সফর ১৪৪০   ||   নভেম্বর ২০১৮

বই পড়ি মজা করি

মুহাম্মাদ আলফাতিহ

ছোট্টমনি তাকিয়া।

সবাই আদর করে ডাকে তাকিমনি। আজ সে খুব খুশি। আব্বু সুন্দর একটি বই এনে দিয়েছেন। কী সুন্দর সুন্দর ছবি! ফুল, ফল, সবুজ মাঠ, আকাশ, নৌকা আরো কত্তো কী।

আব্বুকে অনেকদিন ধরে একটি মজার বই এনে দিতে বলছিল সে। আব্বুর নাকি অফিস থেকে ফেরার পথে মনে থাকে না। তাই সকালে তাকিমনি আব্বুর সঙ্গে অভিমান করে বলল-

: আজকে বই না আনলে খাব না, কারো সঙ্গে কথাও বলব না।

বলে সে চোখ পাকিয়ে মুখটাকে বেলুনের মতো ফুলিয়ে চুপটি মেরে রইল।

সত্যি সত্যি আব্বুর আজ ভুল হল না। বিকেলবেলা নিয়ে এলেন দারুণ একটি মজার বই। হাতে পেয়েই তাকিমনি অস্থিরভাবে সবগুলো পৃষ্ঠার ছবি উল্টে পাল্টে একবার দেখে নিল। তারপর এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলল পুরো বই। ছোট্ট ছোট্ট গল্প আর সুন্দর সুন্দর ছবি। একবার তাকালে চোখ আর ফেরানোই যায় না।

বইটি পেয়ে তাকিমনি সে কী খুশি! হরিণ-ছানার মতো ছোটাছুটি করে বইটি একে ওকে দেখাতে লাগল। চাচাত বোন যাকিয়াকে দেখাল। দেখেই যাকিয়ার চোখ চকচক করে উঠল।

: আমাকে কিন্তু একবার পড়তে দিবি। বল, দিবি!

: আচ্ছা দিব।

বলে তাকিমনি ছুটে গেল ছোট চাচ্চুর কাছে। এরপর হঠাৎ মনে পড়ল সুমাইয়াকে তো দেখাইনি। মনে হতেই ছুটল ওদের বাড়ি।

পথের ধারে বাগান। সেখানে ফুটে আছে হরেক রকমের ফুল। ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াচ্ছে রঙ-বেরঙের প্রজাপতি। ডানায় তাদের রঙের বাহার। একটি ছোট্ট প্রজাপতি ডেকে বলল-

: তাকিমনি, তাকিমনি কোথায় যাও?

: হাঁপাতে হাঁপাতে তাকিমনি বলল, সুমাইয়াদের বাসায়। একটা সুসংবাদ দিতে। প্রজাপতি সই। যাবে তুমি আমার সাথে?

: ছোট্ট প্রজাপতি তার সুন্দর ডানা দুটি হাওয়ায় দুলিয়ে দুলিয়ে বলল, না-রে সই, আম্মু রাগ করবে।

তাকিমনি বলল, ঠিক আছে, তাহলে আমিই যাই।

: প্রজাপতি-ছানা পেছন থেকে ডেকে বলল, সই লো সই! তোমার হাতে ওটা কী?

: এটা বই। খুব সুন্দর দেখতে। পড়তে আরো মজা।

: প্রজাপতি ছানা ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইল, কিসের বই এটা?

: গল্পের বই। বড় বড় মানুষের সুন্দর সুন্দর ঘটনা।

এই যে দেখ-

সুলতান সালাহউদ্দিন আইউবীর ঘটনা। অনেক বড় বীর। একসময় তিনি ছিলেন মুসলিম বিশে^র একজন প্রতাপশালী সুলতান (বাদশাহ)। খুব বিখ্যাত রণবীর এবং দয়ালু। ইসলামের শত্রুরা তাকে বাঘের মতো ভয় পেত।

আর  এদিকে দেখ- উঁচু নিচু প্রায় দশ মাইল পথ। তার ওপর বড় বড় সত্তরটি যুদ্ধ জাহাজ। কেমন ঠেলে ঠেলে ও পাশের পানিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ হল ইস্তাম্বুল বিজয়ের আগে যুদ্ধের ছবি। পৃথিবীর সবচে মজবুত দুর্গ ছিল ইস্তাম্বুল।  খ্রিস্টানদের দুর্গ। ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুদের দুর্গ। এই যুদ্ধের নেতৃত্ব যিনি দিয়েছেন, তার নাম মুহাম্মাদ ছানী। লোকে যাকে চেনে মুহাম্মাদ ‘আল ফাতিহ’ হিসেবে। ইস্তাম্বুল বিজয়ী হিসেবে। ইনি হলেন তুর্কি সালতানাতের (রাজ্যের) একজন বিখ্যাত সুলতান এবং শাসক।

আর এই যে দেখ ভারতের সিন্ধু নদ। তার আশ-পাশের বিভিন্ন রাজ্যজুড়ে যিনি সর্বপ্রথম বিজয়-পতাকা উড়িয়েছেন, তিনি হলেন মুহাম্মাদ বিন কাসেম। অনেক সাহসী বীর। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে এবং তার জামাতা। উমাইয়া শাসক খলিফা অলীদ বিন আবদুল মালেকের শাসনামলের বিখ্যাত বীর। অল্প বয়সী যুবক।

আরো অনেকের ঘটনা আছে এতে। তোমাকে পরে বলব প্রজাপতি সই, কেমন? বলে তাকিমনি আবার পোঁ পোঁ করে ছুটতে লাগল। ছুটতে ছুটতে দেখা হল এক টিয়া পাখির সাথে। লাল বড়শির মতো বাঁকা ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে ঠুকরে কলা খাচ্ছিল পাখিটা। টি টি করে নাকি কণ্ঠে বলল-

: তাঁকিমনি তাঁকিমনি! তোঁমার হাঁতে এঁত সুঁন্দর বঁই, কীঁ আঁেছ ওঁ তে?

: তাকিমনি একটু ভেবে বলল, তুরস্কের মুসলিম বিজ্ঞানী খ্যাদাফীন আহমাদের ঘটনা আছে। ইনি ১৭ শ সালে কী কা- করেছিলেন জান? আকাশে উড়ে হুলস্থুল কা- বাধিয়ে ফেলেছিলেন। হাঁ, চামড়ার দুটি মাত্র ডানা দিয়ে আকাশে রীতিমত প্রায় ৮ মাইল উড়ে বেড়িয়েছিলেন। এটা উড়োজাহাজ আবিষ্কারের অনে-ক আগের ঘটনা আছে। পাখাদুটো এখনো আছে ইস্তাম্বুলের বাতিঘর ‘বুরুজে গাল্লাতায়’।

: টিয়া টি টি করে আবার বলল, আঁর কাঁর কঁথা আঁছে তাঁকিমঁনি?

: তাকিমনি বলল, টিয়ামনি, আমি এখন যাই। তোমার সাথে পরে আবার কথা হবে। জরুরি কাজ আছে। বলে আবার ছুটতে থাকে তাকিমনি। এক দৌঁড়ে চলে এল সুমাইয়াদের বাড়ি। এসেই গলা চড়িয়ে ডাকতে লাগল সুমাইয়াকে। ওর ডাক শুনে লাঠি হাতে ঠক ঠক করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সুমাইয়ার দাদি। থুর থুরে বুড়ি। কিশমিশের মতো তোবড়ানো চেহারা। লাল টুকটুকে পান খাওয়া মুখ। লাঠির উপর কেমন হেলে আছেন। অনেকটা নামাযে রুকুর মতো দেখতে। জানালেন সুমাইয়া গোসল করতে গেছে। দাদি মানুষ, কাঁপা কাঁপা গলায় ঢং করে কথা বলেন।

: আ-লো তাকিমনি, তোর হাতে এ তো সুন্দর বই কিসের লো-?

: এটা গল্পের বই দাদি, গল্পের বই।

: কার গল্পের বই?

: অনেকের গল্প। তার মধ্যে একটি হল ক্বারী আসেমের গল্প।

: দাদি পিচিক করে পানের পিক ফেলে বলল, আসেম কে লো?

: তুমি চিনবে না দাদি। সাতজন ক্বারী বিখ্যাত ছিলেন। সেই সাত ক্বারীর একজন হলেন এই আসেম। বাবার নাম বাহদালা। লোকে বলত আবুন নাজুদ।

: দাদি বলল, তাঁর বাড়ি বুঝি নোয়াখালী? আমরা ছোটকালে দেখছি লো নোয়াখালীর হুজুর! কী সুন্দর কুরআন পড়া আর কী সুরেলা ওয়াজ!

: তাকিমনি ফিক করে হেসে বলল, না গো দাদি, না। তার বাড়ি হল ইরাকের কূফা নগরী। উনি মারা গেছেন ১২৭ হিজরী সালে। তাবেয়ী ছিলেন। আবু আবদুর রহমান সুলামী রাহ. -এর কাছে ছেলেবেলা থেকেই কুরআন পড়তেন। তাঁর কুরআন তিলাওয়াত অনেক সুন্দর ছিল। তিলাওয়াত করলে চারদিকে যেন সুরের ঢেউ খেলত। মানুষেরা দুলত সে মধুর তিলাওয়াতে।

তাঁর আরেকটি গুণ হল- তিনি কথা বলতেন চমৎকারভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে। স্পষ্ট এবং শুদ্ধ ভাষায়। বিখ্যাত আরবী ব্যাকরণবিদও ছিলেন তিনি। খুব আল্লাহওয়ালা মানুষ। নামাযে কাঠের মতো স্থির দাঁড়িয়ে থাকতেন।

আরো  কী যেন বলতে যাচ্ছিল তাকিমনি। হঠাৎ দেখল সুমাইয়া গোসল সেরে এসেছে। রেশমের মতো ছোট ছোট ভেজা চুল। হাল্কা বাতাসে উড়ছে। তাকিমনি ছুটে গেল তার কাছে। জামার নিচে বই লুকিয়ে সকৌতুকে বলল-

: বল তো জামার নিচে কী?

: সপ্রশ্নভাবে তাকাল সুমাইয়া। ঠোঁট উল্টে বলল, কী আবার, চকলেট। না হয় পেয়ারা।

: তাকিমনি মাথা নেড়ে রহস্য করে বলল, উঁ-হু, হল-না। ব-ই। বলেই ফস করে চোখের সামনে বইটি মেলে ধরে হি হি করে হাসতে লাগল।

দেখেই সুমাইয়া চোখ বড় বড় করে ফেলল। বলল-

: তাকিয়া, সই আমার! দে-না একটু পড়ি। পড়েই দিয়ে দেব। সত্যি বলছি, পড়েই দিয়ে দেব।

: তাকিমনি ঠোঁটে দুষ্টুমির একটা হাসি ঝুলিয়ে মাথা নেড়ে নেড়ে বলল, না-না, দেবো-না।

সুমাইয়ার মুখে ঝিলিক দিয়ে উঠল দুষ্টুমির পাল্টা হাসি। ঝাঁপিয়ে পড়ল বই কেড়ে নিতে। তাকিমনি হি হি করে হাসতে হাসতে এদিক সেদিক তিড়িং বিড়িং করে দৌড়াতে লাগল। সুমাইয়া তার পিছে  পিছে।

 

 

advertisement