যিলহজ্ব ১৪৩৯   ||   সেপ্টেম্বর ২০১৮

মহীয়সী নারীদের জীবনকথা

মাওলানা এমদাদুল হক

হুজায়মা বিনতে হুয়াই

প্রখ্যাত নারী তাবেয়ী হুজায়মা বিনতে হুয়াই। উপনাম উম্মুদ্ দারদা আস সুগরা। প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবুদ্ দারদা রা.-এর দ্বিতীয় পত্নী। হযরত আবুদ্ দারদা রা. দুইটি বিবাহ করেন। প্রথম স্ত্রীর উপনামও উম্মুদ্ দারদা, তবে তাকে বলা হয় বড় উম্মুদ্ দারদা। তিনি সাহাবী ছিলেন। তিনি মারা গেলে হযরত আবুদ্ দারদা রা. তাকে বিবাহ করেন। তার উপনামও উম্মুদ্ দারদা, তবে তাকে বলা হয় ছোট উম্মুদ্ দারদা।

তিনি ছোটবেলা থেকে হযরত আবুদ্ দারদার হাতে লালিত পালিত হয়েছেন। হযরত আবুদ দারদা তাকে এমনভাবে গড়ে তোলেন এবং তিনিও এমনভাবে শিখেন যে, পরবর্তীতে তিনি স্বামীর স্থলাভিষিক্তে পরিণত হন।

সাহাবীগণ নারী-পুরুষ সকলে কুরআন তো জানতেনই এবং খুব ভালোভাবে জানতেন। তবে কিছু সাহাবী ছিলেন এক্ষেত্রে সেরা থেকে সেরা। তাদের ব্যাপারে স্বয়ং নবীজী কিংবা সাহাবীগণ স্বীকৃতি দিয়েছেন যে, এঁরাই হলেন মাখরাজ, মদ, গুন্নাহ, সিফাত, কেরাতসহ পুরো পাঠরীতি তথা তাজবীদের ইমাম। যেমন হযরত উবাই ইবনে মাসউদ প্রমুখ। হযরত আবুদ্ দারদাও এঁদের অন্যতম।

কুরআনের ন্যায় সাহাবায়ে কেরাম হাদীস শেখার জন্যও উন্মুখ হয়ে থাকতেন। এবং যখন যে হাদীস শুনতেন তা লুফে নিতেন; শিখে নিতেন, বুঝে নিতেন এবং নিজের জীবনের সাথে যুক্ত করে নিতেন। তবে এক্ষেত্রেও কিছু সাহাবী অন্য সবার থেকে এগিয়ে থাকতেন। তারা কুরআন-হাদীস বেশি থেকে বেশি শেখার জন্য নবীজীর দরবারে পড়ে থাকতেন। ফলে নবীজী থেকে কুরআনের ন্যায় বহু বহু হাদীস শিখেছেন, মুখস্থ করেছেন। হযরত আবুদ্ দারদা এঁদের অন্যতম প্রধান ছিলেন। আল্লামা যাহাবী তাযকিরাতুল হুফফায নামে একটি কিতাব রচনা করেন। এ কিতাবের বিষয়বস্তু হল, যেসব ব্যক্তিগণ বহু বহু হাদীস জেনেছেন ও আয়ত্ত করেছেন তাদের জীবনী লিপিবদ্ধ করা। হযরত আবুদ দারদা রা.-এর জীবনী তিনি এগারো নম্বরেই নিয়ে আসেন।

কুরআন-হাদীস অর্জনের পর একজন মুমিনের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দ্বীনের প্রজ্ঞা। এ প্রজ্ঞার আলোকে সে কুরআন-হাদীস ভালোভাবে বুঝবে, দ্বীন বুঝবে। হযরত আবুদ্ দারদা এ প্রজ্ঞাও লাভ করেন। কুরআন মাজীদে হযরত লোকমান হাকীমের প্রজ্ঞাপূর্ণ কথা আলোচিত হয়েছে। হযরত লোকমানকে লোকমান হাকীম (প্রজ্ঞাবান) বলা হয়। যেহেতু দ্বীনের সমঝ তাঁর মধ্যে এত বেশি ছিল যে, তাঁর মুখ থেকে সর্বদা প্রজ্ঞাপূর্ণ কথা বের হত। হযরত আবুদ্ দারদার অবস্থাও এমন ছিল। এজন্য স্বয়ং নবীজীই তাঁকে হাকীম তথা প্রজ্ঞাবান বলে খেতাব দেন। এবং বলেন- حكيم أمتي عويمر আমার উম্মতের হাকীম (প্রজ্ঞাবান) হল উয়াইমির (আবুদ্ দারদার নাম)।

হযরত উম্মুদ্ দারদা হুজায়মা শৈশব থেকে নিয়ে পুরো জীবনব্যাপী স্বামী আবুদ্ দারদা থেকে কুরআন-হাদীস, হেকমত তথা প্রজ্ঞা অর্জনে অক্লান্ত সাধনা করেন। একসময় তিনি স্বামীর এসব ইলমের ধারক হন।

পূর্বে গিয়েছে, কুরআনের পাঠরীতি সম্পর্কে যে কয়জন সাহাবী অধিক জ্ঞানী এবং যাদের থেকে হাজার হাজার মানুষ কুরআন শিখেছে হযরত আবুদ্ দারদা তাদের একজন। মুসলিম ইবনে মিশকাম বলেন, একদিন আবুদ্ দারদা কুরআন পাঠদান শেষে আমাকে বললেন, আজকে পাঠদান মজলিসে কত লোক শরীক হয়েছে একটু গুণে দেখ। আমি গুণে দেখলাম ষোল শ-এর থেকে বেশি লোক জমায়েত হয়েছে। তারা পড়ত তিনি শুনতেন। এরপর নিজে কিছু অংশ পড়তেন। তারা খুব লক্ষ্য করে তাঁর পাঠের ধরন ও উচ্চারণরীতি শ্রবণ করত।

উম্মুদ্ দারদাও হযরত আবুদ্ দারদা থেকে শৈশবে কুরআন পাঠ শেখেন। আর পরে তো শিখতেই থাকেন। একসময় তিনি এক্ষেত্রে বড় বিদ্বানে পরিণত হন। এরপর তিনিও কুরআন শেখাতে থাকেন। অনেক মানুষ তাঁর থেকে কুরআন শেখে। ইবনে জাবের বলেন, ছাত্ররা উম্মুদ্ দারদার ঘরে একত্রিত হত। তাদের একজন- জুলাইদ ইবনে সাদ পড়ত। উম্মুদ্ দারদা শুনতেন এবং ভুল হলে শুধরে দিতেন। ছাত্রদেরকে এমন মেহনত করে পড়াতেন যে, এদের অনেকে পরবর্তীতে শিক্ষিকার ন্যায় কেরাতের ক্ষেত্রে ইমামে পরিণত হন। এবং যাদের নাম আজও কেরাতের ইতিহাসে ভাস্বর। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, আতিয়্যা ইবনে কায়স। তিনি এমন সাধনার সাথে উম্মুদ্ দারদা থেকে কুরআন শিখেন যে, পরবর্তীতে তিনি গোটা শামবাসীর একক উস্তাযে পরিণত হন। তাঁর হস্তলিখিত কুরআনের কপিটি পাঠরীতির ক্ষেত্রে এত নিখুঁত ছিল যে, গোটা শামবাসী তাদের কুরআন মাজীদের কপি এ কপির অনুসারে শুধরে নিত। আরেকজন হলেন ইব্রাহীম ইবনে আবি আবালা। তিনি পুরো কুরআন মাজীদ একে একে সাতবার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কেরাতের নিয়মানুসারে উম্মুদ্ দারদা কে পাঠ করে শোনান।

উম্মুদ্ দারদা শিশুদেরও পড়াতেন। তাদেরকে যেমন কুরআন মাজীদ শেখাতেন তেমনিভাবে শ্লেটের মাধ্যমে হাতের লেখাসহ বিভিন্ন উত্তম বাণীও শেখাতেন। আবদু রাব্বিহি ইবনে সুলাইমান বলেন, উম্মুদ্ দারদা শ্লেটে আমার জন্য যেসব হিকমত লিখে দিতেন এবং শেখাতেন তন্মধ্যে একটি হল-

تعلموا الحكمة صغارا، تعملوا بها كبارا، وإن كل زارع حاصد ما زرع من خير أو شر.

শৈশবেই হিকমত শিখে নাও, তাহলে বড় হয়ে আমল করতে পারবে। কেননা কৃষক সে ফসলই ঘরে তোলে, যা সে বপন করে; ভালো হলে ভালো, মন্দ হলে মন্দ।

কুরআনের ন্যায় স্বামী থেকে তার হাদীস ভাণ্ডারও আয়ত্ত করে নেন। স্বামীর হাদীস ভাণ্ডার কত বৃহৎ তা পূর্বে উল্লেখ হয়েছে। এছাড়াও তিনি সালমান ফারসী রা., আবু হুরায়রা রা., আয়েশা রা. প্রমুখ সাহাবী থেকে হাদীস শিখেন। এক পর্যায়ে তাঁর হাদীস ভাণ্ডার বিশাল হয়ে যায়। আর শুধু শেখা নয় বরং সেগুলোকে মুখস্থ ও সংরক্ষণ করতেন নিখুঁতভাবে। এজন্য তিনি সে যুগ থেকে নিয়ে প্রতিটি যুগে হাদীসের এক বড় বিদ্বান ও প্রামাণ্য ব্যক্তিত্বের আসনে সমাসীন হন। হাদীসের খুব কম কিতাবই পাওয়া যাবে, যাতে তাঁর হাদীস নেই। আবু আহমাদ আলআসসাল তার কিতাবে ‘যাদের হাদীস সংকলিত হয়’- এ শিরোনামে একটি তালিকা পেশ করেন।  সে তালিকাতে উম্মুদ্ দারদাকেও এ বলে উল্লেখ করেন, “তার থেকে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। ফলে এককভাবে তার হাদীস যেমন সংকলিত হয়, সাথে সাথে তিনি এত প্রজ্ঞাবান ছিলেন যে, তার বাণীও সংকলিত হয়।”

হাফেয যাহাবী রাহ. তাযকিরাতুল হুফফাযে বড় বড় তাবেয়ী মুহাদ্দিসগণের তালিকায় চৌদ্দ নম্বরে হযরত উম্মুদ্ দারদাকেও উল্লেখ করেন। যাহাবী এ বলে আলোচনা শুরু করেন-

كانت فقيهة عالمة عابدة مليحة جميلة واسعة العلم وافرة العقل روت الكثير عن أبي الدرداء.

তিনি বড় প্রজ্ঞাশীল আলিম ও আবিদ ছিলেন। ইলমের প্রশস্তি ছিল বেশ। আকল বুদ্ধি ছিল পূর্ণ। আবুদ্দারদা সালমান ফারসী ও আয়েশা রা. থেকে বহু হাদীস বর্ণনা করেন।

সে সময়ে উম্মুদ্ দারদা কুরআন-হাদীসের জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। হাজারো লোক তার থেকে হাদীস শেখে। এদের মাঝে ইবরাহীম ইবনে আবি আবালা, ইসমাঈল ইবনে উবায়দুল্লাহ, যায়েদ ইবনে আসলাম, রজা, সালিম ইবনে আবিল জা‘দ, আবু হাযিম, তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ, মাকহুল, আওন ইবনে আব্দুল্লাহ, আযহার ইবনে ওয়ালীদ, হারেস ইবনে উবায়দুল্লাহ, আব্দুল্লাহ ইবনে আবি যাকারিয়্যা, শাহর ইবনে হাওশাব প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

তিনি সর্বদা হয়ত ইবাদত-বন্দেগীতে মগ্ন থাকতেন নয় তো ইলমী আলোচনায় ব্যস্ত থাকতেন। আওন ইবনে আব্দুল্লাহ বলেন, একদিন আমরা উম্মুদ্ দারদার মজলিসে ছিলাম যেখানে ইলমী অনেক আলোচনা হল। আল্লাহ্র মারেফাত নিয়েও আলোচনা হল অনেকক্ষণ। তিনি একটু ক্লান্ত হলেন। আমরা বললাম মনে হয় আমরা আপনাকে কষ্টে ফেলে দিয়েছি। তিনি বললেন, তোমরা এমন বলছ, অথচ আমি সব আমলই করে দেখেছি, কোনো আমলেই আমার অন্তর ততটুকু শীতল হয় না যতটুকু উলামা ও যাকিরীনের মজলিসে হয়।

ইবাদত বন্দেগীতেও তিনি এত মশগুল থাকতেন যে, ঐ সময়ই পুরো  শামে তার প্রসিদ্ধি হয়ে পড়ে। মাইমুন ইবনে মেহরান বলেন, আমি একদা তার ঘরে গেলাম। দেখি তিনি বোরকা পরে বসে আছেন। আর আমি যখনই তার ঘরে যেতাম তাকে নামাযরত পেতাম। তার সাথে থাকার জন্য ও ইবাদত করার জন্য হাজারো মহিলা তার ঘরে জমায়েত হত এবং রাতভর ইবাদত করত। কিন্তু তার মত ইবাদত কেউ পারত না। ইউনুস ইবনে হালবাস বলেন, নারীরা তার সাথে রাতভর ইবাদত করত।

স্বামীর দুনিয়াবিমুখতা দুনিয়াজোড়া প্রসিদ্ধ। স্ত্রীও স্বামীর থেকে তা শিখেন এবং তিনি দুনিয়াবিমুখ হন। দুনিয়াবিমুখ ও দুনিয়াবিমুখতা নিয়ে যত কিতাবাদি রচনা হয়েছে সবগুলোতে তার জীবনী বা বাণীসমূহ উদ্ধৃত হয়েছে। ইমাম যাহাবী তার জীবনীর শুরুতে এভাবে পরিচয় দেন-

طال عمرها واشتهرت بالعلم والعمل والزهد

দীর্ঘ হায়াত পেয়েছেন, ইলম আমল ও দুনিয়াবিমুখতায় প্রসিদ্ধ ছিলেন।

স্বামী এ উম্মতের প্রজ্ঞাবান ছিলেন স্ত্রী তার থেকে সেই প্রজ্ঞা শেখেন এবং তিনিও উম্মতের অন্যতম প্রজ্ঞাবানে পরিণত হন। ইমাম বুখারী রাহ.-সহ অনেকে বিশিষ্ট তাবেয়ী মাকহুল-এর উক্তি বর্ণনা করেন : كانت فقيهة তিনি বড় প্রজ্ঞাবান ছিলেন। এমনকি তিনি সে যুগেই ‘ফকীহা’ খেতাবে প্রসিদ্ধ হয়ে যান। তার প্রতিটি কাজকর্ম কথাবার্তাতেই প্রজ্ঞা ঝরতো। পরবর্তী লোকেরা তার প্রজ্ঞাময় মুক্তা-বাণী সংকলনও করে। ইমাম বুখারীও তার এসব প্রজ্ঞাময় কথা তার রচনায় উদ্ধৃত করেন। একদিন তিনি তার ছাত্র হাজ্জাজকে বলেন, হে হাজ্জাজ! আমি কী তোমাকে শোনাবো- মৃত ব্যক্তি খাটিয়াতে শুয়ে আমাকে তোমাকে কি বলে? ছাত্র বলল, অবশ্যই। তিনি বললেন, মৃত বলে, ‘হে আমার পরিবার, হে আমার পড়শী! হে আমার খাটিয়া বহনকারীগণ! দুনিয়া আমাকে যেমন প্রতারিত করেছে তোমাদেরকে যেন না করে। আমাকে নিয়ে সে যেমন খেলেছে তোমাদের নিয়ে যেন না খেলে। আজ আমার পরিবার আমার কোনো  গোনাহের দায়ভার নিবে না। অতপর উম্মুদ্ দারদা বলেন, ‘দুনিয়া বান্দার অন্তরকে হারূত মারূত থেকেও বেশি দ্রæত যাদুগ্রস্ত করে ফেলে। আর কোনো বান্দা যদি দুনিয়াকে প্রাধান্য দেয় তবে দুনিয়া তাকে আছাড় দেয়।’

একদিন এক ব্যক্তি এসে বলল, আপনি নাকি মিথ্যুক হারিসের আনুগত্য করেছেন। তিনি এর কোনো প্রতিবাদ করেননি এবং এ মিথ্যা কথা তাকে কে বলেছে তাও জিজ্ঞেস করেননি। যেন সে লোকের প্রতি তার মনে কোনো ক্রোধ ও বিদ্বেষ না জন্মে। আরেক লোক এসে বলল, এক লোক খলিফা আব্দুল মালেকের নিকট আপনার বদনাম করেছে। জবাবে বললেন, রাখ তো! যদি সে আমার এমন কোনো দোষ বলে বদনাম করে, যা আমার মাঝে নেই, তো কত সময় তো এমন হয় যে, মানুষ আমার এমন বিষয় নিয়েও প্রশংসা করে, যা আমার মাঝে নেই।

স্বামীর প্রতি টান ছিল বেশ! স্বামীর ইন্তেকালের সময় স্বামীকে বলেন, দুনিয়াতে আপনি আমার পিতা-মাতার নিকটে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তারা সে প্রস্তাবে সম্মত হয়ে আমাকে আপনার নিকট বিবাহ দিয়েছেন। এখন আমি আপনার নিকট প্রস্তাব করছি আখেরাতেও যেন আমি আপনার সাথে থাকি। তখন স্বামী বললেন, ঠিক আছে! তাহলে আমার পর আর কারো বিবাহে আবদ্ধ হয়ো না। কেননা নারীরা জান্নাতে শেষ স্বামীর সাথেই থাকে। স্ত্রীও পরবর্তীতে আর কোনো বিবাহে আবদ্ধ হননি। এমনকি মুআবিয়া রা. প্রস্তাব দিলেও তা প্রত্যাখান করে দেন।

হিজরী ৮১ সন-এর পর এ মহীয়সী নারী ইন্তেকাল করেন। হ

তথ্যসূত্র : তবাকাতে ইবনে সা‘দ; তারীখে দিমাশক; গায়াতুন নিহায়া; সিয়ারু আলামিন নুবালা; তাযকিরাতুল হুফফায ইত্যাদি

 

 

advertisement