শাওয়াল ১৪৩৯   ||   জুলাই ২০১৮

হু    কু    ক : মজদূরের মজুরি

গোলাম এলাহী

প্রতি বছরের মতো এবারও নানা রকম আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয়েছে পয়লা মে। এ উপলক্ষে বিভিন্ন আলোচনা-পর্যালোচনাও সামনে এসেছে। ফিলহালের সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে মজুরি সংক্রান্ত দুটি বিষয় নিয়ে কিছু কথা বলার ইচ্ছা রাখি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) ২০১৭ সালে দেশের শ্রমপরিস্থিতি নিয়ে একটি জরিপ করে। গত ৩০ এপ্রিল সোমবার এই প্রতিষ্ঠানটি তার জরিপের তথ্য প্রকাশ করেছে, যা পরদিন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়েছে, গত বছর দেশের শিল্পখাতে ১৮১টি বিরোধ বা অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে পোষাক শিল্পে ৯১টি ও পরিবহন খাতে ৩৬টি।  সে কারণে ৬৮টি বিক্ষোভ ও ২১টি মানববন্ধন ছাড়াও ১৮টি ধর্মঘট ও ১৫টি সড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটেছে। সমাবেশ হয়েছে ১২টি। এসব আন্দোলন কর্মসূচির ৫৬টি হয়েছে বকেয়া বেতনের দাবিতে, যার মধ্যে ৪৩টি পোষাক খাতে। (দৈনিক প্রথম আলো, ১ মে ২০১৮, পৃ. ১৪)

দেশের পোষাকশিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। এই শিল্পের মাধ্যমে যেমন অসংখ্য নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে তেমনি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও তা গভীর ভূমিকা রাখছে। এই খাতটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত একটি শিল্প। আর একারণে এর পিছনে দেশি-বিদেশি চক্রান্তও একেবারে কম নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, কোনো চক্রান্তই ঐ পর্যন্ত সফল হতে পারে না যে পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে ছিদ্র ও দুর্বলতার সৃষ্টি না হয়। উপরের রিপোর্টে সেই রকমই একটি ছিদ্রের উল্লেখ হয়েছে।

শ্রমিকের প্রাপ্য যথাযথভাবে পরিশোধ না করা ভয়াবহ গুনাহ। আর গুনাহের পরিণাম কখনো ভালো হয় না। কাজেই সতর্ক হওয়া কাম্য।

হাদীস শরীফে শ্রমিকের মজুরি নিয়ে টালবাহানা না করে তা দ্রুত পরিশোধের তাকিদ করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হাদীসটি সবারই জানা আছে-

أَعْطُوا الْأَجِيرَ أَجْرَهُ، قَبْلَ أَنْ يَجِفّ عَرَقُهُ.

মজদুরকে তার মজুরি দিয়ে দাও তার ঘাম শুকোবার আগেই। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২৪৪৩ 

মজদুরকে মজুরি থেকে বঞ্চিত করার ব্যাপারে হাদীস শরীফে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হয়েছে।

সহীহ বুখারীতে হযরত আবু হুরায়রা রা.-এর সূত্রে এই হাদীসে কুদসী বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

قَالَ اللهُ: ثَلاَثَةٌ أَنَا خَصْمُهُمْ يَوْمَ القِيَامَةِ: رَجُلٌ أَعْطَى بِي ثُمّ غَدَرَ، وَرَجُلٌ بَاعَ حُرّا فَأَكَلَ ثَمَنَهُ، وَرَجُلٌ اسْتَأْجَرَ أَجِيرًا فَاسْتَوْفَى مِنْهُ وَلَمْ يُعْطِ أَجْرَهُ

আল্লাহ তাআলা বলেছেন, কিয়ামতের দিন আমি নিজে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াব : এক. ঐ ব্যক্তি যে আমার নামে অঙ্গিকার করে তা ভঙ্গ করেছে। দুই. যে কোনো স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রি করে সেই মূল্য ভক্ষণ করেছে। আর তিন. যে কোনো মজদুরের শ্রম পুরোপুরি গ্রহণ করে তাকে তার মজুরি থেকে বঞ্চিত করেছে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২২২৭   

ইবনে খুযাইমা, ইবনে হিব্বান ও ইসমাঈলীর বর্ণনায় একথাটুকুও আছে-

وَمَنْ كُنْتُ خَصْمَهُ خَصَمْتُهُ.

‘আর আমি যার বিরুদ্ধে দাঁড়াব তাকে পরাস্ত করেই ছাড়ব।’

এ হাদীসের আলোচনায় ইবনুত তীন রাহ. বলেছেন, আল্লাহ তাআলা সকল জালিমের বিরুদ্ধেই দাঁড়াবেন, কাজেই এই হাদীসে বিশেষভাবে এদের উল্লেখের তাৎপর্য হচ্ছে এই জুলুমগুলোর গুরুতরতা ও ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে হুঁশিয়ার করা। -ফাতহুল বারী ৫/৩২২-৩২৩

এ থেকে বোঝা যায়, শ্রমিককে তার চুক্তিকৃত মজুরি থেকে বঞ্চিত করা বা মজুরি নিয়ে টালবাহানা করা কত বড় অন্যায়। এই অন্যায় থেকে অবশ্যই আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।

শ্রমিককে তার চুক্তিকৃত মজুরি যথাসময়ে পরিশোধ করা যেমন একটি কর্তব্য তেমনি আরেকটি কর্তব্য হচ্ছে, মজুরির পরিমাণ যুক্তিসঙ্গত হওয়া। মজুরি এমন হওয়া কাম্য, যা দ্বারা একজন শ্রমিকের স্বাভাবিক প্রয়োজন মেটে। এক্ষেত্রেও নিয়ম কানুন ও আন্তরিকতার ঘাটতি আছে বলেই প্রতীয়মান হয়।

বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম  মে দিবসের প্রসঙ্গে এক নিবন্ধে লিখেছেন, একজন শ্রমিকের বেতন এবং তাঁর সংসারের ছোট একটি পরিসংখ্যান দেখে নেওয়া যেতে পারে। একজন শ্রমিকের স্ত্রী, তাঁর দুটি অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানকে একজন ধরে নিলে শ্রমিকসহ ওই সংসারে মোট মানুষ তিনজন। বর্তমান বাজারদর হিসাবে প্রতিজনের পেছনে মাথাপিছু খাদ্য খরচ ৩ হাজার-তিন জনের ক্ষেত্রে ৯ হাজার টাকা। ন্যূনতম হিসাবে খাদ্যদ্রব্যের বাইরে এই তিনজনের বাসা ভাড়া, পোশাক, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও যাতায়াত ইত্যাদি আনুষঙ্গিক খরচ আরও ৯ হাজার।

অর্থাৎ পরিবারপিছু খরচ ১৮ হাজার টাকা। অথচ পোশাক-শ্রমিকের মজুরি মাত্র ৫ হাজার ৩০০ টাকা। (দৈনিক প্রথম আলো, ১ মে ২০১৮ পৃ. ১০)

এটি একটি পারিবারিক খরচের হিসাব। একটি পরিবারের জন্য একে ন্যূনতম খরচ ধরে নেওয়া যায়। পরিবারের কর্তা হিসেবে একজন শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি নজরে রাখা কর্তব্য। এছাড়া এই বিপুল জনগোষ্ঠীর রুচি, মানসিকতা ও জীবন-মানের উন্নয়ন কঠিন।

এক্ষেত্রে আল্লাহ্র রাসূল  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদীস খুবই প্রাসঙ্গিক। সাহাবী হযরত মুস্তাওরিদ ইবনে শাদ্দাদ রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَنْ كَانَ لَنَا عَامِلًا فَلْيَكْتَسِبْ زَوْجَةً، فَإِنْ لَمْ يَكُنْ لَهُ خَادِمٌ فَلْيَكْتَسِبْ خَادِمًا، فَإِنْ لَمْ يَكُنْ لَهُ مَسْكَنٌ فَلْيَكْتَسِبْ مَسْكَنًا، قَالَ: قَالَ أَبُو بَكْرٍ: أُخْبِرْتُ أَنّ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ قَالَ: مَنِ اتّخَذَ غَيْرَ ذَلِكَ فَهُوَ غَالّ أَوْ سَارِقٌ

যে আমাদের ‘আমিল’ (কর্মচারী) তার যদি স্ত্রী না থাকে তাহলে বিয়ে করে একজন স্ত্রী গ্রহণ করবে, খাদিম না থাকলে একজন খাদিম গ্রহণ করবে, ঘর না থাকলে একটি ঘরের ব্যবস্থা করবে। এর অতিরিক্ত যদি কিছু গ্রহণ করে তাহলে সে তসরুফকরী ও চোর বলে গণ্য হবে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৯৪৫; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ১৪৭৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৮০১৫; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ২৩৭০

এই হাদীসে একটি মানদ- বর্ণিত হয়েছে। শিকাগোর হে মার্কেটের ঘটনার ১৩২ বছর পর মে-দিবস উদ্যাপনের প্রসঙ্গে মজদুরের ন্যূনতম প্রয়োজন পূরণের যে দাবি আজ উচ্চারিত হচ্ছে তা প্রায় দেড় হাজার বছর আগে আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছিলেন। মুসলিমসমাজে সেই অনন্য ও কল্যাণ-ব্যবস্থা এক দীর্ঘ সময় পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিতও ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে যতই আমরা আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিধান ও আদর্শ থেকে দূরে সরেছি ততই আমাদের জীবনে অশান্তি ও বঞ্চনার অমানিশা নেমে এসেছে। আজ আবার আমাদের সেই কল্যাণ ও ইনসাফের আদর্শের দিকেই ফিরে যেতে হবে। তাহলে যেমন শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে তেমনি তার কর্তব্য সম্পর্কেও সে সচেতন হয়ে উঠবে। মালিক-শ্রমিক উভয় শ্রেণি নিজ নিজ কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠলেই শ্রমের অঙ্গনে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও কল্যাণপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত হতে পারে। আর এ শুধু আমাদের পার্থিব প্রয়োজনই নয়, পরকালীন প্রয়োজনও বটে।

 

 

advertisement