অচিন দ্বীপের সেই হীরা
রাতের খাবার পর্ব শেষ।
উঠোনে চেয়ার ফেলে বসল মামা মিকদাদ।
সাথে ভাগ্নে ইয়ায।
হেমন্তকাল। না শীত, না গরম। আকাশে নরম নরম জোছনা। সব মিলিয়ে চমৎকার এক রাত্রি। এমন সুন্দর রাতে গল্প শোনার মজাই আলাদা।
ইয়াযের বয়স দশ। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। মামা পড়ে নবম শ্রেণিতে। দু’জনের গলায় গলায় ভাব। মামা ছুটি পেলেই আসে। প্রতিবারই গল্পের আবদার করে ইয়ায। আজও আহ্লাদে গলায় বলল-
: মামা, একটা গল্প বলনা- না-রে, আজ কোনো গপসপ হবে না। খাসা একটা ঘুম হবে। বলে আড়চোখে ইয়াযের দিকে তাকায়।
: সত্যিই বলবে না?
: না।
মুখটাকে বেলুনের মতো ফুলিয়ে ইয়ায অভিমানী সুরে বলল, তাহলে তোমার সাথে আর কথাই বলব না, এই যে বলে দিলাম।
মামা হেসে বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে, বলছি।
তা কিসের গল্প শুনবি, ভূতের নাকি রাজা-রাণীর?
: ভূতেরটা বল।
: ভূতের গল্প শুনে নাকি ঘুমের মধ্যে ‘ভূত ভূ-ত’ বলে হুলুস্থূল কা- ঘটিয়ে ফেলিস?
ইয়ায মাথা চুলকে আমতা আমতা করে বলল, ওটা তো মাঝেমধ্যে, সব সময় না!
: শোন তাহলে আজ একটা সত্যি ঘটনা বলি।
: সত্যি ঘটনা?
: হাঁ, একেবারে সত্যি। আর খুবই চমৎকার। শুনবি?
একটু ভেবে মুখে সতর্ক হাসি ছড়িয়ে ইয়ায বলল, ভালো না হলে কিন্তু আরেকটা বলতে হবে। মনে থাকে যেন!
মামা হেসে দিল, এরপর বলা শুরু করল :
আজ মুহাম্মাদের বিবাহ হয়েছে। অনুষ্ঠানপর্ব শেষে বর-কনে ঘরে গেল। স্ত্রীর দিকে তাকিয়েই মুহাম্মাদ তো অবাক! সে স্ত্রীর দিকে তাকায়নি, তাকিয়ে রয়েছে তার গলার হারের দিকে। তাকিয়েই রইল অপলক দৃষ্টিতে। উত্তেজনায় চিকচিক করছে তার চোখ। মুখে কোনো কথাই আসছে না।
: মামা, কোন্ মুহাম্মাদ? আগা-মাথা না বুঝে জিজ্ঞেস করল ইয়ায।
: সবুর, সবুর! এত তাড়াহুড়ো করছিস কেন? সবই আসছে সামনে।
যে সময়ের কথা বলছি, তা পাঁচ শ হিজরী সনের কথা। বাগদাদের এক যুবক। নাম কাজী আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল বাক্বী। সংক্ষেপে মুহাম্মাদ।
কাজী বললাম, কারণ ইনি মারস্তানের বিচারক ছিলেন। বিখ্যাত কাজী। জন্ম ৪৪২ হিজরী সালে। বহুমুখী প্রতিভা ছিল তাঁর। ইসলামের প্রত্যেকটা বিদ্যায় ছিল অসাধারণ পাণ্ডিত্য। বিশেষ করে হাদীসশাস্ত্রে ছিল আলাদা মর্যাদা। সেই মর্যাদা বোঝাতে লোকে বলত হাফেজে হাদীস। দেখতে ছিলেন চাঁদ-সুন্দর। স্বল্পভাষী। মিষ্টি-কণ্ঠ। লোকে বলতো তাঁর মতো এমন চরিত্রে সুন্দর, আলাপে মধুর ব্যক্তি এই দেশে দ্বিতীয়জন নেই। সময় নষ্ট করতেন না মোটেই। কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত থাকতেন সবসময়। লিখতেও পারতেন ভালো। হাতের লেখাও ছিল খুব সুন্দর। এই গুণী মানুষটিরই জীবনে ঘটে যাওয়া এক আশ্চর্য ঘটনা এখন তোকে বলছি-
তখন তিনি তরুণ। অভাবের সংসার। অসহ্য ক্ষুধা কামড়ে ধরেছে পেট। ঘরে খাবার নেই আজ তিন দিন। প্রচ- ক্ষুধায় চারদিকে যেন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। কাজের খোঁজে বাজারের পথ ধরে এলোমেলো হাঁটছেন।
ইয়ায ভেজা গলায় বলে উঠল ,ইস, সে যুগে এত অভাব ছিল? অথচ আমরা তিন বেলা পেটপুরে খেয়ে হেসে-খেলে কত শান্তিতে আছি! আল্লাহ্র প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতায় তার দু’চোখ ভিজে ওঠে।
মামা বলল-
আনমনে হাঁটছিল মুহাম্মাদ। হঠাৎ রাস্তার পাশে একটি পুঁটলি দেখে থমকে দাঁড়াল। চকচক করে উঠল ক্ষুধার্ত চোখ। চারদিকে তাকাল। কাউকে না দেখে তীক্ষèভাবে চেয়ে রইল পুঁটলিটার দিকে। দ্বিধা-দ্বন্দে ভুগছে। ‘ধরি কি ধরি না, উঠাই কি উঠাই না’ করছে। শেষে উঠাল পুঁটলিটা। কী আছে ভেতরে? অসম্ভব কৌতুহল নিয়ে সেটা খুলল। ও মা, এ কী! প্রচ- ঝাঁকুনি খেল মনে। ভেতরে অসাধারণ একটা জিনিস। প্রচ- উত্তেজনায় টগবগ করছে মুহাম্মাদ। বহু কষ্টে স্বাভাবিক হল সে। চুপিচুপি বাড়িতে নিয়ে এল পুঁটলিটি।
কবুতরের খোপের মতো ছোট্ট ঝুপড়িঘর। আলগোছে সামলে রাখল সেই ঘরে। তার আগে খিল লাগাল। এরপর পুঁটলিটি খুলে বের করে আনল একটি অসম্ভব উজ্জ্বল হার। রীতিমত ধাঁধিয়ে উঠল তার চোখ। স্বর্ণের নয়। হীরার। লক্ষ দিরহাম না হয়েই যায় না এর দাম।
হীরার কথা শুনে ইয়ায খুশিতে লাফিয়ে উঠে বলল, হুর-রে, হিপ্ হিপ্, একচান্সে কোটিপতি। একেই বলে কপাল। সকাল বেলার ফকিররে তুই ধনী সন্ধ্যাবেলা।
মামা বলতে লাগল-
মুহাম্মাদ আবার বাজারের পথ ধরল। ক্ষুধার অনুভূতি উবে গেছে তার। এ পথে-সে পথে ঘুরছে।
দুপুর গড়িয়ে বিকাল যাই যাই করছে। গোধুলির আবির রঙ ছড়িয়ে পড়েছে, বাগদাদের প্রতিটি পথ-প্রান্তরে।
শীতকাল। তাই বেলা নামতেই বাজার হর হর করে খালি হয়ে গেছে। সে দেশে বেজায় শীত।
একজন বৃদ্ধ অস্থিরভাবে কেবল রাস্তার এ মাথা ও মাথা করছে। কপালে চিন্তার ভাঁজ। চোখে অশ্রুর ধারা। পাগড়ির খুঁট দিয়ে চোখ মুছছে বারবার। আর ঘোষণা করছে- যে আমার হারটি ফেরত দেবে, তাকে পাঁচ শ দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) পুরস্কার দেয়া হবে।
কাছে গিয়ে মুহাম্মাদ ফিসফিস করে বৃদ্ধকে কী যেন বলল। এরপর তাকে ঘরে নিয়ে এল। পুঁটলিটার হাল-হকিকত জিজ্ঞেস করে ফেরৎ দিয়ে দিল হীরার হার। বৃদ্ধ তো খুশিতে বাগবাগ। তরুণ ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আনন্দে কেঁদেই ফেলল সে।
: অ্যাঁ-! বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে গেল ইয়াযের- পুঁটলিটা তাহলে দিয়ই দিল। মামা বললেন,
বৃদ্ধ এবার পাঁচ শ দিরহামের থলেটা এগিয়ে ধরল তার দিকে- পুরস্কার স্বরূপ।
মুহাম্মাদ বলল, না, আমি এটা নিব না। ওটা ফিরিয়ে দেওয়া তো আমার দায়িত্ব ছিল। আর আমি তা ফিরিয়ে দিয়েছি দিরহামের জন্য নয়, আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য। (যদিও এখন এই অভাবের মুহূর্তে এ দিরহামগুলো তার খুব প্রয়োজন ছিল)। বৃদ্ধ অনেক জোর করল, কিন্তু কিছুতেই সে রাজি হল না।
ইয়াযের মুখে কথা নেই; হারটিও ফিরিয়ে দিল আবার এই অভাবের সময় দিরহামও নিল না।
এই ঘটনায় ইয়াযের মনে মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল বাক্বীর প্রতি আলাদা একটা শ্রদ্ধা জেগে উঠেছে। ভাবছে অভাবের সংসার। ক্ষুধার্ত পেট। এমন অবস্থায় এমন সততা? এ শুধু আল্লাহ্র ভয় থাকলেই সম্ভব।
মামা আবার শুরু করে-
কয়েক বছর পরের কথা। মুহাম্মাদ এখন জাহাজে। যাচ্ছে দূরদেশে। চারদিকে পানি আর পানি। হঠাৎ কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেল। সাগরের বুকে শোঁ শোঁ শব্দে বাতাসের সে কী গর্জন! বড় বড় উথাল-পাথাল ঢেউ। ঢেউয়ের সাথে লড়তে লড়তে একসময় জাহাজ ভেঙে দুই টুকরা হয়ে গেল। তলিয়ে গেল সাগর তলে।
অস্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল ইয়ায- মামা, মুহাম্মাদও কি মারা গেল?
মামা কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইল। এরপর বলতে লাগল- মুহাম্মাদ এসে একটি মসজিদে বসল। কোনো এক দ্বীপের মসজিদ। জাহাজ ডুবে গেলেও কাঠের একটি বড় পাটাতনে উঠতে পেরেছিল সে। তারপর কয়েকদিন সাগরের বুকে ভাসতে ভাসতে এই দ্বীপে এসে ঠেকেছে।
ইয়ায খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, যাক, তাহলে বেঁচে আছে মুহাম্মদ। আমি তো ভেবেছিলাম...।
মামা বলে চলল-
অপরিচিত এক আলেমের আগমন, বিষয়টি পাঁচকান হয়ে ছড়িয়ে পড়ল দ্বীপবাসীর ঘরে ঘরে। তাঁর কুরআন তিলাওয়াত, চেহারা-সুরত এবং আচরণ-উচ্চারণ দেখে সবাই যারপরনাই মুগ্ধ। তিনি যেন এই মসজিদে থেকে যান, ইমামতি করেন ও দ্বীপের বাচ্চাদের দ্বীন শিক্ষা দেন এই আবেদন সবার।
এভাবে দেখতে দেখতে কেটে গেল অনেক দিন। একদিন দ্বীপবাসী অনেক বলে কয়ে তার বিয়ে দিয়ে দিল। মেয়েটি যেমন অসম্ভব সুন্দরী। তেমনি গুণবতী। অঢেল সম্পদের মালিক। দ্বীনদারী ছিল তারচেও অনে-ক বেশি। স্বামী-স্ত্রী দ্বীনদার হলে নাকি সংসারে সুখ আসে। তবে মেয়েটির মা-বাবা বলতে কে-উ নেই। প্রতিবেশীরাই এখন তার সব।
আকাশে ফকফকা জোছনা। দ্বীপ জুড়ে বইছে সাগরের নির্মল-শীতল হাওয়া। প্রকৃতির মাঝে বিরাজ করছে ভিন্ন খুশির আমেজ। লজ্জা লজ্জা পায়ে নববধূ এল মুহাম্মাদের ঘরে। প্রতিবেশীরা নিয়ে এসেছে তাকে। মেয়েটি লজ্জায় একেবারে গুটিসুটি মেরে বসে আছে।
মুহাম্মাদ কাছে গেল। কিন্তু এ কী? তার বিস্ফারিত চোখ আটকে গেল মেয়েটির গলায়। বিস্ময়ে চোখ তার ছানাবড়া। এযে সেই হার, যা সে কুড়িয়ে পেয়েছিল বাগদাদের বাজারে। কিন্তু এখানে ওর গলায় এল কী করে? হিসাব মেলাতে পারে না সে।
মুহাম্মাদের বিস্ময় দেখে মেয়েটি গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তাহলে ইনিই কি সেই ছেলে, যার প্রশংসায় আব্বু মৃত্যু পর্যন্ত পঞ্চমুখ ছিলেন। যার সাথে আমার বিয়ের জন্যে তাহাজ্জুদের জায়নামাযে দুআ করতেন। আসলে মুমিনের কোনো দুআ-ই ব্যর্থ হয় না। খুশিতে তার ভেতরটা ভরে হয়ে উঠল। দুচোখ ছাপিয়ে ঝরতে লাগল আনন্দের অশ্রু।
মামা থামলেন। মুখে একরাশ তৃপ্তির হাসি। বললেন- এই হল সততার পুরস্কার।
ইয়ায মোহাবিস্টের মতো তাকিয়ে আছে। এরপর নিজের অজান্তেই বলে উঠল মামা, তারপর?
: তারপর আমার গল্পটি ফুরল, নটে গাছটি মুড়ল...।