মুহাররম ১৪৪০   ||   অক্টোবর ২০১৮

সু স্থ তা : ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ

আব্দুল্লাহ আবু মুহাম্মাদ

এবারও রাজধানীতে অনেক মানুষ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। মিডিয়া সূত্রে জানা যাচ্ছে, শুধু রাজধানীতেই এ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা চার হাজারের কম নয়। এডিস মশাবাহিত এই জ্বরে রোগীর মৃত্যুও ঘটতে পারে। ইতিমধ্যে ৭-৮ জনের মৃত্যুর সংবাদও পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে সতকর্তা ও সচেতনতা কাম্য।

জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ডেঙ্গু-আক্রান্তের সংখ্যা কম থাকলেও মে থেকে বৃষ্টিপাত বাড়ার সাথে সাথে ডেঙ্গু  ও চিকুনগুনিয়ার প্রকোপও বৃদ্ধি পায়। জুন মাসে নতুন করে মওসুমি বৃষ্টিপাত হয় কিছুটা বিরতি দিয়ে। এই বিরতির সময়ই এডিস মশা সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করে।

বাসা-বাড়িতে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা বংশবৃদ্ধি করে। ঘরের শোভাবৃদ্ধির জন্য গাছ ও ফুলের টবের পানি, এসি ও ফ্রিজ থেকে বের হওয়া পানি এবং অন্যান্য স্থানের জমে থাকা পানি এডিস মশার বংশবৃদ্ধির অনুকূল স্থান। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোর বাসা-বাড়িতে এডিস মশার বংশবিস্তারের হার অপেক্ষাকৃত বেশি।  কাজেই বাসা-বাড়ির ভিতরে ও বাইরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও শুষ্ক রাখার ব্যাপারে যত্নবান হতে হবে।

রোগ-ব্যাধি ও বিপদাপদের ব্যাপারে উদাসীনতা কাম্য নয়; বরং সতর্কতা ও সচেতনতা কাম্য। হাদীস শরীফে দৈনন্দিন জীবনের নানা বিষয়ে সতর্কতার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। সহীহ বুখারীর একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

خَمِّرُوا الآنِيَةَ، وَأَجِيفُوا الأَبْوَابَ، وَأَطْفِئُوا المَصَابِيحَ، فَإِنّ الفُوَيْسِقَةَ رُبّمَا جَرّتِ الفَتِيلَةَ فَأَحْرَقَتْ أَهْلَ البَيْتِ.

অর্থাৎ (রাতে শোবার সময়) বরতনসমূহ ঢেকে রাখবে, দরজা বন্ধ করবে এবং বাতি নিভিয়ে দিবে। কারণ কখনো ইঁদুর সলতে টেনে ঘরের অধিবাসীদের আগুনে পুড়িয়ে দেয়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬২৯৫

অন্য হাদীসে আছে-

إِذَا آوَى أَحَدُكُمْ إِلَى فِرَاشِهِ فَلْيَنْفُضْ فِرَاشَهُ بِدَاخِلَةِ إِزَارِهِ، فَإِنّهُ لاَ يَدْرِي مَا خَلَفَهُ عَلَيْهِ.

অর্থাৎ তোমরা যখন বিছানায় যাও তখন তহবন্দের ভেতরের অংশ দিয়ে বিছানাটি ঝেড়ে নেবে। কারণ, তোমাদের অনুপস্থিতিতে বিছানায় কী এসেছে তা তোমাদের জানা নেই। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৩২০

এই হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনুল আরাবী রাহ. বলেছেন-

هَذَا مِنَ الْحَذَرِ وَمِنَ النّظَرِ فِي أَسْبَابِ دَفْعِ سُوءِ الْقَدَرِ.

অর্থাৎ এটি সতর্কতা ও মন্দ ভাগ্যের কারণসমূহের বিষয়ে সচেতন থাকার শিক্ষার একটি উদাহরণ। -ফাতহুল বারী ১১/১২৭

এই পবিত্র হাদীসদুটি আমাদের সাবধানতা অবলম্বনের শিক্ষা দিচ্ছে। এই শিক্ষার অনুসরণ কাম্য এবং এর অনুসরণের মাঝে রয়েছে কল্যাণ ।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনিস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান জানিয়েছেন, ‘ডেঙ্গুজ্বর হলে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত ১০৪-১০৫ ডিগ্রি (ফারেনহাইট) পর্যন্ত উঠতে পারে। সাথে মাথা ব্যথা, মাংসপেশি, চোখের পেছনে ও হাড়ে প্রচÐ ব্যথা, ত্বকে লালচে ছোপ (র‌্যাশ) দেখা দেবে। এ সময় রোগীকে প্রচুর তরল খাবার খাওয়াতে হবে এবং মশারির ভেতরে বিশ্রামে রাখতে হবে। জ্বরে শুধু প্যারাসিটামল ব্যবহার করা যেতে পারে। কোনো অবস্থাতেই এসপিরিন (এনএসএআইডি) জাতীয় ওষুধ দেয়া যাবে না। হেমোরেজিক ডেঙ্গুজ্বর ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হলে দাঁতের মাড়ি, নাক, মুখ ও পায়খানার রাস্তা দিয়ে রক্তপাত হতে পারে। সেক্ষেত্রে বিলম্ব না করে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।’

সুস্থতা আল্লাহ তাআলার নিআমত। সুস্থতা রক্ষার সাধারণ উপায়গুলো অবলম্বন করা এই নিআমতের শোকরগোযারির অন্তর্ভুক্ত। কাজেই রোগ-ব্যাধির ক্ষেত্রে সচেতনতা, সতর্কতা যেমন কাম্য তেমনি আক্রান্ত হয়ে গেলে সঠিক চিকিৎসা ও বিশেষজ্ঞ-পরামর্শ অনুসরণও কাম্য। এটা তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী নয়।

রোগ-ব্যাধি আল্লাহর হুকুমে হয়। এর কারণগুলোও তাঁরই সৃষ্টি। রোগের কারণ এবং রোগমুক্তির উপায়গুলোও কাজ করে একমাত্র তাঁরই হুকুমে। কাজেই সুস্থতার সাধারণ উপায়গুলো অবলম্বনের সাথে বিশ্বাস রাখতে হবে যে, এই প্রচেষ্টার ফলাফল নির্ভর করে আল্লাহর ইচ্ছার উপর। এই ঈমান ও বিশ্বাসের সাথেই একজন মুসলিম সতর্কতামূলক পদক্ষেপ এবং আরোগ্যের উপায় অবলম্বন করেন। বিশ্বাস ও কর্মের এই সমন্বিত রূপটিই ইসলামের শিক্ষা।

একারণে এই শিক্ষার অনুসারীগণ যেমন সকল পরিস্থিতিতে প্রধানত আল্লাহ তাআলার দিকে রুজু করেন এবং তাঁরই কাছে সুস্থতা ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করেন তেমনি যুক্তিসঙ্গত চেষ্টা-প্রচেষ্টাতেও ত্রæটি করেন না। এই সকল চেষ্টার সুফলের জন্যও তাঁরই উপর ভরসা রাখেন। আর সর্বাবস্থায় তাঁর ইচ্ছায় সন্তুষ্ট থাকেন। এভাবে জীবনের প্রতিটি অবস্থায় স্বাভাবিক চেষ্টা-প্রচেষ্টার সাথে আল্লাহর উপর ভরসা ও আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকা তাদের বৈশিষ্ট্য হয়ে থাকে। ফলে জীবনের সকল অবস্থা তাদের জন্য যেমন আখিরাতের সঞ্চয় হয়ে যায় তেমনি শান্তি ও স্বস্তির এক পবিত্র আবহ তাদের বেষ্টন করে রাখে।

হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

لَا يَمْرَضُ مُؤْمِنٌ وَلَا مُؤْمِنَةٌ، وَلَا مُسْلِمٌ وَلَا مُسْلِمَةٌ، إِلّا حَطّ اللهُ بِهَا عَنْهُ خَطَيئَتَهُ.

কোনো মুমিন নারী-পুরুষ কিংবা মুসলিম নারী-পুরুষ যখন অসুস্থ হয় আল্লাহ তাআলা এর বিনিময়ে তার ভুলত্রæটি ক্ষমা করে দেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৪৭২৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ২৯২৭

আল্লাহ তাআলা সবাইকে দুনিয়া-আখিরাত উভয় জাহানে ভালো রাখুন, শান্তিতে রাখুন- আমীন।

 

 

advertisement