যিলহজ্ব ১৪৩৯   ||   সেপ্টেম্বর ২০১৮

‘দান করেছি লুকমানকে হিকমাহ...’ :  মা-বাবার সাথে সদাচার

মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ

وَ وَصَّیْنَا الْاِنْسَانَ بِوَالِدَیْهِ، حَمَلَتْهُ اُمُّهٗ وَهْنًا عَلٰی وَهْنٍ وَّ فِصٰلُهٗ فِیْ عَامَیْنِ اَنِ اشْكُرْ لِیْ وَ لِوَالِدَیْكَ،  اِلَیَّ الْمَصِیْرُ.  وَ اِنْ جَاهَدٰكَ عَلٰۤی اَنْ تُشْرِكَ بِیْ مَا لَیْسَ لَكَ بِهٖ عِلْمٌ  فَلَا تُطِعْهُمَا وَ صَاحِبْهُمَا فِی الدُّنْیَا مَعْرُوْفًا  وَّ اتَّبِعْ سَبِیْلَ مَنْ اَنَابَ اِلَیَّ  ثُمَّ اِلَیَّ مَرْجِعُكُمْ فَاُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُوْن.

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত লুকমান আ. সম্পর্কে বলেছেন- তাকে ‘হিকমাহ’ দান করেছি।  وَ لَقَدْ اٰتَیْنَا لُقْمٰنَ الْحِكْمَةَ। হিকমা এর সরল অর্থ জ্ঞান। যে জ্ঞান আল্লাহ পাকের পছন্দনীয়। সেই জ্ঞানের প্রথম কথা, اَنِ اشْكُرْ لِلهِ   আল্লাহর শোকরগোযারী।

আল্লাহ তাআলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, সকল নিআমত তিনিই দান করেছেন। মানুষ যদি আল্লাহকে না চিনে, আল্লাহর শোকরগোযার না হয়, তাহলে এর চেয়ে বড় মূর্খতা ও অজ্ঞানতা, এর চেয়ে বড় না-শোকরি আর কী হতে পারে? তো আল্লাহপ্রদত্ত জ্ঞানের অধিকারী এই মানুষটি তার পুত্রকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন তা আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে বর্ণনা করেছেন,  কিয়ামত পর্যন্ত মানুষ এই উপদেশগুলো পড়বে, শুনে চিন্তা-ভাবনা করবে এবং জীবন ও কর্মে  গ্রহণ করবে।

এ সম্পর্কে কিছু আলোচনা আমরা ইতিপূর্বে করেছি। তাঁর প্রথম উপদেশ ছিল,  یٰبُنَیَّ لَا تُشْرِكْ بِاللهِ- বাছা! আল্লাহর সাথে শিরক করো না। اِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِیْم নিঃসন্দেহে শিরক বড় অবিচার।

যা একমাত্র আল্লাহর হক তাতে অন্যকে শরীক করা নিঃসন্দেহে অবিচার। ইবাদত ও উপাসনা একমাত্র আল্লাহর হক। ইতা‘আত ও  চ‚ড়ান্ত আনুগত্যও একমাত্র আল্লাহর হক। তাঁরই ইবাদত করতে হবে। তাঁরই অনুগত থাকতে হবে। আল্লাহ ছাড়া কারো উপাসনা করা যাবে না এবং আল্লাহর নাফরমানী করে কারো ফরমাবরদারী করা যাবে না।

তো লুকমান আ.-এর প্রথম উপদেশ ছিল- ‘বাছা! আল্লাহর সাথে শিরক করো না। শিরক তো বড় অবিচার।’

এর পরের উপদেশ ১৬ নম্বর আয়াতে-

یٰبُنَیَّ اِنَّهَاۤ اِنْ تَكُ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِّنْ خَرْدَلٍ فَتَكُنْ فِیْ صَخْرَةٍ اَوْ فِی السَّمٰوٰتِ اَوْ فِی الْاَرْضِ یَاْتِ بِهَا اللهُ   اِنَّ اللهَ لَطِیْفٌ خَبِیْر.

বাছা! ক্ষুদ্র বস্তুটি (পুণ্যকর্ম বা পাপকর্ম) একটি সরষের দানা পরিমাণ হয় এরপর তা থেকে শিলাগর্ভে অথবা আকাশে কিংবা মৃত্তিকার নীচে আল্লাহ তা-ও হাযির করবেন। আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক অবগত। -সূরা লুকমান (৩১) : ১৬

প্রথম উপদেশ ছিল ঈমান সম্পর্কে, আর দ্বিতীয় উপদেশ আমলে ছালেহ বা নেক কাজ সম্পর্কে। মাঝে দুই আয়াতে আল্লাহ পাক কিছু বিশেষ বিধান দান করেছেন, যা লুকমান আ.-এর অসিয়তে ছিল না। মুফাসসিরীনে কেরামের বক্তব্য অনুযায়ী- এটা লুকমান আ.-এর অসীয়তের মাঝে কুরআনের নিজস্ব বক্তব্য। লুকমান আ.-এর প্রথম উপদেশের পর আল্লাহ তাআলা তাঁর একটি বিধান বান্দাদের বিশেষভাবে স্মরণ করিয়েছেন।

وَ وَصَّیْنَا الْاِنْسَانَ بِوَالِدَیْهِ حَمَلَتْهُ اُمُّهٗ وَهْنًا عَلٰی وَهْنٍ وَّ فِصٰلُهٗ فِیْ عَامَیْنِ اَنِ اشْكُرْ لِیْ وَ لِوَالِدَیْكَ اِلَیَّ الْمَصِیْر.

আমি মানুষকে  তার মা-বাবার ব্যাপারে তাকীদ করেছি- মা তাকে বহন করেছেন দুর্বলতার উপর দুর্বলতায়। আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। (তাকীদ করছি যে,) কৃতজ্ঞ হও আমার প্রতি ও  তোমার মা-বাবার প্রতি। আমার কাছেই তোমাদের ফিরে আসা। -সূরা লুকমান (৩১) : ১৪

লুকমান হাকীমের প্রথম উপদেশ ‘শিরক করো না, নিশ্চয়ই শিরক বড় অবিচার।’ এরপর এই দুই আয়াতে যা বলা হয়েছে তা এই উপদেশকে আরো জোরালো করছে। বিস্তারিত আলোচনায় আমরা তা বুঝতে পারব ইনশাআল্লাহ। সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে ছোট একটি কথা বলি।

লুকমান আ. তার পুত্রকে বলছেন, শিরক করো না, শিরক হল বড় অবিচার। এরপর বলছেন, নেক আমল যত ছোটই হোক সেটা কিয়ামতের দিন আল্লাহ পাক হাযির করবেন। লুকমান আ. তার পুত্রকে যে উপদেশ দিয়েছেন তাতে আল্লাহর হকের কথা বলেছেন। ঐ সময় বাবা-মায়ের হকের কথা বলেননি। এর তাৎপর্য নিশ্চিতভাবে আমরা জানি না। তবে হতে পারে বাবা যদি সন্তানকে বাবার সম্পর্কে বলেন, মা যদি বলেন মায়ের হক সম্পর্কে, তাহলে সন্তান ভাবতে পারে, এটা তো তাদের প্রয়োজন। এজন্য বলছে। (আস্তাগফিরুল্লাহ!) এমন চিন্তার মানুষ কিন্তু আছে। একটি কথার, একটি কাজের ভুল ব্যাখ্যা করে, এমন মানুষ আমাদের মধ্যে আছে। এটা ঠিক নয়। বাবা কি তার সন্তানকে শরীয়তের বিধান হিসাবে বাবার সাথে ভালো ব্যবহারের শিক্ষা দিতে পারেন না? পারেন। মা কি শরীয়তের বিধান হিসাবে মায়ের সাথে সদ্ব্যবহারের শিক্ষা দিতে পারেন না? পারেন। মা-বাবার সাথে সদ্ব্যবহার তো শরীয়তেরও বিধান। সন্তান যদি এই বিধানটা পালন না করে, তাহলে কি শুধু মা-বাবাই কষ্ট পাবেন, না শরীয়তের বিধানও লঙ্ঘিত হবে। তাহলে মা-বাবা সন্তানকে শরীয়তের এই গুরুত্বপূর্ণ বিধান লঙ্ঘন করা থেকে বাঁচানোর জন্যও এই উপদেশ দিতে পারেন। এখন যদি সন্তান মনে করে, তারা তাদের স্বার্থে এই উপদেশ দিচ্ছেন তাহলে সেটা অনেক ক্ষেত্রেই কুধারণার মধ্যে পড়ে যাবে। মূলত এই ধরনের একাধিক সম্ভাবনাযুক্ত ব্যাপারগুলোই সুধারণা-কুধারণার বড় ক্ষেত্র।

মা-বাবার এই উপদেশের পিছনে সম্ভাবনা হিসেবে যখন দুটো ব্যাপারই থাকতে পারে- নিজেদের স্বার্থ রক্ষার প্রেরণা আর আল্লাহর বিধান শেখানোর প্রেরণা তখন সুধারণার দাবি হচ্ছে, এই বিশ্বাস রাখা যে, তারা আমাকে আল্লাহর বিধান শেখানোর প্রেরণা থেকেই বিষয়টি শেখাচ্ছেন। এই সুধারণা পোষণের মতো উদারতা কিংবা পরিবেশ-পারিপাশির্^কতা যদি না থাকে তাহলে অন্তত এ চিন্তা করা যায় যে, তারা যদি নিজেদের স্বার্থ চিন্তার প্রেরণা থেকেও বিধানটি শিখিয়ে থাকেন তাহলে সেটা তাদের নিয়তের ব্যাপার। যে বিধানটি আমাকে শেখাচ্ছেন সেটা তো আমার জন্য প্রয়োজনীয় বিধান বটে। তারা না শেখালেও আমাকে তা মান্য করতে হত। কাজেই আমি তাদের নিয়তের পিছনে না পড়ি, বিধানটি মান্য করার চেষ্টা করি। এতে আমি আল্লাহর কাছে পার পেয়ে যাব। আমার পার পাওয়ার কাছে যদি মা-বাবারও কিছু সুখ-শান্তি হয় তাহলে ক্ষতি কী?

মা-বাবা কি এমন মানুষ, যে তাদের সুখ-শান্তি নিজের পায়ে কুঠারাঘাত করে হলেও প্রতিরোধ করতে হবে? নাউযুবিল্লাহ! এটা তো একজন অজানা-অচেনা মানুষের ক্ষেত্রেও চিন্তা করা যায় না। মা-বাবার মতো আপনজনের ক্ষেত্রে তো নয়ই। এক্ষেত্রে সন্তানের দৃষ্টিভঙ্গি এই হতে হবে যে, মা-বাবার সেবার মাধ্যমে আমি দুই ফায়েদা লাভ করছি। প্রথম ফায়েদা হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি আর দ্বিতীয় ফায়েদা হচ্ছে, আমার মা-বাবার শান্তি। যারা আমার জন্য অনেক কষ্ট, অনেক অশান্তি বরণ করেছিলেন।

এটা হচ্ছে একদিক। দ্বিতীয় দিক হচ্ছে, যেহেতু সন্তানের মনে শয়তান এই কুমন্ত্রণা দিতে পারে সেজন্য বাবা-মাকেও বাবা-মার হক সম্পর্কে শিক্ষা দেয়ার সময় অনেক কুশলী হতে হবে। যেখানে শরীয়তের বিধানে নিজেরও কিছু আনন্দের বিষয় যুক্ত হয় সেখানে নিয়তের বিচার এবং কর্মপন্থা সম্পর্কে কুশলী হওয়ার প্রয়োজন অন্য ক্ষেত্রের চেয়ে বেশি বৈকি।

‘মুযিহুল কুরআন’-এর লেখক লিখেছেন, বাবা আল্লাহর হকের কথা বলেছেন, আর আল্লাহ মা-বাবার হকের কথা বলে দিয়েছেন। সুবহানাল্লাহ! সন্তান কীভাবে মা-বাবার স্নেহ-মমতা ভুলে যেতে পারে? কীভাবে তাদের কল্যাণকামিতার অবমূল্যায়ন করতে পারে? মানুষ তো প্রকৃত মানুষ তখনই হবে যখন সে আল্লাহর হকও আদায় করবে, বান্দার হকও আদায় করবে। যাই হোক, এখানে বলা হচ্ছে-

وَ وَصَّیْنَا الْاِنْسَانَ بِوَالِدَیْهِ.

‘আমি মানুষকে তার বাবা-মার বিষয়ে তাকীদ করেছি...।’

আরবী ভাষায় أمرنا মানে আদেশ করেছি। কিন্তু এখানে أمرنا   বলা হয়নি, বলা হয়েছে وَصَّیْنَا -আরবী ভাষায় শব্দটি আসে তাকীদপূর্ণ আদেশের ক্ষেত্রে। তাহলে কুরআন মাজীদ এই শব্দের মাধ্যমে খুবই তাকীদের সাথে বাবা-মা’র সাথে সদাচারের আদেশ করেছে।

এরপর বিশেষভাবে মায়ের সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-

حَمَلَتْهُ اُمُّهٗ وَهْنًا عَلٰی وَهْن.

তার মা তাকে বহন করেছেন। وَهْن মানে দুর্বলতা, وَهْنًا عَلٰی وَهْن     মানে ‘দুর্বলতার উপর দুর্বলতা’। গর্ভের সন্তানও বড় হতে থাকে, মায়ের দুর্বলতাও বাড়তে থাকে। এভাবেই দীর্ঘ একটা সময় অতিবাহিত হয়। অন্য জায়গায় আছে, حَمَلَتْهُ اُمُّهٗ كُرْهًا وَّ وَضَعَتْهُ كُرْهًا -তার মা তাকে কষ্টের সাথে গর্ভে ধারণ করেন, কষ্টের সাথে প্রসব করেন।’ -সূরা আহকাফ (৪৬) : ১৫

দেখুন, কুরআন মাজীদ কী বাস্তব কথাগুলো আমাদের বলছে। আমরা এই বাস্তব বিষয়গুলোই তো ভুলে যাই। আমাদের চারপাশের চোখে দেখা বিষয়গুলোই আমরা ভুলে যাই। কুরআন আমাদেরকে এই বাস্তব অবস্থাগুলোই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। মা যে সন্তানের জন্য চ‚ড়ান্ত কষ্ট করেছেন, অতিশয় দুর্বল অবস্থায় সন্তানকে বহন করেছেন, এর চেয়ে বড় বাস্তব মানুষের জীবনে আর কী আছে? মানুষ তো এই বিষয়গুলো দেখছে। স্ত্রীর জীবনে দেখছে, বোনের জীবনে দেখছে, কন্যার জীবনে দেখছে। বারবার দেখেও কি সে তার মায়ের কষ্টটা বুঝতে পারে না? এরপরও মানুষ ভুলে যায়। অকৃতজ্ঞ হয়ে পড়ে। তার জন্যও যে তার মা অনুরূপ কষ্ট করেছেন তা সে ভুলে যায়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই বিষয়টা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন।

কুরআন কি শুধু ‘আসমানের উপরের কথা আর যমীনের নীচের কথা’ বলে? এ জাতীয় কথা কারো কারো যবান থেকে  বের হয়। অনেকে অবশ্য কুরআনের ব্যাপারে বলে না, হুযুরদের ব্যাপারে বলে। ‘হুযুররা খালি মাটির নীচের কথা আর আসমানের উপরের কথা বলে। এই যে কথাটি- মায়ের সাথে সদাচার করো, তিনি তোমাকে অতি দুর্বল অবস্থায় বহন করেছেন- এটি কি মাটির নীচের আর আসমানের উপরের কথা? না আমাদের যাপিত জীবনের এক ধ্রæব বাস্তবতা? কুরআনের অধিকাংশ কথাই তো এরকম।

وَ فِصٰلُهٗ فِیْ عَامَیْن    ‘এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে’। সাধারণত দুই বছরে সন্তানের দুধ ছাড়ানো হয়। এই পর্বটাও যে কত কষ্টের পর্ব এবং এটা যে শিশুর কত অসহায়ত্বের সময় সেটা যদি মানুষ চিন্তা করে তাহলে বুঝতে পারবে। শিশু কি কখনো সময় মেনটেইন করে? যেমন সকালে আটটা বাজে সে দুধ পান করবে। এটা তার ব্রেকফাস্ট। এরপর দুপুর দুইটা বাজে সে লাঞ্চ করবে। বিকাল পাঁচটা বাজে নাশতা করবে আর রাতে শোয়ার সময় ১০ টা বাজে ডিনার করবে! সারা রাত আর কিছু খাবে না। সকালে যখন মা উঠবেন তখন আবার...। এমন সময় মেইনটেইন করে চলে? মোটেই না। মা হয়ত সারাদিনের কাজকর্ম শেষ করে মাত্র শুয়েছেন, তখনই শিশুর কান্নাকাটি শুরু হল। তাকে দুধ খাওয়াতে হবে। এই যে দুধ দেয়ার জন্য মায়ের ঘুম ছুটল, আর তো ঘুম আসে না। অনেকক্ষণ পরে, আবার যখন একটু চোখ লেগেছে, বাচ্চা আবার কান্না শুরু করেছে। কী হয়েছে? বিছানা ভিজিয়ে দিয়েছে। বিছানা ভিজিয়েই শেষ নয়, ক্ষুধাও তো পেয়ে গেছে! আবার দুধ দাও। এভাবে দিনের পরিশ্রম, রাতের বিশ্রাম সবকিছুই ওলটপালট হয়ে যায় সন্তানের পিছনে। এটা আমাদেরই জীবন-বাস্তবতা। এভাবেই মায়ের ত্যাগ-তিতিক্ষার উপর ভর করে আমরা বড় হয়েছি। তো মায়ের জীবনের দিবা-রাত্রির এই গদ্যময় আখ্যান কুরআন আমাদের স্মৃতিতে এনে দিয়েছে। মাত্র দুই-তিনটি শব্দে তা বয়ান করে দিয়েছে-

 وَ فِصٰلُهٗ فِیْ عَامَیْن এই দুই বছরকাল একজন মাকে আলাদা কষ্টের ভিতর দিয়ে যেতে হয়। তার রাতের বিশ্রাম বরবাদ হয়ে যায়। দিনের কাজকর্ম এলোমেলো হয়ে যায়। কাজেই হে ইনসান! اَنِ اشْكُرْ لِیْ وَ لِوَالدَیْكِ -আমার শোকরগোযারি করো এবং নিজের মা-বাবার শোকরগোযারি কর।  اِلَیَّ الْمَصِیْر-আমার দিকেই তোমাদের ফিরে আসতে হবে। হুকুম মানলে পুরস্কার পাবে, না মানলে শাস্তি ভোগ করবে।

এর পরের আয়াত হল-

وَ اِنْ جَاهَدٰكَ عَلٰۤی اَنْ تُشْرِكَ بِیْ مَا لَیْسَ لَكَ بِهٖ عِلْمٌ  فَلَا تُطِعْهُمَا وَ صَاحِبْهُمَا فِی الدُّنْیَا مَعْرُوْفًا.

তোমার মা-বাবা যদি তোমাকে পীড়াপীড়ি করে আমার সাথে কিছুকে শরীক করতে, যার সম্পর্কে তোমার কোনো জ্ঞান নেই তাহলে তাদের কথা মানবে না। তবে দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস করবে। আর যে বিশুদ্ধচিত্তে আমার অভিমুখী হয়েছে তার পথে চলবে। এরপর আমারই কাছে তোমাদের ফিরে আসা। সে সময় তোমরা যা করতে সে বিষয়ে তোমাদের অবহিত করব। -সূরা লুকমান (৩১) : ১৫

আগেই বলা হয়েছে, লুকমান আ.-এর অসীয়তের মাঝে এই দুই আয়াতে যেমন মা-বাবার সাথে সদাচারের বিধান আছে তেমনি শিরক থেকে বিরত থাকার উপদেশের তাকীদও আছে।

এই মা-বাবা, যারা তোমার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন, নিঃসন্দেহে তারা তোমার সদাচার ও মান্যতা পাওয়ার অনেক বেশি হকদার। কিন্তু তারাও যদি তোমাকে আমার সাথে শরীক করতে পীড়াপীড়ি করে তুমি এই বিষয়ে তাদের কথা মানবে না।

শিরক থেকে বেঁচে থাকার বিধান কত তাকীদপূর্ণ! দুনিয়ার জীবনে সন্তানের  বেড়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান যাদের, সবচেয়ে বেশি কষ্ট যারা করেছেন, তারাও যদি শিরকে লিপ্ত হওয়ার আদেশ করেন, শিরকে লিপ্ত হতে পীড়াপীড়ি করেন, তাদের কথাও মানা যাবে না। অন্যান্য লোকদের কথা তো বলাই বাহুল্য।

এক্ষেত্রে মা-বাবার কথাই যখন মান্য করা যাবে না তাহলে শিক্ষক-গুরুর কথা, নেতা ও কর্তার কথা, বন্ধু ও বান্ধবীর কথা, কারো  কথাতেই শিরকে লিপ্ত হওয়া যাবে না। শুধু শিরক নয়, অন্যান্য পাপাচারের ক্ষেত্রেও একই কথা। শরীয়তের মূলনীতি-

لا طاعة لمخلوق في معصية الله.

আল্লাহর নাফরমানী করে কোনো মাখলুকের ফরমাবরদারী নয়।

এর পরের বাক্যটি হচ্ছে-

وَ صَاحِبْهُمَا فِی الدُّنْیَا مَعْرُوْفًا  তাদের সাথে দুনিয়ার জীবনে সদ্ভাবে চলবে। ইসলামের ইনসাফ দেখুন। একদিকে বলা হচ্ছে, শিরকে লিপ্ত হতে বললে মা-বাবার কথা মানা যাবে না। সাথে সাথেই বলা হচ্ছে,    وَ صَاحِبْهُمَا فِی الدُّنْیَا مَعْرُوْفًا তাদের সাথে দুনিয়ার জীবনে সদ্ভাবে চলবে। শিরক ও নাফরমানির ক্ষেত্রে তাদের মান্যতা বর্জনের অর্থ এই নয় যে, তুমি তাদের সাথে বে-আদবী ও অসদাচরণ করতে পারবে। মা-বাবা অমুসলিম হলেও তাদের সাথে সদ্ভাবে চলতে হবে। যে কাজ শিরক, যে কাজ আল্লাহর নাফরমানি তাতে উৎসাহিত করলে, আদেশ করলে, পীড়াপীড়ি করলে সেটা মানা যাবে না। তবে অন্য ক্ষেত্রে তাদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখতে হবে। অন্যভাবে তাদেরকে খুশি রাখতে হবে। তাদের সাথে সুন্দর আচরণ করতে হবে। কারণ  তোমার দুনিয়ার জীবনে তাদের ত্যাগ ও অবদান রয়েছে। কাজেই তোমাকেও তাদের সাথে এই দুনিয়ার জীবনে সদ্ভাব বজায় রাখতে হবে।

কত ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষা! ন্যায়সঙ্গত শিক্ষা!!

এর পরের বাক্য-

وَ اتَّبِعْ سَبِیْلَ مَنْ اَنَابَ اِلَیَّ -‘আর তুমি চলবে তাদের পথে, অনুসরণ করবে তাদের আদর্শ, যারা আমার দিকে রুজু করেছেন।’ আল্লাহর দিকে রুজু করেছেন কারা? আল্লাহর দিকে রুজু করেছেন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন, সালাফে সালেহীন, হক্কানী-রব্বানী উলামায়ে কেরাম। এঁরা আল্লাহ অভিমুখী দল। কাজেই আদর্শের প্রশ্ন যখন আসবে তুমি আদর্শ অনুসরণ করবে আল্লাহ অভিমুখী দলের। এখানে কোনো আপোষ নেই, সমঝোতা নেই। দ্বীন ও ঈমানের প্রশ্নে মুমিন মুমিনদের সাথে থাকবে। আর  সাধারণ দুনিয়াবী সদ্ভাব রক্ষার ক্ষেত্রে মুমিন মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-পড়শি, সবার সাথেই ইসলামের শেখানো পদ্ধতিতে সদ্ভাব বজায় রাখবে।

মা-বাবা যদি অমুসলিমও হন তাহলেও তাদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান রক্ষা করতে হবে। আর মা-বাবা যদি মুসলিম হন তবে হাঁ, গুনাহে লিপ্ত, তাহলে তো ভালো ব্যবহার আরো বেশি প্রয়োজন। মা-বাবাকে ঈমানের দিকে নিয়ে আসার চেষ্টা  আর গুনাহে লিপ্ত হলে ঐ গুনাহ থেকে মুক্ত করার চেষ্টাও সন্তানের কর্তব্য। সেটারও নিয়মনীতি আছে, সে সম্পর্কে অন্য অবসরে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

তাহলে এক হল নীতি ও আদর্শ, আরেক হল সহাবস্থান। অনেক সময় মানুষ আদর্শ ও সহাবস্থানকে এক করে ফেলে। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অর্থ মনে করে আদর্শ বিসর্জন দেওয়া, আবার আদর্শ রক্ষার অর্থ মনে করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ত্যাগ করা। দু’টোই প্রান্তিকতা। আদর্শ ও অবস্থান দুটোর জন্যই ইসলামে নীতি ও বিধান দেওয়া আছে। তা জানতে হবে এবং মানতে হবে।

ثُمَّ اِلَیَّ مَرْجِعُكُم -এরপর আমার কাছেই তোমাদের ফিরে আসা। এখানে তিন পক্ষ। সন্তান, মুশরিক মা-বাবা, আর যারা সত্য পথের পথিক। এই তিন পক্ষের কথা উপরে এসেছে। এরপর বলা হচ্ছে, তোমাদের আমার কাছেই ফিরে আসতে হবে। হে সন্তান, তুমি আমার কাছেই ফিরে আসবে। হে মা-বাবা! তোমরা আমার কাছেই ফিরে আসবে। আর অতীতের যারা সত্য-পথের পথিকদল তারাও আমার কাছেই ফিরে আসবে। মুসলিম হও আর অমুসলিম হও, মুশরিক হও আর মুওয়াহহিদ হও, বাবা হও আর সন্তান হও, শিক্ষক হও আর ছাত্র হও, নেতা হও আর অধীন হও, কর্তা হও আর কর্মচারী হও, যা-ই হও না কেন, তোমাদের সবাইকে আমার কাছেই ফিরে আসতে হবে।

এরপর কী হবে?  فَاُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُوْن তখন তোমাদের জানিয়ে দেব দুনিয়ার জীবনে কে কী করতে। ওইদিন সবই জানতে পারবে, সবই দেখতে পাবে। কর্ম সম্পর্কেও জানতে পারবে, কর্মফল দেখতে পাবে। সেদিনের হিসাব হবে ভিন্ন।  দুনিয়াতে তো বিভিন্ন হকের বিষয় আছে, আদর্শ ও সহাবস্থানের প্রসঙ্গ আছে, মুশরিক হওয়ার পরও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সদ্ভাব-সদাচারের বিধান আছে। কিন্তু আখেরাতের আদালতে যখন উপস্থিত হবে, ঐ সময় ব্যক্তি ও তার কর্মের হিসাব হবে, যে যেমন কর্ম করেছে সে তেমন বিনিময় পাবে। এই আদালতে সবাই সমান। বাবা-সন্তানও নেই, কর্তা কর্মচারীও নেই, রাজা-প্রজা কোনো কিছুই নেই; আল্লাহর কাছে সবাই সমান। সবাই আল্লাহর মাখলুক, আল্লাহর বান্দা। সবার উপরেই ছিল ঈমান ও আমলে ছালেহের বিধান। এই আদালতে খালিক-মাখলূক স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে হিসাব নিকাশ হবে। স্রষ্টার কাছে নিজ নিজ কৃতকর্মের হিসাব দিতে হবে। কী কঠিন হুঁশিয়ারি এই বাক্যে শোনানো হয়েছে! দুনিয়ার এই কয়দিনের জীবন যখন শেষ হবে, তখন সবাই আমার নিকটে ফিরে আসবে। আমি তোমাদের সবাইকে জানিয়ে দিব- কে কী করতে।

‘জানিয়ে দিব’ কথাটির মানে নিশ্চয়ই বুঝে এসেছে। শুধু জানাবেন যে, তুমি ঈমান এনেছিলে, আর তুমি শিরক করেছিলে এইটুকু? যে ঈমান এনেছে, সে তো জানেই সে ঈমান এনেছে, যে শিরক করেছে সে তো জানেই সে শিরক করেছে। ‘জানাব’ মানে জানাব এবং জানানোর পরে যা হওয়ার সেটাও হবে। যে ঈমান এনেছ তাকে জানাব, তুমি ঈমান এনেছিলে, এই নাও তোমার ঈমানের পুরস্কার। যে শিরক করেছ তাকে জানাব, তুমি শিরক করেছিলে, এই যে শিরকের শাস্তি। এই যে মুমিন, তুমি আমার বিধান অনুযায়ী মুশরিক মা-বাবার সাথে সদাচার করেছিলে, এই যে এর পুরস্কার। আর তুমি হে মা-বাবা, সন্তানকে শিরকে প্ররোচিত করেছিলে, এই যে এর শাস্তি।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

 

 

advertisement