তাবলীগ জামাতের বিবাদ : দ্বীনদারি রক্ষা করুন
দ্বীনদার হওয়া যেমন জরুরি, দ্বীনদারি রক্ষা করা তার চেয়েও বেশি জরুরি। প্রত্যেক মুসলিমকে আমৃত্যু দ্বীনদার থাকতে হবে। দ্বীনদারির উপরই দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে। কাজেই দ্বীনদারি রক্ষার চেতনা প্রত্যেক মুসলিমের মাঝেই জাগ্রত থাকতে হবে।
দ্বীন ও ঈমান মুমিন-মুসলমানের অমূল্য সম্পদ। আখিরাতের নাজাতের একমাত্র সম্বল। এই সম্বল হাতছাড়া করার কোনো উপায় নেই। কাজেই যা কিছু দ্বীনদারের দ্বীনদারিকে খতম করে বা ক্ষতিগ্রস্ত করে তা থেকে বেঁচে থাকা অতি প্রয়োজন। তেমনি যেসকল ক্ষেত্র ও পরিস্থিতি দ্বীনদারিকে ঝুঁকির মুখে ফেলে ঐসকল ক্ষেত্র ও পরিস্থিতিতে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন কাম্য। এর জন্য প্রয়োজন জানা ও মানা। ক্ষতিকর বিষয় ও ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রগুলো সম্পর্কে ভালোভাবে জানা এবং সেই জানাকে মানায় পরিণত করা।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন উম্মতকে কল্যাণের বিষয়গুলো জানিয়েছেন তেমনি অকল্যাণের বিষয়গুলো সম্পর্কেও সাবধান করেছেন। অনেক হাদীসে তিনি মানুষের ঐসকল কর্ম ও স্বভাবকে চিহ্নিত করেছেন, যা দ্বীনদারিকে ভয়াবহ রকম ক্ষতিগ্রস্ত করে। একটি হাদীসে তিনি বলেছেন, ‘সম্পদ ও মর্যাদার লালসা মানুষের দ্বীনদারিকে যেভাবে তছনছ করে দিতে পারে দুটো ক্ষুধার্ত বাঘও পারে না একটি ছাগলের পালকে তার চেয়ে বেশি তছনছ করতে।’ -জামে তিরমিযী, হদীস ২৩৭৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৫৭৮৪
এই হাদীস যেন সম্পদ ও সম্মানের মোহের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দ্বীনদারির দৃশ্যটি একেবারে প্রত্যক্ষ করে দিয়েছে। দ্বীনদারির ক্ষতিগ্রস্ততা যেহেতু চর্মচক্ষে দেখার মতো বিষয় নয়, তাই দ্বীনী অন্তর্দৃষ্টির অভাব থাকলে তা খুব সহজে ধরা পড়ে না। এ কারণেও এ বিষয়ে অধিক সতর্কতা এবং দ্বীনী অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তিদের শরণাপন্নতা কাম্য।
সম্পদের মোহগ্রস্ত মানুষ যেমন হালাল-হারামের তোয়াক্কা করে না তেমনি পদ ও নেতৃত্বের মোহগ্রস্ত মানুষও জায়েয-না জায়েযের চিন্তা করে না। এইসব চিন্তা তখন গৌণ হয়ে যায়; অর্থ-বিত্ত আর প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জনই মুখ্য হয়ে ওঠে। আর এ কারণে নিজেও যেমন বিচ্যুতির পথে ধাবিত হয়, আরো অনেককে ধাবিত করে। একে একে সব রকমের না জায়েয ও অবৈধ কাজই সংঘটিত হতে থাকে। তখন নিজের অন্যায়-অপরাধের দায় তো নিজের কাঁধে চাপেই, অন্যদের অন্যায়-অপরাধের দায়ও- যাদের সে প্ররোচিত করেছে- কাঁধে চাপে। যদিও একারণে সেই অন্ধ অনুসারীদেরও দায়মুক্তি ঘটে না। কী ভয়াবহ ব্যাপার!
একটু গভীরভাবে তাকালে দ্বীনদারির এই ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ততার বিভিন্ন দৃষ্টান্ত চোখে পড়বে। জাগতিক ক্ষেত্রেও, ধর্মীয় ক্ষেত্রেও। এখন দেশব্যাপী যে নির্বাচনী তোড়জোড় চলছে- কে না জানে এই নির্বাচন ও রাজনীতির ধারায় কত মানুষের দ্বীনদারি বিপর্যস্ত হয়েছে! কটূক্তি-মিথ্যাচার ও অর্থের অবৈধ লেনদেন থেকে শুরু করে কোন্ অনাচারটা আছে, যা এসময় এই ক্ষেত্রে সংঘটিত হয় না? এত সব অনাচার-পাপাচারের পিছনে সম্পদের লিপ্সা আর ক্ষমতার মোহ ছাড়া আর কী আছে?
যুগ যুগ ধরে রাজনীতিতে যে অহেতুক দ্বন্দ্ব-সংঘাত এ তো পার্থিব পদ-পদবী, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব-লিপ্সারই উদাহরণ। ধর্মীয় ক্ষেত্রেও সম্প্রতি যে বিরোধটি ব্যাপক রূপ ধারণ করেছে এরও গোড়ায় কি এই লিপ্সাই কার্যকর নয়? ধর্মীয় নেতৃত্ব-লিপ্সাও তো পার্থিব লালসাই। শুধু ক্ষেত্র ও প্রকারটি ভিন্ন। এটাও মানুষের দ্বীনদারিকে ঐভাবে তছনছ করতে পারে, যেভাবে পারে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার লিপ্সা। কোনো কোনো দিক থেকে তো এটা প্রথমটার চেয়েও ভয়াবহ। কারণ এক্ষেত্রের অনাচার-পাপাচারগুলো তখন সংঘটিত হয় দ্বীনের নামে ও ধর্মের ছদ্মাবরণে। তেমনি যে মানুষগুলো একটা সময় পর্যন্ত শান্তশিষ্টভাবে দ্বীন মেনে চলার চেষ্টা করেছে তারাই এর চক্করে পড়ে বরবাদ হয়। কে না বুঝবে যে, দ্বীনের নামে অনাচার আর দ্বীনদারের বেদ্বীনীর শিকার হওয়ার চেয়ে মর্মান্তিক ব্যাপার আর কিছুই হতে পারে না!
মুসলিমসমাজে দ্বীন প্রচারের যত মেহনত সব তো এজন্যই যে, মানুষ যেন দ্বীনদার হয়, সত্যবাদী হয়, সত্যনিষ্ঠ হয়, আল্লাহর হক ও বান্দার হক সম্পর্কে সচেতন হয়। এখন -খোদা নাখাস্তা- কোনো দ্বীনী মেহনতে জড়িত লোকদেরই একটি দল যদি মিথ্যাচার ও প্রতারণা এবং দ্বীনের অপব্যাখ্যা ও সেই অপব্যাখ্যার পক্ষাবলম্বনের মত ভয়াবহ বিষয়ে লিপ্ত হয় তাহলে বুঝতে হবে, এরা এই মেহনতের আসল পথ থেকে বিচ্যুত। এই বিচ্যুতি, বিচ্যুতির পক্ষপাত এবং তৎপ্রসূত বিবাদ-বিসংবাদ যখন সামনে আসে তখন অনেক বেশি সতর্কতা জরুরি হয়ে পড়ে। আর তা জরুরি হয় নিজের দ্বীনদারি রক্ষার স্বার্থে। দ্বীনের মেহনতটি রক্ষার স্বার্থে।
এ অবস্থায় যেমন বিভেদ-বিসংবাদের স্বরূপ বোঝা এবং বিবাদমান পক্ষগুলোর সঠিক ও নির্মোহ মূল্যায়ন জরুরি হয়ে পড়ে, তেমনি সকল পক্ষের স্ব স্ব দ্বীনদারি রক্ষার স্বার্থে চিন্তা ও কর্ম এবং আচরণ ও উচ্চারণে আরো সংযমী হওয়াও জরুরি হয়ে পড়ে। বলাবাহুল্য, এটা উম্মতের জন্য অনেক বড় এক পরীক্ষার মুহূর্ত। কাজেই এই পরিস্থিতি ক্রোধ ও জিঘাংসার পরিস্থিতি নয়, আল্লাহর দরবারে রোনাজারি, সর্বোচ্চ সংযম ও ন্যায়নিষ্ঠার পরিচয় দেওয়ার পরিস্থিতি।
বিভেদ-বিসংবাদের সঠিক মূল্যায়ন একারণেও জরুরি যে, অজ্ঞতাবশত কারো কর্ম ও তৎপরতা যেন অন্যায় ও বিচ্ছিন্নতার পক্ষে চলে না যায়। সেক্ষেত্রে শুধু দ্বীনী বিষয়ে বিচ্ছিন্নতা প্রচারের দায়ই বর্তাবে না; এই বিভেদকে শক্তিশালী করার দায়ও বর্তাবে। কারণ বিবাদ-বিসংবাদ দূর হওয়ার যৌক্তিক উপায় হচ্ছে ন্যায়ের পক্ষে সকলের একমত হয়ে যাওয়া। অন্যায়ের পক্ষে সমর্থন ও সহযোগিতা প্রত্যাহার করে নেওয়া। কাজেই এধরনের ক্ষেত্রে মৌলিকভাবে দুটো বিষয়ের অপরিহার্যতা যে কেউ বুঝবেন; একটি হচ্ছে, দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ক্ষেত্রে হক্বকে বোঝা ও হক্বের উপর থাকা। আর দুই. সব রকমের জুলুম-অবিচার থেকে বেঁচে থাকা।
নীতিগতভাবে প্রত্যেকেই স্বীকার করেন যে, আমাদেরকে সর্বাবস্থায় হক্বের উপরই থাকতে হবে। বর্তমানে তাবলীগ জামাতে যে বিভেদ-বিশৃঙ্খলা এতে ন্যায়-অন্যায়ের বিষয়টি অস্পষ্ট নয়। কাজেই নীতিগতভাবে যা প্রত্যেকে স্বীকার করেন, সদিচ্ছা থাকলে প্রায়োগিক ক্ষেত্রেও তার অনুসরণ কঠিন নয়।
শুরুতে বিষয়টি ব্যাপকভাবে সামনে না এলেও এখন তো দারুল উলূম দেওবন্দের পরিষ্কার সিদ্ধান্ত এবং প্রাজ্ঞ ও স্বীকৃত উলামায়ে কেরামের অবস্থান সবার সামনে রয়েছে। কাজেই অস্পষ্টতার অজুহাত এখন অবান্তর।
হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আযীয রাহ.-এর একটি কথা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তাঁর সঙ্গীদের জিজ্ঞাসা করলেন, বল তো সবচেয়ে বুদ্ধিহীন মানুষ কে? তারা বললেন, ‘যে দুনিয়ার জন্য দ্বীন বিসর্জন দেয়।’ তিনি বললেন, আমি কি বলব, এর চেয়েও নির্বোধ কে? ‘যে অন্যের দুনিয়ার জন্য নিজের দ্বীন বিসর্জন দেয়।’ -হিলইয়াতুল আউলিয়া ৫/৩২৫
হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আযীয রাহ. এই উক্তিটি যে কোনো পর্যায়ের শায ও বিচ্ছিন্ন মতের অন্ধ অনুসারী ও অতি উৎসাহী কর্মীদের ক্ষেত্রেও বিশেষভাবে প্রযোজ্য।
শায ও বিচ্ছিন্ন মতের লোকেরা অজ্ঞতাবশত কিংবা নেতৃত্বের লিপ্সা বা অন্য যে কোনো কারণে ঐ শুযূয ও বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করে থাকুক, এদের অন্ধ অনুসরণের দ্বারা যারা নিজেদের দুনিয়া-আখিরাত বরবাদ করছেন তাদের কি চিন্তা করা উচিত নয় যে, অন্যের দুনিয়া সাজিয়ে দেয়ার জন্য কেন তারা নিজেদের দুনিয়া-আখিরাত বরবাদ করবেন? কেন নিজেদেরকে জুমহুরে আহলে হক্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ও একঘরে করবেন? কেন নিজেদেরকে আহলে হক্বের কাছে অবাঞ্ছিত করে রাখবেন?
আপনার ইতিপূর্বের পরিচয় যা-ই হোক- সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত দ্বীনদার কিংবা মাদরাসায় পড়া দ্বীনদার, আপনার যদি আত্মমর্যাদা থাকে, দ্বীন ও ইলমে দ্বীনের দিকে নিসবতের মর্যাদা থাকে, তাহলে বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করুন। নিজের সাথে নিজে বোঝাপড়া করুন। আল্লাহর কাছে সঠিক পথের সন্ধান প্রার্থনা করুন। ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তাআলা সঠিক পথের সন্ধান দেবেন।
বর্তমান পরিস্থিতির আরেক করণীয় হচ্ছে, প্রত্যেকে নিজের আচরণ-উচ্চারণে পূর্বের চেয়েও বেশি সতর্ক হওয়া। বিষয়টি যেহেতু বিবাদ-বিসংবাদের রূপ গ্রহণ করেছে এবং অন্যায় হলেও পক্ষ-বিপক্ষের ব্যাপার দাঁড়িয়ে গেছে কাজেই এখানে আলোচনা-পর্যালোচনা ও সংলাপের প্রসঙ্গ আসতেই পারে। এক্ষেত্রে ‘মুজাদালা বিল আহসান’-উত্তম পন্থায় বিতর্কের পথই অবলম্বন করতে হবে। শরীয়তে আলোচনা-পর্যালোচনা নিষিদ্ধ নয়, প্রয়োজনের ক্ষেত্রে তা কাম্যও বটে, তবে তা হতে হবে শরীয়তের উসূল ও আদাব অনুসারে, উত্তম পন্থায়। নিয়ত, কর্মপন্থা ও ফলাফল সব এখানে নজরে রাখতে হবে। এখানে যেমন অন্যায় পক্ষপাত ও অন্যায়ের প্রতি পক্ষপাতের অবকাশ নেই তেমনি অন্যায় কাদা ছোড়াছুড়ি, অসংযত শব্দ-বাক্য ব্যবহারেরও সুযোগ নেই।
এধরনের মতভেদের ক্ষেত্রে বিতর্কের অন্যতম সাধারণ উসূল হচ্ছে, হক্ব ও সত্য প্রতিষ্ঠার নিয়ত, হক্বের প্রতি ওফাদারি এবং আল্লাহর বান্দাদের প্রতি কল্যাণকামিতার চেতনা। আর একারণেই শরয়ী দলীল-প্রমাণ এবং শরীয়তের মাহির ব্যক্তিবর্গের সিদ্ধান্তই এখানে ফয়সালার মূল উপকরণ।
কাজেই অপ্রয়োজনীয় ও অসংযত কথাবার্তা উভয় পক্ষকেই বর্জন করতে হবে। আল্লাহকে হাজির নাজির জেনে নিজের আখিরাতকে সামনে রেখে অগ্রসর হতে হবে। মনে রাখতে হবে, বিবাদ-বিসংবাদের ক্ষেত্রগুলো পদস্খলনের বড় ক্ষেত্র। ঈমান-আমল বরবাদ হওয়ারও বড় ক্ষেত্র। কাজেই প্রত্যেকে সংযত হোন, সংযমী হোন, নিজের আখিরাতকে স্মরণ করুন এবং দ্বীনদারি রক্ষা করুন।
আল্লাহ তাআলা সকলকে তাওফীক দান করুন- আমীন।