জুমাদাল আখিরাহ ১৪৩১   ||   জুন ২০১০

ইলমী নিমগ্নতা : সে যুগে এ যুগে

একজন তালিবে ইলম

আমরা তালিবে ইলম। এটিই আমাদের প্রধান পরিচয়। আমরা এক বিশাল কাফেলা, সময়ের কোনো অংশ এবং পৃথিবীর কোনো ভূ-খণ্ড কখনো আমাদের উপস্থিতি থেকে শূন্য হয়নি। আমরা যেখানে যতদূরেই থাকি, আমাদের মাঝে সময়ের ব্যবধান যতই থাকুক আমাদের পরিচয় একটিই-আমরা তালিবে ইলম। ইলমের বন্ধনের চেয়ে বিস্তৃত ও গভীর বন্ধন আর দ্বিতীয়টি নেই। আমাদের এই কাফেলার কাজ কী? কী তাদের দিবা-রাত্রির ব্যস্ততা? তার উত্তরও একটিই, যা নিহিত আছে ঐ পরিচয়মূলক শব্দটির ভেতরে। তালিবে ইলমের একমাত্র কাজ ‘তলবে ইলম’। অর্থাৎ ইলম-অন্বেষণ। এছাড়া তালিবে ইলমের আর কোনো কাজ নেই। আমাদের দিন ইলম অর্জনের, আমাদের রাত ইলম অর্জনের। আমাদের শয়ন-জাগরণের কাজও ইলম অর্জন। আমাদের সব আয়োজন এবং আমাদের সব প্রয়োজনের কেন্দ্রবিন্দু ‘ইলম অর্জন।’ ইলম অর্জনের নিমগ্নতায় কেটে যাবে আমাদের প্রতিটি মুহূর্ত। চোখে ইলমের নূর। হৃদয় ও আত্মায় থাকবে তলবের জযবা। কিন্তু আমাদের বর্তমান অবস্থা এমন নয়। অত্যন্ত আফসোসের সাথে বলতে হয় যে, আমরা যারা তালিবে ইলম, তাদের অবস্থা এখন বড়ই করুণ। বড়ই বেদনাদায়ক। নিমগ্নতা ও নিবিষ্টতার মহান সম্পদ আমরা হারিয়ে ফেলছি ধীরে ধীরে। আমাদের তলবের জযবায় ঘুণ ধরেছে আর আমরা বিস্মৃত হতে চলেছি আমাদের আত্মপরিচয়। দোকানে-বাজারে যেকোনো মেলা ও মাহফিলে আমরা আছি। বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই অনেকটা দর্শক হিসেবে আমরা মাহফিলে মাহফিলে ঘুরে বেড়াই। সুযোগ পেলেই মাদরাসা থেকে বের হয়ে যাই। যেন এসব আয়োজনে আমাদের উপস্থিতি একান্ত জরুরি। অথচ ভালো কোনো মজমাতেও তো শুধু যাওয়ার জন্য যাওয়া এবং শুধু দেখার জন্য দেখা কোনো তালিবে ইলমের শান হতে পারে না। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যার সাধনার লগ্ন, তার আবার তামাশা দেখার সময় কোথায়? তালিবানে ইলম তো মুয়াত্তা মালিকের ‘রাবী’ হযরত ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়া মাসমুদী রাহ. (২৩৪ হি.)-এর কাফেলা। যিনি সুদূর আন্দালুস থেকে মদীনায় ইমাম মালেক রাহ.-এর দরসে এসেছিলেন। সে যুগে আরব দেশে হাতি ছিল না। একদিনের ঘটনা। ইমাম মালেক রাহ.-এর দরসগাহে কে যেন বলল ‘হাতি এসেছে’। শোনামাত্র সবাই বাইরে ছুটে গেল। ইতিমধ্যে ইমাম মালেক রাহ. দরসে এলেন এবং শুধু ইয়াহইয়া মাসমুদীকে দেখতে পেলেন। ইমাম মালেক রাহ. তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়াহইয়া! তুমি গেলে না যে! তোমাদের আন্দালুসে তো হাতি নেই। তখন তিনি উত্তর দিলেন, ‘আমি তো সুদূর আন্দালুস থেকে এসেছি আপনাকে দেখার জন্য।’ এই উত্তর শুনে ইমাম মালেক রাহ. বললেন, هذا عاقل أندلس এতো আন্দালুসের বুদ্ধিমান! (নাফহাহুত তীব ২/৯) ফল এই হয়েছিল, মুয়াত্তার দরসে হয়তো অনেকেই শরীক হয়েছিল, কিন্তু ইয়াহইয়া মাসমুদীর বর্ণিত মুয়াত্তার রেওয়ায়াতটিই মাশরিক ও মাগরিবে সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। কেউ হয়তো বলতে পারে, এ তো দূর অতীতের কথা। এখন কি এত নিষ্ঠা সম্ভব? তাহলে নিকট অতীতের একটি ঘটনা বলি। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়ার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মুফতী আযিযুল হক রাহ. (১৩৮০ হি.)-এর ছাত্রজীবনের কথা। তখন তিনি জিরি মাদরাসায় অধ্যয়নরত। তখন সবেমাত্র এ দেশের আকাশে বিমান উড়তে শুরু করেছে। একদিনের ঘটনা। বিমানের গর্জন শোনামাত্র দরসগাহের সবাই বের হয়ে গেল বিমান দেখতে। হযরত মুফতী আযিযুল হক রাহ. একটি কিতাব মুতালাআ করছিলেন। তাঁরও একবার মনে হল, জীবনে প্রথমবারের মতো এই বিস্ময়কর আবিষ্কারটি না হয় দেখেই আসি! কিন্তু আবার মনে হল, আহামরি আর কী হবে, কত পাখিই তো আকাশে উড়ে! একথা ভেবে আবারো মুতালাআয় ডুবে গেলেন। (তাযকিরায়ে আযীয, মাওলানা সুলতান যওক নদভী পৃ. ৩৮) তামাশার পেছনে পড়েননি বলে আজও তারা ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন। যুগ যুগ ধরে তাঁরাই স্মরণীয় বরণীয় হয়ে থাকবেন। তাই ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র প্রয়োজনের কথা ভেবে একজন তালিবে ইলম জীবনের মূল্যবান সময় বিসর্জন দিতে পারে না। জীবনের কোনো প্রয়োজন এমন আছে কি, যা ইলম অর্জনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে? অতএব অমুকের বিয়ে, অমুকের মৃত্যুসহ নানা প্রসঙ্গে আমরা যেভাবে অস্থির হয়ে ছুটে যাই তাতে এই প্রশ্ন অবশ্যই দাঁড়ায় যে, আমার উপস্থিতি সেখানে কতটা অনিবার্য ছিল? আমার অনুপস্থিতিতে কোন কাজটি অসম্পূর্ণ থাকত? মনে রাখতে হবে, সকল ডাকে সাড়া দিলে আমরা আমাদের মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হব। আমার দিন-রাতের একমাত্র কাজ তো ইলম-অন্বেষণ। অতএব সাড়া দেওয়ার সময় কোথায়? আমাদের কাফেলার যারা আকাবির-রাহবার তাদের অবস্থা কিন্তু এমনই ছিল। ফিকহুল মুকারানের প্রসিদ্ধ কিতাব ‘বিদায়াতুল মুজতাহিদ’ এর নাম আমরা সকলেই জানি। এই কিতাবের মুসান্নিফ আল্লামা ইবনে রুশদ রাহ. (৫৯৪ হি.) এর জীবনীতে এসেছে, ‘জ্ঞান-বুদ্ধি হওয়ার পর হতে তিনি দুটি রাত ব্যতীত কখনো ইলমী শোগল ছাড়া কাটাননি। একটি পিতার মৃত্যুর রাত, অপরটি তার বিয়ের রাত।’ (সিয়ারু আলামিন নুবালা ১৫/৪৫২) কিন্তু আমরা? আমরা কি এর কাছাকাছি কোনো ইতিহাস রচনা করতে পেরেছি? আমরাও একবার দেখে নিতে পারি আমাদের অতীত। তাঁরাও তালিবে ইলম আর আমরাও তালিবে ইলম! এসব ঘটনা হয়তো আমাদের অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য বলে মনে হবে। আবার কারো মনে হতে পারে যে, এ তো সে যামানার কথা! বর্তমান যুগে কি তা সম্ভব? তাহলে এই যুগের একজন জ্ঞান-সাধকের কাহিনীও আমি তুলে ধরি। মেলালে বুঝা যাবে, দু’ যুগের সাধকদের সাধনার কত মিল! হাতের কাছে পুষ্পসমগ্র থাকলে এর ৩৯৬, ৪০২ পৃষ্ঠা উল্টে দেখুন। একটি আদর্শ দৃষ্টান্ত দেখতে পাবেন। ‘আমার আব্বা/দুই জীবনের সন্ধিক্ষণে’ শিরোনামে সেই ‘অশ্রুভেজা’ লেখাটির কিছু অংশ তুলে ধরার লোভ সম্বরণ করতে পারছি না। ‘... এখন রাত একটা। আব্বার জানাযা এখনও মাটির উপরে আমাদের ঘরে, যেখানে তাঁর মৃত্যু হয়েছে সেখানে। নীচে গিয়ে দেখে এলাম। মুখমণ্ডলে মৃত্যু-যন্ত্রণার চিহ্ন নেই। যেন পরম প্রশান্তির একটি স্নিগ্ধ পরশ বুলিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন তালিবে ইলমের জামাত তাঁকে গোসল দেবে, কাফন পরাবে। আমি ফিরে এলাম আমার কাগজ-কলমের কাছে। আজকের দেখা মৃত্যুর কথা লিখতে আমার ভালো লাগছে। ... নীচে গিয়ে (আবার) দেখে এলাম। আমার এহরামের কাপড় দিয়ে আব্বাকে ঢেকে রাখা হয়েছে। গোসলের পর আতর মেখে চোখে সুরমা লাগানো হচ্ছে। আমার হৃদয়ে একটি আনন্দ-তরঙ্গ অনুভূত হল, আব্বা কি আখেরাতের বাসরঘরের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন! আমি আবার ফিরে এলাম আমার কাগজ-কলমের কাছে। আজকের দেখা মৃত্যুর কথা লিখতে আমার ভালো লাগছে। ... নীচে এলাম আব্বাকে আরেকবার দেখে আসতে। সবকিছু দেখে বড় শান্তি লাগলো। ... আমি আবার ফিরে এলাম আমার কাগজ-কলমের কাছে। আজকের দেখা মৃত্যুর কথা লিখতে আমার ভালো লাগছে। আমারও হৃদয়ে সুন্দর মৃত্যুর তামান্না জাগছে। ... এখন রাত তিনটা। নীচে গিয়ে আব্বাকে আবার দেখলাম। কাফন-সজ্জা হয়ে গেছে। তিনি এখন জানাযার খাটে শুয়ে আছেন। ... আম্মাকে দুটি সান্ত্বনার কথা বলে আমি ফিরে এলাম কাগজ কলমের কাছে। আজকের দেখা মৃত্যুর কথা লিখতে আমার ভালো লাগছে। আমার হৃদয়ে একটি সুন্দর মৃত্যুর তামান্না জাগছে। আব্বার জানাযা নীচে আমাদের ঘরে। আর আমি কলম হাতে পুষ্পের দফতরে। চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে, আর কলম থেকে শব্দ ঝরছে। আমি লিখে চলেছি আমার জীবনের প্রথম ‘অশ্রুভেজা’ লেখা। ...’ এ হল এ যুগের তালিবে ইলম আমাদের প্রিয় আদীব হুজুরের ঘটনা। শুনেছি, তার বিয়ের রাতেও ইলমী মাশগালা অব্যাহত রাখার সুযোগ হয়েছে। সত্যি এটি যুগের পার্থক্য নয়, পার্থক্য শুধু মানসিকতার। সে যুগের তালিবে ইলম ইয়াহইয়া মাসমুদীরা যদি হাতি দেখতে বের না হন তবে এ যুগের মুফতী আযিযুল হকরা বিমানের পিছনে ছুটে চলেননি। সে যুগের ইবনে রুশদরা যদি পিতার মৃত্যু রাত্রি ও বিয়ে রাত্রি ছাড়া জীবনের অন্য কোনো রাত ইলমের শোগল ছাড়া না কাটিয়ে থাকেন, তবে এ যুগের ইবনে মিসবাহ সেই দু’ রাতেও অব্যাহত রাখেন তাদের জ্ঞান-সাধনা। এ যুগ তো চায় আরো বেশি মেহনত, আরো বেশি মুজাহাদা। অতএব আজ একবার আমাদেরকে ফিরে তাকাতে হবে নিজেদের দিকে, চিনতে হবে নিজেদেরকে, জানতে হবে নিজেদের আত্মপরিচয়। অনুধাবন করতে হবে যে, জীবনের সব প্রয়োজন আমার নয়, সমাজের সব আয়োজনও আমার জন্য নয়। তাই জীবনের সব আহ্বানে আমার সাড়া দেওয়ার নয়, সমাজ ও সংসারের সব প্রয়োজনে ছুটে চলাও আমার দায়িত্ব বহির্ভুত। কারণ আমার লক্ষ্য তো মাত্র একটি। আর তা হল ‘তলবে ইলম’। কারণ আমি যে ‘তালিবে ইলম।’

 

advertisement