শাওয়াল ১৪৩৯   ||   জুলাই ২০১৮

আমার মুহসিন কিতাব-৮

মাওলানা বদরুদ্দীন আলাভী রাহ.

[মাওলানা বদরুদ্দীন আলাভী রাহ. ১৩১০ হিজরী মুতাবেক ১৮৯৩ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের আলীগড়ে জন্মগ্রহণ করেন।

খান্দানীভাবে তিনি ছিলেন আলাভী। শুরু জীবনে ইংরেজি পড়াশোনা করেন। সেইসঙ্গে আরবী পড়াও শুরু করেন। ১৯১০ সালে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটিতে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে পরিপূর্ণভাবে আরবী পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেন। তিনি ছিলেন উস্তাযুল উলামা মাওলানা লুতফুল্লাহ আলীগড়ী রাহ.-এর শেষ সময়ের কৃতী ছাত্র।

তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় ১৯১৫ সালে এমএও কলেজ আলীগড়ের ল্যাটিন লাইব্রেরির আরবী ও ফারসী শাখার ইনচার্জ হিসেবে। ১৯২০-১৯২১ সালে তিনি মাদরাসায়ে লতীফিয়া আলীগড়ে শিক্ষকতা করেন। ১৯২১ সালেই মুসলিম ইউনিভার্সিটির ইন্টারমিডিয়েট কলেজে আরবীর শিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৯২৩ সালে মুসলিম ইউনিভার্সিটির আরবী শাখার লেকচারার নিযুক্ত হন। ১৯৫৪ সালে মুসলিম ইউনিভার্সিটির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি গ্রহণ করেন।

ইংরেজি ভাষায় তাঁর অনেক দক্ষতা ছিল। দেশ ভাগ হওয়ার আগে মুসলিম ইউনিভার্সিটির পাঠদান মাধ্যম ছিল ইংরেজি। সেখানে তিনি সাবলীলভাবে ইংরেজিতে লেকচার দিতেন। এছাড়া ইংরেজি, উর্দূ, আরবী তিন ভাষায়ই প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখতেন। এই তিন ভাষায়ই তাঁর রচনাবলী রয়েছে। তন্মধ্যে নি¤েœাক্ত কিতাবগুলো উল্লেখযোগ্য, শরহুল মুখতার মিন শি‘রি বাশশার (তাহকীক ও তালীক), কালামে লুতফ, উসতাযুল উলামা, এরাবিয়ান পয়েট্রি এ- পয়েটস। এছাড়া দেওয়ানে ইবনে দুরাইদ ও দেওয়ানে বাশশার কিতাব দুটিও তাঁর তাহকীকে মিসর ও বৈরুত থেকে প্রকাশিত হয়েছে।

১৭ মুহাররম ১৩৮৫ হিজরী/১৬ মে ১৯৬৫ সালে এই মনীষী আখেরাতের সফরে রওয়ানা হয়ে যান।

আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। -ফয়সাল আহমদ ভাটকালী]

আমার মরহুমা আম্মাজান ছিলেন এক মহীয়সী নারী। পরহেযগার আলেমা। আল্লাহ তাআলা তাঁকে প্রতিপালন ও শাসনের আশ্চর্য যোগ্যতা দান করেছিলেন। বড় হওয়ার পরও বাচ্চাদের তালীম তরবিয়তের সম্পর্ক আব্বাজানের সাথে ছিল না। সব বিষয় ন্যস্ত ছিল আম্মাজানে উপর।

প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী আমাকে প্রথমে কুরআন মাজীদ পড়ানো হয়। এরপর মৌলভী ইসমাঈল মিরাঠীর কিতাবগুলো শুরু হয়। সীরাত ও আরব ইতিহাসের আগ্রহ আম্মাজানই তৈরি করে দিয়েছিলেন। উর্দূ পড়া শেখার সঙ্গে সঙ্গেই সীরাতের এক বিরাট কিতাব ধরিয়ে দেওয়া হয়। নাম ‘শামসুত তাওয়ারীখ’। একজন কিতাব বিক্রেতা ফেরি করে এই কিতাব নিয়ে এলে আম্মা আমার জন্য সেটি সংগ্রহ করেন। এরপর যখন কিতাবটি মলাট লাগানোর জন্য দেওয়া হয়, আমার স্পষ্ট মনে আছে- কী অস্থির হয়ে আমি লোকটির ফিরে আসার অপেক্ষা করেছি। সেসময় আমার সমবয়সী এক চাচাত ভাই এসেছিল। তাগাদা দেওয়ার জন্য বারবার তাকে বাইন্ডারের কাছে পাঠিয়েছি। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর একসময় কিতাবটি আনা হয়! তখন কুরআন মাজীদের সবক ও দাওরের পর পুরো সময় ‘শামসুত তাওয়ারীখ’ পড়ার মধ্যেই কাটাতে শুরু করেছি। সেসময় আমার বয়স নয় দশ বছরের বেশি হবে না। তাই অনেক কথাই বুঝতে পারতাম না। তবু খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ে যেতাম। একপর্যায়ে কিতাবটি সমাপ্ত হল। এরপর শুরু হল আম্মাকে শোনানোর পালা!

মোটকথা কোনো না কোনো বাহানায় এই কিতাবের প্রতি মহব্বত প্রকাশ এবং এই কিতাব নিয়ে পড়ে থাকতে আমার ভালো লাগত। এই অবস্থা দেখে ভাইজান চাকরিতে চলে যাওয়ার পরও প্রত্যেক চিঠিতে প্রিয়জনদেরকে সালাম পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে এই কিতাবের উদ্দেশ্যেও সালাম পাঠাতেন।

সেসময় অমৃতসর থেকে ‘ওয়াকীল’ নামে (সাপ্তাহিক, পরবর্তীতে ত্রৈমাসিক) একটি পত্রিকা বের হত। তাতে মুসলিম বিশ্বের খবরাদি খুব গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হতো। আব্বা আমাকে সেই পত্রিকার গ্রাহক বানিয়ে দিলেন। একবার তাতে ‘শামসুত তাওয়ারীখে’র দ্বিতীয় খণ্ডের একটি বিজ্ঞাপন নজরে পড়ল। অর্ডার পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গেই কিতাবটি চলে এল। এই খ- ছিল হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-এর জীবনী নিয়ে। সেটি প্রথম খণ্ডের একতৃতীয়াংশের সমান। কয়েক দিনেই পড়ে ফেললাম। এবার কিছু লেখার আগ্রহ হল। তিলাওয়াত ও দাওরের জন্য আমার কাছে কুরআন মাজীদের যেই নুসখা ছিল তার হাশিয়ায় শাহ আবদুল কাদের রাহ.কৃত তরজমা ও তাফসীরে ইবনে আব্বাস রাযি.-এর উর্দূ অনুবাদ ছিল। আমি ঐ তাফসীরকে ভিন্ন কিতাব হিসাবে প্রস্তুত করতে শুরু করলাম। অল্পকিছু লেখা হল। এরপর ‘শামসুত তাওয়ারীখে’র সহায়তায় আরব ইতিহাস বিষয়ে লিখতে শুরু করলাম।

‘শামসুত তাওয়ারীখ’ দ্বিতীয় খণ্ডের সাথে মৌলভী আবদুর রহমান অমৃতসরীর ‘সফরনামায়ে বিলাদে ইসলামিয়া’ কিতাবটিও সংগ্রহ করা হয়েছিল। তাতে কনস্টান্টিনোপলের ইতিহাস পড়েছি। সেই সূত্রে মাওলানা শিবলী নোমানী রাহ.-এর সফরনামা (সফরনামায়ে রোম ও মিছ্র ও শাম) এর প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছে। তখন এ কিতাবটিও সংগ্রহ করা হয়। কিতাবটি খুবই সুন্দর এবং মুগ্ধকর।

সেসময় আমাকে ফারসী ও ইংরেজি পড়ানো হচ্ছিল। সেখান থেকেই পড়ানোর প্রতি আগ্রহ হয়। ফলে যেসব ছেলেরা আমার সঙ্গে খেলতে আসত আমি তাদেরকে নিচু একটা জায়গায় বসিয়ে নিজে বসতাম উঁচু জায়গায়। এরপর যেগুলো পড়ে এসেছি সেগুলো তাদেরকে পড়াতাম। সেখানেই (পরিবারের) এক খাদেম সাহেব আমার কাছে ‘তাওয়ারীখে হাবীবে ইলাহ’ কিতাবটি পড়েছেন।

আম্মা যে কিতাবগুলো নানার কাছে পড়েছিলেন তার মধ্যে ফারসী ভাষার নিয়ম-কানুন বিষয়ক একটি কিতাব ছিল ‘উসূলে আজীবা’ নামে। আমাকে এই কিতাব পড়ানো হয়নি। কিন্তু যখনই কিতাবটি দেখেছি খুব পছন্দ হয়েছে। তাই ছোট ভাইকে সেই কিতাব পড়িয়ে নিজের না পড়ার আফসোস দূর করেছি।

ফারসীর পর আরবী পড়ানো শুরু হল। তখন আমার নামে ‘আন-নদওয়া’ ও ‘আলবায়ান’ পত্রিকা দুটিও জারি করা হল। এরই মধ্যে মাওলানা শিবলী নোমানী রাহ.-এর অন্য রচনাগুলোও খুব আগ্রহের সঙ্গে পড়া হয়েছে।

এসময় ‘শামসুত তাওয়ারীখ’-এর তৃতীয় খ- ছাপা শুরু হয়েছে। প্রতি মাসে যেটুকু ছাপা হতো সেটুকু এসে যেত। এভাবে কয়েক বছরে কিতাবটি সমাপ্ত হয়ে পুরো কিতাব সংগ্রহে এল। চতুর্থ খ-ও এভাবে সংগ্রহ করা হল। কিন্তু আফসোসের বিষয় হল, প্রথম যে অংশটি আমার কাছে একসময় খুবই প্রিয় ছিল সেটি হাতছাড়া হয়ে গেল। মেহেরবান একজন ধার নিয়ে আর ফেরত দেননি।

আরবী পড়া শুরু করতেই বিভিন্ন ধরনের আরবী বাক্য তৈরি শুরু হল। যিনি পড়াতেন তিনি যদি কোনো অংশ ছেড়ে যেতেন আমি ছাড়তাম না। আরবী মশকের জন্য ‘ইরশাদুত তালাব’-এর সাহায্য নিতাম। মৌলভী আমজাদ আলী বিহারীর ‘আলইনতিখাবুল জাদীদ’ কিতাবটিও সেসময় প্রাথমিক স্তরগুলোতে খুব উপকারী সাব্যস্ত হয়েছে। এখনো প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য আমি সেই কিতাব পড়ার পরামর্শ দিই। আবদুর রহমান অমৃতসরীর লেখা ‘আরবী বোলচাল’ কিতাবটি আব্বা কিছুদিন আমাকে মশক করিয়েছেন। কিন্তু এই মশক বেশিদিন অব্যাহত থাকেনি। এটা সেই সময়ের কথা যখন আমি মাধ্যমিক স্তরের আরবী পড়ছি।

এইসময় উসতাযুল উলামা (মাওলানা লুতফুল্লাহ আলীগড়ী রাহ.)-এর খেদমতে আমাকে সোপর্দ করা হল। তার কাছে সর্বপ্রথম পড়লাম মাইবুযী। তাঁর বরকতময় সান্নিধ্যে যে কিতাবই পড়া হয়েছে আমার জন্য সেটি খুবই উপকারী এবং মুহসিন সাব্যস্ত হয়েছে। এরমধ্যে দরসে নেযামীর কিতাব ছাড়াও বহু কিতাব ছিল। সেগুলো এত আনন্দ নিয়ে পড়া হয়েছে যে, একটি শুরু হলে অন্যটির দিকে  তাকাতেও মন চাইত না। এগুলোর সঙ্গে আরবী সাহিত্যের কিছু কিতাব পড়া এবং আরবী হাতের লেখার অনুশীলনও অব্যাহত ছিল। সেইসঙ্গে কয়েকটি আরবী পুস্তিকাও রচনা করা হয়েছে।

আরবীর সাথে সাথে ইংরেজি পড়াও কিছুদিন চলল। ১৯১০ সালে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটিতে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, পাশ করলে কলেজে ভর্তি হব। কিন্তু আল্লাহ্র ফায়সালা ছিল ভিন্ন। পরীক্ষায় পাশ করতে পারলাম না। ফলে ইংরেজি পড়া একরকম বন্ধ হয়ে গেল। পুরো সময় তখন কাটতে থাকল আরবী পড়ার মধ্যে। তবে আব্বাজান কখনো ইংরেজিতে কোনো কিছু ‘ইমলা’ করাতেন (অর্থাৎ তিনি যা মুখে বলতেন আমি তাই লিখতাম), ব্যস এতটুকুই।

১৯২১ সালে ইন্টারমেডিয়েট কলেজে আরবী শিক্ষক হিসেবে আমার নিয়োগ হল। প্রথম বছর দরসে উর্দূতেই তরজমা করতাম। কিন্তু ছাত্ররা ইংরেজি অনুবাদ করার জন্য আবেদন করল। তখন ইংরেজি ভাষা ও ব্যাকরণ মুতালাআ করা আবশ্যক হয়ে পড়ল। মোটকথা, ছুটে যাওয়া ইংরেজি আবার ফিরে এল। দ্বিতীয় বছর থেকে ইংরেজিতেই দরস করানো শুরু করলাম। ইংরেজিতে ‘নিকোলসন’-এর লিটারেরী হিস্ট্রি, ‘চার্লস লাইল’-এর এরাবিয়ান পয়েট্রি ও মুকাদ্দামায়ে মুফাদদালিয়াত, ‘ক্লাউসটন’-এর এরাবিয়ান পয়েট্রি এবং ‘ক্লেমেন হার্ট’-এর এরাবিক লিটারেচর ইত্যাদি বই থেকে সেসময় অনেক উপকৃত হয়েছি। আগেই বলেছি, আমার আরবী লেখালেখি অব্যাহত ছিল। সেই সূত্রে ইন্টারমেডিয়েটে থাকাকালে মিসর ও শামের বিভিন্ন পত্রিকায় আমার আরবী প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছেপেছে। একসময় রচনা ও লেখালেখির এই আগ্রহ আমাকে ইবনে দুরাইদ ও বাশশার-এর কিতাবাদির উপর কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করল। এই কাজগুলোর একটি অংশ মিসর থেকে প্রকাশিত হয়েছে (‘শরহুল মুখতার’ নামে)। এই সময় বন্ধুবর মাওলানা আবদুল আযীয মাইমানের -ছোট তবে দুর্লভ- সংগ্রহশালা ব্যবহার করেছি। এর প্রতিটি কিতাবই আমার জন্য মুহসিন হয়েছে। সেইসব কিতাবের একটি সূচি সংযুক্ত হয়েছে ‘শরহুল মুখতার’ কিতাবে।

এগুলো ছাড়া আমার মুহসিন কিতাবের তালিকায় আরো যে কিতাবগুলোর নাম উল্লেখ করা আবশ্যক মনে করি সেগুলো হলো,

তাফসীর শাস্ত্রে- খাযেন, হাশিয়ায়ে জামাল।

শরহুল হাদীসে- ফাতহুল বারী, উমদাতুল কারী, লামাআতুত তানকীহ, মিরকাতুল মাফাতীহ।

রিজাল শাস্ত্রে- তাহযীবুত তাহযীব।

ফিকহ শাস্ত্রে- ফতহুল কাদীর, বিনায়াহ, ইনায়াহ।

অভিধানের মধ্যে- আলকামুসুল মুহীত।

কাব্যে- বিখ্যাত কবিদের দিওয়ানসমূহ।

গদ্যে- আবু আলী আলকালী এর ‘আলআমালী’ এবং মুবাররাদের ‘আলকামেল’।

তাসাওউফ সংক্রান্ত কিতাবাদির মধ্যে-  আখবারুল আখইয়ার (আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহ. রচিত) ও উসূলুল মাকসূদ (শাহ তুরাব আলী কলন্দর কাকূরী রচিত) ইত্যাদি।

অনুবাদ : তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব

 

 

advertisement