বিবাদ-বিসংবাদে করণীয়
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اَطِیْعُوا اللهَ وَ اَطِیْعُوا الرَّسُوْلَ وَ اُولِی الْاَمْرِ مِنْكُمْ فَاِنْ تَنَازَعْتُمْ فِیْ شَیْءٍ فَرُدُّوْهُ اِلَی اللهِ وَ الرَّسُوْلِ اِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَ الْیَوْمِ الْاٰخِرِ ذٰلِكَ خَیْرٌ وَّ اَحْسَنُ تَاْوِیْلًا.
উপরে কুরআন মাজীদের একটি বিখ্যাত আয়াত উদ্ধৃত করেছি। এই আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর মুমিন বান্দাদের সম্বোধন করে আদেশ করেছেন, তারা যেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করে এবং দ্বীনী ও দুনিয়াবী ক্ষেত্রে কর্তা ও দায়িত্বশীলদের আনুগত্য করে। এরপর কোনো বিষয়ে তাদের মাঝে বিবাদ-বিসংবাদ তৈরি হলে তা যেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে পেশ করে। এটি কল্যাণকর এবং পরিণামের দিক থেকে উত্তম। -সূরা নিসা (৪) : ৫৯
কুরআন মাজীদ আমাদেরকে আমাদের জীবনের সকল কথা ও কাজের মূলনীতি জানিয়ে দিয়েছে। মুমিন তার জীবনের সকল কাজ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের হুকুম অনুযায়ী করবে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্যের মধ্য দিয়ে করবে। দ্বীনী ক্ষেত্রে ও দুনিয়াবী ক্ষেত্রে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যাদের দায়িত্বশীল বানিয়েছেন তাদের আনুগত্য করবে। এই আনুগত্য উপরের আনুগত্যের অধীন। এরপর কোনো বিষয়ে তাদের মাঝে বিবাদ-বিসংবাদ তৈরি হলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে পেশ করবে। ওখান থেকে যে ফায়সালা আসে তা সর্বান্তকরণে মেনে নিবে। এটি তাদের দুনিয়া-আখেরাত উভয় জাহানে জন্য কল্যাণকর। তো মুসলিম-জীবনের নীতি হচ্ছে শান্তিতে-বিবাদে সর্বাবস্থায় আল্লাহর হুকুমের সামনে সমর্পিত থাকা ।
মুসলিমের জীবনাদর্শ ইসলাম। জীবনের সকল ক্ষেত্রে সে ইসলামেরই অনুসারী। ব্যক্তি-জীবন, পারিবারিক জীবন, সমাজ-জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবন সকল ক্ষেত্রে ইসলামের বিধি-বিধানেরই অনুগত। ইবাদত-বন্দেগী থেকে শুরু করে লেনদেন, বিয়ে-শাদী, পর্ব-উৎসব, আদব-আখলাক, নীতি-দর্শন, বেশ-ভ‚ষা, লাইফস্টাইল সকল ক্ষেত্রে সে উসওয়ায়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তথা নবী-আদর্শের অনুসারী।
মুসলিমের এই আনুগত্য ও অনুসরণ শুধু শান্তি ও সৌহার্দের অবস্থাতেই নয়, অশান্তি ও বিবাদের ক্ষেত্রেও। মুসলিমের বিচার-সালিশ, রায়-ফায়সালা সবই হবে আল্লাহ তাআলার হুকুম অনুসারে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীয়ত অনুসারে।
এক আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
فَلَا وَ رَبِّكَ لَا یُؤْمِنُوْنَ حَتّٰی یُحَكِّمُوْكَ فِیْمَا شَجَرَ بَیْنَهُمْ ثُمَّ لَا یَجِدُوْا فِیْۤ اَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَیْتَ وَ یُسَلِّمُوْا تَسْلِیْمًا.
এই আয়াতে কসমের সাথে বলা হয়েছে যে, নিজেদের বিবাদ-বিসংবাদের বিচারের ভার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অর্পণ করার আগ পর্যন্ত এবং তাঁর রায় সর্বান্তকরণে মেনে নেয়ার আগ পর্যন্ত মুমিন হওয়া যায় না।
কাজেই বিবাদ-বিসংবাদের ক্ষেত্রেও মুসলিমের করণীয় দ্বীন ও শরীয়তের পাবন্দ থাকা। শরীয়ত এ অবস্থায় যে করণীয় সাব্যস্ত করে তা পালন করা, যা বর্জনীয় সাব্যস্ত করে তা বর্জন করা। ইসলামী জীবনের এটি অনেক বড় মৌলিক বৈশিষ্ট্য।
এই আয়াতে যে মৌলিক শিক্ষা দেওয়া হয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ কুরআন ও সুন্নাহয় আছে, ফিকহে ইসলামীতে আছে। সেই শিক্ষা যদি মুমিনগণ অবলম্বন করেন তাহলে তাদের দুনিয়ার জীবনও সুন্দর হবে, শৃংখলাপূর্ণ হবে, আখেরাতের জীবনেও নাজাত পাওয়া যাবে, শান্তি পাওয়া যাবে।
কুরআন মাজীদের এই আয়াত থেকে আমরা জীবনের এক বাস্তবতা এবং সেই বাস্তবতায় করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা পাই। ‘তানাযূ’- পরস্পরে বিবাদ-বিসংবাদ মানবজীবনের এক বাস্তবতা। বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। তা যতই অপ্রিয় হোক। অপ্রিয় বাস্তবতার ক্ষেত্রেও সঠিক করণীয় জানতে হয় এবং সেই করণীয় অনুসরণ করতে হয়। তাহলেই জীবন ও কর্ম সুন্দর হয়। আমরা যদি বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাই, চোখ বন্ধ করে রাখি, এতে সমস্যার সমাধান হবে না। সমস্যাটি যদি হয় সামষ্টিক জীবনের সমস্যা তাহলে চোখ বুজে থাকার দ্বারা তো সমস্যার সমাধান হবেই না, এক্ষেত্রে নিজের কর্ম ও অবস্থান কী হওয়া উচিত সেটাও সঠিকভাবে বুঝতে পারব না। এ কারণে জীবনের বাস্তবতা অপ্রিয় হলেও তা এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়; বরং সে সম্পর্কে কুরআন মাজীদ যে বিধান দান করেছে সেই বিধান ও নির্দেশনা সঠিকভাবে জানতে হবে ও বুঝতে হবে এবং সে অনুযায়ী নিজেকে চালাতে হবে।
তো এখানে এই আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, যদি তোমাদের পরস্পরে বিবাদ-বিসংবাদ হয় তাহলে বিষয়টিকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর ন্যস্ত করো। ওখান থেকে যে ফায়সালা আসে সেই ফায়সালাকে শিরোধার্য করো। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর ন্যস্ত করার অর্থ কী? যে পর্যন্ত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতের মাঝে ছিলেন ঐ পর্যন্ত সরাসরি তাঁর নিকট থেকে ফায়সালা নেওয়ার সুযোগ ছিল। যখন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন তখন তাঁর উপর ন্যস্ত করা ও তাঁর ফায়সালা গ্রহণ করার অর্থ হল, কুরআন ও সুন্নাহর উপর ন্যস্ত করা এবং কুরআন-সুন্নাহর সঠিক ভাষ্যের ভিত্তিতে ফায়সালা গ্রহণ করা।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, কিন্তু তাঁর সুন্নাহ, তাঁর আনীত দ্বীন ও শরীয়ত কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই দ্বীনকে সংরক্ষণ করেছেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষণ করবেন। কাজেই যে বিবাদ-বিসংবাদই তৈরি হোক, মুমিন-মুসলমানের কর্তব্য হচ্ছে, দ্বীনের বিধানের আলোকে তার সুরাহা করা। দ্বীনের বিধানকে শিরোধার্য করা।
পৃথিবীতে বহু রকমের মতভেদ হতে পারে। নানা বিষয়ে নানা প্রকারের বিবাদ-বিসংবাদ তৈরি হতে পারে। সকল বিবাদ এক প্রকারের হবে এটা সম্ভব নয়। অনেক রকমের হবে। বিবাদের মূলে যে মতভেদ-মতভিন্নতা তা বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। কিছু বিবাদ-বিসংবাদ এমন হয় যেখানে দুটো মতই সঠিক। দুটো মতের পক্ষেই শরীয়তের দলিল রয়েছে। যেরকম আমাদের আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের মাঝে বিভিন্ন বিষয়ে মতভিন্নতা রয়েছে। দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের একাধিক মত সামনে এসেছে। এ জাতীয় ক্ষেত্রে যেহেতু উভয় মতের পক্ষে কুরআন ও সুন্নাহর দলিল রয়েছে সেহেতু উম্মাহর সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত যে, তাদের দলিলসম্মত সিদ্ধান্তগুলো সবগুলোই সহীহ। তো এ জাতীয় বিষয় নিয়ে যদি বিবাদ-বিসংবাদ তৈরি হয় তাহলে তা কুরআন ও সুন্নাহর সামনে পেশ করা হলে কুরআন-সুন্নাহর মাহির ব্যক্তিবর্গ বলে দিবেন, এখানে উভয় মত সঠিক। এখানে এক পক্ষ অপর পক্ষের মতকে সম্পূর্ণ বাতিল করে দেওয়ার সুযোগ নেই। সুতরাং একে অপরের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হও এবং যার জন্য যে মত অনুসরণ উপযোগী হয় সে সেই মতের অনুসরণ কর। ফলে এখানে একাধিক মত থাকবে, কিন্তু বিবাদ-বিসংবাদ থাকবে না।
আর কিছু মতভেদ এমন আছে যেখানে একটা সহীহ, অপরটা গলত। এক সিদ্ধান্ত ঠিক, আরেক সিদ্ধান্ত ভুল। এরকম মতভেদ যদি হয় এবং এর ভিত্তিতে বিবাদ-বিসংবাদ হয়, তাহলে এই মতভেদ কুরআন ও সুন্নাহর উপর ন্যস্ত হলে কুরআন-সুন্নাহর মাহির ব্যক্তিগণ বলে দিবেন যে, এই অবস্থানটা সহীহ, এই অবস্থানটা গলত। সুতরাং যারা ভুল অবস্থানে রয়েছ তাদের কর্তব্য, সেই অবস্থান ছেড়ে দেওয়া এবং সঠিক অবস্থানের দিকে ফিরে আসা। এক্ষেত্রে মুমিনের কর্তব্য হবে সেই ভুল মতকে বর্জন করা এবং সেই ভুল মতের পক্ষে প্রচার-প্রচারণা, সহায়তা-সমর্থন সবকিছু বর্জন করা। এই বর্জনের মধ্য দিয়ে সেই ভুল মতটা সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়বে এবং বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কুরআন মাজীদ তো সহযোগিতা-সমর্থনের মূলনীতিও পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে-
وَ تَعَاوَنُوْا عَلَی الْبِرِّ وَ التَّقْوٰی وَ لَا تَعَاوَنُوْا عَلَی الْاِثْمِ وَ الْعُدْوَانِ
সৎকর্ম ও খোদাভীতিতে তোমরা পরস্পরকে সাহায্য কর; পাপ ও সীমালংঘনে একে অন্যের সাহায্য করবে না। -সূরা মায়েদা (৫) : ০২
ভুল মতের পক্ষে যদি সহযোগিতা-সমর্থন অব্যাহত রাখা হয় তাহলে সেটা তো গুনাহ ও সীমালঙ্ঘনে পরস্পর সহযোগিতার মধ্যে পড়ে যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, গুনাহ ও সীমালঙ্ঘনের ক্ষেত্রে মানুষ একে অপরের সহযোগিতা কেন করে? নানা কারণে করে। নিজের বংশ ও পরিবার বলে করে। নিজের দল ও গোষ্ঠী বলে করে। এই সব কারণে অন্যায়ে সহযোগিতাকে হাদীস শরীফে ‘আসাবিয়্যাহ’ বলা হয়েছে, যা ইসলামী জীবনের নয়, জাহেলী জীবনের বৈশিষ্ট্য।
হাদীস শরীফে আছে, এক ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আসাবিয়্যাহ’ কী? তিনি বললেন,
নিজের কওমকে জুলুমে সহযোগিতা করা। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫১১৯
তো সমর্থন-সহযোগিতার মূল মানদণ্ড হতে হবে নেক কাজ ও দ্বীনের আদেশ-নিষেধের মান্যতা। দ্বীনের কোনো ভুল ব্যাখ্যা ও ভুল কর্মপন্থার ব্যাপারে কারো সমর্থন-সহযোগিতার সুযোগ নেই। সে আমার বংশের হলেও, পরিবারের হলেও, আমার দলের হলেও, সম্প্রদায়ের হলেও।
কুরআন-সুন্নাহ কিন্তু আমাদেরকে আমাদের কর্মনীতি পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে। এখন আমাদের কর্তব্য, বাস্তব ও প্রায়োগিক জীবনে সেই নীতিকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করা এবং অনুসরণ করা। এটা আমাদের দুনিয়ার জন্যও ভালো, আখেরাতের জন্যও ভালো।
বাস্তব ক্ষেত্রে কুরআন-সুন্নাহর সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে কুরআন-সুন্নাহর মাহির হক্কানী রব্বানী উলামায়ে কেরামের কাছে। তাঁরাই দ্বীন ও শরীয়তের বিশেষজ্ঞ। কাজেই বিবাদ-বিসংবাদের ক্ষেত্রে তাদের মাধ্যমে দ্বীন ও শরীয়তের বিধান জেনে সেই মোতাবেক আমল করতে হবে।
এই ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কারো কারো তরফ থেকে যে প্রশ্ন আসতে পারে তা হচ্ছে, আমরা তো এদিকেও আলিম পাচ্ছি, ওদিকেও আলিম পাচ্ছি। তাহলে কীভাবে বুঝব যে, কোনটা সহীহ, কোনটা গলত। আসলে এই প্রশ্নগুলো যখন মনে বা মুখে আসে ঐ সময় নিজের মুহাসাবা করা দরকার। নিজেকেই জিজ্ঞাসা করা দরকার যে, আসলেই কি এই কারণে বিষয়টা আমার সামনে অস্পষ্ট, না আমি এটাকে আমার মনমতে চলার জন্য বাহানা হিসেবে গ্রহণ করছি। নিজেকে জিজ্ঞাসা করলে জবাব পাওয়া যাবে। এখানে বুঝতে হবে যে, সত্য ও ন্যায়কে সঠিকভাবে পাওয়া আমার নিজের প্রয়োজন। আমাকে নিজের কাছে ও আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে পরিষ্কার থাকতে হবে। এই চেতনা নিয়ে কেউ যদি চিন্তা-ভাবনা করে তাহলে হয়ত সঠিক রূপটা সামনে এসে যাবে, অন্তত সত্যকে বোঝার সঠিক অন্বেষা সৃষ্টি হবে।
কোনো আলিমের কোনো সিদ্ধান্ত যখন ভুল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়, জুমহুর উলামা ঐ সিদ্ধান্তকে ভুল হিসেবে চিহ্নিত করেন তখন তার অনুসরণের কোনো সুযোগ থাকে না। এই অবস্থায় ওই মতের অনুগামী হওয়া উচিত নয়। সেটাকে সহায়তা ও সমর্থনের মাধ্যমে উজ্জীবিত করা উচিত নয়। আমাদের আলিমগণ এ বিষয়ে বারবার সতর্ক করেছেন। হাদীস শরীফেও এ বিষয়ে মৌলিক নির্দেশনা আছে।
হাদীস ও সুন্নাহর মাহির সাহাবা-তাবেয়ীন, আমাদের সালাফ এ বিষয়টি খুব পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। হযরত ওমর ফারুক রা. বলেছেন, তিনটি বিষয় মানুষকে গোমরাহ করে। অর্থাৎ যে সকল কারণে মানুষ বিচ্যুত হয় তার মধ্যে তিনটা কারণ গুরুত্বপূর্ণ। এক. الأئمة المضلون ঐসকল নেতৃবৃন্দ, যারা মানুষকে ভুল পথে নিয়ে যায়। সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিচালনায় যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত তারা যদি ভুল পথে চলে, দ্বীন-শরীয়াহ বিরোধী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাহলে মানুষ তাদের অনুসরণ করে ভুল পথে চলতে থাকবে। মানুষের বিভ্রান্তির, ভুল পথে যাওয়ার এক বড় কারণ এটা।
দুই. جدال المنافق بالكتاب মুনাফিকের কুরআন নিয়ে বিতর্ক। হয়ত একেবারেই খালিছ মুনাফিক, ইসলামের বেশ ধারণ করেছে অথবা মুসলিম, কিন্তু কাজকর্ম ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক নয়, কর্মগত দিক থেকে মুনাফিকের কাতারে, এ ধরনের মানুষ যখন কুরআন নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করে তখন এদের অপযুক্তিতেও মানুষ বিভ্রান্ত হয়।
আমাদের সমাজেও আছে এরকম। কুরআন গবেষণার নামে নানা বিভ্রান্তি, নানা ভুল সিদ্ধান্তের প্রচার। মানুষ সেগুলোকে কুরআনের সিদ্ধান্ত মনে করে অনুসরণ করে। বিভ্রান্ত হয়। এরকম এক চক্রের সংবাদ জানি। ওরা ‘গবেষণা’ করে এক সিদ্ধান্ত দিল যে, কুরআন মাজীদ অর্থ বুঝে পড়া ওয়াজিব। অর্থ না বুঝে পড়া গোনাহের কাজ। নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক। এক তো হল অর্থ বোঝার কাম্যতা। কুরআন মাজীদের অর্থ বোঝার জন্য উৎসাহিত করুন। অন্যের তরজমা পড়ে পড়ে কুরআন বোঝা কেন? সরাসরি আরবী ভাষা শিখুন, আলিম হোন; তাহলে কুরআন বুঝে পড়া সহজ হবে। এটা পারছেন না, তরজমা ও নির্ভরযোগ্য তাফসীরের মাধ্যমে অর্থ বোঝার চেষ্টা করছেন, ভালো। কিন্তু এটাকে যদি মাসআলা বানিয়ে দেওয়া হয় এবং বলা হয় যে, কুরআন মাজীদ অর্থ বুঝে পড়া ফরয, ওয়াজিব, অর্থ না বুঝে পড়া গোনাহ তাহলে তো কুরআন তিলাওয়াতের একটি স্বীকৃত প্রকারকেই গোনাহের কাজ সাব্যস্ত করে দিলেন। শরীয়ত যেটাকে বলছে সওয়াবের কাজ আপনি বলে দিলেন গোনাহের কাজ। নাউযুবিল্লাহ। শরীয়তের বিকৃতি হয়ে গেল।
কিছুদিন পর আরেক সিদ্ধান্ত এল যে, কুরআন মজীদ অজু ছাড়া স্পর্শ করা জায়েয। নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক। এ ধরনের আরো বিভিন্ন সিদ্ধান্ত, এগুলো আসছে কুরআন গবেষণার নামে। বলাবাহুল্য যে, এগুলোর দ্বারাও মানুষ বিভ্রান্ত হয়। এগুলোকে কুরআনের কথা মনে করে। আধুনিক সিদ্ধান্ত মনে করে। মনে করে যে, আমাদের পুরান হুযুররা তো এগুলো বলেননি। এখন নতুন নতুন ‘আধুনিক’ সিদ্ধান্ত পাচ্ছি। অথচ এগুলো হচ্ছে বিদআতী মাসআলা। শরীয়তের মাসআলা হচ্ছে, অর্থ না বুঝে কুরআন পড়লেও সওয়াব আছে। বাস্তব অভিজ্ঞতাতেও দেখেছি যে, অর্থ না বুঝে কুরআন পড়লেও তিলাওয়াতকারীর মন নরম হয়, ঈমান-আমলে উন্নতি হয়। কিন্তু এখন এই ‘আধুনিক’ সিদ্ধান্ত মনে করছে যে, অর্থ না বুঝে কুরআন পড়া না-জায়েয। এই ভুল কথাগুলো আসছে কুরআন গবেষণার নামে। নাউযুবিল্লাহ।
তৃতীয় বিষয়, যার কারণে মানুষ বিভ্রান্ত হয় زلة عالم - কোনো আলিমের পদস্খলন। যেহেতু আলিম অনুসরণীয়, তাই যখন আলিমের সিদ্ধান্ত ভুল হয়, আলিমই ভুল কথা বলে, ভুল কথা প্রচার করে, তাহলে যারা সরাসরি দলিল-প্রমাণের বিশ্লেষণের যোগ্যতা রাখে না তাদের অনেকের জন্য এটা বিভ্রান্তির কারণ হয়। শরীয়তের অনেক নসে আলিমের অনুসরণ করার কথা আছে। সাথে সাথে এ কথাও বলে দেওয়া হয়েছে যে, আলিমের যে সিদ্ধান্ত কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী হবে সেই সিদ্ধান্ত মানা যাবে না। সেটা তার পদস্খলন হিসেবে চিিহ্নত হবে।
এখন কোনটা ভুল সিদ্ধান্ত, কোনটা সঠিক সিদ্ধান্ত, এই সিদ্ধান্ত কে দিবে? এই সিদ্ধান্তও উলামায়ে কেরামই দিবেন। একজন সাধারণ মানুষের কাছে একটা কথা ভুল মনে হল, শুধু তার মনে হওয়ার দ্বারাই সেটা ভুল সাব্যস্ত হবে না। তার কাছে ঠিক মনে হল, শুধু তার কাছে ঠিক মনে হওয়ার দ্বারাও কথাটা ঠিক সাব্যস্ত হবে না। এটা সাব্যস্ত হবে যারা শরীয়তের মাহির শরীয়তের বিশেষজ্ঞ, তাদের সিদ্ধান্তের দ্বারা। তারা যখন বলবেন, এই কথাটা ভুল আমাকে বিশ্বাস করতে হবে, এই কথাটা ভুল। তারা যখন বলবেন, এই সিদ্ধান্তটা সঠিক আমাকে বিশ্বাস করতে হবে, এই সিদ্ধান্তটা সহীহ। যেরকম আলিমের অনুসরণের কথা আছে তেমনিভাবে এটাও বলা হয়েছে যে, কারো কোনো সিদ্ধান্ত যদি ভুল প্রমাণিত হয় তাহলে সেই সিদ্ধান্ত মানা যাবে না।
দেখুন, এভাবেই কিন্তু ইসলামী শরীয়ত আমাদেরকে সীমার ভেতরে রাখছে। আমাদেরকে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় রাখছে। আমাদের কর্তব্য, কুরআন ও সুন্নাহকে অনুসরণ করা। উলামায়ে কেরামের অনুসরণ তো আমরা এজন্যই করি যে, এটা কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণের নিরাপদ ও স্বাভাবিক পন্থা। আমরা ব্যক্তির মত হিসেবে অনুসরণ করি না। ব্যক্তির ভুলও হতে পারে। যদি তার সিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণিত হয় তাহলে সেই সিদ্ধান্ত বর্জন করতে হবে, সেই সিদ্ধান্ত অনুসরণ করার সুযোগ নেই।
দেখুন, কখনো কখনো ব্যক্তির ব্যাখ্যা ও ভাষ্য এমনভাবে উপস্থাপিত হয় যেন সেটা সরাসরি কুরআন-সুন্নাহ, অথচ সেটা সরাসরি কুরআন-সুন্নাহ নয়, ব্যক্তির ভাষ্য ও ব্যাখ্যা। সেই ভাষ্য সঠিক হতে পারে, কিন্তু ভাষ্য তো ভাষ্যই, সেটা তো সরাসরি কুরআন-সুন্নাহ নয়।
ছোট ছোট কিছু উদাহরণ দেই। আরবের একজন আলিম সায়্যিদ সাবিক রাহ.। তার একটা কিতাব আছে। কিতাবের নাম ‘ফিকহুস সুন্নাহ’। সুন্নাহর ফিকহ। আমরা শুনেছি ফিকহু আবী হানিফা, ফিকহু মালিক, ফিকহুশ শাফেয়ী, ফিকহু আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ.। আবূ হানিফার ফিকাহ, মানে যে ফিকহ আবূ হানিফা রাহ.-এর নেতৃত্বে সংকলিত হয়েছে। ইমাম মালিক রহ. এর ফিকাহ, অর্থাৎ যে ফিকহ ইমাম মালিক রাহ.-এর নেতৃত্বে সংকলিত হয়েছে। এরকম আমরা জানি। কিন্তু এই কিতাবের শিরোনাম হল, ফিকহুস সুন্নাহ। সুন্নাহর ফিকহ। এর মানে কী? এর অর্থ যেন এই যে, আমার ফিকাহটা সুন্নাহর ফিকহ, আর অন্য ফিকাহ যেগুলো আছে সেগুলো উম্মতের ফিকাহ। পরবর্তী লোকদের ফিকাহ। তো তুমি কোনটা মানবে? সুন্নাহর ফিকাহ মানবে, নাকি আবু হানিফার ফিকাহ মানবে? এরকম প্রশ্ন যদি আসে তাহলে মানুষ তো একথাই বলবে যে, আমি সুন্নাহর ফিকাহ মানব। হাদীস ও সুন্নাহরই অনুসরণ করব। কিন্তু যদি একটু চিন্তা করা হয়, তাহলে বুঝে আসবে যে, এখানে উপস্থাপনার ভুল আছে। একে যদিও নাম দেওয়া হয়েছে ফিকহুস সুন্নাহ, সুন্নাহর ফিকাহ- আসলে এটা ‘ফিকহুস সায়্যিদ সাবিক’ সায়্যিদ সাবিকের ফিকহ। বর্তমান সময়ের একজন আলিম সায়্যিদ সাবিকের ফিকাহ। আর ওটা হল আগের যুগের, তাবেয়ী যুগের স্বীকৃত ইমাম ও মুজতাহিদ ইমাম আবূ হানিফা রাহ.-এর ফিকহ। অথচ শুধু নামের ভুল দাবির কারণে মানুষ মনে করে, এটা সরাসরি সুন্নাহ, আর ওটা ব্যক্তির রায়, ব্যক্তির মত। আসলে উভয় ফিকাহ’র ভিত্তি হল সুন্নাহ। ইমাম আবু হানিফা রাহ. যেই ফিকাহ সংকলন করেছেন তার সূত্র কী? সূত্র হল সুন্নাহ। সুন্নাহ থেকেই তিনি ফিকহ আহরণ করেছেন। সুন্নাহর বিধি-বিধানকে এবং সুন্নাহ থেকে আহরিত বিধি-বিধানকে সংকলন করেছেন। ভাষ্য ও সংকলনটা তার। সূত্র হচ্ছে সুন্নাহ। তেমনি সায়্যিদ সাবিক যেই ফিকহ উপস্থাপন করেছেন, এখানেও সূত্র হল সুন্নাহ। কিন্ত তা থেকে ফিকহ আহরণকারী ও সংকলনকারী হলেন সায়্যিদ সাবিক।
এখন যদি ইনসাফের সাথে কথা বলেন, তাহলে সূত্র উল্লেখ করলে দুই জায়গাতেই সূত্র উল্লেখ করুন। এটাও ফিকহুস সুন্নাহ, ওটাও ফিকহুস সুন্নাহ। এটাও সুন্নাহ থেকে আহরিত ফিকহ, ওটাও সুন্নাহ থেকে আহরিত ফিকহ। আর যদি সংকলক ও আহরণকারীর কথা উল্লেখ করেন তাহলে উভয় জায়গায় উল্লেখ করুন। এটা আবু হানিফার ফিকহ, অর্থাৎ সুন্নাহ থেকে আবু হানিফার আহরণ ও সংকলন। আর এটা সায়্যিদ সাবিক-এর ফিকহ। সুন্নাহ থেকে সায়্যিদ সাবিকের আহরণ ও সংকলন। এখন জিজ্ঞাসা করুন; কোনটা মানবেন? পরিষ্কার প্রশ্ন করলে যে কোনো চিন্তাশীল মানুষ বলবেন, সায়্যিদ সাবিক হলেন বর্তমান সময়ের একজন আলিম, তার ফিকহ মানার চেয়ে তাবেয়ী যুগের গোটা উম্মতের সর্বস্বীকৃত মুজতাহিদ ইমাম, ইমাম আবু হানিফা রাহ. যে ফিকহ আহরণ করেছেন সেটা মানাই উত্তম। তিনি সুন্নাহকে যেভাবে বুঝেছেন তার বুঝটাই অনুসরণ করা উচিত। সেটাই হাদীস ও সুন্নাহর অধিকতর নিকটবর্তী হবে। আর সেটা তো যুগ যুগ ধরে পরীক্ষিত, নিরীক্ষিত। সুতরাং সেখানে ভুলের সম্ভাবনা কম। ভুলত্রæটি যদি থেকেও থাকে সেগুলো চিহ্নিত হয়ে গিয়েছে। পরিত্যক্ত হয়ে গিয়েছে। একই কথা ফিকহের অন্যান্য ইমামদের ক্ষেত্রেও। তো কখনো কখনো শুধু দাবির কারণে ভাষ্যকেই মূল মনে করা হয় এবং বড় ধরনের বিচ্যুতি সৃষ্টি হয়।
এখন মনে করুন, কোনো একজন আলিম যদি বলেন যে, আমি সীরাত মোতাবেক চলি, সীরাত মোতাবেক চালাই। আর অন্যরা নিজেদের অভিজ্ঞতা মোতাবেক চলেছে ও চালিয়েছে। ‘তাজরিবা’র ভিত্তিতে চলেছে ও চালিয়েছে। যদি কেউ এটা বলেন, তাহলে সাধারণ শ্রোতা তো বলবে, তাই তো! আমরা কারো অভিজ্ঞতার কেন অনুসরণ করব? আমরা তো সীরাতকেই অনুসরণ করব। কিন্তু এখানেও সেই দাবির ভুল। আমি সীরাত থেকে যা বুঝেছি সেটিই সীরাত, নাকি সেটা আমার বুঝ, আমার ভাষ্য ও ব্যাখ্যা? আমার পূর্বের উলামায়ে কেরাম যেভাবে চলেছেন, চালিয়েছেন বিনা দলিলে সেটাকে নিছক তাজরেবা বা অভিজ্ঞতা বলে দেওয়া অন্যায়। তাহলে বিষয়টা এই দাঁড়িয়েছে যে, আমি যা বলেছি তা হচ্ছে সীরাত ও সুন্নাহয় আমার ভাষ্য, আমার উপলব্ধি। আর ওটা হচ্ছে আমার চেয়ে প্রবীণ ও অভিজ্ঞ দশজন, বিশজন মানুষের ভাষ্য, সুন্নাহ ও সীরাতের উপলব্ধি। এখন কোনটা অনুসরণের বেশি উপযোগী? এক দুই ব্যক্তি যেটাকে সীরাত মনে করছেন সেটা অনুসরণের বেশি উপযোগী নাকি দশজন যেটাকে সীরাত মনে করছেন সেটা অনুসরণের বেশি উপযোগী? কথা যদি ইনসাফের সাথে বলতে হয় তাহলে তো এভাবেই বলতে হবে। আমি এটাকে সীরাত মনে করছি, আর ইতিপূর্বের লোকেরা ওটাকে সীরাত মনে করেছেন। তো আপনারা কি আমার সীরাতের বুঝ অনুসরণ করবেন, না দশজনের সীরাতের বুঝ অনুসরণ করবেন? এভাবে যদি সামনে আসে তাহলে যে কোনো চিন্তাশীল ব্যক্তিই বলবেন, আমি তো একজনের বুঝকে অনুসরণ করব না, আমি দশজনের বুঝকে অনসরণ করব। কারণ, একজনের ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। দশজনের ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম। কাজেই দশজন যেটা বুঝেছেন আমি সেটাকে অনুসরণ করব। একজন যেটা বুঝেছেন আমি সেটাকে অনুসরণ করব না। বিশেষ করে যেখানে একজনের বুঝ আর দশজনের বুঝের মাঝে সংঘর্ষ হয় সেখানে একজনের বুঝকে অবশ্যই বর্জন করতে হবে। দশজনের বুঝকেই গ্রহণ করতে হবে। এরপর যখন শরীয়তের দলিল-প্রমাণের মাহির ব্যক্তিগণ দশজনের বুঝকে সঠিক বলেন তখন তো অস্পষ্টতার কোনোই অজুহাত থাকে না।
ইসলাম আমাদের শেখায় যে, মানুষের ভুল হতে পারে। কিন্তু শুধু এইটুকুই তো শেখায় না, ইসলাম আরো শেখায় যে, সেই ভুলের উপর অটল থাকা যাবে না। সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। এটা যদি করি তাহলে ইসলামের ক্ষতি করব, মুসলমানদের ক্ষতি করব।
একজন বড় ইমাম ছিলেন ইমাম আবুল হুসাইন আল-কারাবীসী রাহ.। তিনি তার এক কিতাবে বিভিন্ন বিষয়ে পূর্বের যুগের লোকদের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত উল্লেখ করেছেন। উল্লেখ করার পর বলেছেন যে, এই সিদ্ধান্তগুলো ভুল। এসকল সিদ্ধান্ত অনুসরণ করা যাবে না। এরপর তিনি বলছেন, কেউ যদি প্রশ্ন করেন, هؤلاء من أهل العلم যাদের মত এখানে উল্লেখ করা হয়েছে তারাও তো আলিম। সুতরাং তাদের মত অনুসরণ করা উচিত। তিনি বলেন, তাহলে জবাবে বলব-
إنما يهدم الإسلام زلة عالم ولا يهدمه زلة ألف جاهل.
‘একজন আলিমের ভুল ইসলামকে ধ্বংস করে, এক হাজার জাহেলের ভুল ইসলামকে ধ্বংস করে না।’ (তবাকাতুশ শাফিইয়্যাতিল কুবরা ২/১২৫) এই কথাটার উপরে আরবের বিখ্যাত মনীষী শায়খ মুহাম্মদ আওয়ামাহ হাফিযাহুল্লাহু তাআলা একটি টীকা লিখেছেন । তিনি যে ‘ইসলামকে ধ্বংস করে’ বলছেন, একজন আলিমের ভুল ইসলামের ক্ষতি করে কখন? ইসলামের ক্ষতি করে তখন যখন সেই ভুলটার পক্ষপাতিত্ব করা হয়, সেটাকে সমর্থন করা হয়, সেই ভুলকে সমর্থন করে সেটাকে শক্তিশালী করে ফেলা হয়। তখন এটার দ্বারা ইসলামের ক্ষতি হয়, মুসলমানদের ক্ষতি হয়, ফেরকা তৈরি হয়। কিন্তু সে ভুলের সমর্থন না করা হলে অথবা ভুলকে ভুল হিসেবে চিহ্নিত করে দাফন করে দিলে এই ভুল দ্বারা ইসলামের ক্ষতি হয় না, মুসলমানের ক্ষতি হয় না।
কাজেই ইসলামের প্রতি এবং সত্যের প্রতি আমাদের ওয়াফাদারি এই যে, মানুষের ভুল হতে পারে, মানুষের স্বভাবও বিভিন্ন রকম, ভুল থেকে ফিরে আসা সবার পক্ষে সহজ হয় না, অনেকের তো বিষয়টা দ্রæত বুঝেও আসে না, কিন্তু অন্য যারা দায়িত্বশীল ও বুদ্ধিমান মানুষ, যারা আহলে ইলম, যাদের কাছে নিজের মূল্য আছে, নিজের দ্বীনদারির মূল্য আছে এবং ইসলামের মূল্য আছে, ইলমের মূল্য আছে তাদের কর্তব্য, ঐসকল ভুলের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়া। তাহলে ধীরে ধীরে ভুলটা দুর্বল হয়ে যাবে এবং বিলুপ্ত হয়ে যাবে। যিনি ভুল করেছেন তার জন্যও সঠিক পথে ফিরে আসাটা সহজ হবে। কিন্তু ভুলের পক্ষে সমর্থন অব্যাহত থাকলে যেমন ভুল সম্পর্কে ধোঁয়াশা তৈরি হবে তেমনই যিনি ভুল করেছেন তারও সমর্থক-সাপোর্টার থাকার কারণে ভুল থেকে ফিরে আসাটা কঠিন হবে। এটা তার প্রতিও কল্যাণকামিতা নয়, ওয়াফাদারি নয়, দ্বীনের প্রতিও ওয়াফাদারি নয়। তো ‘তানাযূ’-এর ক্ষেত্রে, বিবাদ-বিসংবাদের ক্ষেত্রে একটি মূলনীতি এখানে উপস্থাপন করলাম।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে আমাদের জীবনের সকল ক্ষেত্রে হক্কানী উলামা ও জুমহুর উলামা যে পথে চলেন, যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন সেই পথে চলার, সেই সিদ্ধান্তের সঙ্গে থাকার তাওফীক দান করুন। ইনশাআল্লাহ এটাই হক। ইনশাআল্লাহ এটার মাধ্যমেই আমাদের দ্বীনদারি রক্ষা পাবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে আমল করার তাওফীক দান করুন।
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين