মুহাররম ১৪৪০   ||   অক্টোবর ২০১৮

হজ্বের পর : হজ্ব-পরবর্তী জীবনের আলোক-প্রদীপ

হজ্বের মওসুম শেষ হয়েছে। আল্লাহর বান্দাগণ দেশে ফিরে আসছেন। একটি ভূখণ্ডের জন্য এটা খুবই বরকতের বিষয় যে, এখান থেকে আল্লাহর বান্দারা আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে আল্লাহর ঘরের দিকে যান, এরপর আল্লাহর বিধান পালন করে সেই ভূখণ্ডে প্রত্যাবর্তন করেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন, ‘জনপদের অধিবাসীরা যদি জানত তাদের উপর হজ্ব আদায়কারীদের কী হক, যখন তারা তাদের কাছে ফিরে আসে, তাহলে তারা তাদের সওয়ারিগুলোকেও চুমু খেত! এঁরা তো সকল মানুষের মাঝে আল্লাহর প্রতিনিধি দল।’ -শুআবুল ঈমান, বাইহাকী ৮/৫৩

হজ্ব আদায়ের সূত্রে আল্লাহর সাথে বান্দার এই যে নিসবত এবং এ নিসবতের এই যে মর্যাদা, তা যেমন অন্যদের উপলব্ধির বিষয়, তেমনি যাদের হজে¦র মতো মর্যাদাবান ইবাদত আদায়ের সৌভাগ্য হয়েছে তাদেরও উপলব্ধির বিষয়। এই মহা নিসবতের মর্যাদা উপলব্ধি করতে পারলেই তো তা রক্ষা করার ব্যাপারে যত্নবান হওয়া যাবে।

জীবনের কোনো কাজকেই হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়। মনুষ্যজীবনের কোনো কিছুই হালকা নয়। কারণ তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত এবং সেই মুহূর্তের কাজের বিষয়ে জবাবদিহিতার প্রসঙ্গ আছে। জীবনের কাজগুলো ভালো হোক বা মন্দ, কিছুতেই গুরুত্বহীন নয়; যে কোনো মানুষের ক্ষেত্রেই এ বিষয়টি সত্য এবং মানুষমাত্রেরই এই বাস্তবতা উপলব্ধি করা প্রয়োজন। এরপর যাদের আল্লাহ ঈমানের মতো মহা নিআমত দান করেছেন, যাদের বুকের ভিতর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ঐশী প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছেন তাদের কাছে তো জীবন ও কর্মের মূল্য একেবারেই স্পষ্ট। জীবনের কোনো কথা ও কাজই যে গুরুত্বহীন নয়, প্রতিটি কথা ও কাজের সাথেই যে রয়েছে শেষ পরিণামের ভালো-মন্দের গভীর সম্পর্ক- এ হাকীকত তো তাদের কাছে মোটেই অস্পষ্ট থাকে না। তাঁদের বিশ্বাস- যে যাররা পরিমাণ ভালো কাজ করবে সে তা দেখবে আর যে যাররা পরিমাণ মন্দ কাজ করবে সে তা দেখবে। তাহলে জীবনের কাজকর্ম কীভাবে অবহেলাযোগ্য হতে পারে?

মুমিন তো বিশ্বাস করে, প্রত্যেকের জন্য বিশ্বাস ও কর্মের ঐ পথটিই সহজ করে দেওয়া হয়, যে পথের শেষ পরিণামের জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। কাজেই সে যখন পুণ্য ও ভালোর পথে চলার তাওফীকপ্রাপ্ত হয় তখন তার মনে উত্তম পরিণামের প্রত্যাশা জন্ম নেয়। তার মন আনন্দে ভরে ওঠে এবং এই পথে অটল থাকার চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করে। পক্ষান্তরে যখন পাপ ও মন্দের পথে চলে তখন তার মনে অশুভ পরিণামের আশঙ্কা জাগে এবং দ্রুত সে ঐ পথ থেকে ফিরে আসে এবং ভালোর পথে চলা শুরু করে। আশা ও ভয়ের মাঝে আশার পাল্লা ভারী করার চেষ্টা মুমিনের কাজ-কর্মের নিয়ন্ত্রক ও পরিচালক হয়ে দাঁড়ায়।

কাজেই কোনো ভালো কাজের তাওফীক হলে সেটার গুরুত্ব ও মর্যাদা উপলব্ধি করা এবং সেই মর্যাদা ও গুরুত্ব রক্ষা করা অতি প্রয়োজন। ছোট-বড় সকল ভালো কাজের ব্যাপারেই একথা। হজ্ব  তো বড় কাজগুলোর মধ্যেও উপরের দিকের বড় কাজ। এটি একটি ফরয আমল, ইসলামের অন্যতম প্রধান রোকন। কাজেই এই আমলের মর্যাদা রক্ষা করার চেষ্টা অবশ্যকর্তব্য।

হজ্ব এবং অন্যান্য ইবাদত ও নেক আমলের মর্যাদা রক্ষার সাধারণ উপায় হচ্ছে আল্লাহ তাআলার ইবাদত ও ইতাআতের পথে অবিচল থাকা। নিজের বিশ্বাস ও কর্মের মুহাসাবা করে ত্রæটিগুলো সংশোধনের চেষ্টা করা। বর্তমান দ্বীনদারি রক্ষা করা এবং প্রতিদিন কিছু পরিমাণে হলেও উন্নতির চেষ্টা করা।

এটি একটি সাধারণ কথা, যা সকল ইবাদতের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে প্রযোজ্য। এরপর প্রত্যেক আমল ও ইবাদতের মধ্যে এমন কিছু শিক্ষার উপাদান রয়েছে, যা বিশেষভাবে আমাদেরকে সামনের জীবনের দুরস্তির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং  উৎসাহিত করে। হজে¦র মধ্যে এমন উপাদান অনেক রয়েছে, তা সঠিকভাবে উপলব্ধি করলে তা আমাদের সামনের জীবনের জন্য প্রেরণার ও পথ প্রদর্শনের আলোকবর্তিকা হতে পারে। যেমন আমরা চিন্তা করতে পারি, আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজে¦র খুতবাগুলোতে কী শিক্ষা, কী বিধান দান করেছিলেন। সেই শিক্ষা ও নির্দেশনাগুলোকে আমরা বিশেষভাবে আমাদের সামনের জীবনের পথনির্দেশক হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। নমুনা স্বরূপ একটি-দুটি হাদীস এখানে উল্লেখ করছি।

হযরত আবু উমামা বাহেলী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিদায় হজে¦র খুতবায় বলতে শুনেছি-

اتّقُوا اللهَ رَبّكُمْ، وَصَلّوا خَمْسَكُمْ، وَصُومُوا شَهْرَكُمْ، وَأَدّوا زَكَاةَ أَمْوَالِكُمْ، وَأَطِيعُوا ذَا أَمْرِكُمْ تَدْخُلُوا جَنّةَ رَبِّكُمْ.

তোমরা আল্লাহকে ভয় করো,  তোমাদের পাঁচ (ওয়াক্ত) নামায আদায় করো, তোমাদের সম্পদের যাকাত দিও এবং তোমাদের দায়িত্বশীলের অনুগত থেকো। তাহলে তোমাদের রবের জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৬১৬

হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হজে¦র যে দীর্ঘ বিবরণ দিয়েছেন, তাতে আরাফার ময়দানে তাঁর প্রদত্ত খুতবার জ্যোতির্ময় কিছু বাণীর উল্লেখ এভাবে এসেছে :

إِنّ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ حَرَامٌ عَلَيْكُمْ، كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا فِي شَهْرِكُمْ هَذَا، فِي بَلَدِكُمْ هَذَا، أَلَا كُلّ شَيْءٍ مِنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيّةِ تَحْتَ قَدَمَيّ مَوْضُوعٌ، وَدِمَاءُ الْجَاهِلِيّةِ مَوْضُوعَةٌ، وَإِنّ أَوّلَ دَمٍ أَضَعُ مِنْ دِمَائِنَا دَمُ ابْنِ رَبِيعَةَ بْنِ الْحَارِثِ، كَانَ مُسْتَرْضِعًا فِي بَنِي سَعْدٍ فَقَتَلَتْهُ هُذَيْلٌ، وَرِبَا الْجَاهِلِيّةِ مَوْضُوعٌ، وَأَوّلُ رِبًا أَضَعُ رِبَانَا رِبَا عَبّاسِ بْنِ عَبْدِ الْمُطّلِبِ، فَإِنّهُ مَوْضُوعٌ كُلّهُ، فَاتّقُوا اللهَ فِي النّسَاءِ، فَإِنّكُمْ أَخَذْتُمُوهُنّ بِأَمَانِ اللهِ، وَاسْتَحْلَلْتُمْ فُرُوجَهُنّ بِكَلِمَةِ اللهِ، وَلَكُمْ عَلَيْهِنّ أَنْ لَا يُوطِئْنَ فُرُشَكُمْ أَحَدًا تَكْرَهُونَهُ، فَإِنْ فَعَلْنَ ذَلِكَ فَاضْرِبُوهُنّ ضَرْبًا غَيْرَ مُبَرّحٍ، وَلَهُنّ عَلَيْكُمْ رِزْقُهُنّ وَكِسْوَتُهُنّ بِالْمَعْرُوفِ، وَقَدْ تَرَكْتُ فِيكُمْ مَا لَنْ تَضِلّوا بَعْدَهُ إِنِ اعْتَصَمْتُمْ بِهِ، كِتَابُ اللهِ.

তোমাদের শোণিত ও সম্পদ পরস্পরের উপর এমনই হারাম যেমন তোমাদের আজকের এই দিনটি, তোমাদের এই মাসে, তোমাদের এই শহরে! শোনো, জাহিলিয়্যাতের সবকিছু আমার দুই পায়ের নীচে। জাহিলী যুগের সকল রক্তের দাবি রহিত। আর সর্বপ্রথম যে রক্তের দাবি রহিত করছি, তা আমাদের রক্তের দাবি, রবীআ ইবনে হারিছের রক্তের দাবি। সে বনু সা‘দ কবীলায় দুধমায়ের কাছে ছিল, হুযাইল গোত্র তাকে হত্যা করে।

জাহেলী যুগের সকল সুদ রহিত। আর সর্বপ্রথম যে সুদ রহিত করছি তা আমাদের প্রাপ্য সুদ- আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের সুদ। তা সম্পূর্ণরূপে রহিত। এরপর শোনো, স্ত্রীদের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করো। কেননা তোমরা তাদের গ্রহণ করেছ আল্লাহর নিরাপত্তায় আর তাদের লজ্জাস্থানকে হালাল করেছ আল্লাহর কালিমার দ্বারা। তাদের কাছে তোমাদের অধিকার এই যে, তোমরা অপছন্দ করো এমন কাউকে অর্থাৎ পর পুরুষকে তোমাদের বিছানায় স্থান দিবে না। এটা যদি তারা করে তাহলে তোমরা তাদের হালকা প্রহার করতে পারবে। আর তোমাদের কাছে তাদের অধিকার হচ্ছে, নিয়মমতো তাদের খাদ্য ও বস্ত্রের সংস্থান করা। আমি তোমাদের মাঝে এমন বস্তু রেখে যাচ্ছি, যার পর তোমরা কিছুতেই গোমরাহ হতে পার না, যদি তোমরা আল্লাহর কিতাবকে অবলম্বন কর।... -সহীহ মুসলীম, হাদীস ১২১৮

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হজে¦র খুৎবার একটি অংশ বর্ণনা করার পর বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন-

فَوَالّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، إِنّهَا لَوَصِيّتُهُ إِلَى أُمّتِهِ، فَلْيُبْلِغِ الشّاهِدُ الغَائِبَ، لاَ تَرْجِعُوا بَعْدِي كُفّارًا، يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَابَ بَعْضٍ

ঐ সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, এ তো আপন উম্মতের প্রতি তাঁর অসীয়ত। কাজেই উপস্থিত যেন অনুপস্থিতকে পৌঁছে দেয়- তোমরা আমার পরে কাফিরদলে পরিণত হয়ো না যে, একে অপরের গর্দান ওড়াবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৭৩৯

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ কিয়ামত পর্যন্ত তার সকল উম্মতের জন্য। সকলের কর্তব্য, সে নির্দেশ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে নিজের কর্ম ও জীবনে তা প্রতিফলিত করা। বিশেষত যাঁরা হজে¦র মোবারক আমলটি আদায় করেছেন, মিনা-আরাফার সেই পবিত্র স্থানের যিয়ারত করে এসেছেন তাঁরা তো ঐসকল স্থানে উচ্চারিত প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ ও নির্দেশনাকে জীবন ও কর্মে ধারণ করার বেশি হক্বদার। আমাদের হজ্ব-পরবর্তী জীবনের জন্য সেই পবিত্র অসীয়তকে আমরা যেন আলোকবর্তিকা হিসেবে গ্রহণ করি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন।

 

 

advertisement