মহীয়সী নারীদের জীবনকথা
। এক।
আল্লামা আলাউদ্দীন সমরকান্দী (মৃত্যু ৫৪০ হি.) হানাফী মাযহাবের একজন প্রসিদ্ধ বিদ্বান। হানাফী মাযহাবের উলামায়ে কেরামের মাঝে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ও অগ্রগামিতা অনস্বীকার্য। মাযহাবের ক্ষেত্রে তাঁর মতামত সকলের নিকট প্রামাণ্য। তাঁর রচিত ‘তুহফাতুল ফুকাহা’ ফিকহে হানাফীর এক প্রাঞ্জল কিতাব এবং অনেক কিতাব থেকে অগ্রগণ্য ও সবার নিকট নির্ভরযোগ্য।
এ গ্রন্থটির ব্যখ্যাগ্রন্থ রচনা করেন তাঁরই একান্ত শাগরিদ, কাসান অঞ্চলের অধিবাসী আল্লামা আবু বকর কাসানী রাহ. (মৃত্যু ৫৮৭) যাকে তার যোগ্যতা ও পাণ্ডিত্যের জন্য ‘মালিকুল উলামা’-আলেমদের রাজা বলা হয়। এ ব্যখ্যাগ্রন্থের নাম ‘বাদায়েউস সানায়ে’। এটিও এত শক্তিশালী এক রচনা যে, পুরো ফিক্হ-ফতোয়ার জগতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। ফতোয়ার জগতে কোনো মুফতী তা থেকে বে-নিয়ায হতে পারে না। রচনাশৈলীও অত্যন্ত চমৎকার। আল্লামা শামী এ গ্রন্থ সম্পর্কে বলেন, এটি অতি উঁচু মানের কিতাব, ফিকহে হানাফীতে এর কোনো উপমা আমি দেখি না।
এ মালিকুল উলামা আল্লামা কাসানী হলেন আল্লামা সামারকান্দীর জামাতা। আল্লামা সামারকান্দীর এক মেয়ের নাম ফাতিমা, পিতা সামারকান্দি শুরু থেকেই মেয়েকে এমনভাবে গড়ে তুলেন যে, বড় হয়ে তিনি বড় আলেমা, মুহাদ্দিস, ফকীহ ও মুফতী হন। হাতের লেখা বেশ সুন্দর ছিল। বড় হয়ে তিনি নিজেকে পাঠদানেও নিয়োজিত করেন। তার থেকে অনেক মানুষ ইলম শেখে। সাথে সাথে লেখালেখিও চালিয়ে যান। হাদীস ও ফিকহ বিষয়ে বিভিন্ন গ্রন্থও রচনা করেন। ইলম ও প্রজ্ঞার ক্ষেত্রে এমন শীর্ষে পৌছেন যে, স্বয়ং সমকালীন সুলতান, ন্যায়পরায়ণতা ও ইসলামের খেদমতে সুপ্রসিদ্ধ বাদশাহ নূরুদ্দীন ঝাংকীও রাষ্ট্রীয় বিষয়ে তার থেকে বিভিন্ন সময় পরামর্শ গ্রহণ করতেন এবং মাসআলা-মাসায়েলও জেনে নিতেন।
হানাফী মাযহাব সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল অগাধ। ঐতিহাসিকগণ লেখেন, তিনি খুব সহীহভাবে মাযহাব বর্ণনা করতেন।
ফতোয়াদানের ক্ষেত্রেও ছিল তার বিশাল পাণ্ডিত্য। তার পিতা ছিলেন সমকালীন বড় মুফতী। তার নিকট হাজারো মানুষের প্রশ্ন আসতেই থাকত। এসব প্রশ্ন তিনি মেয়েকে দিয়ে দিতেন। মেয়ে সেগুলোর সমাধান বের করে জবাব লিখে পিতার নিকট পেশ করত। পিতা তা দেখে দিয়ে নিজেও দস্তখত করে দিতেন, সাথে মেয়েরও দস্তখত থাকত। এভাবে প্রতিটি ফতোয়া পিতা-কন্যা উভয়ের দস্তখতে বের হত। এটা হল কন্যার বিবাহের আগের কথা। বিবাহের পরও তিনি এসব খেদমত চালিয়ে যান। এবং জামাতাও এদের সাথে ফতোয়ার কাজে যোগ দেন। তখন থেকে তিনজনের দস্তখতেই প্রতিটি ফতোয়া বের হত। ফিকহ-ফতোয়ার ক্ষেত্রে এ মহান নারী এতই পা-িত্য অর্জন করেন যে , স্বয়ং স্বামী আলেমদের রাজা হওয়া সত্ত্বেও কখনো কখনো তার ভুল ধরে দিতেন। আর স্বামীও তা মেনে নিতেন। এসবের জন্য স্বামীও তাকে খুব সম্মান করতেন ও ভালোবাসতেন।
তার বিবাহের ঘটনাও চিত্তাকর্ষক। কন্যার এমন যোগ্যতা দেখে তৎকালীন রাজা-বাদশাহদের অনেকে তাদের পুত্রের জন্য পিতার নিকট প্রস্তাব পেশ করতে লাগল। পিতা এদের কারো প্রস্তাবে সাড়া দেননি। পিতার ছাত্রদের মধ্যে কাসান অধিবাসী এক ছাত্র ছিল। সে পিতার সাথে পড়াশোনায় একেবারে মিশে গেল এবং পড়াশোনায় এতই অগ্রগামী হল যে, ফিকহ, হাদীস, উসূল, ফতোয়া প্রভৃতি বিষয়ে পণ্ডিতে পরিণত হল।
একসময় এ ছাত্র শায়েখের কিতাব ‘তুহফাতুল ফুকাহা’-এর ব্যখ্যাগ্রন্থ রচনা করেন এবং তা শায়েখের নিকট পেশ করেন। নাম দিলেন ‘বাদায়েউস সানায়ে’। শায়েখ তা দেখে খুব খুশি হলেন, স্বীয় কন্যাকে তার নিকট বিবাহ দিয়ে দিলেন। এবং এই কিতাবকেই মহর ধার্য করলেন।
তথ্যসূত্র : আলজাওয়াহিরুল মুদিয়্যা, মিফতাহুস সাআদাহ, আদদুররুল মানসূর
। দুই।
ইলমী দুনিয়ায় ইমাম আবুল হাজ্জাজ মিয্যীকে চেনে না এমন মানুষ কমই আছে। কেননা যিনি আপন কর্ম ও কীর্তিতে ভাস্বর তাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। হাফেয যাহাবী, হাফেয ইবনে হাজার আসকালানীকে চেনে না এমন কে আছে। ইমাম মিয্যী এঁদের থেকেও বড়। নাহু, সরফ, আরবীভাষা ও সাহিত্য, ফিকহ, হাদীস, রিজালসহ অনেক শাস্ত্রের বিদগ্ধ পণ্ডিত। অবশ্য বেশি সময় ব্যয় করেছেন হাদীস ও রিজাল শাস্ত্রে। রাত-দিন ছাত্রদের পড়ানো এবং লেখালেখিতেই কাটাতেন। বর্তমানে রিজাল শাস্ত্র তো অনেকটা তাঁর কিতাবের সহায়তায়ই চলে। ১৫ খণ্ডে “তুহফাতুল আশরাফ” সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এক নিখুঁত ও শ্রেষ্ঠ কিতাব। ইমাম যাহাবী তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘তাযকিরাতুল হুফ্ফায”-এ ইমাম মিয্যী সম্পর্কে লেখেন, তার যুগের মানুষ তার মত কাউকে দেখেনি। ইমাম সুবকী বলেন, তিনি স্বীয় যুগের বিস্ময় । ইবনু সায়্যিদিন নাস বলেন, তিনি তাঁর শাস্ত্রের উত্তাল সমুদ্র।
তেমনিভাবে হাফেয ইবনে কাসীরও ইলমী জগতে আরেক ভাস্বর ব্যক্তিত্ব।
কুরআন, হাদীস, তাফসীর, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর বুৎপত্তি দুনিয়া জোড়া খ্যাত। তাঁর তাফসীরগ্রন্থ তাফসীরুল কুরআনিল আযীম যা তাফসীরে ইবনে কাসীর নামে অধিক প্রসিদ্ধ সেটি তো প্রায় সকল আলেম ও অনেক শিক্ষিতজনেরা পড়ে থাকেন। ইতিহাস নিয়ে লেখা ‘আলবিদায়া ওয়াননিহায়া’ তো সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এক অনবদ্য গ্রন্থ। হাফেয যাহাবী ইবনে কাসীর সম্পর্কে বলেন, “তিনি ইমাম, মুফতী, বিদগ্ধ মুহাদ্দিস, ফকীহ ও মুফাস্সির। অনেক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের রচয়িতা”। হাফেয ইবনে হাজার বলেন, তার জীবদ্দশাতেই তার গ্রন্থগুলো বিশ্বময় সমাদৃত হয়। তার মৃত্যুর পরও মানুষ তা থেকে উপকৃত হয়ে চলেছে।
এ বিদগ্ধ মনীষী হলেন পূর্বোক্ত হাফেয মিয্যীর জামাতা। ইমাম মিয্যীর মেয়ে যায়নাবকে তিনি বিবাহ করেন। ইমাম মিয্যীর স্ত্রী আয়েশা বিনতে ইবরাহীম হলেন ইবনে কাসীরের শাশুড়ী।
আয়েশাও ছিলেন ইলম, আমল, ইবাদাত-বন্দেগী, উত্তম চরিত্র, দুনিয়া বিমুখতা ও দ্বীনী খেদমতে এক মহান ব্যক্তিত্ব। বরং তার অনেক গুণাবলি হাজার পুরুষকেও ছাড়িয়ে যায়। তিনি যেমন বড় মুহাদ্দিসা ছিলেন তেমনিভাবে কুরআনের হাফেযাও ছিলেন এবং অনেক বড় কারীয়াও ছিলেন। কুরআন শরীফ তাজবীদ ও ফাসাহাত-বালাগাত অনুসারে এত সুন্দর করে পড়তেন, যা অনেক পুরুষও পারে না। তিনি দিনভর নারীদের পড়াতেন। কাউকে হাদীস পড়াতেন, কাউকে কুরআন পড়াতেন। তার নিকট বহু নারী পড়ত।
এ বিদুষী নারীর জন্ম হয় ৬৬১ হিজরীতে। সমকালীন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণ থেকে হাদীসের পাঠ গ্রহণ করেন। এরপর শুরু হয় তার ইবাদাত-বন্দেগী, দুনিয়া বিমুখতা ও দ্বীনী খেদমতের সাধনার জীবন। তাঁর জামাতা হাফেয ইবনে কাসীর ৭৪১ হিজরী পহেলা জুমাদাল উলার ঘটনাবলির বর্ণনায় লিখেন, আজ ইন্তেকাল করেন নারীগুরু, আলেমা, কারীয়া, নেককার ইবাদাতগুযার, মহান মনীষী উম্মে ফাতেমা আয়েশা বিনতে ইবরাহীম। যিনি আমাদের শায়েখ হাফেয জামালুদ্দীন মিয্যী-এর সহধর্মিণী। তিনি ইবাদাত-বন্দেগী, কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদির ক্ষেত্রে ছিলেন যুগের উপমাহীন নারী। কুরআনে কারীম তাজবীদ ও ফাসাহাত-বালাগাতের সাথে এমন সুন্দর ও নিখুঁতভাবে পড়তে পারতেন, যা অনেক পুরুষের জন্যও সম্ভব হয় না। তার নিকট অনেক নারী কুরআন পড়েছেন এবং খতম করেছেন। তার সততা, পরহেযগারী, দুনিয়া বিমুখতা, অল্পেতুষ্টি ইত্যাদি সব গুণ দ্বারা নারীরা উপকৃত হত। তিনি দীর্ঘ আশি বছর হায়াত লাভ করেন। দুনিয়ার সাদাসিধা জিন্দেগীর উপর তুষ্ট থেকে পুরো জীবনটাই আল্লাহ্র কাজ ও নামায-তিলাওয়াতে ব্যয় করেন। এসবের জন্য শায়েখ (তার স্বামী ইমাম মিয্যী)ও তাকে খুব ভালবাসতেন, তার প্রতি দয়াদ্র ছিলেন এবং তার পাণ্ডিত্য ও বিচক্ষণতার কারণে তার মতের বিপরীত করতেন না।
তথ্যসূত্র : আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, আদদুরারুল কামিনা