য রক্ষার বিষয়ে সচেতন করেছেন। কোনো একটি দিক বা একটি বিষয় যেন অন্য সকল দিক বা বিষয়ের উপর এমনভাবে প্রাধান্য বিস্তার না করে যে, অন্য বিষয়গুলো অবহেলিত হয়ে পড়ে- এটা  খেয়াল রাখতে হবে। তেমনি অবকাশের বা ঐচ্ছিক ক্ষেত্রগুলোতে সহজ পন্থা অবলম্বনও হাদীস ও সুন্নাহর একটি মৌলিক শিক্ষা। এই নীতি নিজের ক্ষেত্রে এবং অধীনস্তদের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা কাম্য।

নফল রোযার বিভিন্ন প্রকার ও তার ফযীলত সংক্রান্ত আলোচনাটি ইমাম আবু বকর আলআছরাম রাহ.-এর একটি বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শেষ করতে চাই, যার মাধ্যমে নফল রোযাসমূহের বিভিন্ন প্রকারের তাৎপর্য যেমন বোঝা যাবে তেমনি নফল ও ফরযের মধ্যে একটি তুলনাও বোঝা যাবে, যা ভারসাম্যপূর্ণ চিন্তা ও আচরণের জন্য খুবই প্রয়োজন। আর যা শুধু নফল রোযা নয়, যে কোনো নফল ইবাদতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

বিভিন্ন প্রকারের নফল রোযা যেমন, মাসে তিন দিন রোযা, আইয়ামে বীযের রোযা, শা‘বান মাসের রোযা ইত্যাদি বর্ণনার পর তিনি লেখেন-

وذلك أن أصل الفرض إنما هو الشهر المبارك الذي افترضه الله عز وجل، وأجمع أهل الإسلام على صومه، وكانت الفسحة فيما بعده للأمة، وكان الصوم بعده تطوعاً، وكانت الفضائل في بعضه أكثر منها في بعض، وكان من شاء استكثر من تلك الفضائل، ومن شاء استقل، ومن شاء تركها إلى غير حرج.

أما سمعت حديث طلحة بن عبيد الله في قول الأعرابي للنبي صلى الله عليه وسلم حين سأله عن الصوم فذكر شهر رمضان، فقال: هل علي غيره، قال: لا، إلا أن تطوع ثم قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: لئن صدق ليدخلن الجنة وذلك عند قوله: والذي بعثك بالحق لا أزيد على هذا شيئاً ولا أنتقص منه.

ومثل حديث النبي صلى الله عليه وسلم في الرجل الذي قال: إني لأبغض فلاناً، فكان مما احتج به عليه: أنه لا يصوم إلا شهر رمضان، فقال النبي صلى الله عليه وسلم: قم، إن أدري لعله خيرٌ منك.

في أشباهٍ لهذا كثيرة.

وإنما يرى أنه كره أن يجعل شيئاً من هذه الفضائل في الصوم معلومة فيلم بها الناس، فتكون كالشيء المفترض عليهم، فأخذ ببعضها في وقت، وأخذ ببعضها في آخر، وذكر لكل شيء فضيلة؛ لئلا يلزم شيء واحد بعينه كأنه لا يجوز غيره، فيكون بمنزلة [ .. ... ] الواجب، ففي صوم ثلاثٍ من كل شهر فضلٌ، فإن تعمد به البيض كان أفضل، وإن صامهن في غير البيض فقد أخذ بفضلٍ دون فضل، وكذلك سائر ما ذكرناه.

অর্থাৎ, এ বিষয়ে বাহ্যত বিভিন্ন ধরনের বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে। মূল ব্যাপারটি হচ্ছে, এক্ষেত্রে ফরয হচ্ছে শুধু মাহে রমযানের রোযা। এই রোযার বিষয়ে গোটা মুসলিম উম্মাহ একমত। এই ফরয রোযার পর অন্যান্য রোযা ঐচ্ছিক, যাতে উম্মাহর জন্য অবকাশ রয়েছে এবং এই রোযাগুলোর মধ্যে ফযীলতের তারতম্যও রয়েছে। কাজেই যার ইচ্ছা ঐ ফযীলত বেশি অর্জন করবে, যার ইচ্ছা কম অর্জন করবে। কেউ অর্জন না করলেও কোনো অসুবিধা নেই। ঐ বেদুঈনের হাদীস তো বিখ্যাত যাতে আছে যে, তিনি যখন রোযা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন এবং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের রোযার কথা বললেন তখন ঐ বেদুঈন সাহাবী বললেন, এছাড়া কি আমার উপর অপরিহার্য আরো কোনো রোযা আছে? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না। সাহাবী বললেন, ঐ সত্তার শপথ যিনি আপনাকে সত্য (দ্বীন) দিয়ে পাঠিয়েছেন আমি এর চেয়ে বাড়াবও না, কমাবও না। তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে যদি সত্য বলে থাকে তাহলে অবশ্যই জান্নাতে যাবে।

তেমনি আরেক হাদীসে আছে যে, এক ব্যক্তি বলল, আমি অমুককে দেখতে পারি না। এরপর এর কারণ হিসেবে বলল, সে রমযানের রোযা ছাড়া আর কোনো রোযা রাখে না। তো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

قم إن أرى لعله خير منك.

উঠে যাও, আমি জানি না হতে পারে সে তোমার চেয়ে ভালো। দ্র. -মুসনাদে আহমদ, হাদীস ৫/৪৫৫

এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ফযীলতের কাজগুলোর কোনো একটিকে এমনভাবে নির্ধারিত করে দেওয়া অপছন্দ করেছেন যে, লোকেরা এটাকে অবলম্বন করবে এবং তা ফরযের মতো হয়ে যাবে। কাজেই কখনো এই রোযা রেখেছেন, কখনো ঐ রোযা রেখেছেন এবং প্রত্যেকটিরই ফযীলত বয়ান করেছেন। যেন বিশেষ কোনোটি এমন না হয়ে দাঁড়ায় যে, এখানে অন্য কিছুর অবকাশ নেই, ফলে তা ওয়াজিবের মতো হয়ে যায়।

 তো মাসের তিন রোযার ফযীলত রয়েছে। আর সেই তিন রোযা যদি হয় তের-চৌদ্দ-পনের তারিখ তাহলে আরো ভালো। তের-চৌদ্দ-পনের ছাড়া অন্য তারিখে রাখলেও এক ফযীলত পাওয়া যাবে। তেমনি অন্যান্য রোযা। -নাসিখুল হাদীসি ওয়া মানসূখুহু, ইমাম আবু বকর আল আছরাম পৃ. ১৭৬-১৭৮

ইমাম আবু বকর আলআছরাম রাহ. দ্বিতীয় যে হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, তা মুসনাদে আহমাদে হযরত আবুত তুফাইল আমির ইবনে ওয়াছিলা আললাইছী রা.-এর ‘মুসনাদে’ মুরসাল সনদে বর্ণিত একটি রেওয়ায়েত। পূর্ণ  রেওয়ায়েতটি নিম্নরূপ :

এক ব্যক্তি কিছু লোকের পাশ দিয়ে গমন করছিলেন, যাবার সময় তিনি তাদের সালাম দিলেন, তারাও সালামের জবাব দিলেন। তাদের অতিক্রম করে যাওয়ার পর ঐ মজলিসের একজন বললেন, আল্লাহর কসম! আমি এই লোকটির প্রতি আল্লাহর ওয়াস্তে বিদ্বেষ রাখি। উপস্থিত লোকেরা বললেন, ওয়াল্লাহ! তুমি  একটা খুব মন্দ কথা বললে! আমরা অবশ্যই তাকে বিষয়টি জানিয়ে দিব। এরপর তারা তাদের একজনকে বললেন, এই যে অমুক! আপনি যান। সেই দূত গিয়ে গমনকারীকে ঐ ব্যক্তির কথাটি জানিয়ে দিলেন।

তিনি তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে বৃত্তান্ত জানালেন যে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি মুসলমানদের একটি মজলিসের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলাম, যে মজলিসে অমুক ব্যক্তিও ছিলেন। আমি তাদের সালাম করি, তারা সালামের জবাব দেন। যখন তাদের অতিক্রম করে চলে আসি তখন তাদের একজন এসে আমাকে জানালেন যে, অমুক ব্যক্তি আমার সম্পর্কে বলেছে যে, আমি তার প্রতি আল্লাহর ওয়াস্তে বিদ্বেষ পোষণ করি। তো আপনি তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করুন, কেন তিনি আমার প্রতি বিদ্বেষ  পোষণ করেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ডাকলেন এবং অভিযোগকারী যা যা বলেছে তা তাকে জানালেন। অভিযুক্ত ব্যক্তি তা স্বীকার করে বললেন, আল্লাহর রাসূল! আমি তা বলেছি। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদ্বেষের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি বললেন, আমি তার প্রতিবেশী, তার সম্পর্কে অবগত। আল্লাহর কসম আমি তাকে এই ফরয নামায ছাড়া, যা ভালো-মন্দ সব লোকই পড়ে, আর কোনো নামায পড়তে দেখিনি। তখন প্রথমজন বললেন, ‘আল্লাহর রাসূল! তাকে জিজ্ঞাসা করুন, তিনি কি কখনো আমাকে দেখেছেন, নামাযকে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বিলম্বিত করতে, কিংবা নামাযের অযুতে বা রুকু-সিজদায় ত্রুটি করতে।’

দ্বিতীয়জনকে বিষয়টি জিজ্ঞাসা করলে তিনি না-সূচক জবাব দিলেন। এরপর বললেন, আল্লাহর কসম! আমি তাকে এই রমযান মাস ছাড়া, যে মাসের রোযা ভালো-মন্দ সব লোকই রাখে আর কোনো রোযা রাখতে দেখিনি।

প্রথমজন বললেন, ‘আল্লাহর রাসূল! তাকে জিজ্ঞাসা করুন, তিনি কি আমাকে কখনো ফরয রোযা ভাঙ্গতে বা তার কোনো হক নষ্ট করতে দেখেছেন?’

বিষয়টি জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি না-সূচক জবাব দিলেন। এরপর বললেন, আল্লাহর কসম! আমি তাকে কখনো কোনো ভিক্ষুককে কিছু দিতে দেখিনি এবং এই ‘যাকাত’ ছাড়া, যা ভালো-মন্দ সব লোকই আদায় করে, আর কোনো ভালো কাজে সম্পদ খরচ করতে দেখিনি।

প্রথমজন বললেন, আল্লাহর রাসূল! তাকে জিজ্ঞাসা করুন, আমি কি কখনো যাকাতযোগ্য কোনো কিছু গোপন করেছি কিংবা যাকাত উসুলকারীদের সাথে টালবাহানা করেছি।

এবারও দ্বিতীয় জন না-সূচক জবাব দিলে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে লক্ষ্য করে বললেন, যাও, আমি জানি না, হতে পারে সে তোমার চেয়ে ভালো।’ -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩৮০৩, ২৩৮০৪

এই বর্ণনার মৌলিক বিষয়গুলো অন্যান্য দলীলের দ্বারাও প্রমাণিত। এতে যেমন ফরয ইবাদতের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য প্রকাশিত হচ্ছে তেমনি নফল ইবাদতের একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘আদব’ও পাওয়া যাচ্ছে। আর তা হচ্ছে, নফল ইবাদতের কারণে অন্য কোনো মুসলিমের ব্যাপারে তাচ্ছিল্যের মনোভাব, এমনকি ‘ধর্মীয় বিদ্বেষ’ও পোষণের সুযোগ নেই। ধর্মীয় বিদ্বেষের ক্ষেত্র এটি নয়। আর কোনো মুসলিমকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা তো এমন গুনাহ, যা নফলের ছওয়াবের তুলনায় অনেক মারাত্মক। কাজেই নফল ইবাদতের অন্যতম দাবি ও আদব হচ্ছে, অন্যের প্রতি অবজ্ঞা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের মনোভাব থেকে পবিত্র হওয়া।

আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন।

 

 

advertisement