রবিউল আউয়াল ১৪৪০   ||   ডিসেম্বর ২০১৮

রেওয়াজি উপহার : সামাজিকতার এক নিষ্ঠুর চেহারা

মাওলানা শিব্বীর আহমদ

বিয়ে-শাদি আকীকা কিংবা এ জাতীয় কোনো অনুষ্ঠানে কেউ যখন আমন্ত্রিত হয় তখন সেখানে কোনো উপহারসহ উপস্থিত হওয়া যেন আমাদের একপ্রকার সামাজিক বাধ্যবাধকতা। এ বাধ্যবাধকতা দুই দিক থেকেই। যিনি আমন্ত্রিত, তিনি ভাবেন-একটি মানসম্মত উপহার ছাড়া সেখানে যাওয়া যাবে না। আবার যারা আমন্ত্রক, তারা অতিথিদের বরণ করার তুলনায় উপহার গ্রহণের প্রতিই অধিক মনোযোগী হয়ে থাকেন। উপহার গ্রহণের জন্য থাকে ভিন্ন ব্যবস্থাপনা। এবং সেটাও অনেকটা এমনভাবে, যেন চক্ষুলজ্জার কারণে হলেও কেউ উপহার প্রদান না করে অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করতে না পারেন। এটাও এখন সামাজিকতা।

এ উপহার এখন নতুন রূপ গ্রহণ করেছে। কিছুকাল আগেও রেওয়াজ ছিল, উপহার দেওয়ার জন্য পছন্দসই কোনো কিছু কিনে ‘গিফট পেপার’ দিয়ে মুড়িয়ে তা নিয়ে যাওয়া হত। সে রেওয়াজ কিছুটা এখনো আছে। তবে এখনকার রেওয়াজ অনেকাংশেই নগদ টাকা। কেউ চাইলে এটাকে কোনো রেস্টুরেন্টের বিল পরিশোধের সঙ্গেও মিলিয়ে ভাবতে পারেন। তবে পার্থক্য হল, রেস্টুরেন্টে বিল দিতে হয় খাবার পর, আর অনুষ্ঠানে দিতে হয় খাবারের আগে।

 

। ২।

আসলে এ সামাজিকতায় মৌলিকভাবে দুটি ভালো দিকও রয়েছে এবং দুটোই ইসলামসমর্থিত। কেবল সমর্থিত বললেও অবশ্য যথেষ্ট নয়, এ দুটি বিষয় ইসলামে কাক্সিক্ষতও। এক. উপহার প্রদান, দুই. অন্যের আনন্দে শরিক হওয়া। পারস্পরিক উপহার আদান-প্রদানের বিষয়টি কতটা গুরুত্বপূর্ণ-লক্ষ করুন; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ তাঁর কসম, তোমরা কিছুতেই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না যতক্ষণ তোমরা ঈমান না আনবে, আর যতক্ষণ তোমরা একে অন্যকে ভালো না বাসবে ততক্ষণ তোমরা (পূর্ণ) ঈমানদারও হতে পারবে না। আমি তোমাদেরকে এমন একটি কাজের কথা বলে দিই, যা করলে তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা সৃষ্টি হবে? তোমরা তোমাদের মধ্যে সালামের প্রচলন ঘটাও। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৮৮

আরেকটি হাদীস বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী রাহ. তার ‘আলআদাবুল মুফরাদ’ নামক গ্রন্থে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

تَهَادَوْا تَحَابّوا.

তোমরা একে অন্যকে উপহার দাও, ভালোবাসা সৃষ্টি হবে। -আলআদাবুল মুফরাদ, হাদীস ৫৯৪

উল্লেখিত দুটি হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি-

১. জান্নাতে যেতে হলে ঈমান আবশ্যক। ঈমান ছাড়া কেউ জান্নাতে যেতে পারবে না।

২. ঈমান যদিও আল্লাহ তাআলার ওপর এবং নবী-রাসূল, ফেরেশতা, আসমানী কিতাব, পরকাল ও তাকদীরের ওপর বিশ্বাসের নাম, কিন্তু পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে হলে এবং ঈমানের পূর্ণ সুফল পেতে চাইলে এ বিশ্বাসের পাশাপাশি ঈমানদারদের পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভালোবাসাও জরুরি।

৩. পারস্পরিক এ ভালোবাসা সৃষ্টির জন্য দুই হাদীসে দুটি পথ বলে দেয়া হয়েছে- এক. অধিক হারে সালামের প্রচলন ঘটানো, দুই. পারস্পরিক উপহার আদান-প্রদান।

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন-

تَهَادَوْا فَإِنّ الهَدِيّةَ تُذْهِبُ وَحَرَ الصّدْرِ.

তোমরা একে অন্যকে হাদিয়া-উপহার দাও। এ উপহার অন্তরের শত্রুতা ও বিদ্বেষ দূর করে দেয়। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২১৩০

উপহারের আদান-প্রদানে সামাজিক বন্ধন যে কতটা বৃদ্ধি পায় তা তো আর নতুন করে বলার কিছু নেই। এটা আমাদের দেখা বাস্তবতা। পারস্পরিক এ নেয়া-দেয়াটা যখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে হয় তখন দূর-বহুদূরের কারও সঙ্গেও গড়ে ওঠে আত্মার সম্পর্ক। এ সম্পর্ক অনেক সময় ছাড়িয়ে যায় রক্ত ও আত্মীয়তার বাঁধনকেও। এসবই মানুষের স্বাভাবিকতা।

আবার কাছের বা দূরের কোনো আত্মীয় কিংবা কোনো প্রতিবেশী বা বন্ধুর যখন কোনো খুশির উপলক্ষ আসে তখন তার সে আনন্দ ভাগ করে নেওয়াটাও আত্মীয়তা, প্রতিবেশ কিংবা বন্ধুত্বের দাবি। সকলের তরে সকলে আমরা/ প্রত্যেকে মোরা পরের তরে-এটা তো ইসলামের শিক্ষাই। তাই কারও বিপদে যেমন পাশে দাঁড়াতে হয়, পাশে থাকতে হয় কারও সুখের সময়ও। এটাই সামাজিকতা। এ নিয়েই আমাদের সমাজ। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তাআলা আমাদের আদেশ করেছেন আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী প্রমুখের সঙ্গে সুন্দর আচরণ করতে। পড়–ন-

وَ اعْبُدُوا اللهَ وَ لَا تُشْرِكُوْا بِهٖ شَیْـًٔا وَّ بِالْوَالِدَیْنِ اِحْسَانًا، وَّ بِذِی الْقُرْبٰی وَ الْیَتٰمٰی وَ الْمَسٰكِیْنِ وَ الْجَارِ ذِی الْقُرْبٰی وَ الْجَارِ الْجُنُبِ وَ الصَّاحِبِ بِالْجَنْۢبِ وَ ابْنِ السَّبِیْلِ،     وَ مَا مَلَكَتْ اَیْمَانُكُمْ ،     اِنَّ اللهَ لَا یُحِبُّ مَنْ كَانَ مُخْتَالًا فَخُوْرَا.

তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে এবং কোনো কিছুকে তাঁর সঙ্গে শরিক করবে না। আর সদাচরণ কর বাবা-মায়ের সঙ্গে এবং আত্মীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, নিকট প্রতিবেশী ও দূর প্রতিবেশী, সঙ্গীসাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসীদের সঙ্গেও। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না। -সূরা নিসা (৪) : ৩৬

এই আয়াতে আমাদেরকে যেমন লা-শারিক আল্লাহর ইবাদত করতে আদেশ করা হচ্ছে, একই গুরুত্বের সঙ্গে বাবা-মায়ের সঙ্গে সদাচারের আদেশও করা হচ্ছে। আর বাবা-মায়ের পাশাপাশি উল্লেখিত হয়েছে আত্মীয়-স্বজন এতীম-মিসকীন, প্রতিবেশীসহ আরও কতজন। আদেশ করা হচ্ছে তাদের সঙ্গে সুন্দর আচরণের। সুন্দর আচরণ বলতে আমরা সাধারণত বুঝে থাকি-তাদের বিপদে সহযোগিতা করতে হবে, তাদের সঙ্গে কোনো মন্দ আচরণ করা যাবে না ইত্যাদি। সন্দেহ নেই, এগুলোও সুন্দর আচরণ। কিন্তু কেবল এগুলোই নয়, সুন্দর আচরণের সীমা আরও বিস্তৃত। সুন্দর আচরণ করতে হবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই। কেউ যখন কোনো আনন্দ অনুষ্ঠান করে, তখনো সে চায়- তার কাছের সবাইকে নিয়ে সে আনন্দ উদ্যাপন করবে। আবার তার ঘনিষ্ঠ যারা তারাও আশা করে, তাদেরকে সঙ্গে নিয়েই সে অনুষ্ঠান করবে। একে অন্যের কাছে এটা সামাজিকতার দাবি, ঘনিষ্ঠতার দাবি। শরীয়তের নীতি ও বিধান অনুসারে উভয়েরই এ দাবি রক্ষা করা উচিত। কাছের কেউ যখন কোনো আমন্ত্রণে সাড়া না দেয় কিংবা কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ না জানায়, তখন আমরা অনুভব করি এর গুরুত্ব।

তাই বিয়ে-শাদিসহ এরকম কোনো অনুষ্ঠানে যদি কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং আমন্ত্রিত ব্যক্তির স্বাস্থ্যগত, পরিবেশগত কিংবা শরীয়তের দৃষ্টিতে কোনো সংকট না থাকে, তখন ওই আমন্ত্রণ সে রক্ষা করবে- এটাই ইসলামের শিক্ষা। এ শিক্ষা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তাও দেখুন। প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেছেন-

شَرّ الطّعَامِ طَعَامُ الْوَلِيمَةِ يُدْعَى لَهَا الأَغْنِيَاءُ وَيُتْرَكُ الْفُقَرَاءُ، وَمَنْ تَرَكَ الدّعْوَةَ فَقَدْ عَصَى اللهَ وَرَسُولَهُ صلى الله عليه وسلم.

যে ওলিমায় কেবল ধনীদেরকেই আমন্ত্রণ জানানো হয় আর গরীবদেরকে বর্জন করা হয়, সে ওলিমার খাবার নিকৃষ্ট খাবার। আর যে আমন্ত্রণ রক্ষা করে না, সে তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের অবাধ্য হল। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫১৭৭

এই হাদীস থেকে আমরা দুটি বার্তা পাই। এক. কেউ যখন বিয়ে-পরবর্তী ওলিমার আয়োজন করবে, তখন সেখানে বেছে বেছে কেবল ধনীদেরকেই আমন্ত্রণ করবে না, বরং ধনী আত্মীয়, ধনী প্রতিবেশী আর ধনী বন্ধুবান্ধবের পাশাপাশি তুলনামূলক অসচ্ছল গরীব আত্মীয়, প্রতিবেশী ও বন্ধুদেরও দাওয়াত করবে। আর যদি কাউকে কেবল এজন্যেই আমন্ত্রণ জানানো না হয় যে, সে গরীব, তাহলে সে ওলিমার খাবার হবে নিকৃষ্ট খাবার!

দুই. কাউকে যখন এমন কোনো অনুষ্ঠানে দাওয়াত করা হয়, সে যেন তাতে শরিক হয়। তাতে অংশগ্রহণ না করা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে অবাধ্যাচরণ করারই নামান্তর। আরেক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

حَقّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ خَمْسٌ رَدّ السّلاَمِ وَعِيَادَةُ الْمَرِيضِ وَاتِّبَاعُ الْجَنَائِزِ وَإِجَابَةُ الدّعْوَةِ وَتَشْمِيتُ الْعَاطِسِ.

এক মুসলমানের ওপর আরেক মুসলমানের পাঁচটি অধিকার- ১. সালামের জবাব দেওয়া, ২. অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া, ৩. জানাযায় শরিক হওয়া, ৪. দাওয়াত করলে তা রক্ষা করা, ৫. হাঁচির জবাবে দুআ পড়া। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১২৪০

তাই আমন্ত্রণ রক্ষা করা কেবল সামাজিকতার দাবিই নয়, এ দাবি বরং মুমিনের কাছে ঈমানের দাবি।

অনেকে আবার অসচ্ছলদের দাওয়াতকে পরোয়া করেন না। অথচ নৈতিকতার দাবি হল, সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা কারও দাওয়াতেই অধিক গুরুত্বের সঙ্গে সাড়া দেওয়া উচিত। প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় জীবনাদর্শ আমাদেরকে এ শিক্ষা-ই দেয়। তাঁকে যখন কেউ আমন্ত্রণ করত, তিনি সে আমন্ত্রণ রক্ষা করতেন। আমন্ত্রণকারী ধনী না গরীব, সচ্ছল না অসচ্ছল, সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত না কোনো সাধারণ ব্যক্তি- এসব বিষয় তিনি মোটেও লক্ষ করতেন না। তিনি স্পষ্ট বলেছেন-

لَوْ دُعِيتُ إِلَى كُرَاعٍ لأَجَبْتُ.

আমাকে যদি (বকরির পায়ের) মাংসবিহীন চিকন হাড় খেতেও দাওয়াত করা হয় তবুও আমি সে দাওয়াত রক্ষা করব। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫১৭৮

হাঁ, যদি আমন্ত্রণ রক্ষা করায় কোনো সংকট থাকে, যেমন, আমন্ত্রণকারী আয়-উপার্জনে হালাল-হারামের বিবেচনা না করে, আমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেলে উল্টো আরও কিছু গোনাহে জড়িয়ে পড়ার আশংকা দেখা দেয় কিংবা অসুস্থতা বা অন্য কোনো বাস্তব সমস্যা, তাহলে সেখানে অংশগ্রহণ না করার সুযোগ রয়েছে, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে সে দাওয়াতে না যাওয়াটাই অধিক কাক্সিক্ষতও হতে পারে।

 

। ৩।

এ তো হাদিয়া-উপহার আর অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ রক্ষা করার ক্ষেত্রে মৌলিক কথা। কিন্তু আমরা সামাজিকভাবে এ বিষয়টি যেভাবে নিজেদের ওপর চাপিয়ে নিয়েছি, এখন তা নিয়ে অবশ্যই ভাবনার অবকাশ আছে। স্বাভাবিক সময়ে কেউ যদি কারও অতিথি হয় তাহলে সাধারণত গৃহকর্তাদের জন্যে কিছু একটা নিয়েই যায়। এক্ষেত্রে অবশ্য কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যার যা ইচ্ছা তা-ই নেয়। দামি-কমদামি নানান কিসিমের জিনিসই মানুষ নিয়ে যায় অতিথি হিসেবে। এটাও হাদিয়া, আবার অতিথির আপ্যায়নও তো একপ্রকার হাদিয়া। কিন্তু সংকট হল বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে। বিয়ে-শাদির অনুষ্ঠান, আকীকার অনুষ্ঠান- এ জাতীয় আরও যত অনুষ্ঠান, সেখানে যদি কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, তবে সে আমন্ত্রণ কেউ কেউ যেমন খুশিমনে গ্রহণ করে এবং তা সাগ্রহে রক্ষাও করে, আবার এই আমন্ত্রণ অনেকের জন্যেই বিপদেরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যাদের অভাবের বা টানাটানির সংসার, কিংবা যাদেরকে চলতে হয় অত্যন্ত মিতব্যয়িতার সঙ্গে এবং একটি নির্দিষ্ট আয় দিয়ে, তারা আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আর প্রতিবেশীর এরকম আনন্দ অনুষ্ঠানের সংবাদে ও আমন্ত্রণে যেমন আনন্দিত হয়, পরক্ষণেই আবার দুশ্চিন্তায়ও ছেয়ে যায় তাদের চেহারা। কারণ সেখানে একটা মানসম্মত ‘গিফট’ দিতেই হবে। সামর্থ্য যতটুকু আছে তাতে মান রক্ষা হয় না। আর মান রক্ষা করতে গেলে নিজের ক্ষমতায় কুলায় না। আপনজন কারও বিয়েতে বা অন্য কোনো আয়োজনে শরিক না হওয়ার কোনো ইচ্ছাও নেই, আবার সামাজিকতা রক্ষা করে সেখানে শরিক হওয়ার মতো সচ্ছলতাও নেই। এ এক উভয়সংকট। আর বিয়ের দাওয়াতের অর্থই হল- আপনাকে উপস্থিত হতেই হবে এবং মানসম্মত উপহারও নিয়ে যেতে হবে। এ উপহার গ্রহণ করার জন্য করা হয় নজরকাড়া আয়োজন। তা আবার ‘দলিলস্বরূপ’ লিখেও রাখা হয়। এরপর চলে হিসাব- কে কত দিল এবং কত খরচ হল আর কত টাকা উঠে এল। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, তবে আমাদের সমাজের স্বাভাবিক বাস্তবতাটা এমনই।

একটা সময় যখন বিভিন্ন উপহারসামগ্রী কিনে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল, তখন এ রেওয়াজের মধ্যেও একটু আন্তরিকতার ছোঁয়া ছিল। কিছু উপহার ঘরে স্মৃতি হিসেবে রেখে দেওয়া হত, কিছু আবার ভাই-বোন কিংবা এজাতীয় কাছের আত্মীয়দের মধ্যে বণ্টন করা হত। ওসব এখন আর নেই বললেই চলে। এখনকার বাস্তবতা হল- দাওয়াত দিলাম, আসবেন, খাবেন এবং টাকা দিয়ে চলে যাবেন। আরও মজার বিষয় হল, এ উপহার যেন ‘মানসম্মত’ হয় সেজন্য অনুষ্ঠানের তারিখটাও ‘সুবিধামতো’ নির্ধারণ করা হয়।

এর প্রতিক্রিয়া বিপরীত দিক থেকেও হয়। আমন্ত্রণ জানানো হল একজনকে, কিন্তু টাকা যা দিতে হবে তা তো একজন খেয়ে ‘পোষাতে পারবে’ না। তাই আমন্ত্রকের অনুমতি এবং মৌন সম্মতি ছাড়াই সে নিয়ে যায় তার ছেলে, ভাই কিংবা বন্ধুকে। যেন পুষিয়ে আসার একটু চেষ্টা! এতে যে আমন্ত্রণকারীর অতিথি-আপ্যায়নে ব্যাঘাত ঘটবে না- এ নিশ্চয়তা দেবে কে? একটি অন্যায় সামাজিকতা এভাবেই আরেকটি অন্যায়কে টেনে নিয়ে আসে।

কারও বাড়িতে বেড়াতে যাবার সময় যেমন কখনো ফল নিয়ে কখনো মিষ্টি নিয়ে কিংবা অন্য আরও কিছু নিয়ে যাই আমরা, এসব অনুষ্ঠানে উপহারের বিষয়টিকেও যদি এরকম উন্মুক্ত রাখা হত এবং সামাজিক বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত রাখা হত, তাহলে এখনকার মতো সংকটের সৃষ্টি হত না। কেউ যদি সামাজিক কিংবা পারিপার্শ্বিক চাপে পড়ে কাউকে হাদিয়া দেয় আর তা আন্দাজও করা যায়, তবে তা গ্রহণ করা কতটুকু বৈধ হবে- তাও ভাবনার বিষয়। হাঁ, কেউ যদি আন্তরিকভাবেই কাউকে উপহার দিতে চায়, কারও আনন্দে সেও একটু শরিক হতে চায়, তাহলে এ সুযোগ তো থাকবেই। তবে এজন্য আনুষ্ঠানিকতার বাধ্যবাধকতা কেন?

এভাবে কতরকমের রেওয়াজ যে আমাদের সমাজে ছড়িয়ে আছে! অবশ্য এর অধিকাংশই বিয়েশাদি কেন্দ্রিক। একবার বিয়েতে টাকা, এরপর ছেলেপক্ষের হলে নতুন বউকে আর মেয়েপক্ষের হলে নতুন জামাইকে সালামি। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে এক পক্ষের আত্মীয়-স্বজনকে দাওয়াত করা এবং উপহার দেওয়ার বাধ্যবাধকতা এবং এর প্রত্যুত্তরে ওপক্ষ থেকেও একই মানের দাওয়াত ও উপহার। সামাজিকতার এ ছোবল সত্যিই ভয়ংকর।

আমরা যদি এ থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজতে চাই, তাহলে প্রথমেই এগিয়ে আসতে হবে আমন্ত্রকদের। তারা যদি অনুষ্ঠানে কেবল অতিথিকেই বরণ করে আর উপহার গ্রহণের আনুষ্ঠানিক কোনো ব্যবস্থা না রাখে, তবে অনেকাংশেই দুর্বল হয়ে পড়বে এ অন্যায় সামাজিকতা। আর যারা অতিথি, তারাও যদি একটু হিম্মত করতে পারেন, তাহলে তো দাফনই হয়ে যেতে পারে এ অন্যায়ের।

কিছু কিছু মানুষকে উদ্যোগী হতে দেখাও যায়। হয়ত এ উপলব্ধি থেকেই তারা ওলিমার দাওয়াতপত্রে লিখে দেন- ‘দয়া করে সাথে কোনো গিফট আনবেন না’। এ উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। এর দ্বারা আমন্ত্রিত অতিথিদের অনেকেরই হয়ত টনক নড়বে। আরও মানুষ উদ্যোগী হবে।

যাইহোক, সামাজিক চাপ নয়; হাদিয়া আদান-প্রদান হওয়া উচিত আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। ইসলামের হাদিয়ার যে ধারণা ও শিক্ষা সে অনুসারে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য (কাউকে কিছু) দেয়, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই দেওয়া থেকে বিরত থাকে; আল্লাহর জন্যই যে ভালোবাসে আর আল্লাহর জন্যেই যে ঘৃণা করে, ... সে তার ঈমান পূর্ণ করল। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৫২১

তাই প্রচলিত সামাজিক রীতি-রেওয়াজের অন্ধ অনুসরণ নয়,পূর্ণ ঈমানের অধিকারী হতে চাইলে প্রাধান্য দিতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টিকেই। সমাজ কী বলল- সেটা দেখার বিষয় নয়। এটাই মুমিনের বৈশিষ্ট্য, মুমিনের পরিচয়। সামাজিকতার চাপে নয়, কাউকে যদি কিছু সে উপহার দেয়, তাহলে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই দেবে, যদি কাউকে না দেয়, তাহলে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই দেওয়া থেকে বিরত থাকবে। ঈমানের পূর্ণতার জন্য আমাদেরকে এখানে উঠে আসতেই হবে।

 

 

advertisement