পাহাড়পুরী হুযূর রাহ. : কিছু স্মৃতি কিছু অনুভূতি
পাহাড়পুরী হুযূর রাহ. ছিলেন সত্যিকার অর্থেই এক পাহাড়। সারাটি জীবন যিনি নিজ আদর্শে অটল থেকেছেন ঈমানী দৃঢ়তায়। আর অসংখ্য শঙ্কিত প্রাণকে আগলে রেখেছেন তাঁর ছায়ায় পরম নিশ্চয়তায়। অশান্ত ও সন্ত্রস্তকে করেছেন শান্ত ও আশ্বস্ত। ব্যথিতকে দিয়েছেন সান্ত¡না। পীড়িতকে উপশম। আহতের ক্ষতে মলম এবং দিকহারাকে দিশা!...
এমন এক উদার, এক বিশাল হৃদয় ছিল তাঁর। এমনই এক মমতাভরা মন ছিল তাঁর যে, তাঁর কাছে এসে কখনো কেউ নিরাশ হয়নি। বরং নিরাশকে আশান্বিত করাই ছিল তাঁর কাজ। ঘুমন্তকে জাগানো, জাগ্রতকে কর্মচঞ্চল, নিশ্চেষ্টকে সচেষ্ট, আর সচেষ্টকে অবিশ্রান্ত ও দুর্বার করে তোলা, এ-ই ছিল তাঁর ব্রত। যে-ই এসেছে তাঁর কাছে কিংবা যেখানেই গেছেন তিনি সবাইকে বলেছেন একই কথা। একই রকম ব্যাকুলতা নিয়ে, একই রকম মমতা মিশ্রিত আর আবেগনিঃসৃত ভাষায়। তিনি ডাক দিয়েছেন তালিবে ইলমদের আদর্শ ইনসান হওয়ার, আল্লাহ্র সাথে সম্পর্ক রচনার, ইলম ধারণের জন্য সিনাকে পবিত্র করার এবং আসাতিযার কাছে সম্পূর্ণরূপে নিজেকে সঁপে দেয়ার...। আর এই কথাগুলো তিনি বলতেন এমনই এক ঢঙে ও কাইফিয়তে, যে কাইফিয়তই বলে দিতো- হৃদয়ের কত গভীর থেকে, কতটা বেদনা নিয়ে, আর কী পরিমাণ হিতাকাক্সক্ষার সাথে বলছেন কথাগুলো। কতবার যে শুনেছি তাঁর মুখে- ‘ইলম প্রবেশের রাস্তা তিনটি : চোখ, কান ও যবান। সুতরাং এগুলোকে নাপাক করো না। তাহলে ইলম কখনো তোমার সিনার ভিতরে যাবে না।’
আসাতিযার কাছে নিজেকে সমর্পণের কথা তিনি বলতেন ফিরিশতাদের উদাহরণ টেনে। আল্লাহর- ‘اَنْۢبِـُٔوْنِیْ بِاَسْمَآءِ هٰۤؤُلَآءِ ’-এর জবাবে তারা যে বলেছিলেন- سُبْحٰنَكَ لَا عِلْمَ لَنَاۤ اِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا’। এখান থেকে শিখতে বলতেন- বিনয়, আনুগত্য ও সমর্পণের শিক্ষা। ইলমের জন্য সবকিছু উজাড় করে জান-প্রাণ দিয়ে মেহনতে উদ্দীপ্ত করতেন ইমাম মালিকের সেই অমর উক্তিটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে-
العلم لا يعطيك بعضه حتى تعطيه كلك তোমরা সবটুকু না দিলে ইলম তোমাকে তার সামান্যটুকুও দেবে না।
তালিবে ইলমদের প্রায় সবারই অভিযোগ- পড়া বুঝে আসে না, পড়া মনে থাকে না। তিনি এর নোসখা বাতলেছেন- গোনাহ ছেড়ে দাও। ‘মাহারিমুল্লাহ্’ থেকে নিজেকে বাঁচাও! কারণ ইলম তো হল আল্লাহ্র পক্ষ থেকে এক নূর। মা‘ছিয়াত ও নাফরমানীতে ডুবে থেকে যা আশা করা যায় না।
এ প্রসঙ্গে শোনাতেন সেই বিখ্যাত চরণ দুটি-
شكوت إلى وكيع سوء حفظي + فأوصاني إلى ترك المعاصي
فإن العلم نور من إلهي + ونور الله لا يعطى لعاص
‘আমার উস্তায ওয়াকী রাহ.-কে বললাম আমার স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার কথা। তিনি উপদেশ দিলেন- গোনাহ ছেড়ে দাও। কেননা ইলম হল আমার আল্লাহ্র পক্ষ থেকে এক নূর। গোনাহে লিপ্ত ব্যক্তিকে তা দেয়া হয় না।’
তাঁর বলা কথাগুলো এমনভাবে অন্তরে রেখাপাত করত যে, উন্মুক্ত মন নিয়ে কেউ তা শুনলে জীবনে কখনো ভুলবে না। এবং একটু চেষ্টা করলেই যিন্দেগীভর আমলের তাওফীক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। তাঁর একেকটি মজলিস থেকে ওঠার পর ভিতরে এমন এক সংকল্প জাগত, যা কখনো ভঙ্গ হবার নয়। কখনো বা কিছুটা শৈথিল্য এসে গেলে তাঁর কথাগুলো স্মরণ হওয়ামাত্র এবং তাঁর নূরানী মুখমণ্ডলের দরদী চাহনি খেয়াল হওয়ামাত্র সংকল্প আবার জেগে উঠত। থেমে পড়া পথিক আবার নতুন উদ্যমে রওয়ানা করার হিম্মত পেত...।
তাঁর কথার আন্দাযে ও কণ্ঠস্বরে ছিল الحلم والأناة (প্রজ্ঞা, সহনশীলতা ও ধীরস্থিরতা)-এর সেই অনন্যসাধারণ গুণ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে গুণগুলোর প্রশংসা করেছেন, আর আমাদের আমীনুত তালীম ছাহেব হুযূর সবসময় যার তাকিদ করে থাকেন। তাঁর কথা ও কাজ সবকিছুতেই ছিল এটা পুরোমাত্রায়। তাই তাঁর প্রত্যেকটি আলফায ও হরকত তালিবে ইলমদের উদ্দীপ্ত করত- তাঁকে অনুকরণে। উৎসাহ যোগাতো- তাঁর ও তাঁদের মতো করে জীবনকে গড়তে।
পাহাড়পুরী হুযূরকে দেখতে পাওয়ার, তাঁর রূহানিয়াত ও নূরানিয়াতে ধন্য হওয়ার সুযোগ আমার সামনে অবারিত করেছিল যে প্রতিষ্ঠান, তার নাম মাদরাসা-ই-আনওয়ারুল উলূম। এ সেই প্রতিষ্ঠান, যেখানে অসংখ্যবার তাঁকে দেখেছি, পেয়েছি। ইফতেতাহী মজলিসে, পুরস্কার বিতরণী জলসায়, সাপ্তাহিক হাফলায়, বাৎসরিক মাহফিলে। এছাড়াও বছরের মাঝখানে বিভিন্ন সময়...। এখানে তিনি আসতেন, বসতেন, আসাতিযার সাথে কথা বলতেন এবং তালিবানে ইলমের উদ্দেশে কথা রাখতেন। উপদেশ দিতেন, উদ্দীপনা যোগাতেন। ইলমের পথের নবীন যাত্রীদলকে হুঁশিয়ার করতেন, আবার আশার বাণী শোনাতেন। তাদেরকে চলার পদ্ধতি শিখিয়ে দিতেন।
এ প্রতিষ্ঠানের আসাতিযা ও তলাবার সাথে তাঁর ছিল এক অন্যরকম কলবী তা‘আল্লুক ও আন্তরিক সম্পর্ক। ‘হাজারীবাগ মাদরাসা’ কথাটি যে তিনি কী মমতা মেখে, স্নেহের কী রস ও পরশ মিশিয়ে উচ্চারণ করতেন, না শুনলে বোঝা যাবে না। এ মাদরাসাকে তিনি ভালোবাসতেন অন্তর দিয়ে। আমরা সেটা অনুভব করতাম বলেই হয়ত তাঁর প্রতিটি কথা শোনামাত্র বসে যেত অন্তরে এবং বিপ্লব আনত জীবনে...।
আনওয়ারুল উলূমের সাথে তাঁর এই সম্পর্কের সূত্র বা উপলক্ষ তো মাদানী নেসাব। তবে যে মানুষটিকে কেন্দ্র করে ঐ অসীম অপরিমেয় ভালোবাসা, তিনি মাওলানা আবদুল হামীদ ছাহেব রাহ.। বড়দের প্রতি যার বিনয় ও আনুগত্য এবং ইলম ও তালিবানে ইলমের প্রতি যার আত্মনিবেদন ও আত্মবিসর্জন ছিল প্রবাদতুল্য। তিনি ছিলেন বয়সে তরুণ এবং কর্মচাঞ্চল্যেও তাই। আজ থেকে এক যুগেরও বেশি সময় আগে বর্ষার এক বিকেলে যেদিন পাহাড়পুরী হুযূর তার জানাযা পড়ালেন, সেদিনই বুঝেছিলাম, আমরা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্পদ হারালাম। সেটি যে কী, তা চিহ্নিত করতে না পারলেও অনুভব করছিলাম, খুঁটির সাথে দড়ির বাঁধনটা আলগা হয়ে আসছে একটু একটু করে এবং আমাদের চেনা পৃথিবীটা কেমন অচেনা হয়ে যাচ্ছে...। আজ এক যুগ পর সেই খুঁটিকেও হারালাম! জানি না কী অপেক্ষা করছে এরপর!! শুধু বলবো- বড়দের যেমন বলতে শুনেছি, বড়দের বিদায়ে-
اللّهُمّ لَا تَفْتِنّا بَعْدَهُ.
***
পাহাড়পুরী হুযুর রাহ.-এর সাথে খুব সামান্য হলেও আমার কিছু স্মৃতি আছে, সেই স্মৃতিগুলো পরিধিতে ছোট হলেও তার অনুভবের অংশটুকু বিশাল!... এই স্মৃতির মিছিলে তাঁর প্রত্যক্ষ সান্নিধ্য পাবার মুহূর্ত যেমন আছে, তেমনি আছে কাছে ও দূরে থেকে তাঁকে দেখা। একাকী সাক্ষাতে এবং মজমায় অনেকের মাঝে দেখা।
তাঁর মজলিসে যখনই গিয়েছি প্রত্যেকবারই জীবনের সেই ঊষালগ্নে গৃহীত আহাদনামার নবায়ন করেছি। আল্লাহ্র সাথে দুর্বল হওয়া সম্পর্ককে পুনরায় মজবুত করার সবক পেয়েছি। কারণ তিনি ছিলেন সত্যিই সেই মহৎ মানুষদের একজন, যাদের পরিচয়ে বলা হয়েছে-
مَنْ ذَكّرَكُمْ بِاللهِ رُؤْيتُهُ، وَزَادَ فِي عِلْمِكُمْ مَنْطِقُهُ، وَذَكّرَكُمْ بِالْآخِرَةِ عَمَلُهُ.
যাকে দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়, যার কথায় জ্ঞান বৃদ্ধি পায়, যার আমল আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
***
তাঁর নাম প্রথম শুনতে পাই হিফয পড়ার সময়। উস্তাযে শফীক মাওলানা বেলাল ছাহেবের মুখে। তিনি ছিলেন লালবাগের ফারেগ এবং পাহাড়পুরী হুযূর রাহ. ছিলেন তাঁর মুরব্বী। সেটা ১৪১৭ হিজরী, ১৯৯৭ সাল। আমার হিফয শেষ হয়েছে কেবল। শুনাচ্ছি জামিয়া মুহাম্মাদিয়া ইসলামিয়া কড়াইল (বনানী) মাদরাসায়। মাওলানা বেলাল ছাহেব আমাদের এক সাথীকে পাঠাচ্ছেন মিফতাহুল উলূম আলুবাজার মাদরাসায়, তাঁর উস্তাযের কাছে। একটি চিঠি আর কিছু হাদিয়া সহকারে...। সেই প্রথম ‘পাহাড়পুরী হুযূর’ নামটা শুনতে পাই। এরপর আমার এই মুহসিন উস্তাযেরই কল্যাণে আমার পরিবার আমাকে মাদানী নেসাবে ভর্তি করতে আগ্রহী হয়। হুযূর স্বয়ং উপস্থিত থেকে আমাকে ভর্তি করে দেন উত্তরা বায়তুস সালাম মাদরাসায়। আর নিজে চলে আসেন আনওয়ারুল উলূম হাজারীবাগ, বটতলায়। মনে আছে, সেবার ইফতেতাহী মজলিসে জীবনে প্রথমবার পাহাড়পুরী হুযূর এবং আদীব হুযূরকে একসঙ্গে দেখেছিলাম এবং মজলিস শেষে, পাহাড়পুরী হুযূর যখন অবস্থান করছিলেন বায়তুস সালাম মসজিদের দক্ষিণ দিকের একটি হুজরায়, তখন বেলাল ছাহেব আমাকে দেখা করিয়েছিলেন আদীব হুযূরের সঙ্গে। আদীব হুযূর তখন খুব ¯েœহ করেছিলেন আর প্রতিযোগিতাময় লেখাপড়ায় উৎসাহিত করেছিলেন। সময়টা ১৪১৯ হিজরী, ১৯৯৯ সাল। সেবার ইফতেতাহী জলসায় পাহাড়পুরী হুযূর কী আলোচনা করেছিলেন তার সবটা মনে নেই। তবে একটা কথা আমার মনে ধরেছিল। তাই মন থেকে তা আজো মুছে যায়নি। তিনি বলেছিলেন, যে পাখি উড়বে, পাখীর বাসার ভিতরে থাকা অবস্থায় তার ডানা ঝাপটানো দেখেই তা বোঝা যায়। কিংবা বলেছিলেন, কোন্ পাখী উড়বে, উড়ে কতদূর যেতে পারবে, সেটা পাখীর বাসায় থাকা অবস্থায় যখন সে ডানা ঝাপটায়, তা থেকেই বোঝা যায়। উদ্দেশ্য, জীবনে কে বড় হবে, আদর্শ মানুষ হতে পারবে- সেটা যখন সে ছোট, তখনকার কথাবার্তা ও চলাফেরা থেকেই আন্দায করা যায়। অতএব জীবনে সেরকম কিছু হতে হলে এখন থেকে, এই বয়স থেকেই চেষ্টা করতে হবে। নচেৎ সময় বয়ে যাওয়ার পর আফসোস ছাড়া আর কিছু নছীব হবে না...।
হুযূরের এই কথাটি সেই যে গেঁথে গিয়েছিল মনের মধ্যে, আজো তা অন্তরে গাঁথা রয়েছে।
আমার মুহতারাম উস্তায মাওলানা বেলাল ছাহেব সে বছর রমযানেই আমাকে নিয়ে এলেন আনওয়ারুল উলূমে।
আনওয়ারুল উলূমে পাহাড়পুরী হুযূরের আসা যাওয়ার স্মৃতিগুলো আমার চোখে সবসময় জ্বলজ্বল করে। অবস্থা এমন হয়েছে, পাহাড়পুরী হুযূর বললেই আমার সামনে সর্বপ্রথম আনওয়ারুল উলূমের স্মৃতি ভেসে ওঠে। একা এক বেবিটেক্সিতে, কখনো বা রিকশায় চেপে এসে নামছেন মাদরাসার সামনে। সিঁড়ি ভেঙে উঠছেন। মাথায় লাল রুমালে বাঁধা পাগড়ী। পরনে জুব্বা ও লুঙ্গি। কখনো জুব্বা ও সালোয়ার। হাতে লাঠি। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। পঞ্চাশোর্ধ্ব একজন মানুষ। লম্বা গড়ন। নীরব চুপচাপ। অবনত মস্তক। বিনয়ে ঝুঁকেপড়া বক্ষ। নূরে উদ্ভাসিত চেহারা। আর অন্তর ঠাণ্ডা করা চাহনি। দোতলায় গিয়ে বসলেন। আসাতিযাগণ বসেছেন তাঁর সম্মুখে, আদবের সাথে। খুব শান্ত, নিরালা এক পরিবেশ। কথা বলছেন খুব অল্প। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করছেন তো জবাব দিচ্ছেন। কথার শেষে ‘আল্লাহ’ উচ্চারণ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস...। চারতলায় জড়ো হয়েছে তালিবানে ইলমের জামাত। দক্ষিণদিকে করা হয়েছে আসাতিযার বসার জায়গা। ইফতেতাহী মজলিস। তিনি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন। পাশেই আদীব হুযূর বসা। পাহাড়পুরী হুযূর কথা আরম্ভ করলেন। পুরো মজলিসের উপর অঝোর ধারায় বর্ষিত হতে শুরু করলো সাকীনা ও রহমত...। মন ভিজল, হৃদয় সিক্ত হল। অন্তরের ময়লারা ধুয়ে যেতে লাগল এবং আত্মা হয়ে উঠল পবিত্র, প্রশান্ত ও প্রদীপ্ত...। মজলিস শেষ হল। সবাই উঠে যাচ্ছে। তবে অন্তরে তখনো বেজেই চলেছে মজলিসে শোনা শব্দমালা। ঝংকৃত অনুরণিত হচ্ছে বারবার। আর জাগ্রত হচ্ছে নিজেকে গড়ার প্রত্যয়। ইলমের জন্য ফানা হবার প্রেরণা এবং আল্লাহ্র রজ্জুকে শক্ত করে ধরার প্রতিজ্ঞা।
এমন করেই শুরু হল আমাদের তৃতীয় বর্ষের প্রথম দিনটা। তাই সারা বছর লেগে থাকা সম্ভব হল মেহনতে একটানা।
এ বছরটি যেমন সুন্দর করে গেল, তেমনি সুন্দরভাবে শুরু হল চতুর্থ বর্ষের নতুন শিক্ষাবছরটি। কিন্তু ষাণ¥াসিক পরীক্ষার মাত্র কিছুদিন আগে আমরা হারালাম আবদুল হামীদ রাহ.-কে। মনে হল, হৃদয় আছে, কিন্তু হৃদয়ের স্পন্দন যেন থেমে গেছে! মানুষ জীবনে কত কিছুই তো হারায়, কত রকম ক্ষতির সম্মুখীন হয়, কিন্তু কিছু কিছু ক্ষতি আছে, যা কখনো যেন পূরণ হবার নয়। আবদুল হামীদ রাহ.-এর বিদায় ছিল আমাদের জন্য তেমনি। চতুর্থ বর্ষের শেষ দিনটাতে তাঁর স্মৃতিবিজড়িত আনওয়ারুল উলূমকে ছেড়ে আসবার মুহূর্তটি তাই ছিল বেদনাবিধুর! ...
***
চতুর্থ বর্ষের পর আর কোনো জামাত যেহেতু এখানে ছিল না। তাই আমার উসতায মাদানী হুযূর মাওলানা আশরাফুযযামান ছাহেব সিদ্ধান্ত নিলেন- আমাকে জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগে ভর্তি করবেন। অতএব ১৪২৩ হিজরীর শাওয়ালে নিজে উপস্থিত হয়ে এখানে ভর্তি করে দিলেন।
এখানে এসে পেলাম আলোর এক কাফেলা। পেলাম জীবনের নতুন লক্ষ্যের সন্ধান। চলার নতুন ঢঙ এবং চেতনার অনিঃশেষ ফল্গুধারা। নিজেকে গড়ার এক প্রদীপ্ত প্রত্যয়...।
মালিবাগের স্বপ্নময় দিনগুলোতেও অনুভব করলাম নিজের মধ্যে আনওয়ারুল উলূমের সেই নূরানী দিনগুলোর প্রভাব। পাহাড়পুরী হুযূরের মুখে শোনা নসীহতগুলোর রোশনি সদা রওশান করে রাখত হৃদয়-মন। স্মরণ করিয়ে দিত আল্লাহ্র সাথে কৃত অঙ্গীকার। তাই ঈমান ও আখলাক অর্জন এবং আত্মশুদ্ধি ও আত্মোন্নয়ন, জীবন গঠনের এই দিকটিতে কোনো রকম দুর্বলতা অনুভব করলে সর্বপ্রথম মনে পড়ত তাঁর কথা। তখন স্মরণ করতে চেষ্টা করতাম তাঁর উপদেশগুলো। কখনো বা চলে যেতাম তাঁর সান্নিধ্যে।
জালালাইনের বছর। একদিন সন্ধ্যায় দেখা করতে গেলাম তাঁর সঙ্গে, লালমাটিয়া মাদরাসায়। বুখারী ছানী পড়াতেন তিনি ওখানে। দরস শেষে তাঁর হুজরায় এসে বসলেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর সাক্ষাতের অনুমতি পেলাম। নিজের কিছু হালত পেশ করলাম। তখন তিনি বললেন, কাপড় যেমন ময়লা হলে আমরা ওভাবেই রেখে দেই না; বরং দ্রæত ধুয়ে ফেলি এবং অসুস্থ হলে রোগ নিয়ে বসে থাকি না; বরং ডাক্তারের শরণাপন্ন হই। তেমনি দিলের মধ্যেও ময়লা জমে এবং অসুখ হয়। তাই দ্রæত তা পরিষ্কার করতে হয়, রূহানী চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়...। তিনি বোঝাতে চাইলেন, সবসময় ছাহিবে দিল কোনো একজন বুযুর্গের সঙ্গে সম্পর্ক ও নিয়মিত যোগাযোগ রেখে নিজের সংশোধন জরুরি। তাহলেই দিলের কাক্সিক্ষত হালত বজায় থাকা সম্ভব।
পড়ায় মনোযোগ কীভাবে বাড়তে পারে এবং পড়া কীভাবে দ্রুত ইয়াদ করা যায়, এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি একটি আমল বাতলে দিলেন। বললেন, যখন পড়তে বসো কিংবা কোনো কাজে মন দাও; যেমন সবক, মুতাআলা, তাকরার এমনকি যখন মুনাজাতের জন্য হাত উঠাও, বলবে-
سُبْحٰنَكَ لَا عِلْمَ لَنَاۤ اِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا اِنَّكَ اَنْتَ الْعَلِیْمُ الْحَكِیْمُ.
অর্থাৎ تفويض এবং إنابة إلى الله (আল্লাহর দিকে রুজু এবং আল্লাহ্রই কাছে সমস্ত কিছু অর্পণ)। মুমিনের স্বভাবে যে দু’টি গুণ থাকা উচিত খুবই উজ্জ্বল।
এ বছরই রমযানে কিংবা মেশকাতের বছর শেষে যে রমযান এল, সেই রমযানে একদিন খবর পেলাম, পাহাড়পুরী হুযূর ‘বারডেমে’ ভর্তি। একেবারে ভড়কে গেলাম। কারণ, হুযূর কখনো এতটা গুরুতর অসুস্থ হয়েছেন বলে এর আগে শুনিনি। হাজির হলাম হুযূর যে কামরায় অবস্থান করছিলেন ওখানে। নীরব মুলাকাত। অল্পক্ষণ। ঐ সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতের যে দৃশ্যটা এখনো চোখে ভাসে- হুযূর বসে আছেন বিছানার উপর। অযু করে এসেছেন। সরিষার তেল ব্যবহার করছেন চেহারায় খানিকটা, আর খানিকটা হাতে পায়ে। ...হুযূরের জীবন ছিল এমনই সাদাসিধা। সরিষার তেল মুখে মাখতে দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু খেয়াল করে দেখলাম, তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে শুরু করে জীবন যাত্রার সবকিছুই অতি সাধারণ। সবকিছুই প্রয়োজন পরিমাণ। আড়ম্বরহীন। আড়ম্বর যা কিছু তাঁর আমলে, আখলাকে। সৌন্দর্য এবং রুচিশীলতার সবই তাঁর ‘আন্দায ও আদা’য় এবং সালাফে সালিহীনের মতো সীরাত-সুরত ও বেশ-ভ‚ষায়।
***
আদীব হুযূরের ছোহবতে মাদরাসাতুল মাদীনার দিনগুলোতে পাহাড়পুরী হুযূরের সাক্ষাৎ পেয়েছি বেশ কয়েকবার। ১৪২৬ হিজরীর ১২ শাওয়াল ছিল নতুন শিক্ষাবর্ষের মজলিসে ইফতেতাহ। নিজের স্বভাবজাত দুর্বলতার কারণে ঠিক সময় উপস্থিত হতে না পারায় মজলিস পাওয়া হল না। আসরের পর হয়ে গেছে ইফতেতাহ। আমি হাজির হয়েছি মাগরিবেরও বেশ খানিক পরে। আসলে জীবনে যারা ভাবে, সময়ের প্রতি উদাসীন থেকে শুধু ভাগ্যের জোরে শেষ মুহূর্তে হলেও কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে, ভাগ্য তাদের সবসময় সঙ্গ দেয় না। তখন তিক্ত বাস্তবতাকেই বরণ করে নিতে হয়! এভাবে মুহূর্তের উদাসীনতায় কত সৌভাগ্য যে হাতছাড়া হয়ে যায়!...
১৪২৭-২৮ হি. শিক্ষাবর্ষের প্রায় শেষ দিকে এসে এক রাতে একটি খাব দেখে খুবই পেরেশান হলাম। আদীব হুযূরকে জানিয়ে তা‘বীর জিজ্ঞেস করলাম। হুযূর নিজে কোনো তা‘বীর করলেন না। শুধু বললেন, জুমার দিন পাহাড়পুরী হুযূরের ওখানে গিয়ে জুমা পড়ো (মিফতাহুল উলূম, আলু বাজার জামে মসজিদ)। জুমা আদায় করলাম। জুমার পর সাক্ষাৎপ্রার্থীরা একে একে দেখা করে চলে যাবার পর আমি এগিয়ে গেলাম। হুযূরকে খাবের বিস্তারিত জানালাম। তিনি প্রয়োজনীয় কিছু প্রশ্ন করে আমার তখনকার দিনকাল এবং পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝতে চেষ্টা করলেন। তারপর কিছু বিষয়ে সাবধান করে দিলেন। যা পরবর্তী জীবনে অনেক কাজে এসেছে।
খাবের তা‘বীর জানতে চাওয়ার সুবাদে যদিও এই সাক্ষাৎ, কিন্তু নিজের ঈমানী তারাক্কির কিছু সামানও এই মজলিস থেকে তোহফা স্বরূপ পেলাম। আমার আগে সর্বশেষ যিনি কথা বলছিলেন পাহাড়পুরী হুযূরের সঙ্গে; দেখলাম, তিনি জিজ্ঞেস করছেন ‘মুনাজাতে মাকবুল’ সম্পর্কে। কখন পড়বেন, কীভাবে, কী নিয়মে পড়বেন ইত্যাদি। মুনাজাতে মাকবুলের সঙ্গে পরিচয় এবং অন্তরঙ্গতা হয়েছিল আদীব হুযূরকে খুব আগ্রহ সহকারে তা পড়তে দেখে। হুযূরের দেখাদেখি আমিও কয়েক দিন কয়েক সাফা পড়েছিলাম। এই ক্ষণে প্রশ্নকারীর এই প্রশ্ন আমাকে সচকিত করল। খেয়াল করে শুনলাম হুযূর কী উত্তর দেন। তিনি বললেন, এটার জন্য কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। দিনেরাতে যখন মন চায়, যখন সুযোগ হয়। প্রতিদিন এক মনযিল করে। টানা দুই সপ্তাহ, নাগা না করে পড়ে যেতে পারলে ‘দাওয়ামের’ অভ্যাস হয়ে যাবে এবং বারাকাতও পেতে থাকবে। প্রশ্নকারী উঠে যাবার পর যখন আমি একান্তে হুযূরকে পেলাম তখন আমার আগ্রহের কথা জানিয়ে মুনাজাতে মাকবুলের এই অযিফা পাঠের অনুমতি চাইলাম। হুযূর অনুমতি দিলেন।
***
মারকাযে আসার পর যে কয়বার পাহাড়পুরী হুযূরকে দেখেছি, তার মধ্যে সবচে’ উজ্জ্বল একটি দিনের স্মৃতি। এদিন আদীব হুযূরও এসেছিলেন। ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৩২ হি.। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১১। এ দিনের ‘রোয়েদাদ’ উল্লেখ করেছেন আদীব হুযূর ‘এখনো আছে একটি প্রদীপ’ শীর্ষক লেখায়। যা প্রকাশিত হয়েছে মাসিক আলকাউসার জুমাদাল আখিরাহ ১৪২৩ হি./মে ২০১১ সংখ্যায়। দিনটি ছিল মেঘাচ্ছন্ন। আর তাই খানিকটা সহজ হয়েছে ‘তাশরীফ আওয়ারি’। বেশি আলো সইতে পারেন না বলে সাধারণত দিনে আর বের হন না এখন। সে হিসেবে আজকের আবহাওয়া বেশ উপযোগী। মাঝে এক বছরের মত হবে হুযূরকে দেখিনি। এরই মধ্যে যে এত পরিবর্তন ঘটে গেছে স্বাস্থ্যের, না দেখলে বিশ্বাস হতো না। বার্ধক্যে এমনই কাবু হয়েছেন যে, দূর থেকে দেখে চেনার উপায় নেই। কিন্তু, চেহারার সেই নূর ও নূরানিয়াত, আর সেই শান্ত কণ্ঠস্বর আছে আগের মতই।
মারকায হযরতপুর প্রাঙ্গণের সে বছরই ইফতেতাহ হয়েছে। হযরতপুর প্রাঙ্গণ বলতে তখন শুধু মারকাযের ঐ সাদাসিধা মসজিদটিই। হিফযখানা-মকতব থেকে শুরু করে কিতাব বিভাগ ও উলূমুল হাদীসের জামাত (সালে ছানী), তলাবা ও আসাতিযা সকলেরই অবস্থান এখানেই। পূর্বদিকের দীর্ঘ প্রসারিত শিক্ষাভবনটির কাজ তখনও শেষ হয়নি। পাহাড়পুরী হুযূর এসে মসজিদের সামনে দাঁড়ালেন। অযূ করলেন, মসজিদে প্রবেশ করে প্রথমে নামায আদায় করলেন। এরপর সমবেত তালিবানে ইলমের উদ্দেশে এক সংক্ষিপ্ত নছীহত পেশ করলেন। বললেন, ছাত্র-শিক্ষক সবাই আমরা তালিবে ইলম। আমিও ছিলাম এই বাগিচায়। কিছুদিন হল আলগ হয়েছি, ইলমের এই মহান নিআমত ও পবিত্র নূর হাছিল করতে হলে নিজেদের পাকছাফ করতে হবে-
وَ ذَرُوْا ظَاهِرَ الْاِثْمِ وَ بَاطِنَهٗ.
তোমরা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য উভয় প্রকার পাপ ছেড়ে দাও। -সূরা আনআম (৬): ১২০
গোনাহ ছাড়তে না পারলে সাফল্য স্থায়ী হবে না। গোনাহ পরিত্যাগ না করে ইলম তলবের চেষ্টার অর্থ হবে, শক্তিশালী ওষুধের সঙ্গে বিষ পান করা, যা দেহের মরযকে আরো বাড়িয়ে দেবে এবং করুণ পরিণতিই ডেকে আনবে। হুযূর বললেন, এসব কথা আমরা জানি। এখন হিম্মতের সঙ্গে আমল শুরু করতে হবে। প্রতিদিন সকালে উঠে গোনাহ না করার অঙ্গীকার ও রাতে শোয়ার আগে মুহাসাবার আদত গড়তে হবে। গোনাহমুক্তির জন্যও আল্লাহ্র তাওফীক প্রয়োজন। আর আল্লাহ্র কাছে চাইলে তিনি নিশ্চয়ই সহজ করে দেবেন। যা করলে তিনি খুশী হন, সেই কাজের জন্য সাহায্য চাওয়া হচ্ছে, আর তিনি সাহায্য করবেন না- তা কি হয়?!
মারকায প্রসঙ্গে বললেন, এখানে এসে আমার খুব ভালো লাগছে। ইলমের এই নতুন বাগান দেখে আমার দিল খুশিতে বাগ বাগ। আল্লাহ্র শোকর যে, এমন একটি সুন্দর জায়গা তিনি মিলিয়েছেন। এরপর মুনাজাত করে আলোচনা শেষ করলেন। হুযূরের নসীহতের এই শব্দগুলি আমার রোযনামচায় সংরক্ষিত ছিল। যে গুণ ও বৈশিষ্ট্যের কারণে তাঁর বক্তব্য শ্রোতাচিত্তকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে এবং কঠিন তালাবদ্ধ অন্তরেও করাঘাত করে পৌঁছে যায় অন্দরে, তারই সামান্য উদাহরণ হিসেবে তুলে দিলাম এই লাইনগুলো।
এদিনের আলোচনাতেই কিংবা অন্য কোনো দিন এই হযরতপুর প্রাঙ্গণ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘এ এলাকার নাম হযরতপুর। কারণ, আল্লাহ জানতেন আমার হযরতেরা আসবেন এখানে’। উদ্দেশ্য, আদীব হুযূর, মুদীর ছাহেব এবং আমীনুত তালীম ছাহেব।
মারকাযে তিনি সর্বশেষ এসেছিলেন জুমাদাল উলা ১৪৩৫ হি. (মার্চ ২০১৪)-এর ওয়াজ-মাহফিল উপলক্ষে। তখনো স্বাস্থ্যের অবস্থা কিছুটা চলার মত ছিল। সেদিন খুব দরদের সঙ্গে তিনি সবাইকে ‘নাওয়াফেল’-এর প্রতি যতœবান হওয়ার আহŸান জানিয়েছিলেন। ইশরাক, চাশত এবং আল্লাহ্কে সারাদিনের কাজকর্মের জন্য ওয়াকীল বানানোর নিয়তে আরো দু’রাকাত। দিনের শুরুতে এই কয়েক রাকাত নফল আদায়ের কী যে বরকত পাওয়া যায় দিনভর সমস্ত কাজে, সে কথা বুঝিয়েছিলেন হাদীসে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উদ্ধৃত করে। দিলের সবটুকু দরদ ঢেলে দিয়ে...!
এদিন খুব সংক্ষিপ্ত করেছিলেন তাঁর বয়ান। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে রেখেছিলেন শুধু এই একটিই মিনতি।
গাড়ী এসেছিল মঞ্চ পর্যন্ত। দু’জনে ধরে তাঁকে নামিয়ে নিয়ে গেলেন। গাড়ী বেরিয়ে গেল। কে জানত, এই যে গেলেন আর কোনো দিন তিনি আসবেন না মারকাযে! আজকের পর তাঁর মুখ থেকে আর কোনো দিন কোনো নছীহত শোনা হবে না আমার!...
এরপর আর একবারই শুধু তাঁর দেখা পেয়েছি, পূর্ণ শয্যাশায়ী হবার আগে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত আলমারকাযুল ইলমীর তত্ত¡াবধানে পরিচালিত মাদরাসা দারুল কুরআনের হাফেয ছাত্রদের দস্তারে ফযীলত প্রদান মাহফিলে। আমীনুত তালীম ছাহেব নিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে তাঁর সঙ্গে। পাহাড়পুরী হুযূরের যখন বয়ান পেশ করার সময় হল, চারজনে ধরে চেয়ারে করে তাঁকে মঞ্চে ওঠালেন। তিনি কোনো কথা বলতে পারলেন না। শুধু হাত উঁচু করে আসমানের দিকে তাকিয়ে কয়েকবার বললেন, ‘আল্লাহ’...! আর কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। তারপর নিঃশব্দ মুনাজাত!... সেই দৃশ্য যত বার স্মরণ হয় চোখ ফেটে কান্না আসে। আল্লাহ্-পথের মুজাহিদ জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় কী ফরিয়াদ পেশ করলেন আসমানের মালিকের কাছে? কী বলতে চাইলেন হাত উঁচু করে? মাওলা! আমার তো ডাক এসে যাবে, তুমি দেখে রেখো...! তুমিই পূর্ণ করে দিও এই অধরা স্বপ্ন, রেখে যাওয়া সব কাজ...। তোমার কাছেই সোপর্দ করলাম। কবুল কর মাওলা..? যা আসলে বলেছিলেন তা তো বোঝা গেল না। তবে যা বলতে চেয়েছেন হতে পারে তা এরকম কিংবা আরো কোনো গোপন-গভীর কথা।
পাহাড়পুরী হুযূর শয্যাশায়ী অবস্থায় যখন অতিবাহিত করছিলেন জীবনের শেষ দিনগুলি, তখন একদিন (১৫শা‘বান ১৪৩৭ হি.) গেলাম নূরিয়ার পাশে অবস্থিত তাঁর বাসায়। মাদানী হুযূরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। হুযূর আমাকে নিয়ে গেলেন ভিতরে। যেখানে পাহাড়পুরী হুযূর নিবিড় পরিচর্যায় ছিলেন। হুযূরের বর্তমান এই সেবা ও শুশ্রূষায় হাজারীবাগ বায়তুর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মাদরাসার আসাতিযা ও তলাবায়ে কেরামের স্বতঃস্ফ‚র্ত ও নিবেদিত অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করে মাদানী হুযূর জানালেন, তালিবানে ইলমের এই জামাত পালা করে দিনরাত সর্বক্ষণ তাঁর পাশে থাকছে এবং দেখাশোনা করছে। হুযূর এবং তার ভাই মাওলানা আবরারুয যামান ছাহেবও দিনরাতের চব্বিশ ঘণ্টাকে ভাগ করে নিয়েছেন নিজেদের মধ্যে...। এই দৃশ্য, এই বণ্টন এবং এই বন্দোবস্ত দেখে আমার কেবলই মনে পড়ল নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই নছীহত, যা তিনি করেছিলেন তাঁর প্রিয় ছাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর উদ্দেশে-
يَا غُلَامُ احْفَظِ اللهَ يَحْفَظْكَ، احْفَظِ اللهَ تَجِدْهُ تُجَاهَكَ.
(হে বৎস! তুমি আল্লাহ্র আদেশ-নিষেধগুলো)কে হেফাযত করো। আল্লাহ্ও তোমাকে হেফাযত করবেন। তুমি আল্লাহ্র হকগুলো যথাযথ পালন করো, তাঁকে সর্বদা তোমার সামনেই পাবে।)
পাহাড়পুরী হুযূর রাহ.-এর সেই অন্তিম দিনগুলো, যখন তাঁর কোনরকম অনুভ‚তি নেই এবং নেই নড়াচড়ার সামান্য শক্তি, সেই মুহূর্তেও যেরকম যত্ন ও পরিচর্যা এবং সার্বক্ষণিক সেবা-শুশ্রূষার মধ্যে তিনি ছিলেন এবং তাঁর তরবিয়তধন্য সন্তানেরা পিতার প্রতি পুত্রের কর্তব্য পালনের যে অনন্য সাধারণ দৃষ্টান্ত রেখেছেন, তার ব্যাখ্যা হতে পারে এই নববী হাদীসটিই।... পাহাড়পুরী হুযূরকে যারা দেখেছেন তারা সকলেই সাক্ষ্য দেবেন, তিনি ছিলেন সেই মানুষ, সারাটি জীবন যিনি মৃত্যুপরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। আর তাই মৃত্যুর সাক্ষাৎ পাবার আগেই রব্বে কারীমের পক্ষ থেকে শুরু হয়ে গেছে তাঁর সমাদর ও তাকে বরণ করে নেয়ার প্রস্তুতি!...
পাহাড়পুরী হুযূরের ইন্তিকালের মাত্র এক সপ্তাহ আগে। মাদানী হুযূরের সঙ্গে সাক্ষাৎ। একদিন পরই তিনি রওয়ানা হবেন বাইতুল্লাহ্র সফরের উদ্দেশ্যে। এসেছেন আমীনুত তালীম ছাহেবের সঙ্গে জরুরি কথা বলতে। বেশ খানিকক্ষণ থাকলেন।... মাদানী হুযুরও রওয়ানা হলেন বাইতুল্লাহ্র উদ্দেশ্যে আর পাহাড়পুরী হুযুরও রওয়ানা হয়ে গেলেন আল্লাহ্র কাছে!