এখন আসবে একজন জান্নাতী মানুষ
একদিন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের নিয়ে মসজিদে নববীতে বসে আছেন। সবার মনে তাঁর কথা শোনার আগ্রহ। নবীজী বললেন,
يَطْلُعُ عَلَيْكُمُ الْآنَ رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ الْجَنّةِ.
‘তোমাদের মাঝে এখন আসবে একজন জান্নাতী মানুষ।’ নবীজীর মুখে একথা শুনে নিশ্চয়ই সবাই খুব উৎসুক হয়ে উঠেছিলেন, সেই সৌভাগ্যবান মানুষটি কে- তা দেখার জন্য। ইতিমধ্যে একজন আগমন করলেন, যিনি সবেমাত্র ওযু করেছেন। দাড়ি বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরছে। জুতা জোড়া বাম হাতে ভাঁজ করা। ধীরে ধীরে মসজিদের দিকে আসছেন। এ দরোজা দিয়েই প্রবেশ করলেন তিনি নবীজীর মজলিসে শরীক হওয়ার জন্য।
দ্বিতীয় দিন। সবাই নবীজীকে ঘিরে বসে আছেন। নবীজী গতকালের মতই বললেন- ‘এখন তোমাদের মাঝে একজন জান্নাতী মানুষের আগমন ঘটবে।’ দেখা গেল এই দিনও সেই মানুষটিকেই আগমন করতে।
তৃতীয় দিন। গত দু’দিনের মত আজও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন সে একই কথা। দেখা গেল নবীজীর কথার পর সেই মানুষটিই মজলিসে আগমন করলেন।
কে এই সৌভাগ্যবান, যিনি তিন তিনদিন তিন তিনবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখে জান্নাতী হওয়ার সনদ পেলেন? তিনি হচ্ছেন হযরত সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা.।
হযরত সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা.। কেমন ছিলেন তিনি? কী ছিল তাঁর গুণ ও বৈশিষ্ট্য? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাঁর সম্পর্কে এই সুসংবাদ দিলেন তার পরের জীবনটুকু কীভাবে কেটেছে? সংক্ষেপে বললে তিনি ছিলেন নবীজীর অত্যন্ত প্রিয় ও বিশ্বস্ত ছাহাবী। নবীজী তাকে খুব মহব্বত করতেন। তিনিও নবীজীকে ভালবাসতেন প্রাণ দিয়ে। মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি ইসলাম কবুল করেন। তাঁর ইসলাম কবুলের বিবরণও খুবই চমৎকার। দ্বীন-ঈমানের জন্য অতুলনীয় ত্যাগ স্বীকার করেছেন তিনি। জিহাদের ময়দানে ছিল তাঁর অসাধারণ নৈপুণ্য। নবীজী তাঁর সমরকুশলতার প্রশংসা করেছেন। ইসলামের ইতিহাসে তিনিই সর্বপ্রথম শত্রুর বিরুদ্ধে তীর নিক্ষেপ করেছেন।
বদর, ওহুদসহ বড় বড় যুদ্ধে নবীজীর সাথে অংশগ্রহণ করেছেন। বিভিন্ন যুদ্ধে সেনাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি।
ইলমের দিগন্তে তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনেক হাদীস তিনি বর্ণনা করেছেন।
খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত উমর রা.-এর আমলে তিনি কুফার খণ্ডকালীন গভর্নর ছিলেন। এই সব কিছু সত্তে¡ও তিনি ছিলেন সাদামাটা স্বভাবের একজন মানুষ। ৫৫ হিজরী সনে ৮২ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। (দ্র. সিয়ারু আলামিন নুবালা, যাহাবী)
তাঁর জীবনটিই প্রমাণ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী কত সত্য। তিনি যাকে জান্নাতী বলেছেন বাস্তবেও তাঁর জীবন জান্নাতী আমলের মধ্যেই অতিবাহিত হয়েছে।
যে ঘটনাটি বলছিলাম- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখে হযরত সা‘দ রা. সম্পর্কে এই মহা সুসংবাদ ঘোষিত হওয়ার পর যা ঘটল; মজলিস শেষে হযরত সা‘দ রা. যখন বাড়ির পথে রওয়ানা হলেন তখন সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. তাঁর পিছু পিছু হাঁটতে লাগলেন। তাঁর মনে একটিই চিন্তা হযরত সা‘দ রা. কী আমল করেন? কোন আমলের গুণে তিনি এই মহা সৌভাগ্য অর্জন করলেন- তা তাকে জানতেই হবে। রহস্য উদঘাটনে তিনি একটুখানি কৌশল করলেন।
হযরত সা‘দ রা.-এর কাছে গিয়ে বললেন, চাচা, ঘরে আব্বার একটি কথার জবাব দিয়েছিলাম, এরপর কসম করেছি যে, তিন দিন বাড়িতে যাব না। তো মেহেরবানী করে কি এই তিন দিন আমাকে আপনার ঘরে থাকতে দিবেন?
-ঠিক আছে, থাকো। কোনো অসুবিধা নেই।১[1]
হযরত আবদুল্লাহ একে একে তিন রাত হযরত সা‘দের বাড়িতে রইলেন। কৌতুহলের এ তিনরাতে তিনি যা কিছু আবিষ্কার করতে পারলেন তার মুখেই শোনা যাক সেই বিবরণ-
আমি তিন রাত কাটালাম। তাঁকে রাত জেগে জেগে তাহাজ্জুদও তেমন পড়তে দেখলাম না। তবে রাতে ঘুম ভাঙ্গলেই পাশ ফেরার সময় আল্লাহু আকবার বলতেন; আল্লাহ্র যিকির করতেন; এরপর ফজরের সময় হলে নামাযের জন্য উঠে পড়তেন।
তবে এ তিন দিন তাঁকে কোনো অর্থহীন শব্দ বা বাক্য বলতে শুনিনি। শুধু ভালো কথাই বলতে দেখেছি।
তিন রাত কাটানোর পর তাঁকে বললাম- চাচা, আব্বার সাথে আমার রাগারাগির কিছু ঘটেনি।২[2] শুধু আপনার সাথে কিছু সময় থাকা এবং আপনার আমল পর্যবেক্ষণ করাই ছিল আমার উদ্দেশ্য। কারণ পর পর তিন দিন আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
يَطْلُعُ عَلَيْكُمُ الْآنَ رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ الْجَنّةِ.
এখন তোমাদের মাঝে একজন জান্নাতী মানুষের আগমন ঘটবে।’ তিন বারই দেখা গেল আপনার আগমন হয়েছে। তখন থেকেই আমি সংকল্প করেছি, আপনার সাথে থেকে আপনার ‘আমল’ পর্যবেক্ষণ করব এবং সে মোতাবেক আমল করে আমিও জান্নাতী হব।
কিন্তু চাচা, আপনাকে তো বেশি কিছু আমল করতে দেখলাম না! তাহলে কী এমন বিষয়, যা আপনাকে নবীজীর পাক যবানে উচ্চারিত এই সৌভাগ্য এনে দিল?
সা‘দ রা. বললেন, (ভাতিজা!) আমার আমল তো ঐটুকুই যা তুমি দেখেছ!
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. বোধ হয় কিছুটা আশাহত হলেন। ফিরে যাওয়ার সময় পেছন থেকে ডাক আসল- আবদুল্লাহ!
আবদুল্লাহ ফিরে তাকালেন।
হযরত সা‘দ বললেন, ভাতিজা, তুমি আমাকে যেমন দেখেছ আমার আমল তো ঐটুকুই। তবে একটি বিষয় আছে।
হযরত আবদুল্লাহ আগ্রহী হয়ে শুনতে লাগলেন। হযরত সা‘দ রা. বললেন, কোনো মুসলিম ভাইয়ের প্রতি আমি অন্তরে কোনো ক‚ট চিন্তা পোষণ করি না আর আল্লাহ কাউকে যে নিআমত দান করেছেন তার কারণে হিংসা করি না।
এ কথা শুনে হযরত আবদুল্লাহ বলে উঠলেন, হাঁ, এই গুণটিই আপনাকে ঐ সৌভাগ্যের অধিকারী করেছে। আর এটিই আমরা পারি না।
[দ্রষ্টব্য : মুসনাদে আহমাদ ৩/১৬৬, হাদীস ১২৬৯৭; কিতাবুয যুহদ- ইবনে মোবারক রাহ. হাদীস : ৬৪৬ বাবু মা জাআ ফিশশুহ্
)قال الحافظ المنذري: إسناده على شرط البخاري ومسلم.
كذا في الترغيب والترهيب، باب ما جاء في ترهيب الحسد[(
আল্লাহ শুধু মানুষের বাইরের আমল দেখেন না, মনের অবস্থাটাও দেখেন। কার মনে অন্যের প্রতি হিংসা, কার মনে অন্যের ক্ষতি সাধনের চিন্তা তা আল্লাহ ভালো করেই জানেন। কাজেই আল্লাহ্র সন্তুষ্টি পেতে হলে বাইরের আমলের সাথে ভিতরটাকেও পবিত্র ও নির্মল করতে হবে। অন্যের সুখে ও সৌভাগ্যে আনন্দিত হতে হবে। অন্যের দুঃখে দুঃখী হতে হবে। তাহলেই আল্লাহ আমাদের উপর খুশি হবেন, আমরাও হতে পারব জান্নাতী মানুষ। হ
১. হযরত আবদুল্লাহ রা. এই কৌশলটুকুর আশ্রয় নিয়েছেন একটি পুণ্য সম্পর্কে অবগতি লাভ করার জন্য। এ ধরনের কৌশল গ্রহণে আপত্তি নেই। কেননা কোনো ভালো কাজ করতে কিংবা মন্দ পরিহার করতে কৌশল অবলম্বনে সমস্যা থাকে না; যদি তাতে আল্লাহ কিংবা বান্দার হক নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা না থাকে। তবে কোন্ ক্ষেত্রে কীভাবে তা অবলম্বন করবে আর কোন্ ক্ষেত্রে করবে না- বিষয়টি বিজ্ঞ আলেমের পরামর্শে হওয়া কাম্য।
قال الشيخ عبد الفتاح : وإنما احتال عبد الله بن عمرو رضي الله تعالى عنه بهذه الطريقة ليتوصل بها إلى الوقوف على عمل ذلك الرجل الصالح فيقتدي به. وهذا من الحيل المشروعة التي لا تناقض مقاصد الشرع.
والضابط العام في الحيل المشروعة أنها ما كان المقصود بها إحياء حق أو دفع ظلم أو فعل واجب أو ترك محرم أو إحقاق حق أو إبطال باطل او جلب محبوب مشروع أو دفع مكروه أو نحو ذلك مما يحقق مصلحة مشروعة ولا يناقض مقصود الشارع الحكيم، ولا يكون فيه تفويت حق للخالق أو المخلوق...انتهى.
২. সূক্ষ্মভাবে বিচার করলে দেখা যাবে, বাবার সাথে রাগারাগি হয়েছিল এমন কথা তিনি স্পষ্টভাবে বলেননি। হাঁ, যা বলেছিলেন তা থেকে কেউ রাগারাগিই বুঝতে পারে।