জুমাদাল আখিরাহ ১৪৩১   ||   জুন ২০১০

সন্তান যে কলিজার টুকরা তাই ...

শামীমা বিনতে নূর

মাতৃহৃদয় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বিস্ময়কর সৃষ্টি। সন্তানের জন্য মায়ের হৃদয়ে মমতার যে ঝর্ণাধারা বয়ে যায় তার তুলনা পৃথিবীতে নেই। মা তাঁর সকল সুখ সন্তানের জন্য বিসর্জন দেন। সন্তানের চাঁদমুখ তার সকল যাতনার অবসান ঘটায়। মা নিজেকে ভুলে সন্তানের জন্য ব্যাকুল থাকেন। মায়ের মমতা পৃথিবীর এক পরম সত্যি। তবে একটি চরম বাস্তব এই যে, শুধু মায়ের মমতা সন্তানের ভবিষ্যত-কল্যাণের পক্ষে যথেষ্ট নয়। আল্লাহ মাকে মমতাময়ী করেছেন, স্বয়ংসম্পূর্ণ করেননি। সব কিছু সত্ত্বেও মা একজন মানুষ। তাই সকল মানবীয় সীমাবদ্ধতার মাঝেই তাঁর অবস্থান। মা সন্তানের জন্য কল্যাণ চাইতে পারেন, কল্যাণ দান করতে পারেন না। সকল কল্যাণের মালিক আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। তাই মমতাময়ী মা তখনই কল্যাণময়ী হন যখন তাঁর মমতাকেও তিনি অনুগত করেন রাব্বুল আলামীনের। দুই. সন্তান মায়ের কাছেই গ্রহণ করে জীবনের প্রথম পাঠ। মায়ের ভাষাতেই শিশুর মুখে বোল ফোটে এবং পৃথিবীর সাথে পরিচয় ঘটে। মায়ের আচরণ থেকে সে জীবন-যাপনের নিয়ম শেখে। তাই বলা যায়, শিশু তার মায়ের কর্ম ও চেতনার দর্পন। তাই সন্তান যখন উত্তম স্বভাব-চরিত্রের অধিকারী হয় তখন মায়ের অবদান ভোলা যায় না। পক্ষান্তরে সে যখন ভুল পথে চলে তখনও মা এর দায় এড়াতে পারেন না। কারণ মায়ের সান্নিধ্যই শিশুর ভবিষ্যত চলার পথ নির্ধারণ করেছে। কিছু বেদনাদায়ক দৃষ্টান্ত মনে পড়ছে। আমাদের পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদে দুটি শিশু খেলা করত। ওরা ছিল ভাই বোন। ছেলেটির পোশাক স্বাভাবিক, কিন্তু মেয়েটির পোশাক দেখে খুব কষ্ট হত। ছোট ছোট হাতা-কাটা জামা, বুকের অর্ধেক থেকে উরু পর্যন্ত, মাঝে মাঝে দেখা যেত পিঠের মাঝেও গোল করে কাটা। সবচেয়ে কষ্টকর ছিল শিশুটির অঙ্গভঙ্গি। ছাদে বিভিন্ন বয়সী ছেলেরা খেলতে আসত। সবার মনোযোগ থাকত মেয়েটির প্রতি। আরেকটি মেয়ের কথা মনে পড়ছে। ওকে এমন একটি জামা পরানো হত, যা শিশুদের পোশাক হিসেবে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। খেলার সাথীরা এলে ও খুব লজ্জা পেত এবং দুই হাত দিয়ে জামার ওপরের অংশটা ঢেকে রাখত। ওর মা জোর করতেন জামাটা পরার জন্য। কিন্তু সে কোনোভাবেই লজ্জা কাটিয়ে উঠতে পারত না। শেষে জামাটি ওদের কাজের মেয়েকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অনেক বাবা-মা ১০-১২ বছরের মেয়েকেও হাফপ্যান্ট পরান। বলেন যে, এখনো বয়স কম। বড় হলে পাজামা পরবে। মায়ের কাছে সন্তান তো কখনো বড় হয় না। এটা মায়ের আবেগ, মাতৃহৃদয়ের অনুভূতি। কিন্তু যাদের অন্তরে আল্লাহর ভয় আছে, তারা তো শুধু হৃদয়ের অনুভূতি দ্বারা পরিচালিত হতে পারে না। সন্তানের কল্যাণের স্বার্থেই তাদেরকে বিসর্জন দিতে হয় নিজের ইচ্ছা ও আবেগ। আমরা অনেকেই ভাবি, বড় হয়ে তো আমার মেয়ে পর্দা করবেই, এখন একটু ‘ফ্যাশনেবল’ পোশাক পরুক। আমার মেয়েটি কত সুন্দর, কেমন স্বাস্থ্যবতী, সবাই একটু দেখুক! কদিন পর মেয়ে আমার চলে যাবে পরের সংসারে, তখন তো স্বাধীনতা বলে তার কিছুই থাকবে না। এখন একটু আনন্দ করুক। কিন্তু এই ভাবাবেগ যে কলিজার টুকরা সন্তানকে কত বড় বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারে তা কি আমরা চিন্তা করি? আল্লাহ না করুন-সন্তান যদি চলে যায় জাহান্নামের পথে, তার নির্মল চরিত্রে যদি লাগে আবিলতার ছাপ, তাহলে মা কোন প্রাণে তা সইবেন? মা তো জনমদুঃখিনী, সন্তানের কল্যাণের জন্য তাকে বিসর্জন দিতে হয় সব, এমনকি মমতার সুখটুকুও! তিন. কিছু ভালো দৃষ্টান্তও আছে। আমি একজন মাকে জানি, যিনি খুব সাধারণ একজন মানুষ। কিন্তু একটি বিষয়ে তিনি ছিলেন অনমনীয়। হয়তো খুবই সাধারণ বিষয়, কিন্তু তাঁর কাছে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তা হচ্ছে, তিনি কখনো মেয়েদের একা একা বেড়াতে পাঠাতেন না। নিজে সঙ্গে না গেলে আত্মীয়-স্বজনের বাসায় তাদের থাকতে দিতেন না। এমনিভাবে কোনো আত্মীয়ের উপর নির্ভর করে মেয়েদের ঘরে রেখে কখনো বাইরে যেতেন না। অনেকের কাছেই এটা বাড়াবাড়ি মনে হত। আপনজনদের সাথে এ নিয়ে মনোমালিন্য হত, এমনকি কন্যারাও কখনো কখনো বিরক্ত হত। কিন্তু তিনি এর ব্যতিক্রম কখনো করতেন না। আজ জীবনের কিছুটা পথ পাড়ি দিয়ে আসার পর বুঝতে কষ্ট হয় না যে, কেন তিনি এমন করতেন। তাই যাদের মাথার উপর আল্লাহ তাআলা দ্বীনদার পিতামাতার ছায়া রেখেছেন তাদের কর্তব্য, পিতামাতার প্রতি আস্থাশীল থাকা এবং বিনা বাক্যব্যয়ে তাদের আদেশ পালন করা। এর সুফল একদিন না একদিন অবশ্যই বুঝে আসবে। সেদিন পিতামাতার ঐ ‘বাড়াবাড়ি’গুলোই পরম অনুগ্রহ বলে মনে হবে এবং আপ্লুত হৃদয়ে বলতে ইচ্ছ হবে-রাব্বিরহামহুমা কামা রাব্বায়ানী ছগীরা।

 

advertisement