মেহমানের শিষ্টাচার মেজবানের অধিকার
মেহমানের অধিকার এবং মেহমানের প্রতি মেজবানের দায়িত্ব ও শিষ্টাচার নিয়ে কথা বললে স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে মেহমানের দায়িত্ব ও মেজবানের অধিকারের কথা। ইসলামের এ এক অনন্য সৌন্দর্য-মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের যাবতীয় দিক নিয়েই নির্দেশনা রয়েছে তাতে। ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন মানুষ হিসেবে দুনিয়ার স্বাভাবিক জীবন কাটানোর মধ্য দিয়ে সমাজের সকল শ্রেণির সকল বয়সের মানুষের জন্যেই অনুপম আদর্শ হয়ে উঠেছেন। পবিত্র কুরআনের ভাষায়-
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِیْ رَسُوْلِ اللهِ اُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَنْ كَانَ یَرْجُوا اللهَ وَ الْیَوْمَ الْاٰخِرَ وَ ذَكَرَ اللهَ كَثِیْرًا.
তোমাদের মধ্য থেকে যে আল্লাহর (সন্তুষ্টি) আশা করে, পরকালের (উত্তম প্রতিদান) আশা করে এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করে তার জন্যে আল্লাহর রাসূলের (জীবনীর) মধ্যে রয়েছে সুন্দর আদর্শ। -সূরা আহযাব (৩৩) : ২১
এই তো ইসলাম। মানবতা ও মানবিকতার ধর্ম হিসেবে ইসলাম যেমন আমাদেরকে অতিথিসেবার শিক্ষা দেয়, তেমনি অতিথিদের জন্যেও এতে রয়েছে চমৎকার নির্দেশনা। উভয়পক্ষের এ শিক্ষাগুলো যদি আমরা আমাদের জীবনে বাস্তবায়িত করতে পারি, তাহলে আমাদের পারস্পরিক ভালোবাসা সৌহার্দ-সম্প্রীতি বৃদ্ধি পাবেই।
মেহমান-মেজবান উভয়ের জন্যেই এক অনুপেক্ষ বিষয়-আন্তরিকতা। মেজবান যেমন সাধ্যের সবটুকু আন্তরিকতা দিয়ে মেহমানের সেবা করবে, সম্মান করবে, তেমনি মেহমানকেও হতে হবে আন্তরিক। খাবারের মান যা-ই হোক না কেন, মেজবানের আন্তরিকতাটুকু হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করা মেহমানের জন্যে জরুরি। এটা মেজবানের অধিকার। আপ্যায়ন যদি সাধারণ খাবার দিয়েও হয়, কিন্তু তাতে যদি মেজবানের সাধ্যমতো আন্তরিকতার মিশেল থাকে তাহলে এটাও অনেক তৃপ্তিকর। পারস্পরিক সৌহার্দ বৃদ্ধির জন্যে এ বিষয়টির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন-
لَوْ دُعِيتُ إِلَى ذِرَاعٍ أَوْ كُرَاعٍ لَأَجَبْتُ
আমাকে যদি বকরির (সামনের) রানের গোশত খেতে আমন্ত্রণ জানানো হয় কিংবা এর পায়ের হাড় খেতে, আমি উভয় দাওয়াতই গ্রহণ করব। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৫৬৮
খাসির সামনের রানের গোশত খুবই সুস্বাদু এবং তৃপ্তিদায়ক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তা পছন্দ করতেন। আর পশুর পায়ের নিচের দিকের চিকন হাড়টি কোনো ভালো মানের খাবার নয়। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীসে খাবারের এসব ভালো-মন্দের মধ্যে কোনো ফারাক করেননি। তিনি বলেছেন, আমাকে যে খাবারের জন্যেই আমন্ত্রণ জানানো হোক, মানসম্মত ভালো খাবার হোক কিংবা অতি সাধারণ কিছু হোক, আমি সে আমন্ত্রণ রক্ষা করব। আন্তরিকতার এ মূল্যায়নটুকু মেজবানের পাওনা ও অধিকার।
আতিথেয়তার ক্ষেত্রে খাবারের মান যেমন কোনো বিবেচ্য হতে পারে না, তেমনি নিমন্ত্রণ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে নিমন্ত্রণকারীর সামাজিক মর্যাদার বিষয়টিও এড়িয়ে চলা উচিত। এখানেও একই কথা-যিনি নিমন্ত্রণ করলেন সমাজের চোখে তিনি বড় না ছোট, মানুষ তাকে সম্মানের চোখে দেখে কি না এগুলো বিবেচ্য নয়; বরং আন্তরিকতাই আসল বিষয়। হৃদয়-ভরা ভক্তি নিয়ে যদি সমাজের নি¤œশ্রেণির কেউ দাওয়াত দেয় তবুও তা গ্রহণ করা উচিত। একজন কোটিপতির আন্তরিকতাহীন রেওয়াজি দাওয়াতের তুলনায় তা অনেক গুণ শ্রেষ্ঠ। উপার্জন যদি হালাল হয়, তাহলে যে কারও দাওয়াতই গ্রহণ করা যেতে পারে। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল এমনই ছিল।
সহীহ বুখারী শরীফের হাদীস, হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, আমি একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে তাঁর এক দর্জি গোলামের বাড়িতে গেলাম। সেই গোলাম তাঁর সামনে ‘ছারীদ’ ভর্তি একটি পাত্র পেশ করল। এরপর সে তার কাজে মনোনিবেশ করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন খুঁজে খুঁজে (তা থেকে) লাউয়ের টুকরো খেয়েছেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৪২০
আলোচ্য বিষয়ে হাদীসটির নির্দেশনা খুবই স্পষ্ট। কী আন্তরিকতা নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দাওয়াত গ্রহণ করেছেন, ভাবা যায়! আমন্ত্রণকারী একদিকে একজন দর্জি গোলাম, আবার খাবারও যা দিয়েছে তা খুব উৎকৃষ্টমানের কিছু নয়। এরই সঙ্গে একজন মেহমানকে সঙ্গ দেয়া, তার সঙ্গে বসা ইত্যাদি কিছুই ওই নিমন্ত্রকের পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। তাকে তার কাজে মনোনিবেশ করতে হয়েছে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগ্রহভরেই সে খাবার খেয়েছেন। এমনকি লাউয়ের টুকরো খুঁজে খুঁজে খেয়েছেন। এ হাদীসের বর্ণনাকারী সাহাবী হযরত আনাস রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সেবক। তিনি বলছেন, তখন আমিও তাঁর জন্যে লাউয়ের টুকরো খুঁজছিলাম, খুঁজে খুঁজে তাঁর সামনে রাখছিলাম আর এরপর থেকেই আমি (খাদ্য হিসেবে) লাউ ভালোবাসতে শুরু করেছি।
মেজবানের যেন কষ্ট না হয় সেদিকে লক্ষ রাখাও একজন মেহমানের শিষ্টাচার। আমাদের বর্তমান নাগরিক জীবনে বিষয়টি খুবই প্রাসঙ্গিক। সাধ ও সাধ্যের সমন্বয় এখানে অনেকাংশেই হয় না। অতিথিসেবার মন আছে, কিন্তু আদরযতœ করে তাকে এক রাত নিজের বাসায় থাকার ব্যবস্থা করবে- এ সুযোগ হয়ত নেই। তাই মেহমান যেন মেজবানের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে না দাঁড়ায়- সে বিষয়ে সচেতন দৃষ্টি রাখতে হবে।
উপরোক্ত হাদীস থেকেও আমরা এমন একটি শিক্ষা পাই। মেহমান যখন খাবার খাবে, তখন মেজবানকেও তার সঙ্গে খেতে সে অনুরোধ করবে-এটা ভদ্রতা ও স্বাভাবিকতার দাবি। ঘনিষ্ঠতার ভিত্তিতে কেউ এজন্যে পীড়াপীড়িও করতে পারে। কিন্তু এতে আবার মেজবানের কোনো ক্ষতি হয়ে যায় কি না- সেদিকটিও অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে। এ ঘটনায় আমরা দেখতে পাই, দর্জি মেজবান খাবারের পাত্রটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে দিয়ে নিজে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। হয়ত তার হাতে এমন কোনো কাজ ছিল, যা তখন তাকে সম্পন্ন করতে হত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে নিষেধ করেননি। নিজের সঙ্গে বসে খেতেও পীড়াপীড়ি করেননি।
আমন্ত্রণকারীকে কষ্ট দেয়ার একটি আধুনিক রূপ- কথামতো যথাসময়ে উপস্থিত না হওয়া। কেমন যেন আমরা এটাকে রেওয়াজই বানিয়ে নিয়েছি। মেহমান যদি দুপুর একটায় আসার কথা থাকে, তাহলে কমপক্ষে দুইটায় আসা যেন তার অধিকারের মধ্যেই পড়ে! বাড়িতে খাওয়ার দাওয়াতে যেমন এটা ঘটে, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানেও তা ঘটে সমান তালেই। বিকাল চারটায় যে অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা, তা যদি পাঁচটায়ও শুরু হয় তবুও যেন সময়মতোই হল। এটাও তো একপ্রকার ওয়াদা-খেলাফ। ওয়াদা যখন করা হয়, তখনই ভেবেচিন্তে করা উচিত। ওয়াদা করার পর তা রক্ষা করা তো মুমিনের কাছে ঈমানের দাবি। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لَا دِينَ لِمَنْ لَا عَهْدَ لَهُ.
যে ওয়াদা রক্ষা করে না, তার দ্বীনদারি নেই। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২৪০৬
কখনো কখনো মেহমান মেজবানের কাজকর্ম আটকে দেয়। এতেও তার কষ্ট হয়। অনেক সময় তো তাকে বিপদেই পড়ে যেতে হয়। নবীজীবনের একটি ঘটনা। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মুল মুমিনীন হযরত যায়নাব রা.-কে বিয়ে করেছেন। বিয়ের পর ওলিমার আয়োজন করেছেন। সেখানে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতে এসে কেউ কেউ গল্পগুজবে মেতে ওঠে। খাওয়া-দাওয়া শেষেও তারা অনেকক্ষণ বসে থাকে। এ প্রেক্ষিতে নাযিল হয় পবিত্র কুরআনের এ আয়াত-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تَدْخُلُوْا بُیُوْتَ النَّبِیِّ اِلَّاۤ اَنْ یُّؤْذَنَ لَكُمْ اِلٰی طَعَامٍ غَیْرَ نٰظِرِیْنَ اِنٰىهُ، وَ لٰكِنْ اِذَا دُعِیْتُمْ فَادْخُلُوْا فَاِذَا طَعِمْتُمْ فَانْتَشِرُوْا وَ لَا مُسْتَاْنِسِیْنَ لِحَدِیْثٍ، اِنَّ ذٰلِكُمْ كَانَ یُؤْذِی النَّبِیَّ فَیَسْتَحْیٖ مِنْكُمْ، وَ اللهُ لَا یَسْتَحْیٖ مِنَ الْحَقِّ، وَ اِذَا سَاَلْتُمُوْهُنَّ مَتَاعًا فَسْـَٔلُوْهُنَّ مِنْ وَّرَآءِ حِجَابٍ، ذٰلِكُمْ اَطْهَرُ لِقُلُوْبِكُمْ وَ قُلُوْبِهِنَّ .
হে ঈমানদারগণ! তোমরা নবী-গৃহে প্রবেশ করো না, তবে যদি তোমাদের খাওয়ার জন্যে (আসার) অনুমতি দেওয়া হয় (তাহলে প্রবেশ করতে পারবে,) তবে এভাবে আসবে যে, তোমরা খাবার প্রস্তুত হওয়ার অপেক্ষায় থাকবে না। যখন তোমাদের আমন্ত্রণ করা হয় তখন তোমরা প্রবেশ করো। অতপর যখন খেয়ে নেবে, তখন চলে যাবে এবং পরস্পর গল্পগুজবে মেতে ওঠবে না। তোমাদের এ আচরণ নবীকে কষ্ট দেয়। কিন্তু তিনি তোমাদেরকে তা বলতে লজ্জাবোধ করেন। তবে আল্লাহ সত্য প্রকাশে লজ্জা করেন না। আর যখন তোমরা নবীপত্নীদের নিকট কোনো কিছু চাও তখন পর্দার আড়াল থেকে চাও। এ খুবই পরিচ্ছন্ন পন্থা- তোমাদের অন্তর ও তাদের অন্তরের জন্যে। -সূরা আহযাব (৩৩) : ৫৩
আয়াতটি নাযিল হওয়ার প্রেক্ষাপট এবং আয়াতের দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য আমাদেরকে স্পষ্টই এ নির্দেশনা দিচ্ছে- দাওয়াত গ্রহণ করতে গিয়ে খাবার খাওয়া শেষে এমনভাবে পরস্পরে কথাবার্তায় লিপ্ত হওয়া যাবে না, যাতে মেজবান কষ্ট পেতে পারে। একইভাবে একজন মেহমানকে এমন প্রতিটি কাজ ও আচরণ থেকে বিরত থাকতে হবে, যাতে তার মেজবানের কোনোরূপ কষ্ট হতে পারে কিংবা তাকে বিব্রত করে তুলতে পারে। আয়াতের শুরুতেও বলা হচ্ছে একই কথা- তোমাদেরকে যদি দাওয়াত দেয়া না হয় তাহলে যাবে না। আবার দাওয়াত দেয়া হলেও এমন সময় গিয়ে ওঠবে না, যাতে তোমার উপস্থিতির কারণে বাড়ির লোকদের কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটে। আয়াতে যদিও কথাগুলো হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘর সম্পর্কে বলা হয়েছে, কিন্তু এর শিক্ষা সকলের জন্যেই ব্যাপক। আতিথেয়তা ও নিমন্ত্রণ কীভাবে গ্রহণ করা হয়- সেই আদব ও শিষ্টাচারই এখানে সকলকে শেখানো হচ্ছে।
মেহমান যদি সঙ্গে করে কাউকে নিয়ে আসতে চান, কিংবা কেউ যদি মেহমানের সঙ্গে আসতে চায়, তাহলে মেজবানের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। আমন্ত্রণ জানানো হয়নি এমন কারও আতিথেয়তার ভার আমন্ত্রকের ওপর চাপিয়ে দেয়া যাবে না। হাঁ, যদি তিনি স্বাচ্ছন্দ্যে মেনে নেন, তাহলে কথা ভিন্ন। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জীবনেরই আরেকটি ঘটনা। হযরত আবু মাসউদ আনসারী রা. বর্ণনা করেন, এক আনসারী সাহাবী হযরত আবু শুআইব রা. একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দাওয়াত করলেন। পাঁচজন মেহমানের জন্যে খাবার রান্না করা হয়েছিল। আর তিনি ছিলেন পাঁচজনের একজন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে গেলেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে সঙ্গে গেল আরেকজন, দাওয়াত ছাড়াই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আমন্ত্রণকারীকে বললেন-
إِنّ هَذَا اتّبَعَنَا، فَإِنْ شِئْتَ أَنْ تَأْذَنَ لَهُ، وَإِنْ شِئْتَ رَجَعَ.
ও তো আমাদের সঙ্গে এসেছে। এখন তোমার ইচ্ছা, চাইলে তুমি তাকে অনুমতি দিতে পার, অথবা তুমি চাইলে সে (এখান থেকেই) ফিরে যাবে।
সাহাবী বললেন, আমি তাকে অনুমতি দিচ্ছি, ইয়া রাসূলাল্লাহ! -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৪৫৬, সহীহ মুসলিম, হাদীস ২০৩৬
এমনটা ভাবার অবকাশ নেই- মেহমান যদি সঙ্গে করে কাউকে নিয়ে এসে অনুমতি চায়, তাহলে মেজবান কি তাকে ফিরিয়ে দিতে পারে? বাধ্য হয়েই তো সে অনুমতি দিয়ে দেবে। এ অনুমতি চাওয়ার তাহলে কী অর্থ?
না, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে তাঁর সাহাবীদের সম্পর্ক ছিল খুবই আন্তরিকতাপূর্ণ এবং লৌকিকতামুক্ত। সাহাবী যখন অনুমতি দিচ্ছেন, তখন তিনি আন্তরিকভাবেই দিচ্ছেন। আবারও ঘুরে ফিরে সেই একই কথা- সবকিছুর মূলে এই আন্তরিকতা।
উপরোক্ত আয়াতে মেহমানদের আরেকটি নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। আল্লাহ তাআলার নির্দেশ- নবীপত্নীদের কাছে যদি তোমাদের কিছু চাইতে হয় তাহলে পর্দার বাইরে থেকে তা চাও। এটা তোমাদের অন্তরের জন্যেও পরিচ্ছন্ন পন্থা, তাদের অন্তরের জন্যেও। অর্থাৎ প্রয়োজন হলে পর্দার আড়াল থেকে ঘরের নারীদের সাথে কথা বলতে পারবে বা কিছু চাইতে পারবে, কিন্তু তাই বলে পর্দার বিধান যেন আবার লঙ্ঘিত না হয়।
মোটকথা, মেহমানের কারণে মেজবানকে যেন কোনো গোনাহে জড়াতে না হয়। এখানেও একই কথা, আয়াতে যদিও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণের বিষয়ে বিধান দেয়া হয়েছে, কিন্তু এর ব্যাপকতায় পুরো উম্মতই অন্তর্ভুক্ত। এ বিধান মেনে চলতে হবে সকলকেই।
খাবারের দোষ ধরা সবসময়ের জন্যেই নিষিদ্ধ। সর্বত্রই নিষিদ্ধ। হযরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনোই কোনো খাবারের দোষ ধরতেন না। ভালো লাগলে খেতেন, ভালো না লাগলে রেখে দিতেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২০৬৪
খাবারের দোষ ধরা নিজের বাড়িতেই যখন নিষিদ্ধ, অন্যের বাড়িতে মেহমান হয়ে কীভাবে সে কাজ করা যেতে পারে? উপরন্তু মেহমান যখন কোনো খাবারের দোষ ধরে তখন খাবারের নিন্দা করার পাশাপাশি মেজবানকে কষ্টও দেওয়া হয়। সে বিব্রত হয়। কখনো বা আশাহতও হতে পারে। হতে পারে, খুব শখ করে মেহমানের জন্যে সে কিছু রান্না করল কিংবা কিনে আনল। খেতে গিয়ে দেখা গেল- তা আশানুরূপ হয়নি। তবুও এ শখটুকুর মূল্যায়ন করতে হবে। মেজবানকে বিব্রত করা যাবে না কিছুতেই।
মেজবান ও নিমন্ত্রণকারীকে বিব্রত করার আরেক দিক- তাকে তার গোপন বিষয়াদি সম্পর্কে প্রশ্ন করা। প্রায় সবারই কিছু দুর্বল দিক থাকে। সে চায় না, এগুলো কেউ জানুক কিংবা আলোচনা করুক। কেউ বেড়াতে এসে যদি তেমনি কোনো বিষয়ে কথা বলতে শুরু করে তাহলে সে হয়ত এড়িয়ে যায় কিংবা মিথ্যা বলে অথবা কষ্ট করে হলেও সত্যটাই বলে। যেটাই করুক, বিব্রত তাকে হতেই হয়। মেহমানের জন্যে মেজবানকে যেন এমন কোনো পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়- এটাও মেহমানের দায়িত্ব, মেজবানের অধিকার।
খাবারের দোষ ধরার মতোই আরেকটি বিষয়- মেজবানের সমালোচনা করা। গীবত-সমালোচনাও সর্বসময়ের জন্যেই নিষিদ্ধ। সবার জন্যেই নিষিদ্ধ। পবিত্র কুরআনে এ গীবতকে বলা হয়েছে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার মতো জঘন্য অপরাধ। তাই আপ্যায়নে যদি কোনো ত্রুটি থাকে, এমনকি যদি আন্তরিকতায় কোনো ঘাটতি স্পষ্টত পরিলক্ষিত হয়, তবুও এ বিষয় নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনা না করাই উচিত।
সর্বশেষ- মেজবানের প্রতি মেহমানের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এ শিক্ষাও জীবনের সর্বক্ষেত্রব্যাপী। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لَا يَشْكُرُ اللهَ مَنْ لَا يَشْكُرُ النّاسَ.
মানুষের প্রতি যে কৃতজ্ঞ হয় না, সে তো আল্লাহর প্রতিও কৃতজ্ঞ হয় না। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৮১৩
এ কৃতজ্ঞতা-প্রাপ্তি মেজবানের অধিকার। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে এবং তার জন্যে দুআ করতে হবে। কখনো দুআর মধ্য দিয়েও কৃতজ্ঞতার প্রকাশ হতে পারে। এ প্রসঙ্গে প্রিয় নবীজী থেকে বর্ণিত দুটি দুআ-
اللّهُمّ أَطْعِمْ مَنْ أَطْعَمَنِيْ، وَاسْقِ مَنْ سَقَانِيْ.
হে আল্লাহ! আমাকে যে খাইয়েছে তুমিও তাকে খাওয়াও, আমাকে যে পান করিয়েছে তুমিও তাকে পান করাও। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩৮০৯
أَفْطَرَ عِنْدَكُمُ الصّائِمُونَ، وَأَكَلَ طَعَامَكُمُ الأَبْرَارُ، وَصَلّتْ عَلَيْكُمُ الْمَلاَئِكَةُ.
রোযাদারেরা তোমাদের নিকট ইফতার করুক, নেককার লোকেরা তোমাদের খাবার গ্রহণ করুক আর ফেরেশতারা তোমাদের জন্যে দুআ করুক। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৫৬
আবুল হায়ছাম রা. নামের এক সাহাবী একবার হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এবং তাঁর সঙ্গীগণকে খাবারের দাওয়াত দিলেন। খাবার শেষে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : এবার তোমরা তোমাদের ভাইকে প্রতিদান দাও। সাহাবায়ে কেরাম জানতে চাইলেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ! তার প্রতিদান কী? তিনি বললেন-
إِنّ الرّجُلَ إِذَا دُخِلَ بَيْتُهُ فَأُكِلَ طَعَامُهُ وَشُرِبَ شَرَابُهُ فَدَعَوْا لَهُ فَذَلِكَ إِثَابَتُهُ.
কারও বাড়িতে গিয়ে যখন তার খাবার-পানীয় গ্রহণ করা হয়, এরপর (দাওয়াতগ্রহীতাগণ) তার জন্য দুআ করে, তা-ই তার প্রতিদান। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৫৫