কুরআনের স্বাদ থেকে যেন কেউ বঞ্চিত না হয়
* বিরাট একটা অপরাধ করা হচ্ছে মেয়েদেরকে লেখাপড়া না শিখিয়ে। আসলে মন-মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। আমরা ধরে নিয়েছি যে, এই অংশটার লেখাপড়া নেই, দুনিয়াবী লেখাপড়াও নেই, দ্বীনী লেখাপড়াও নেই। প্রতিকূল পরিবেশের কারণে তাদের দুনিয়াবী শিক্ষা বন্ধ হয়ে গেছে। দ্বীনী শিক্ষারও আদর্শ কোনো উদ্যোগ নেই। তাদেরকে সময়ও দেওয়া হয় না। আলিমরাও কি তাদের স্ত্রী-কন্যাদের সময় দেন? অথচ ইচ্ছা থাকলে ঘরোয়াভাবেও প্রয়োজনীয় দ্বীনী ইলম শিক্ষা দেওয়া যেত।
# আপনি একবার বলেছিলেন যে, মেয়েদের দ্বীনী তালীমের জন্য প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে সময় দেওয়াই যথেষ্ট।
* শুধু মেয়েদের জন্য নয়, ছেলেদের জন্যও যথেষ্ট। তবে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা কদর বেশি করে এবং সময়কে কাজে বেশি লাগায়। ছেলেদের মন থাকে মুনতাশির। না হয় একজন শিক্ষক যদি তরীকামতো এক ঘণ্টা সময় দেন তাহলে তা ছেলেদের জন্যও যথেষ্ট। কিন্তু ভাই! আমাদের না শিক্ষকতার অভ্যাস আছে, না শিক্ষকতার উপর কোনো মেহনত! এক আজীব-গরীব অবস্থা! ন্যূনতম ইজতিহাদী সালাহিয়্যাতের শিক্ষক, যিনি চিন্তা করতে পারেন যে, এই কিতাবটা এই ছেলেকে কীভাবে পড়াতে হবে, বহু মাদরাসায় দেখা যাবে, একজনও নেই। কোনো কোনো মাদরাসায় হয়তো পাওয়া যাবে একজন! উর্দূতে যাকে বলে ‘খাল-খাল’ ঠিক সেই রকম অবস্থা!
# অনেক পিতামাতার আগ্রহ থাকে, মেয়েকে হিফয করানোর। তবে আশঙ্কাও হয় যে, পরবর্তী জীবনে সে হিফয ঠিক রাখতে পারবে কি না। এক্ষেত্রে কী করণীয়?
* সুযোগ-সুবিধা থাকলে হিফয করানো ভালো। তখন ভবিষ্যতের চিন্তাও সেভাবেই করতে হবে, যেন হিফয ঠিক থাকে। তবে এটা ব্যাপকভাবে হওয়া উচিত নয়। আর চাপ প্রয়োগ করার তো প্রশ্নই আসে না। সহজভাবে যদি হয় ভালো। তবে কুরআন মজীদ বোঝার মতো যোগ্যতা অর্জন করা প্রত্যেকের কর্তব্য। কুরআনের স্বাদ থেকে যেন কেউ বঞ্চিত না হয়।
# তাহলে তো প্রথমে আরবী ভাষা শিখতে হবে। কিন্তু একটি নতুন ভাষা শেখার মতো দীর্ঘ সময় ও মেহনত দেওয়া অনেকের জন্যই কষ্টকর। বিশেষত মেয়েদের সংসার জীবন আরম্ভ হওয়ার পর তো সময় বের করা বেশ কঠিন।
* আরবী ভাষা শেখার দু’ টো পর্যায় আছে। প্রথম পর্যায় হল পড়তে পারা ও বুঝতে পারা। এটা কঠিন নয় এবং এটুকু যোগ্যতা অর্জনের জন্য লম্বা মেহনতেরও প্রয়োজন নেই। যেকোনো ভাষা কঠিন হয় প্রথমত বলতে, তারপর লিখতে। শুধু পড়া ও বোঝা হচ্ছে ভাষা শেখার প্রথম ধাপ। এটা সহজ। আমি তো প্রথম বর্ষের অনেক ছাত্রকে বলি, তোমাদের শুধু বুঝতে পারলেই চলবে। কিছু কিছু লেখার চেষ্টা কর, অল্প অল্প বলারও চেষ্টা কর, কিন্তু জান প্রাণ দিয়ে মেহনত করার দরকার নেই।
তরীকাটা এই হতে পারে যে, প্রথমে ‘এসো আরবী শিখি’ সহজভাবে, তামরীনাতের উপর জোর না দিয়ে, পড়তে হবে। বইটি একাধিকবার পড়া যায়। প্রথমবার পাক্কা ইয়াদ করে পড়ার দরকার নেই। মোটামুটিভাবে একবার পড়া হয়ে গেলে দ্বিতীয়বার ও তৃতীয়বার কিছু কিছু তামরীনসহ পড়বে। তবে লক্ষ রাখতে হবে, তামরীন ও অনুশীলন যেন বোঝা না হয়ে যায়। ‘আততামরীনুল কিতাবী’ও শুধু আরবী থেকে বাংলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। বাংলা থেকে আরবী অংশটার এই পর্যায়ে প্রয়োজন নেই, এরপর ‘কাসাসুন নাবিয়ীন’ প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড পড়ার পর ‘আত্তরীক ইলাল কুরআন’ পড়বে। তৃতীয় খণ্ডের বায়ানুল লোগাত, তারকীব, মোলাহাযাত এগুলি বাদ দিয়ে। এই পর্যন্ত হয়ে গেলে বাংলা তরজমায়ে কুরআন পড়ানো যাবে।
# নাহব্-ছরফ-বালাগাত ইত্যাদি বিষয়ের প্রয়োজন নেই?
* এই পর্যায়ের ভাষা-জ্ঞানের জন্য দরকার নেই। নাহ্ব, ছরফ, বালাগাত-এগুলো দরকার ফন্নী ইসতি’দাত ও শাস্ত্রীয় যোগ্যতা অর্জনের জন্য। মাদরাসার তালিবে ইলমদের জন্য তা দরকার। এরকম মেয়েদের মাদরাসা হলে তাদের নেসাবেও এগুলো থাকবে। কিন্তু পড়া ও বোঝার মতো ভাষা-জ্ঞান অর্জনের জন্য এগুলো অপরিহার্য নয়।
প্রসঙ্গত বলি, যিনি আল্লাহর কালাম বোঝার জন্য আরবী ভাষা শিখছেন তারও তরক্কী কোনো অংশেই কম হবে না। আল্লাহর কালাম যখন বুঝতে আরম্ভ করবেন তখন প্রতিদিনের তিলাওয়াতে তার তরক্কী হবে। হাদীস শরীফ পড়তে পড়তে তরক্কী হবে। আর এমন তো নয় যে, এটুকু যোগ্যতা অর্জনের পর আর আগে বাড়া যাবে না। যাদের সুযোগ আছে তারা আগে বাড়বে। তখন পরবর্তী পড়াশোনা- নাহব, ছরফ, বালাগাত ইত্যাদিও তার জন্য সহজ হয়ে যাবে।
# এভাবে তো হাদীস শরীফও পড়ানো যাবে?
* কুরআন মজীদ যদি পড়ানো যায় তাহলে হাদীস শরীফও পড়ানো যাবে। তবে হাদীসের ক্ষেত্রে অন্য একটি কাজ আছে। মেয়েদের জন্য হাদীস শরীফের একটি আলাদা ইন্তিখাব (সংকলন) লাগবে। মাদানী নেসাবেও হাদীসের ইন্তিখাব হবে ইনশাআল্লাহ। তখন এটাও সহায়তা করবে। এরপরও মেয়েদের উপযোগী একটি পূর্ণাঙ্গ ইন্তিখাব তৈয়ার করতে হবে। একইভাবে ‘তারীখে ইসলামী’র উপরও সংক্ষিপ্ত আকারে বই তৈরি করতে হবে, যা ছেলেরাও পড়তে পারে, মেয়েরাও পড়তে পারে।
এ তো গেল পড়াশোনার দিক। এছাড়া আরো কিছু দিক আছে। যেমন ফিকিরের উন্নতি ও আখলাকের উন্নতি। ওরা তো মা হবে, যেন আদর্শ মা হতে পারে সেজন্য সহায়তা করতে হবে।
শুদ্ধ ভাষার চর্চাও হওয়া দরকার। পিতামাতার কর্তব্য ছেলেমেয়েকে প্রথম থেকেই শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে শেখানো। আলিমদের এ বিষয়ে খুবই মনোযোগী হওয়া দরকার। উর্দূভাষী আলিমরা কিন্তু ভাষার বিষয়ে অনেক এগিয়ে গেছেন। সে তুলনায় আমরা অনেক পিছিয়ে আছি।
মেয়েরা ‘পুষ্প’ নিয়মিত পড়তে পারে। সব বিভাগ সবার জন্য দরকার নেই। শিশু-কিশোরদের জন্য যে বিষয়গুলি থাকে তা সবাই পড়তে পারে। এরপর যে যদ্দুর পারে পড়বে।
আমার মনে হয়, শুরু থেকেই মেয়েদের খুব দিলজুয়ী করা দরকার এবং উৎসাহ দেওয়া দরকার। ছেলেদের শাসন আর মেয়েদের শাসন কোনোভাবেই একরকম হওয়া উচিত নয়। মেয়েদের শাসনটা হওয়া উচিত খুবই দিলজুয়ীর সাথে এবং মন রক্ষা করে।
# অনেক সাধারণ মানুষের মাঝেও কুরআন বোঝার খুব আগ্রহ আছে। তাদের জন্যও তো এই পন্থাটা ফলপ্রসূ হতে পারে?
* খুব আগ্রহ বলেন না, আগ্রহ বলেন। ‘খুব’ শব্দটাকে একটু ইজ্জত করেন। এক ছেলে লিখেছে যে, ‘লেখা শেখার প্রতি আমার অতিশয় আগ্রহ।’ আমি তাকে লিখেছি, ‘আগ্রহ তো বুঝলাম, কিন' সে আগ্রহ যে অতিশয়-এ সিদ্ধান্ত তুমি কীভাবে নিলে?’ খুব আগ্রহ হলে তো রাস্তা বের হয়ে যায়। অথচ আমাদের অবস্থা এই যে, রাস্তা বের হওয়ার পরও কদর করা হয় না। সত্যি সত্যি যদি কারো আগ্রহ থাকে তাহলে আসমানের পক্ষ থেকে পথ খুলে যায়। আমি যখন একথাগুলো বলি অনেকে ভুল বোঝে। মনে করে যে, আমি ইমাম আবু হানীফা রাহ.কে দিয়ে তাদের আগ্রহ পরিমাপ করছি। ভাই! আমি তো আমার নিজেকে দিয়েও পরিমাপ করি না। ছাত্রদেরকে আমি রাত জাগতে দেই না। আমার মাদরাসায় তো দস্তুরমতো আইন যে, কেউ রাত জাগতে পারবে না। স্বাভাবিক নিয়মে লেখাপড়া করবে। এতে যদ্দুর মেহনত করা যায় করবে। আসলে মেহনত দিয়ে তো তুমি কিছুই করতে পারবে না, শুধু যেন আল্লাহর নুসরত হয়-এই ব্যবস্থাটা করতে হবে। ছাত্রদেরকে আমি এ কথাগুলোই বলি। তো মূল কথা হল, সত্যিকার আগ্রহ থাকলে আসমানের পক্ষ থেকেই ইনতিযাম হয়। আর আগেই বলেছি ছেলেদের জন্যও আরবী ভাষা শেখার এই পদ্ধতি ফলপ্রসূ হতে পারে।
# মেয়েদেরকে সময় দেওয়ার বিষয়ে আপনার নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কিছু বলুন।
* আল্লাহ তাআলার শোকর, মা-বাবার বিষয়ে বোনদের বিষয়ে, ছেলে-মেয়ের বিষয়ে সময় দেওয়ার ক্ষেত্রে আমি কখনো কার্পণ্য করিনি। এতে আমার সময়ে বরকত হয়েছে। কারণ সময় দিলে দোয়া পাওয়া যায়। আর কাজ তো দোয়ার দ্বারাই হয়। এটাই তো কেউ বোঝে না। আলী তানতাবী তাঁর বাবা সম্পর্কে শেকায়েত করেছেন যে, তিনি সময় দেননি। আমি লেখাটা ছেলেকে দেখিয়ে বলেছি, দেখ বাবা! তোমার কিন্তু এই শেকায়েতের সুযোগ নেই। আমি তোমাকে সময় দিচ্ছি।
এরপরও আমি যখন নিজের দিকে তাকাই তখন দেখি যে, সময়ের অনেক অপচয় আমি করেছি। এটা বোঝা যাবে সম্ভাবনার দিকে তাকালে। আর সব বাদ দেন, আমার কলমের কাজ যদ্দুর হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি হওয়া দরকার ছিল। মানুষ সব সময় আত্মতুষ্টির চিন্তা করে। শুধু কাজটুকু দেখে, সম্ভাবনা কী ছিল তা দেখে না। আমাদের সবারই কিন্তু সময়ের অপচয় হচ্ছে। অথচ মা-বাবার জন্য সময় দেওয়াকে, ছেলে-মেয়ের পিছনে সময় দেওয়াকে আমরা মনে করি সময়ের অপচয়। খুব দুঃখজনক একটি বিষয়।
অনেকের বাবা-মা দেশে আছে, নিজেও দেশে যায় না, স্ত্রী-পুত্রও নিজের সঙ্গে, ওদিকে বাবা-মা কষ্ট পায়। অথচ সে দ্বীনের খেদমত করছে। পরে দেখা যায়, বরকত হচ্ছে না। কেউ হয়তো বলবে, এ তো শরীয়তও বলে না যে, দ্বীনের কাজ ফেলে বাড়ি যেতে হবে; কিংবা স্ত্রী-পুত্রকে মা-বাবার কাছেই রাখতে হবে। সব কথা সহীহ, কিন্তু যখন ছেলেকে বিয়ে করায় তখন সব চিন্তা ও নযরিয়া পাল্টে যায়। তখন ছেলের উপর শেকায়েত যে, এখনি বউ নিয়ে যায়। অথচ আপনার আদর্শই তো ছেলের সামনে আছে। আবার অনেকে স্ত্রীর হকতলফী করে। ভারসাম্যপূর্ণভাবে চলা-এটা খুব কম।
সন্তানের ব্যাপারে অনেক পিতামাতার আজীব-গরীব মানসিকতা দেখা যায়। একজন আমাকে বলছে, ‘আমি অনেক কোরবানী করেছি, ছয় বছর বয়সে ছেলেকে শাহতলীতে দিয়ে দিয়েছি!’ আমি তাকে বললাম, আপনার মতো জালেম তো দুনিয়াতে দ্বিতীয়জন নেই। ছেলের উপর এত বড় জুলুম মানুষ করে? ছয় বছর বয়সে তাকে এত দূরে পাঠিয়ে দিয়েছেন?
এগুলি অনেকেই বোঝে না। পরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে আফসোস করে।
# এই মজলিসে অনেক ফায়দার কথা এসেছে। জাযাকুমুল্লাহু খায়রান।
* ওয়া ইয়্যাকুম! আল্লাহ কবুল করুন এবং আমলের তাওফীক দান করুন।
[মাদরাসুলত মাদীনাহ থেকে মারকাযুদ দাওয়াহয় আসার পথে গাড়িতে এই সাক্ষারটিতে গ্রহণ করা হয়েছিল।
সাক্ষাতকার গ্রহণ করেছেন : মুহাম্মাদ যাকারিয়া আবদুল্লাহ]