বিশ্বকাপ ফুটবল : উন্মাদ হওয়ার আগে একটু ভাবুন
আবদুল্লাহ মা’ছূম
আগামী ১০ জুন বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হবে। তবে এ নিয়ে মাতমাতি শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। আর টুর্নামেন্ট চলা অবস্থায় তো গোটা দেশ বুঁদ হয়ে থাকে খেলার নেশায়। স্বাস্থ্যের ক্ষতি, অর্থের ক্ষতি, সময়ের অপচয়, গোনাহ ও পাপাচার কোনো কিছুই তাদের চেতনা জাগ্রত করতে পারে না।
মিডিয়া একে সোহাগ করে বলে ‘বিশ্বকাপ জ্বর।’ সম্ভবত বাংলাদেশের হুজুগে জনতা এ ‘জ্বরে’ একটু বেশিই আক্রান্ত হয়। শিক্ষিত অশিক্ষিত কোনো শ্রেণীই বাদ থাকে না। অথচ এই সর্বব্যাপী মত্ততা যে ব্যক্তিগত ও জাতীয় পর্যায়ে কী পরিমাণ ক্ষতি সাধন করে তা কেউ তলিয়ে দেখেন না।
বর্তমান নিবন্ধে এ সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করার চেষ্টা করব।
সময়ের অপচয়
মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত এ টুর্নামেন্টে প্রতিদিন ৯০ থেকে ১০০ মিনিটের একটি খেলা থাকে, কোনো কোনো দিন দু’টোও থাকে। বাংলাদেশ সময়ে গভীর রাতেও এই খেলা সমপ্রচারিত হয়। অর্থাৎ টুর্নামেন্ট চলা অবস্থায় কী দিন কী রাত মানুষ সবকিছু ফেলে খেলা নিয়েই মেতে থাকে।
এরপর আছে খেলার আগে পরে আলোচনা ও পর্যালোচনা। আছে কুইজ, পত্রিকা, ইন্টারনেট। সব মিলিয়ে কোটি কোটি মানুষের কত কোটি শ্রম-ঘণ্টা যে এর পিছনে নষ্ট হয় তা খুব সহজেই অনুমেয়। বলাবাহুল্য, কোনো চিন্তা্শীল মানুষ এতে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারেন না।
পতাকা সমাচার
খেলা শুরু হওয়ার বেশ আগে থেকেই বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দেশের পতাকায় গোটা দেশের বাসা-বাড়ি ও দোকানের ছাদগুলো ছেয়ে যায়। সম্ভবত বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী কোনো দেশেও অন্য দেশের পতাকার এমন ছড়াছড়ি হয় না। বিদ্যমান দেশীয় আইনেও তা কতটুকু গ্রহণযোগ্য?
একটি জাতীয় দৈনিক থেকে একটি উদ্ধৃতি তুলে দিচ্ছি। বাংলাদেশ সংবিধানের ৪ নং অনুচ্ছেদের বিধি ৯-এর ৪ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, ‘কোনো বিদেশী পতাকা বাংলাদেশের কোনো ভবন বা গাড়িতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সুনির্দিষ্ট অনুমতি ছাড়া উত্তোলন করা যাবে না।’ ৪ নং অনুচ্ছেদের বিধি ৭-এর ৭ ধারায় আরো বলা হয়েছে, ‘অন্য কোনো পতাকা বাংলাদেশের পতাকার চেয়ে উঁচুতে উত্তোলন করা যাবে না।’ আইনে আরো আছে, ‘বাংলাদেশের পতাকা ভিন্ন দেশের পতাকার চেয়ে আকারে ছোট না হতে হবে।’
বলাবাহুল্য, বিশ্বকাপ উন্মাদনায় এসব আইনের কোনো তোয়াক্কা করা হয় না। অথচ গত আসরে যে দেশে খেলা হল, সেখানেও ভিন দেশীয় পতাকা উত্তোলনের ব্যাপারে সে দেশের সরকার হস্তক্ষেপ করেছিল। আইন করে পুলিশদের জন্য পতাকা উত্তোলন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। (সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক, ১৪ জুন ২০০৬)
অর্থের অপচয়
অর্থ অপচয়ের একটি দিক হল, টিভি কেনা। টিভি না থাকলে বিশ্বকাপ উপলক্ষে তো একটি অবশ্যই কিনতে হবে। আর থাকলেও নতুন টিভি চাই। এছাড়া পাড়ায় পাড়ায় বড় পর্দায় খেলা দেখার জন্য বড় জায়ান্ট স্ক্রীনে খেলা দেখার আয়োজনে এবং ত্রিমাত্রিক মনিটরের ব্যবস্থার পিছনে অর্থের অপচয় কম নয়। এরপর জাতীয় পর্যায়ে কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয় তা কিছুটা অনুমান করা যাবে নীচের পরিসংখ্যান দ্বারা।
গত ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে গ্রান্ট থনটন নামের এক বৃটিশ হিসাব কর্মকর্তা বিশ্বকাপ উপলক্ষে অর্থনৈতিক ক্ষতির একটি রিপোর্ট পেশ করেছিলেন। ঐ রিপোর্টে তিনি বলেন, খেলা নিয়ে মত্ত থাকার কারণে কর্মস্থলে অনুপস্থিতির হার অনেক বেড়ে যায়। উপস্থিতকর্মীদেরও মন পড়ে থাকে খেলার দিকে। রাত জেগে খেলা দেখার কারণে তারা কাজ করে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে। ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতি আনুমানিক ১ দশমিক ২৬ মিলিয়ন পাউন্ড, যা খেলায় অংশগ্রহণ করে যে অর্থ আয় হয় তার দ্বিগুণ। (দৈনিক প্রথম আলো, ১৯ জুন ২০০৬)
সেন্টার ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড বিজনেস রিচার্সের হিসাব মতে ২০০২ সালের বিশ্বকাপে ইউরোপীয় দেশগুলোর মোট ক্ষতি হয়েছিল ৮ দশমিক ৭ বিলিয়ন পাউন্ড। (প্রাগুক্ত)
আশ্চর্যের বিষয় এই যে, হজ্ব ও কোরবানীর মওসুমে যেসব বুদ্ধিজীবী সরব হয়ে ওঠেন এবং গরীব-মিসকীনকে দান-খয়রাত করার সুফল ও যথার্থতা সম্পর্কে ‘সূক্ষ্ম’ বিচার-বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে থাকেন তারা বিশ্বকাপের সর্বব্যাপী অপচয়ের বেলায় সম্পূর্ণ নিরব হয়ে যান। তাদের বিচার-বুদ্ধি যেন দন্ত-নখরহীন হয়ে পড়ে এবং গরীব-দুঃখীর প্রতি মমতাও তখন তাদেরকে টু শব্দটি করাতে পারে না। সত্যিই বড় অদ্ভুত এই প্রজাতি!
পড়াশুনার ক্ষতি
রাত জেগে খেলা দেখার কারণে ছাত্রছাত্রীরা পরদিন ক্লাসে উপস্থিত হতে পারে না, উপস্থিত হলেও মনোযোগ থাকে না। আর এ শুধু এক দুই প্রতিষ্ঠানের বিষয় নয়, গোটা দেশেই এই চিত্র পরিলক্ষিত হয়। ২০০৬-এর বিশ্বকাপের জন্য তো দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানে ক্লাস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ১৬ জুন থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। ৩ জুন টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা পিছানো হয়েছিল ২৯ জুলাই পর্যন্ত। (প্রথম আলো, ১৮ জুন ২০০৬)
এতে পরীক্ষা ও সেশন দু’ টোই পিছানো হয়েছে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে মূল্যবান দু’টি মাস। বাংলাদেশ বিশ্বের একটি দরিদ্রতম দেশ। তদুপরি তা বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী কোনো দেশ নয়। অথচ দেশের প্রকৌশল শিক্ষার সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানটি এজন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। গত বিশ্বকাপে ৩২টি দেশ অংশগ্রহণ করেছিল। ঐসব দেশেও খেলার জন্য তাদের গুরুত্বপূর্ণ কোনো শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল এমন খবর পাওয়া যায় নি। এমনকি খোদ আয়োজক দেশেও এ রকম ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়নি।
দায়িত্ব পালনে অবহেলা
খেলা দেখার অজুহাতে কর্মস্থলে উপস্থিত না হওয়া কিংবা উপস্থিত হলেও রাত জেগে খেলা দেখার কারণে অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে না পারা তো সাধারণ চিত্র। এর ক্ষতি গোটা দেশবাসীকেই বহন করতে হবে। এর কারণে জাতীয়ভাবে কী পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়ে থাকে সে সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে পূর্বে উল্লেখিত বৃটিশ কর্মকর্তার উদ্ধৃতি থেকে।
তাছাড়া শিক্ষক ও চাকুরীজীবীরা দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে অন্যের হক নষ্ট করা হয়। শিক্ষক দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে ছাত্রের হক নষ্ট হয়। চাকুরীজীবী অবহেলা করলে চাকুরীদাতার হক নষ্ট হয়। বিনোদনে মত্ত হয়ে অন্যের হক নষ্ট করার বৈধতা ও যৌক্তিকতা কতটুকু?
শরীয়তের সীমা লঙ্ঘন
খেলা দেখতে গিয়ে নামায আদায়ে চরম অবহেলা করা হয়। এছাড়া খেলা দেখার সময় অন্যের সতর দেখার গুনাহ, বে-পর্দা দৃশ্যাবলি, পুরুষ নারীকে এবং নারী পুরুষকে অত্যন্ত দৃষ্টিকটু অবস্থায় দেখার গুনাহ ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব নয়। এতে পার্থিব ক্ষতিও রয়েছে। এর দ্বারা স্বভাব-চরিত্র নষ্ট হয়। পরিবারের ছোট বড় সবাই একসঙ্গে এসব দৃষ্টিকটু দৃশ্য দেখার কারণে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ উঠে যায়।
বিশ্বজুড়ে ফুটবলবাণিজ্য
বিশ্বকাপ ফুটবল শুধু একটি ক্রীড়া ইভেন্ট বা বিনোদন নয়, এটি বিশ্ববাণিজ্যের অন্যতম প্রধান উপলক্ষ। একে কেন্দ্র করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আদান-প্রদান হয়। শুধু ফিফার বাণিজ্যের কথাই ধরুন। ফিফা তার বিপণন খাতকে তিন ভাগে ভাগ করেছে : ১. অফিসিয়াল পার্টনার, ২. অফিসিয়াল সাপ্লায়ার্স ও ৩. লাইসেন্সেস।
নির্দিষ্ট মেয়াদের চুক্তিতে পার্টনার প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাপী তাদের পণ্যের বিপণন প্রক্রিয়ায় ফিফা ও তার অধীনের যেকোনো টুর্নামেন্টের নাম-লোগো ব্যবহার করতে পারে। এই নাম-লোগো ব্যবহার করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো অঢেল অর্থের মালিক হয়ে যায়। এই সুবিধা পাওয়ার জন্য ফিফাকে তারা কত দিয়েছে তা বলা নিষেধ। ২০০৬-এর বিশ্বকাপে ফিফার অফিসিয়াল পার্টনার ছিল ১৫টি। এদের অন্যতম হল কোকাকোলা, মাস্টার কার্ড, ফিলিপস, ইয়াহু, এডিডাস ইত্যাদি বহুজাতিক কোম্পানি।
আর সাপ্লায়ার্স প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু নির্দিষ্ট টুর্নামেন্টের আয়োজক দেশে বিপণন প্রক্রিয়ায় নাম-লোগো ব্যবহার করতে পারে। ২০০৬ সালে ফিফার সাথে সাপ্লায়ার্স প্রতিষ্ঠান ছিল ৫টি। ফিফার পার্টনার হতে তাদেরকে কত ডলার গুণতে হয়েছে তা কল্পনাতীত।
বিশ্বকাপকে ঘিরে তাদের অর্থ আয়ের আরেকটি খাত হল টিভিস্বত্ত্ব বিক্রি। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি লোকের দেখা ক্রীড়া ইভেন্ট বিশ্বকাপ ফুটবল। গত আসরে প্রায় সাড়ে দেড় বিলিয়ন সুইস ফ্রাঙ্ক দিয়ে সে স্বত্ত্ব বিক্রি করেছে ফিফা। (সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক, ৩ জুন ২০০৬)
বস্তুত এ ধরনের টুর্নামেন্টগুলো পুঁজিবাদীদের অর্থ-উপার্জনের একটি উপলক্ষ মাত্র। নিজেদের স্বার্থেই তারা গোটা পৃথিবীতে উন্মাদনা সৃষ্টি করে। আর সাধারণ মানুষ তাদের পরিকল্পিত ফাঁদে পা দিয়ে নিজের সময়, স্বাস্থ্য ও গাঁটের পয়সা অবলীলায় বিসর্জন দিতে থাকে। আর এই বিশ্ববাণিজ্যের নেপথ্য নায়কদের অন্যতম প্রধান দোসর হিসেবে অবতীর্ণ হয় গোটা মিডিয়াজগত। সাধারণ মানুষের পকেটকাটার জন্য এরা বিশ্বকাপ শুরুর আগে থেকেই পরিবেশ তৈরি করে। ফিফা, বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি ও মিডিয়া সকল গোষ্ঠীই বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে নিজ নিজ ঝোলা পূর্ণ করে। আর তা পূর্ণ করে সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত অর্থের দ্বারা। তাই উন্মাদ হওয়ার আগে একটু ভাবা উচিত, এতে কার লাভ, কার ক্ষতি।
পশ্চিম জার্মানীর বিশ্বকাপজয়ী খেলোয়াড় বেকেন বাওয়ার এই ফুটবল বাণিজ্য সীমিত করার দাবি জানিয়ে বলেছিলেন, ফুটবলকে ভালোভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা দরকার। অর্থের উপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করা প্রয়োজন। (সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক, ৬ জুন ২০০৬)
বিশ্বকাপকেন্দ্রিক পাপাচার
যে দেশে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় সেদেশে পাপচারের প্লাবন বয়ে যায়। কোনো ঈমানদার ব্যক্তি, এমনকি একজন সাধারণ রুচিশীল মানুষও একে সমর্থন করতে পারেন না এবং নিজ দেশে এমন একটি টুর্নামেন্ট কল্পনাও করতে পারেন না। নিম্নে কয়েকটি মাত্র দিক তুলে ধরা হল।
পতিতাবৃত্তি
বিশ্বকাপ উপলক্ষে পতিতাবৃত্তি সীমা ছাড়িয়ে যায়। যে দেশে এই টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয় সেখানে অসংখ্য পতিতা ছড়িয়ে পড়ে। হাজার হাজার দর্শক, সমর্থকের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে পতিতা সংগ্রহ করা হয়।
গত আসরে যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছে যে, বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার নারী পাচার হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইসের আদম পাচার বিষয়ক উপদেষ্টা জন মিলার বলেছিলেন, বিশ্বকাপ নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। নারী পাচারের ক্ষেত্রে এর প্রভাব বেশি। তিনি আরো বলেন, বিশ্বকাপের সময় যৌনকর্মের জন্য হাজার হাজার নারী পাচার হচ্ছে।’ (সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক, ৭ জুন ২০০৬)
সুন্দরী প্রতিযোগিতা
বিশ্বকাপ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয় মিস ওয়ার্ল্ডকাপ প্রতিযোগিতা। খেলায় অংশগ্রহণকারী দেশগুলো থেকে একজন করে সুন্দরী বাছাই করা হয়। এরপর তাদের মাঝে হয় চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা। যে নির্বাচিত হয় তাকে বিশ্বকাপের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এবং বেশ কিছু খেলার সময় প্রদর্শন করা হয়। (সূত্র : ইত্তেফাক, ৩ জুন ২০০৬)
জুয়া
বিশ্বকাপ উপলক্ষে জুয়ার মাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। ২০০৬ সালে শুধু ইংল্যান্ডে জুয়ার খাতে কী পরিমাণ অর্থের লেনদেন হয়েছিল তার একটি পরিসংখ্যান উল্লেখ করছি।
‘বিশ্বকাপে ডেভিড বেকহামের হেয়ার স্টাইল কী রকম হবে, গোল্ডেন বুট তার পায়ে শেষ পর্যন্ত উঠবে কি না-এ রকম অসংখ্য বিষয়কে সামনে নিয়ে আসে বৃটিশ বাজিকররা। আগে একটি ম্যাচে ম্যাচের আগে একবারই বাজি ধরার সুযোগ ছিল। এখন ঘরে বসে টেলিভিশনে খেলা দেখতে দেখতে অসংখ্যবার বাজি ধরা যায়। বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে ইংল্যান্ডের বাজিকর হাউসগুলোর ব্যবসা রমরমা হয়ে ওঠে। ২০০৬ সালে এই খাতে বাজির লেনদেন ছিল ৭০০ কোটি পাউন্ড। (সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক, ১ জুন ২০০৬)
ইংল্যান্ডের মতো ব্যাংককেও বাজির ব্যবসা রমরমা। এদেশে বৈধ লাইসেন্সপ্রাপ্ত বাজিকর প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি অবৈধ বাজিকরও রয়েছে। গত আসরে ফাইনালের বাজি ধরা হয়েছিল ৫০ থেকে ৬০ বিলিয়ন হংকং ডলার। (সূত্র : ইত্তেফাক, ৭ জুন ২০০৬)
মদ্যপান
খেলা উপলক্ষে মদ্যপান বেড়ে যাওয়া তো অনিবার্য। এমনকি আগে থেকেই হিসাব করে বলে দেওয়া এবার কী পরিমাণ মদ্যপান করা হবে। একটি দৈনিকে গত আসরের মদ্যপান সম্পর্কে অনুমান করা হয়েছিল এ রকম-‘বিশ্বকাপ চলাকালে সমর্থকরা অতিরিক্ত ৮০ মিলিয়ন পাইন্টস (১পাইন্ট সমান ১০ আউন্স) বিয়ার খাবেন।’ (প্রথম আলো)
মদের এই অতিরিক্ত চাহিদার কারণে ফিফাও হাত মেলায় মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে। ফিফার অর্থ উপার্জনের এটি অন্যতম খাত। গত আসরে ফিফার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল যে, ফিফার এক অঙ্গে দুই রূপ। একদিকে তারা নেশা করতে নিষেধ করেছে, অন্যদিকে হাত মিলিয়েছে মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। বৃটেনের চিকিৎসা বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘দ্যা ল্যাঙ্কেট’’ বলেছিল, ফিফার অফিসিয়াল পার্টনারশিপ হিসাবে যে মদ পরিবেশন করা হচ্ছে তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর! (ইত্তেফাক, ১৭ জুন ২০০৬)
বিশ্বকাপের ক্ষতিকর দিকগুলি নিয়ে পত্রপত্রিকার আলোচনা
এ বিষয়ে পত্রপত্রিকায় খুব কমই লেখা হয়। এ লেখাটি তৈরি করতে গিয়ে একাধিক পত্রিকা ঘেটেছি। বিশেষ করে বদলে যাওয়ার, বদলে দেওয়ার শ্লোগানধারী একটি দৈনিকের জুন ২০০৬ এর প্রতিটি সংখ্যা এবং জুলাই ২০০৬-এরও অধিকাংশ সংখ্যায় নজর বুলিয়েছি। রিপোর্ট আকারে দু’একটি বিষয় পাওয়া গেলেও, যা এই প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্বকাপের ক্ষতির দিকগুলো সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াস চোখে পড়েনি। এমনকি খেলা উপলক্ষে বুয়েট বন্ধের প্রতিবাদে বুয়েটের একজন শিক্ষকের লেখাটিও ছাপা হয়েছে পাঠকের কলামে। এই হল দিন বদলে বিশ্বাসী পত্রিকার অবস্থা।
আরো আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এ দেশে বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের মাঝে ‘জাগ্রত বিবেকে’র অভাব নেই। বিশেষ বিশেষ সময়ে তাঁদের বাকশক্তি ও বাক্যশক্তিরও পরিচয় পাওয়া যায় কিন্তু তারাও বিশ্বকাপের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে মুখ খুলতে নারাজ। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই সন্দেহ জাগে যে, দিন বদলের শ্লোগান যারা দেয় এবং মুক্ত বুদ্ধিচর্চার উপদেশ যারা খয়রাত করে তাদের এই সব শ্লোগান-উপদেশও সম্ভবত উদ্দেশ্যপূর্ণ।বস্তুত পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার এজেন্ডা বাস্তবায়নই এদের সবার সর্বশেষ লক্ষ্য। তাই ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করুন, উন্মাদনার জোয়ারে ভেসে যাওয়া আদৌ আপনার পক্ষে লাভজনক কি না।