যিলকদ ১৪৩৯   ||   আগস্ট ২০১৮

ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও পরার্থপরতা : কিছু উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

আহমাদুল্লাহ বিন রুহুল আমীন

ইসলামী ভ্রাতৃত্বের মানদ- ঈমান। তাই একজন মুমিন অপর মুমিনের প্রতি সম্প্রীতি-ভালবাসা, সহানুভূতি ও সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করবে, তা সে যে দেশের হোক, যে ভাষারই হোক। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে-

اِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ اِخْوَةٌ فَاَصْلِحُوْا بَیْنَ اَخَوَیْكُمْ.

মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং  তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মাঝে মীমাংসা করে দাও। -সূরা হুজুরাত (৪৯) : ১০

আরেক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

وَ الْمُؤْمِنُوْنَ وَ الْمُؤْمِنٰتُ بَعْضُهُمْ اَوْلِیَآءُ بَعْضٍ.

মুমিন নর ও মুমিন নারী সকলেই একে অন্যের বন্ধু। -সূরা তাওবা (৯) : ৭১

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

مَثَلُ الْمُؤْمِنِينَ فِي تَوَادِّهِمْ، وَتَرَاحُمِهِمْ، وَتَعَاطُفِهِمْ مَثَلُ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى مِنْهُ عُضْوٌ تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ الْجَسَدِ بِالسّهَرِ وَالْحُمّى.

সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও সহানুভূতির ক্ষেত্রে মুমিনদের দৃষ্টান্ত এক দেহের ন্যায়, যার একটি অঙ্গ অসুস্থ হলে গোটা দেহ জ¦র ও অনিদ্রায় আক্রান্ত হয়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০১১; সহীহ মুসলিম, হদীস ২৫৮৬

অন্য হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-

الْمُؤْمِنُ مِرْآةُ الْمُؤْمِنِ، وَالْمُؤْمِنُ أَخُو الْمُؤْمِنِ، يَكُفّ عَلَيْهِ ضَيْعَتَهُ، وَيَحُوطُهُ مِنْ وَرَائِهِ.

মুমিন মুমিনের জন্য আয়না। মুমিন মুমিনের ভাই। সে তার জমি সংরক্ষণ করে এবং তার অনুপস্থিতিতে তাকে হেফাযত করে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯১৮

এই সম্প্রীতি ও সহযোগিতার নির্দেশ তাকওয়া ও কল্যাণের পথে, ন্যায় ও বৈধ কাজে। কুরআনে কারীমের ইরশাদ-

وَ تَعَاوَنُوْا عَلَی الْبِرِّ وَ التَّقْوٰی  وَ لَا تَعَاوَنُوْا عَلَی الْاِثْمِ وَ الْعُدْوَان.

তোমরা তাকওয়া ও ন্যায় কাজে পরস্পরে সহযোগিতা করো। পাপাচার ও অন্যায় কাজে সহযোগিতা করো না। -সূরা মায়েদা (৬) : ০২

ন্যায় ও কল্যাণের বিষয়ে নিজ কওমকে সাহায্য করা অন্যায় সম্প্রদায়প্রীতি নয়। জুলুম ও অন্যায় কাজে কওমকে সহযোগিতা করাই হচ্ছে নিষিদ্ধ সাম্প্রদায়িকতা। একবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হল, ‘আসাবিয়াত’ (তথা সাম্প্রদায়িকতা) কী? তিনি জবাব দিলেন, নিজ কওমকে তার অন্যায় অবিচারে সাহায্য করা। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫১১৯

সুতরাং অন্যায়ের ক্ষেত্রে পক্ষপাতই হল সাম্প্রদায়িকতা, যা ইসলামে কঠিনভাবে নিষিদ্ধ। ইরশাদ হয়েছে-

لَيْسَ مِنّا مَنْ دَعَا إِلَى عَصَبِيّةٍ، وَلَيْسَ مِنّا مَنْ قَاتَلَ عَلَى عَصَبِيّةٍ، وَلَيْسَ مِنّا مَنْ مَاتَ عَلَى عَصَبِيّةٍ.

যে ব্যক্তি আসাবিয়াতের দিকে ডাকে বা আসাবিয়াতের কারণে লড়াই-যুদ্ধ করে বা আসাবিয়াতের উপর মৃত্যুবরণ করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫১২১

অতএব ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা হল, তাকওয়া ও কল্যাণের কাজে মুসলমানগণ পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। নিজেদের মাঝে প্রীতি ও সৌহার্দ্য বজায় রাখবে এবং অন্যায়ের পক্ষাবলম্বন ও সহযোগিতা থেকে বিরত থাকবে।

এখানে ইসলামের সীমাহীন সৌন্দর্য এই যে, ইসলাম প্রীতি-সৌহার্দ্যরে চূড়ান্ত স্তরের প্রতিও মুসলমানদেরকে উদ্বুদ্ধ করে। ঈমানী ভাইয়ের জন্য আপন স্বার্থ বিসর্জনেরও উৎসাহ দেয়।

ইসলামের সূচনালগ্নে মক্কার মুসলিমগণ এক কঠিন পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন। আপন গোত্রের অবিচার ও নিপীড়ন তাদেরকে স্বদেশত্যাগে বাধ্য করেছিল। তখন মদীনার মুসলমানগণ সহযোগিতা ও সহানুভূতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। তারা নিজেদের প্রয়োজন ও দারিদ্র্য সত্ত্বেও সহায়-সম্বলহারা মুহাজির মুসলমান ভাইদের জন্য ধন সম্পদ ও আপন স্বার্থ ত্যাগ করেছিলেন।

তাদের পরার্থপরতার এ গুণটি পছন্দ করে আল্লাহ পাক কুরআনে কারীমে ইরশাদ করেছেন-

وَ یُؤْثِرُوْنَ عَلٰۤی اَنْفُسِهِمْ وَ لَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ ۫ؕ .

তারা (আনসারেরা) নিজেদের উপর (মুহাজিরদের) প্রাধান্য দেয়। যদিও নিজেদের প্রয়োজন ও অভাব থাকে। -সূরা হাশর (৫৯) : ০৯

সূরাতুদ দাহরে আল্লাহ পাক জান্নাতের বিশেষ কিছু নিআমত উল্লেখ পূর্বক এসকল নেআমতের অধিকারীগণের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেছেন-

وَ یُطْعِمُوْنَ الطَّعَامَ عَلٰی حُبِّهٖ مِسْكِیْنًا وَّ یَتِیْمًا وَّ اَسِیْرًا اِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللهِ لَا نُرِیْدُ مِنْكُمْ جَزَآءً وَّ لَا شُكُوْرًا .

(তারাই এসকল নিআমত লাভ করবে যারা...) এবং যারা মিসকীন, এতীম ও বন্দিদেরকে খাবার দান করে তার প্রতি (নিজেদের) আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও। (আর বলে) আমরা তো তোমাদেরকে খাওয়াই কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। তোমাদের থেকে আমরা কোনো প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতা কামনা করি না। -সূরা দাহর (৭৬) : ৮-৯

অন্য এক আয়াতে সৎকর্ম ও পুণ্যের বর্ণনা দেয়া হয়েছে এভাবে-

وَ لٰكِنَّ الْبِرَّ مَنْ اٰمَنَ بِاللهِ وَ الْیَوْمِ الْاٰخِرِ وَ الْمَلٰٓىِٕكَةِ وَ الْكِتٰبِ وَ النَّبِیّٖنَ  وَ اٰتَی الْمَالَ عَلٰی حُبِّهٖ ذَوِی الْقُرْبٰی وَ الْیَتٰمٰی وَ الْمَسٰكِیْنَ وَ ابْنَ السَّبِیْلِ  وَ السَّآىِٕلِیْنَ وَ فِی الرِّقَابِ.

বরং পুণ্য তো হল, মানুষ ঈমান রাখবে আল্লাহ, শেষ দিন, ফেরেশতা, (আল্লাহর) কিতাব আর নবীগণের প্রতি এবং (নিজ) সম্পদের প্রতি ভালবাসা থাকা সত্ত্বেও তা দান করবে আত্মীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন মুসাফির ও সওয়ালকারীদেরকে এবং দাসমুক্তিতে। -সূরা বাকারা (২) : ১৭৭

নিজের প্রয়োজন সত্ত্বেও নিঃস্বার্থভাবে অপর ভাইকে নিজের উপর প্রাধান্যদানের বিষয়ে ইসলামের এই সুমহান আদর্শ সহজে হৃদয়ঙ্গম করার জন্য এখানে সাহাবায়ে কেরামের আলোকিত জীবনচরিত থেকে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা হচ্ছে, যাতে ফুটে উঠেছে এ-শিক্ষাটির বাস্তব ও সমুজ্জল চিত্র। শুরুতেই স্বয়ং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কর্মপন্থা ও পবিত্র সীরাত থেকে তাঁর একটি ঘটনা লক্ষ করুন।

হযরত সাহল বিন সাদ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একজন নারী সাহাবী নবীজীর জন্য সুন্দর কারুকার্য করা একটি নতুন কাপড় হাদিয়া এনে আরয করলেন, আমি এটি স্বহস্তে তৈরি করেছি। আপনি তা পরিধান করলে খুশী হব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাপড়টি গ্রহণ করলেন। তাঁর কাপড়ের প্রয়োজনও ছিল। যখন তিনি তা লুঙ্গি হিসাবে পরিধান করে ঘরের বাইরে আসলেন, এক ব্যক্তি বলল, খুব চমৎকার কাপড় তো! আমাকে তা দান করবেন কি? তখন নবীজী ঘরে ফিরে গিয়ে তা খুলে ভাঁজ করে লোকটির জন্য পাঠিয়ে দিলেন। এ দৃশ্য দেখে অন্যান্য সাহাবী ঐ ব্যক্তিকে তিরস্কার করে বলতে লাগলেন, আরে মিয়া! তুমি কি জানো না, কাপড়টি নবীজীর প্রয়োজন রয়েছে।  আর তিনি কোনো কিছু চাইলে  ‘না’ বলেন না। সে  জবাবে বলল, আমি সবই জানি, এরপরও চেয়েছি, যাতে তাঁর মুবারক শরীর-স্পর্শে ধন্য কাপড় দিয়ে আমি নিজের কাফন বানাতে পারি। বর্ণনাকারী সাহাবী বলেন, ঐ ব্যক্তির মৃত্যুর পর সেই কাপড়েই তাকে দাফন করা হয়েছিল। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১২৭৭, ২০৯৩, ৫৮১০, ৬০৩৬

এটা তো নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নূরানী জীবনের একটি ঘটনামাত্র। তাঁর পবিত্র সীরাত অধ্যয়ন করলে এ চিত্র খুব স্পষ্টভাবেই ফুটে ওঠে যে, জান-মালের পুরাটাই তিনি দ্বীন-ইসলামের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। তিনি কখনোই আপন স্বার্থ বা নিজের সুখ-শান্তির কথা ভাবেননি। সর্বদাই তাঁর চিন্তা ছিল উম্মতকে নিয়ে। তাদের প্রয়োজন ও কল্যাণ নিয়ে। তাঁর কাছে কোনো সম্পদ এলেই তিনি তা অভাবী ও প্রয়োজনগ্রস্তদের মাঝে অকাতরে বিলিয়ে দিতেন; এক বর্ণনায় তো এসেছে, এক ব্যক্তি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটে এসে কিছু চাইল। তিনি প্রার্থনাকারীকে বললেন, এখন তো আমার কাছে দেয়ার মত কিছুই নেই, তোমার প্রয়োজন মোতাবেক তুমি আমার নামে কারো থেকে কর্জ নিয়ে নাও, আমার হাতে কিছু আসলে আমি ঐ ঋণ পরিশোধ করে দিব। এ কথা শুনে হযরত উমর রা. বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ পাক তো আপনাকে সাধ্যের বাইরে কিছু করার নির্দেশ দেননি; বরং আমিই প্রার্থনাকারীকে কিছু দিয়ে দিই। হযরম উমরের একথা নবীজীর মনঃপুত হল না। ঐ মুহূর্তে এক আনসারী সাহাবী বলে উঠলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি ইচ্ছা মত দান করতে থাকুন। মহান আরশপতির কাছে কমে যাওয়ার আশংকা করবেন না। তার এ কথায় নবীজী খুবই খুশি হলেন এবং মুচকি হাসলেন। বললেন, আমাকে এমনটিই আদেশ করা হয়েছে। -শামায়েলে তিরমিযী (৩৫৫) (শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামাহ তাহকীককৃত) মুসনাদে বাযযার (২৭৩); আলমুখতারাহ, যিয়া মাকদিসী (৮৮); মাজমাউয যাওয়ায়েদ ১০/২৪২

 

***

অন্ধকারের আলোকিত মেজবান

একজন ক্ষুধার্ত অসহায় ব্যক্তি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে তার অবস্থা জানাল। তিনি তাঁর স্ত্রীগণের নিকট লোক পাঠিয়ে ঘরে কোনো খাবার আছে কি না জানতে চাইলেন। সকলের কাছ থেকেই সংবাদ এল, ঘরে পানি ছাড়া কিছুই নেই। এরপর নবীজী সাহাবীদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের মধ্যে কে আজ এই ব্যক্তির মেহমানদারি করাতে প্রস্তুত? আনসারী সাহাবী আবু তালহা রা. দাঁড়িয়ে বললেন,  আমি। তিনি তাকে নিজ বাড়িতে নিয়ে গেলেন। স্ত্রীকে বললেন, সে  নবীজীর মেহমান, তার সমাদর করতে হবে। ঘরে কী খাবার আছে বল? স্ত্রী বললেন, বাচ্চাদের জন্য অল্প কিছু খাবার আছে। আর কিছুই নেই। তিনি বললেন, আচ্ছা, তুমি সেটুকুই মেহমানের জন্য প্রস্তুত কর। আর বাচ্চাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে ফেলো। আর শোনো, মেহমানের সামনে খাবার দেওয়ার পর বাতি ঠিক করার ছুতায় তা নিভিয়ে ফেলবে। স্ত্রী সবকিছু প্রস্তুত করলেন। মেহমানের সামনে খাবার উপস্থিত করার পর পূর্বের কথা অনুযায়ী বাতি নিভিয়ে দেয়া হল। স্বামী-স্ত্রী উভয়ে অন্ধকারের মধ্যে ভান করলেন যে, তারাও সাথে খাচ্ছেন। এভাবে তারা পুরো পরিবার উপোস থেকে মেহমানকে খুশী করার চেষ্টা করলেন। সকালে যখন আবু তালহা রা. নবীজীর দরবারে উপস্থিত হলেন, নবীজী তাকে বললেন, গত রাতে মেহমানের সাথে তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর আচরণে আল্লাহ পাক খুবই খুশি হয়েছেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৭৯৮,৪৮৮৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২০৫৪

এই ঘটনায় আমাদের জন্য অনেক শিক্ষা রয়েছে। যেমন : (ক) নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ  ব্যক্তিকে প্রথমে নিজেই মেহমানদারি করাতে চেয়েছেন। শুরুতেই তাকে অন্যের কাছে পেশ করেননি। (খ) এতে নবীজীর মুজাহাদার যিন্দেগীর চিত্রও ফুটে উঠেছে। (গ) নিজের ঘরের অবস্থা সাহাবী আবু তালহা রা.-এর অজানা থাকার কথা নয়। এরপরও তিনি ক্ষুধার্তকে খাওয়ানোর মত মহা পুণ্যের কাজটি হাতছাড়া করতে চাননি।

পাঠক একটু চিন্তা করলেই এই ঘটনায় আরো বহু শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত দেখতে পাবেন।

 

এক পরার্থপরায়ন এক পরবিমুখ

মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের পর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুহাজির ও আনসার ছাহাবীদের মাঝে আনুষ্ঠানিকভাবে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করে দিয়েছিলেন। সুন্দর শৃংখলার জন্য মুহাজির ও  আনসারের কে কার সাথে বসবাস করবেন সেটাও নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। আবদুর রহমান বিন আউফের ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেছিলেন আনসারী সাহাবী সা‘দ বিন রবীর সাথে। তিনি আবদুর রহমান বিন আউফকে ঘরে নিয়ে  গেলেন। এরপর তাকে সম্বোধন করে বললেন, ভাই আবদুর রহমান! আজ থেকে আমার অর্ধেক সম্পদের মালিক তুমি। আর শোনো, আমার দুজন স্ত্রী রয়েছে। তোমার যাকে পছন্দ হয় বল, আমি তাকে তালাক দিয়ে দিব। ইদ্দত শেষ হলে তুমি তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে। আবদুর রহমান বিন আউফ রা. জবাবে বললেন, ভাই সা‘দ! আল্লাহ পাক তোমার সম্পদ ও পরিবারে বরকত দান করুন। তোমার সবকিছু  তোমার কাছেই থাক। আমাকে শুধু বাজারের রাস্তাটা দেখিয়ে দাও। আমি ব্যবসা করতে চাই। সা‘দ বিন রবী রা. তাকে বনু কায়নুকার বাজার দেখিয়ে দিলেন। তিনি সেখানে গিয়ে বেচা-কেনা শুরু করলেন। প্রথম দিনই কিছু টাকা লাভ হল। তা দিয়ে তিনি খাওয়ার জন্য কিছু ঘি ও মাখন কিনে আনলেন। এভাবে তার ব্যবসায় দিন দিন উন্নতি হতে লাগল। নিজ হাতের উপার্জনের মাধ্যমেই তিনি আস্তে আস্তে সচ্ছল হয়ে উঠলেন। এরপর এক আনসারী নারীর সাথে তার বিবাহ হল। সহীহ বুখারী, হাদীস ৫১৬৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৩৮৬৩; মুসনাদে আবদ ইবনে হুমাইদ, হাদীস ১৩৩৩

পাঠক এ ঘটনায় আনসারী সাহাবী সাদ বিন রাবী রা.-এর আপন মুসলিম ভাইয়ের জন্য বিরাট ত্যাগ ও নিঃস্বার্থ কুরবানী পেশ করার বিষয়টি লক্ষ করলেন। আবার এটাও দেখলেন যে, মুহাজির ছাহাবী আবদুর রহমান বিন আউফ রা. এটাকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে তার আনসারী ভাইয়ের সম্পদ ও ব্যক্তিগত বিষয়ে দখল দেননি। তিনি সহানুভূতি দেখানোর কারণে তার শুকরিয়া জ্ঞাপন করলেন এবং তার জন্য দুআ করলেন।

এটা কেবল বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনা নয়; বরং মুহাজির ও আনসারী সাহাবীগণের সাধারণ কর্মপন্থা এরকমই ছিল। হাঁ, কেউ কেউ তার কর্মসংস্থান তৈরি বা জীবন-যাপনের নিজস্ব একটা ব্যবস্থা হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আনসারী ভাইয়ের সাহায্য গ্রহণ করেছেন ঠিক তবে তা ছিল ক্ষণকালের জন্য। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তারা নিজেরাই কর্ম প্রচেষ্টার মাধ্যমে নিজেদের জীবন ধারণের ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। তাদের মুসলিম ভাইদের উপর বোঝা হয়ে  থাকেননি।

আনসার ছাহাবীদের মুসলিম ভাইদের জন্য স্বার্থত্যাগ এবং মুহাজিরদের পক্ষ থেকেও আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের বিষয়টি যে ব্যাপক ও সাধারণ ব্যাপার ছিল তা বোঝার জন্য আরো এক-দুটি বর্ণনা লক্ষ করুন।

হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, আনসার সাহাবীগণ নবীজীকে বললেন, আমাদের খেজুর বাগানগুলো মুহাজির ভাই ও আমাদের মাঝে সমানভাবে বণ্টন করে দিন। নবীজী তাদের এ প্রস্তাব নাকোচ করে দিলেন। তাই আনসারগণ মুহাজিরগণকে বললেন, তোমরা শুধু আমাদেরকে চাষাবাদের কাজে সাহায্য করবে আর আমরা তোমাদেরকে ফসলের ভাগ দিব। অবশেষে তারা সকলেই এই প্রস্তাবে সম্মত হলেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৩২৫,২৭১৯

হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, মুহাজিরগণ নবীজী সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! যে ভাইদের নিকট আমরা আশ্রয় গ্রহণ করেছি তাদের চেয়ে উত্তম মানুষ আর দেখিনি। তারা সামান্য বিষয়েও আমাদের প্রতি সহানুভূতি দেখায় এবং আমাদের জন্য প্রচুর সম্পদ বিসর্জন দেয়। আমরা শুধু তাদের বাগান ও জমির কাজে সহযোগিতা করি। এতেই তারা আমাদেরকে ফসলের সমান ভাগ দেয়। আমরা আশংকা করছি, তারাই (আখেরাতের) সমস্ত প্রতিদান নিয়ে যাবে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না। যতক্ষণ তোমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে এবং তাদের জন্য দুআ করবে। (তোমরাও প্রতিদান পাবে।) -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৩০৭৫; সুনানে নাসাঈ, আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লায়লা ১৮১

হযরত আনাস রা. থেকে এক বর্ণনায় এসেছে, (বাহরাইন বিজিত হওয়ার পর) নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  সমস্ত যুদ্ধলব্ধ সম্পদ আনসার সাহাবীদের নামে লিখে দিতে চাইলেন। তারা এ প্রস্তাবে অসম্মতি জ্ঞাপন করলেন। আর আবেদন জানালেন, আমাদেরকে যে পরিমাণ সম্পদ দেয়া হবে মুহাজির ভাইদেরও যেন সেই পরিমাণই দেয়া হয়। তখন রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যদি তোমরা (মুহাজিরদেরকে রেখে কোনো কিছু) নিতে সম্মত না হও তাহলে ধৈর্যধারণ করতে থাকো হাউযে কাউসারের নিকট আমার সাথে তোমাদের সাক্ষাৎ হওয়া পর্যন্ত। কেননা, ভবিষ্যতে বিভিন্ন বিষয়ে তোমাদের উপর অন্যদেরকে প্রাধান্য দেয়া হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৭৯৪, ২৩৭৬, ২৩৭৭

এই হাদীসে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিকট আনসারদের পছন্দনীয় তিনটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে,

১. নিজেদের উপর মুহাজিরদের প্রাধান্য দেয়া।

২. মুহাজিরদের প্রতি সর্বদা সমবেদনা প্রকাশ করা।

৩. নিজেদের জন্য দুনিয়ার তুলনায় আখেরাতের প্রতিদানকেই প্রাধান্য দেয়া। -ফাতহুল বারী ৫/৫৯

 

একেই বলে আকাক্সক্ষার কুরবানী

একবার আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. অসুস্থ হলেন। তিনি মৌসুমের প্রথম আঙ্গুর খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। তখন তার স্ত্রী ছফিয়্যা খাদেমকে আঙ্গুর কিনে আনার জন্য বাজারে পাঠালেন। সে এক দিরহামের বিনিময়ে এক থোকা আঙ্গুর কিনে আনছিল। ঐ সময় এক ভিক্ষুক তার পিছু নিল। সে তা নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলে ভিক্ষুক জোরে আওয়াজ দিয়ে বলল, ভিক্ষুক এসেছে, কিছু দিন। ইবনে ওমর রা. তার আওয়াজ শুনে খাদেমকে আঙ্গুরগুলি দিয়ে দিতে বললেন। ভিক্ষুক নিয়ে চলে গেল। স্ত্রী আবার খাদেমকে এক দিরহাম দিয়ে পাঠালেন আঙ্গুর আনার জন্য। সে তা কিনে ঘরে ফিরছিল। পথিমধ্যে সেই ভিক্ষুক পুনরায় তার পিছু নিল এবং পূর্বের মতই আরচণ করল। ইবনে উমর রা. এবারও তাকে আঙ্গুর দিয়ে দিতে বললেন। এভাবে তিন বার বা চারবার ঘটার পর স্ত্রী ভিক্ষুককে ধমক দিয়ে বললেন, তোমার কি লজ্জা-শরম নেই? এবার যদি আস তাহলে...।  এরপর আঙ্গুর আনা হল ইবনে উমর রা. তা খেলেন।

হযরত ইবনে উমর রা.-এর বিশিষ্ট শাগরেদ হযরত নাফে রাহ.-এর বর্ণনায় এসেছে, ইবনে উমর রা. যদি এই ঘটনা জানতেন (স্ত্রী কর্তৃক ভিখারীকে ধমকানো) তাহলে ঐ আঙ্গুর তিনি কখনোই খেতেন না। আরো বর্ণিত হয়েছে, প্রথমবার ছাড়া  প্রতিবারই স্বয়ং ঐ ভিখারীর কাছ থেকেই ঐ আঙ্গুর কেনা হয়েছিল। আর সে নিজেই বারবার নির্লজ্জের মত এসে তা চাচ্ছিল। -তবাকাতে ইবনে সা‘দ ৪/১২০; তবরানী কাবীর (১৩০৬৭) হিলয়াতুল আওলিয়া আবু নূয়াঈম ১/৩৬৯,২৬০ মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৯/৩৪৭

রবী ইবনে খুছাইম রাহ. অনেক বড় বুযুর্গ ছিলেন। তিনি নবীযুগ পেয়েছিলেন। তার খাদেমা বণর্না করেন, তার কাছে চিনি খুব প্রিয় ছিল। কিন্তু যখন কোনো ভিখারী আসত তিনি তা নিজে না খেয়ে ভিখারীকেই দান করে দিতেন। তাই খাদেমা একদিন তাকে বলল, ভিখারীর তো চিনির প্রয়োজন নেই। তার জন্য তো রুটিই যথেষ্ট। তিনি জবাবে বললেন, আমি কী আল্লাহ পাকের এই বাণী পাঠ করিনি-

وَ یُطْعِمُوْنَ الطَّعَامَ عَلٰی حُبِّهٖ .

খাবারের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও তারা তা দান করে... (মিসকীন ও অন্যান্যদেরকে।) তবাকাতে ইবনে সাদ ৮/৩০৮; দুররে মানছূর, সুয়ূতী ৬/২৯৯

 

আম্মাজান এমনই ছিলেন

এক অভাবী ব্যক্তি আম্মাজান হযরত আয়েশা রা.-এর নিকট এসে কিছু চাইল। তিনি সেদিন রোযা ছিলেন। ঘরে মাত্র একটি রুটি ছিল। তিনি তার খাদেমাকে রুটিটা ভিখারিকে দিয়ে দেয়ার জন্য বললেন। খাদেমা বলল, ঘরে তো আপনার ইফতারির জন্য কিছুই নেই। তিনি পুনর্বার বললেন, রুটিটা তাকে দিয়ে দাও। বাধ্য হয়ে খাদেমা তা ভিখারিকে দিয়ে দিল। -মুয়াত্তা মালেক,  বাবুত তারগীব ফিছ ছাদাকাহ

 

ছাগলের মাথা ঘুরে এল প্রথম বাড়িতে

মদীনায় একটি পরিবার ছিল খুবই অভাবগ্রস্ত। তাদের কাছে ছাগলের একটি মাথা ছাড়া কিছুই ছিল না। যখন তাদের নিকট এছাড়া অন্য কিছু আসল তারা বলল, হায় যদি ছাগলের মাথাটি আমাদের চেয়ে অভাবী কাউকে দান করে দিতে পারতাম। অতপর তারা সেটি এক দরিদ্র পরিবারে পাঠিয়ে দিল। এই পরিবারও পূর্বের পরিবারের ন্যায় তাদের চেয়ে বেশি প্রয়োজনগ্রস্ত মনে করে মাথাটি অন্য এক বাড়িতে পাঠিয়ে দিল। এভাবে ছাগলের মাথাটি মদীনার বিভিন্ন বাড়িতে ঘুরতে লাগল। এক পর্যায়ে সর্বপ্রথম যেই বাড়ি থেকে তা দান করা হয়েছিল সেই বাড়িতেই ফিরে এল। আলকুনাওয়াল আসমা, আদদূলাবী ১/২০০; হিলয়াতুল আওলিয়া, আবু নুয়াঈম ৩/৩৩৮

একটি দুর্বল সূত্রে হযরত ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, সেটা ছিল আল্লাহর রাসূলের এক সাহাবীর বাড়ি। আর মাথাটি সাত বাড়িতে ঘুরে পুনরায় তাঁর বাড়িতেই ফিরে এসেছিল। এই প্রেক্ষিতেই নাযিল হয়েছিল-

وَ یُؤْثِرُوْنَ عَلٰۤی اَنْفُسِهِمْ وَ لَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ .

-তাহযীবুল আছার তাবারী, মুসনাদে ওমর রা. অংশ ১/১২১-১২২ (২০০); মুসতাদরাকে হাকেম ২/৪৮৩-৪৮৪; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী ৩/২৫৯ (৩৪৭৯); ফাতহুল বারী ৭/১৫০

 

আত্মবিসর্জনের এক বিস্ময়কর কাহিনী

ইয়ারমুকের যুদ্ধে মুসলমানদের পানির সংকট ছিল। যুদ্ধে আহতদের অনেকে পানির জন্য কাতরাচ্ছিলেন। যখন অল্প কিছু পানি ইকরিমা রা.-এর সামনে উপস্থিত করা হল, তিনি বললেন, অমুক ভাইকে দাও, আমার চেয়ে তার পানির বেশি প্রয়োজন। অথচ তখন তিনি মারাত্মক আহত ছিলেন। তাঁর পানির খুবই প্রয়োজন ছিল। যখন তার ইশারাকৃত ব্যক্তির নিকট পানি আনা হল, তিনিও আরেকজনের দিকে ইশারা করে বললেন, তার পানির বেশি প্রয়োজন তার কাছে নিয়ে যাও। এভাবে সর্বশেষ ব্যক্তির কাছে পানি এনে দেখা গেল তিনি শহীদ হয়ে গেছেন। পূর্বের ব্যক্তির কাছে ফিরে এসে দেখা গেল তিনিও শহীদ হয়ে গেছেন। হযরত ইকরিমা রা. এর কাছে এসেও একই দৃশ্য পরিলক্ষিত হল। এভাবে পানি পান করা ছাড়াই সবাই শাহাদাত বরণ করলেন। রাযিআল্লাহু আনহুম ওয়া আরযাহুম।

-তবাকাতে ইবনে সা‘দ, ৮/৫২০; তাফসীরে ইবনে কাছির, ৪/৩৫৭; আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া ৭/১২

এই ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সান্নিধ্য-ধন্য সাহাবীগণের আদর্শ ও কর্মপন্থা। তাঁরা সকলেই এই মহান নববী আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁরাই আমাদের জীবনের আদর্শ পুরুষ। আল্লাহ পাক আমাদেরকে সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ পথ অবলম্বন করার তাওফীক দান করুন। নবী ও তাঁর ছাহাবীদের পথ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَ السّٰبِقُوْنَ الْاَوَّلُوْنَ مِنَ الْمُهٰجِرِیْنَ وَ الْاَنْصَارِ وَ الَّذِیْنَ اتَّبَعُوْهُمْ بِاِحْسَانٍ رَّضِیَ اللهُ عَنْهُمْ وَ رَضُوْا عَنْهُ وَ اَعَدَّ لَهُمْ جَنّٰتٍ تَجْرِیْ تَحْتَهَا الْاَنْهٰرُ خٰلِدِیْنَ فِیْهَاۤ اَبَدًا  ذٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِیْمُ .

ঈমানে প্রথমে অগ্রগামী তথা মুহাজির ও আনসারগণ এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাঁদের অনুসরণ করেছে। আল্লাহ পাক তাঁদের সকলের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন। আল্লাহ পাক তাদের জন্য এমন জান্নাত তৈরি করে রেখেছেন, যার তলদেশে নহর বহমান। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। এটাই মহা সাফল্য। -সূরা তাওবা (৯) : ১০০

 

 

advertisement