শাওয়াল ১৪৩৯   ||   জুলাই ২০১৮

‘দান করেছি লুকমানকে হিকমাহ...’ : হিকমাহ ও শোকরগোযারি

মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ

সূরা লুকমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে লুকমান আ.-এর উপদেশসমূহ বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাঁর এই প্রিয় বান্দার প্রজ্ঞাপূর্ণ কিছু কথা কুরআনে বর্ণনা করেছেন। যেন মানুষ তা গ্রহণ করে এবং উপকৃত হয়। এই অংশের কারণে এই সূরার নাম ‘সূরা লুকমান’।

কুরআন মাজীদের সূরার নামকরণের একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। এটা এখনকার প্রবন্ধ-নিবন্ধের শিরোনামের মত নয়। সাধারণত প্রবন্ধে-নিবন্ধে আলোচ্য বিষয়কে শিরোনাম করা হয়। কুরআন মাজীদে তা করা হয়নি। গবেষকদের মতে, কুরআন মাজীদের সূরা নামকরণ হয়েছে তৎকালীন আরবীয় রীতি অনুসারে। ঐ সময় আরবে কাব্য ও কাসীদার ব্যাপক চর্চা ছিল, তো কাসীদার নামকরণ হত কাসীদার বিশেষ কোনো শব্দ-শব্দবন্ধ দ্বারা, যে শব্দটি শোনামাত্র গোটা কাসীদা মনে পড়ে যায়।

সারকথা কুরআন মাজীদের সূরার নামকরণ হয়েছে ঐ সূরার বিশেষ কোনো অংশ দ্বারা,  যে অংশটি উচ্চারণ করামাত্র সূরাটি স্মৃতিতে উপস্থিত হয়ে যায়। যেমন ধরুন, ‘সূরাতুল মাইদা’। এই নামকরণের অর্থ এই নয় যে, গোটা সূরায় মাইদা বা দস্তরখান সম্পর্কে আলোচনা হবে; বরং অর্থ হচ্ছে, এটি ঐ সূরা, যাতে মাইদা সংক্রান্ত বিখ্যাত ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে। হতে পারে সেটি সূরার ক্ষুদ্র একটি অংশ, কিন্তু এর দ্বারা সূরাটিকে চিনে নেওয়া যায়। তেমনি, সূরা আলে ইমরান। এই নামকরণের অর্থ এই নয় যে, গোটা সূরায় ইমরান পরিবার সম্পর্কে আলোচনা হবে; বরং অর্থ হচ্ছে, এই সূরায় ইমরান-পরিবারের ঘটনা আছে। তেমনি সূরাতুল বাকারা নামে নামকরণের অর্থ এই নয় যে, গোটা সূরায় বাকারা সংক্রান্ত বিধি-বিধান বর্ণিত হবে; বরং অর্থ হচ্ছে, এটি ঐ সূরা, যাতে বাকারা সংক্রান্ত ঘটনাটি আছে। ঠিক তেমনি সূরায়ে লুকমান অর্থ, এটি সেই সূরা, যাতে লুকমান হাকীমের কিছু উপদেশ বর্ণিত হয়েছে।

***

লুকমান হাকীমের নিবাস ও সময়কাল সম্পর্কে বিভিন্ন রকমের বর্ণনা পাওয়া যায়। এক বর্ণনায় আছে, তিনি ইয়ামানের অধিবাসী ছিলেন। হযরত হুদ আলাইহিস সালামের সমসাময়িক একজন নেককার আল্লাহর বান্দা ছিলেন। হযরত হুদ আ.-এর সাথে যে সকল ঈমানদার আল্লাহ্ পাকের আযাব থেকে নাজাত পেয়েছিলেন তিনি ছিলেন তাদেরই একজন।

কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, তিনি হাবাশার অধিবাসী একজন নেককার মানুষ ছিলেন, যেমন ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে- "كان عبدا حبشيا"

‘তিনি একজন হাবশী গোলাম ছিলেন।’ আবদুল্লাহ ইবনুয যুবাইর রা. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা.-কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন-

ما انتهى إليكم في شأن لقمان؟

লুকমান সম্পর্কে আপনারা কতটুকু জানেন?

তিনি উত্তরে বলেছেন-

كان قصيرا أفطس من النوية

তিনি ছিলেন নূবা-নিবাসী একজন খর্বকায় দীর্ঘ কানবিশিষ্ট  ব্যক্তি। -ইবনে কাসীর ৩/৪৮৮; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/১২৩

‘নূবা’ হচ্ছে মিসর অঞ্চলের দক্ষিণে অবস্থিত একটি জায়গা। মূলত তা সূদানের একটি পাহাড়। এই পাহাড় সংলগ্ন অঞ্চলটি নূবা অঞ্চল। (আল মুজামুল ওয়াসীত)

ইমাম আওযায়ী রাহ. বলেন, আমাকে আবদুর রহমান ইবনে হারমালা এই ঘটনা শুনিয়েছেন যে, একদিন সায়ীদ ইবনুল মুসায়্যিব রাহ.-এর কাছে এক কৃষ্ণাঙ্গ কিছু জিজ্ঞাসা করার জন্য এল। তিনি তাকে বললেন, তোমার গায়ের রংয়ের কারণে মনোকষ্টে ভুগো না; কারণ, তিনজন শ্রেষ্ঠ মানুষ ছিলেন (কালো) সুদানী : বিলাল রা., ওমর রা.-এর মাওলা মাহজা এবং লুকমান হাকীম, যিনি নূবা অঞ্চলের অধিবাসী একজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি ছিলেন। (যামাখশারী, কাশশাফ ৩/২৩১; কুরতুবী জামিউ আহকামিল কুরআন ১৪/৬০; ইবনে কাসীর, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/১২৪)

এই বর্ণনাগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে যে, লুকমান হাকীম ছিলেন একজন কালো হাবশী মানুষ। কিন্তু তাঁর বাণী ও উপদেশ বর্ণিত হয়েছে কুরআন মাজীদে । আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী কতই না সত্য-

إِنّ اللهَ لَا يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ، وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ

আল্লাহ তাআলা তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও রূপ-সৌন্দর্য দেখেন না। দেখেন তোমাদের কর্ম ও হৃদয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৬৪

কথিত আছে, তিনি দিনভর তাঁর মুনিবের জন্য কাঠ কাটতেন। একদিন এক লোক তার দিকে তাকিয়ে ছিল, হয়ত সে দৃষ্টিতে তাচ্ছিল্য ছিল; তিনি বললেন-

"إن كنت تراني غليظ الشفتين فإنه يخرج من بينهما كلام رقيق، وإن كنت تراني أسود فقلبي أبيض"

অর্থাৎ হে দর্শক! আমার ওষ্ঠদ্বয় মোটা দেখালেও তা থেকে নির্গত হয় সূক্ষ্ম বাণী। আর আমার গাত্রবর্ণ কালো দেখালেও আমার হৃদয়টি সাদা। মানুষের প্রকৃত মর্যাদাঈমান ও আমলের মাঝে। বাহ্যিক রূপ সৌন্দর্যের মাঝে নয়। -কাশশাফ ৩/২৩১

ঈমান-আমলের সাথে যদি বাইরের রূপ-সৌন্দর্যও থাকে তাহলে তো ‘নূরুন আলা নূর’-সোনায় সোহাগা। যেমন আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তাআলা দুটোই দিয়েছিলেন এবং ভরপুর দিয়েছিলেন। তবে যেখানে ভেতরের সৌন্দর্য ও বাইরের সৌন্দর্যের মাঝে কোনো একটিকে প্রাধান্য দিতে হয় সেখানে ভেতরের সৌন্দর্য তথা ঈমান-আমল, হুসনে আখলাকই প্রাধান্য পাবে।

যাইহোক, এই গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনার জন্য হযরত লুকমান হাকীমের কিছু অবস্থা আলোচনা করা হল। নতুবা কুরআনের শিক্ষা আলোচনার ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় ঐতিহাসিক তথ্যের পিছনে পড়ে যাওয়া উচিত নয়।

অনেক সময় নানা অপ্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি বিষয়ে মানুষ ফেঁসে যায় এবং কুরআনের মূল শিক্ষা থেকে গাফেল হয়ে পড়ে।

যেমন ধরুন, কেউ হয়ত সূরাতুল কাহ্ফের তাফসীর পড়ছে, সেখানে আসহাবুল কাহ্ফের বিবরণ আছে। এখন কিছু পাঠক আছে, যারা আসহাবুল কাহ্ফ কয়জন ছিল, তাদের নাম কী ছিল, তাদের বংশ-লতিকা কী ছিল, তাদের সঙ্গের কুকুরটির নাম কী ছিল, গায়ের রং কেমন ছিল ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, এগুলোর পিছনেই সময় ব্যয় করতে থাকে, এটা ঠিক নয়।

হাঁ, ঐতিহাসিক তথ্য যদি সহজেই পাওয়া যায় ভালো, কিছু তথ্য এমনও পাওয়া যায়, যেগুলোর দ্বারা ঈমান বাড়ে, সেগুলো ভালো; কিন্তু মনে রাখতে হবে, কুরআন যে জন্য নাযিল হয়েছে সেই শিক্ষার প্রতিই মনোনিবেশে সচেষ্ট থাকতে হবে এবং তা নিজের জীবনে বাস্তবায়িত করতে হবে। সেই শিক্ষা অনুসারে নিজের চিন্তা, বিশ^াস ও কর্মকে আলোকিত করতে হবে।

* * *

কুরআন মাজীদে লুকমান হাকীমের উপদেশসমূহ বর্ণনা করার একটি বিশেষ প্রাসঙ্গিকতাও রয়েছে, আরবে যুগ যুগ ধরে লুকমান হাকীম এক পরিচিত নাম। একজন জ্ঞানী মানুষ হিসাবে আরব সমাজে তিনি ছিলেন পরিচিত; তাঁর অনেক কথা প্রবাদের মতো প্রচলিত ছিল। অথচ তার সবচেয়ে বড় শিক্ষাই আরব জাতি বিস্মৃত হয়েছিল। কুরআন মাজীদ আরবদের সামনে তাঁর মূল শিক্ষাটি তুলে ধরেছে। এই উপস্থাপনার যুক্তিটি এই রকম যে, তোমরা যাকে চেন এবং যাকে জ্ঞানী বলে স্বীকার কর সেই মানুষটির মূল শিক্ষা থেকে  কেন তোমরা বিচ্যুত হয়ে পড়েছ? তোমরা লিপ্ত হয়েছ মূর্তিপূজায়। শিরক করছ আল্লাহ তাআলার সাথে। অথচ যে লুকমান হাকীমের কথা তোমরা বলে থাক, প্রবাদ-প্রবচনে যার জ্ঞানগর্ভ উক্তিসমূহ উদ্ধৃত করে থাকো সেই লুকমান হাকীম ছিলেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের একজন ‘মুওয়াহ্হিদ’ বান্দা। নিজেও শিরক থেকে বেঁচে ছিলেন, সংশ্লিষ্টদেরও তা থেকে বেঁচে থাকার তাকীদ করেছেন। আপন পুত্রকে তিনি যে নসীহত করেছেন তা লক্ষ কর এবং এর আলোকে নিজেদের বিশ^াস ও কর্মকে যাচাই কর। মূলত আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞতাই ছিল লুকমান হাকীমের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মূলকথা। লুকমান যেহেতু তোমাদের মাঝে স্বীকৃত, কাজেই তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মূল কথাগুলো তোমাদের গ্রহণ করা উচিত।

কুরআন মাজীদ বারবার ইবরাহীম আ.-এর বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করেছে। ঐসকল ঘটনাতেও প্রোজ্জ্বলভাবে এসেছে- তাওহীদ-প্রসঙ্গ। কেমন ছিল হযরত ইবরাহীম আ.-এর তাওহীদ-চেতনা, কেমন ছিল শিরকের প্রতি তাঁর ঘৃণা।  আপনজন ও সংশ্লিষ্টজনদের তাওহীদের উপর ওঠাবার ও শিরক থেকে মুক্ত করবার জন্য কেমন ছিল তাঁর আকুতি- কুরআন মাজীদে বিভিন্ন ঘটনায় এই বিষয়গুলো বারবার এসেছে। এতেও রয়েছে গভীর তাৎপর্য, অতি গুরুত্বপূর্ণ দাওয়াতী শিক্ষা। ইবরাহীম আ. ছিলেন আরবজাতির নিকট একজন সম্মানিত ব্যক্তি, আরবেরা নিজেদেরকে তাঁর বংশধর বলে গর্ব করত।

তাই কুরআন মাজীদ হযরত ইবরাহীম আ.-এর ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষা আরবজাতির সামনে উপস্থাপন করেছেন। ‘তোমরা যাকে অনুসরণীয় মনে কর, যাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়াকে গর্বের বিষয় মনে কর তাঁর আদর্শ ছিল তাওহীদ, তিনি ছিলেন একান্তভাবে আল্লাহ্-অভিমুখী বান্দা। তাহলে তোমাদের কি কর্তব্য নয় শিরক বর্জন করা ও তাওহীদ গ্রহণ করা। গায়রুল্লাহ অভিমুখিতা ত্যাগ করে আল্লাহ অভিমুখী হওয়া?

তো লুকমান হাকীমের বৃত্তান্ত কুরআন মাজীদে খুবই প্রাসঙ্গিক, কিয়ামত পর্যন্ত সবার জন্যই প্রাসঙ্গিক।

এমন মনে করার অবকাশ নেই যে, এখন যুগ অনেক অগ্রসর হয়ে গিয়েছে। জাহেলী যুগের মানুষ কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিল, নিজের হাতে মূর্তি বানিয়ে সেই মূর্তির পূজা করত; এখন তো বিজ্ঞানের যুগ, প্রগতির যুগ, মুক্তচিন্তার যুগ, এখন মানুষ চিন্তা-চেতনায়, মন-মননে, বিজ্ঞান-মনষ্ককতায় অনেক অগ্রসর; কাজেই এখন লুকমান হাকীমের উপদেশসমূহের সেই গুরুত্ব নেই- (নাউযু বিল্লাহ!) আসলে পূর্বের জাহেলী যুগে যত কুসংস্কার ছিল, বর্তমানেও তা আছে। আমরা কি এই প্রগতির যুগেও পৌত্তলিকতার ছড়াছড়ি দেখতে পাচ্ছি না? একেই জ্ঞান ও সংস্কৃতি মনে করা, দেশত্ববোধের অংশ মনে করা, এর মহিমা বয়ান করে শত শত পৃষ্ঠা মসিলিপ্ত করা, এমনকি হাতেগড়া নিষ্প্রাণ পুতুলের জন্য মানুষের গলায় ছুরি চালানোর মতো জঘন্য জাহেলী কর্মকা- কি এই ‘প্রগতি’ ও ‘মানবিকতা’র যুগেও আমরা দেখতে পাচ্ছি না? পাচ্ছি এবং এত বিপুল পরিমাণে দেখতে পাচ্ছি যে, এখন এইসব ঘটনা আমাদের আর তেমনভাবে নাড়া দেয় না!

কাজেই জাহেলিয়াত অতীতেও ছিল, এখনও আছে। সেই জাহেলিয়াতের উপশমই হচ্ছে আলকুরআনুল কারীম।

কুরআন নিষেধক ও প্রতিরোধক-

یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ قَدْ جَآءَتْكُمْ مَّوْعِظَةٌ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَ شِفَآءٌ لِّمَا فِی الصُّدُوْرِ، وَ هُدًی وَّ رَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِیْنَ.

হে মানুষ! তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের নিকট থেকে এসেছে নিষেধক তোমাদের অন্তরসমূহে যা আছে তার প্রতিষেধক আর মুমিনদের জন্য হেদায়েত ও রহমত। -সূরা ইউনুস (১০) : ৫৭-৫৮

আল্লামা শাব্বীর আহমদ উছমানী রাহ. এই আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, উপরোক্ত বিষয়গুলো হচ্ছে কুরআন মাজীদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য; কুরআন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নসীহত, যা মানুষকে ক্ষতিকর ও বিধ্বংসী বিষয়াদি থেকে ফিরিয়ে রাখে, অন্তরের ব্যধিসমূহ দূর করে, আল্লাহ্র নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের পথ দেখায় এবং অনুসারীদের দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহ্র রহমতের উপযুক্ত করে তোলে। কোনো কোনো গবেষকের মতে, এই আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, মানবসত্তার উৎকর্ষ ও পূর্ণতার বিভিন্ন স্তর অর্থাৎ যে কুরআনের অনুসরণ করবে সে ঐসকল স্তরে উন্নীত হবে :

এক. নিজেকে অন্যায় কাজকর্ম থেকে মুক্ত করা। যার দিকে مَوْعِظَةٌ বা ‘নিষেধক’ শব্দটি ইশারা করছে।

দুই. অন্তরকে ভ্রান্ত বিশ্বাস ও মন্দ প্রবণতা থেকে মুক্ত করা, যার দিকে شِفَاءٌ لِمَا فِي الصُّدُورِ (অন্তরে যা কিছু আছে তার প্রতিষেধক) কথাটি ইশারা করছে।

তিন. নিজেকে সঠিক বিশ্বাস ও ভালো স্বভাবে সজ্জিত করা, যার জন্য هُدًى (হেদায়েত) শব্দটি উপযুক্ত

চার. ভেতর-বাহিরের দুরস্তির পর আল্লাহ্র পক্ষ হতে নূর ও আলো গ্রহণ করা, যা  رَحْمَةٌ (করুণা) শব্দ থেকে বোঝা যায়। ...[তাফসীরে উসমানী (উর্দু) পৃ. ২৭৭ ফায়েদা : ১০]

কুরআনের মাধ্যমে মানবসত্তা নির্মল ও পরিশুদ্ধ হয়।  সকল প্রকারের অজ্ঞতা ও জাহিলিয়াত থেকে মুক্ত হয়। বলা বাহুল্য যে, এটি সবার সবসময়ের প্রয়োজন। গোটা মানবজাতির জন্যই তা প্রাসঙ্গিক। তবে কথা হচ্ছে প্রয়োজন ও প্রাসঙ্গিক হলেও এর দ্বারা উপকৃত তারাই হয়, যারা ঈমান আনে এবং কুরআন থেকে আলো গ্রহণে সচেষ্ট হয়। ইরশাদ হয়েছে-

وَ نُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْاٰنِ مَا هُوَ شِفَآءٌ وَّ رَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِیْنَ  وَ لَا یَزِیْدُ الظّٰلِمِیْنَ اِلَّا خَسَارًا.

আমি অবতীর্ণ করি কুরআন, যা মুমিনদের জন্য আরোগ্য ও রহমত, কিন্তু তা যালিমদের ক্ষতিই বৃদ্ধি করে। -সূরা ইসরা (১৭) : ৮২

قُلْ هُوَ لِلَّذِیْنَ اٰمَنُوْا هُدًی وَّ شِفَآءٌ،  وَ الَّذِیْنَ لَا یُؤْمِنُوْنَ فِیْۤ اٰذَانِهِمْ وَقْرٌ وَّ هُوَ عَلَیْهِمْ عَمًی،  اُولٰٓىِٕكَ یُنَادَوْنَ مِنْ مَّكَانٍۭ بَعِیْدٍ.

বল, মুমিনদের জন্য এ পথনির্দেশ ও ব্যাধির প্রতিকার। কিন্তু যারা অবিশ্বাসী তাদের কানে রয়েছে বধিরতা আর কুরআন হবে এদের জন্য অন্ধত্ব। এদের যেন আহ্বান করা হয় বহুদূর হতে। -সূরা ফুছছিলাত (৪১) : ৪৪

উপরে সূরা ইউনুসের যে আয়াতে কুরআনের বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণিত হয়েছে তার পরের আয়াতেই আল্লাহ তাআলা বলেন-

قُلْ بِفَضْلِ اللهِ وَ بِرَحْمَتِهٖ فَبِذٰلِكَ فَلْیَفْرَحُوْا، هُوَ خَیْرٌ مِّمَّا یَجْمَعُوْن.

বলো, এ আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও তার দয়ায়, সুতরাং এতে তারা আনন্দিত হোক। ওরা যা পুঞ্জিভূত করে তা থেকে এ উত্তম। -সূরা ইউনুস (১০) : ৫৮

ইমাম তবারী রাহ. হাসান সনদে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর বাণী বর্ণনা করেছেন যে-

"فضله الإسلام ورحمته القرآن"

আল্লাহর ‘ফাদ্ল’ হচ্ছে ‘ইসলাম’ আর তাঁর ‘রাহমাহ’ হচ্ছে ‘আলকুরআন’। (তাফসীরে তবারী ১২/১৯৬-১৯৭)

তো আল্লাহ যাদের ঈমান ও ইসলামের মতো মহা নিআমত দান করেছেন  যে কারণে কুরআনের আলো গ্রহণ তাদের জন্য সহজ হয়ে গিয়েছে তাদের কর্তব্য, এই মহা নিআমতের শোকরগোযারি করা এবং কুরআন মাজীদের শিক্ষাকে সঠিকভাবে উপলদ্ধি করে মনেপ্রাণে নিজের জীবনে বাস্তবায়নের চেষ্টা করা।

* * *

সূরায়ে লুকমানের আলোচ্য আয়াতগুলোতে লুকমান হাকীমের যে উপদেশমালা বর্ণিত হয়েছে তার আগে উল্লেখিত হয়েছে এমন একটি বিষয়ের, যা জাহেলিয়াতের অনুষঙ্গ-

وَ مِنَ النَّاسِ مَنْ یَّشْتَرِیْ لَهْوَ الْحَدِیْثِ لِیُضِلَّ عَنْ سَبِیْلِ اللهِ بِغَیْرِ عِلْمٍ،  وَّ یَتَّخِذَهَا هُزُوًا،  اُولٰٓىِٕكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُّهِیْن.

মানুষের মধ্যে কেউ কেউ ‘লাহওয়াল হাদীস’ ক্রয় করে, অজ্ঞতাবশত আল্লাহ্র পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য এবং তাকে উপহাসের বিষয়ে পরিণত করার জন্য। এদেরই জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি। -সূরা লুকমান (৩১) : ৬

হাসান বসরী রাহ. ‘লাহওয়াল হাদীস’ সম্পর্কে বলেছেন- আল্লাহ্র স্মরণ ও ইবাদত থেকে বিচ্যুতকারী সবকিছুই ‘লাহওয়াল হাদীস’-এর অন্তর্ভুক্ত; যেমন, অনর্থক গল্প-গুজব, হাসি-তামাশা, অর্থহীন কাজকর্ম, গান-বাজনা ইত্যাদি।

كل ما شغلك عن عبادة الله تعالى وذكره من السمر والأضاحيك والخرافات والغناء ونحوها.

 (রুহুল মাআনী ১১/৬৭)

আল্লামা শাব্বীর আহমদ উছমানী রাহ. বলেন, বিভিন্ন রেওয়ায়েতে আছে, এক কাফের রঈস নাদ্র ইবনে হরিছ ব্যবসার উদ্দেশ্যে যখন ফারিস (ইরান) যেত ওখান থেকে আজমী রাজা-বাদশাহ্র কিচ্ছা-কাহিনী কিনে নিয়ে আসত। এরপর মক্কার লোকদের বলত, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তোমাদেরকে আদ ও ছামুদের কাহিনী শোনায়, এসো, আমি তোমাদের রুস্তম, ইস্কান্দিয়ার ও ফারিসের রাজা-বাদশাহ্র কাহিনী শোনাব। কেউ কেউ এতে আগ্রহী হয়ে তাতে মশগুল হয়ে যেত। সে এক গায়িকা বাদীও কিনে রেখেছিল। যখন কাউকে দেখত যে, লোকটার দিল নরম হয়েছে এবং ইসলামের দিকে ঝুঁকেছে সে ঐ দাসীকে তার কাছে নিয়ে যেত এবং দাসীকে হুকুম করত- এর আদর আপ্যায়ন কর এবং গান শোনাও। এরপর ঐ লোককে বলত, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যেদিকে ডাকে- নামায পড়, রোযা রাখ, জান দিয়ে দাও এসবের চেয়ে এই আনন্দ-বিনোদন কি ভালো নয়? [তাফসীরে উছমানী (উর্দু) পৃ. ৫৩৩ ফায়েদা : ৩]

এটা হচ্ছে অসার কিচ্ছা-কাহিনী ও গান-বাজনার মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহ্র পথ থেকে বিচ্যুত করার ও আল্লাহ্র বিধানকে অবজ্ঞা করার এক দৃষ্টান্ত, যার প্রেক্ষাপটে এই আয়াত নাযিল হয়েছে।

তবে এই প্রেক্ষাপটের মাঝেই আয়াতের নির্দেশনা সীমবদ্ধ নয়। সর্বপ্রকারের ‘লাহ্ব’ (মগ্নতা), যা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুতির কারণ হয় তা-ই আয়াতের বিধানের অন্তর্ভুক্ত। যে প্রকারের বিচ্যুতি ঐ প্রকারের বিধান আসবে।

আল্লামা শাব্বীর আহমদ উছমানী রাহ. বলেন, উপরোক্ত আয়াত একটি বিশেষ ঘটনা বা প্রেক্ষাপটে নাযিল হলেও এর বিধান ব্যাপক ও সাধারণ। যে লাহ্ব (ব্যস্ততা) দ্বীন ইসলাম থেকে বিচ্যুত হওয়ার বা করার কারণ হয় তা হারাম; বরং কুফর। যা জরুরি শরয়ী বিধিবিধান থেকে বিরত রাখে বা আল্লাহ্র নাফরমানীর কারণ হয় তা গুনাহ। হাঁ, যে ‘লাহ্ব’ কোনো ওয়াজিব কাজ থেকে বিরত রাখে না এবং যাতে কোনো শরয়ী ‘গরজ ও মাসলাহাত’ও নেই তা ‘মুবাহ’; তবে অনর্থক হওয়ার কারণে ‘খেলাফে আওলা’। ঘোড় দৌড়, তিরন্দাজি, নিশানাবাজি ও স্বামী-স্ত্রীর আদর-সোহাগে (শরীয়তের সীমার ভেতরে) যেহেতু উল্লেখযোগ্য শরয়ী মাকসাদ রয়েছে তাই তা বাতিল লাহ্বের বাইরে। ...আর বাদ্য-যন্ত্রের নিষিদ্ধতার বিষয়ে তো সহীহ বুখারীতেই হাদীস আছে। ... (তাফসীরে উছমানী পৃ. ৫৩৩ ফায়েদা : ৩)

আল্লাহ্র পথ থেকে বিচ্যুতকারী ‘লাহ্ব’ যেমন অতীত জাহেলী যুগে ছিল এখনো আছে। নাচ-গান, অশ্লীলতা-বেহায়াপনা, ঈমান-আমল ধ্বংসকারী শিল্প-সাহিত্য, স্বভাব-চরিত্র বিধ্বংসী বিনোদন-উপকরণ কী এখন নেই? এই সবই আল্লাহ্র পথ থেকে বিচ্যুতকারী ‘লাহ্ব’।

শুধু তা-ই নয় এই সকল অনাচার-অশ্লীলতা এখন শিল্প-সংস্কৃতির অংশ, প্রগতির অংশ, অনাচার-অশ্লীলতার পাশাপাশি এই শিল্প-সংস্কৃতির এক বিরাট অংশ এমন রয়েছে, যা ‘কুফর ও শুআবুল কুফর’-এর বিস্তারের মাধ্যম। ইসলামী বিশ্বাস ও জীবনব্যবস্থার বিপরীতে এক লা-দ্বীনী চেতনা ও জীবনধারার প্রবর্তক। এই চিন্তা-ধারা ও জীবন ধারাকে বলা যায় আল্লাহ-বিমুখ ও আল্লাহ-বিস্মৃত জীবনধারা।

সূরা লুকমানের এ আয়াতে এই আল্লাহ-বিস্মৃত জীবনধারার উপাদান ‘লাহ্ওয়াল হাদীস’-এর উল্লেখের পশাপাশি এই কুফর ও শুআবুল কুফরের বিস্তারের কলাকুশলীদের ব্যাপারেও কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হয়েছে।

এরপর কুরআন মাজীদের সাধারণ উসলূব-কুফরের সাথে ঈমানের, কাফির সম্প্রদায়ের সাথে মুমিনদের এবং কুফরের পরিণামের পাশাপাশি ঈমানের ফলাফল বর্ণনার উসলূব অনুযায়ী ঐ আল্লাহ-বিস্মৃত জীবনের উপকরণ ও তার কুশীলবদের উল্লেখের পর আল্লাহ-অভিমুখী নির্মল চিন্তা ও জীবনের অনুষঙ্গ এবং এই চিন্তা ও জীবনের এক দাঈ ও মুআল্লিমের আলোচনা এসেছে। এর মাধ্যমে  আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের জানিয়ে দিচ্ছেন, কোন্টা জ্ঞান আর কোন্টা অজ্ঞতা; কোন্টা মুসলিমের সংস্কৃতি আর কোন্টা কাফিরের, কোন্টা আল্লাহ-বিমুখ জীবন আর  কোন্টা আল্লাহ-অভিমুখী জীবন। এই প্রসঙ্গে হযরত লুকমান হাকীমের উপদেশগুলো আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-

وَلَقَدْ آتَيْنَا لُقْمَانَ الْحِكْمَةَ

আমি দান করেছি লুকমানকে ‘হিকমাহ’

এখানে ‘হিকমাহ’ শব্দের ব্যাখ্যায় সহীহ সনদে মুজাহিদ রাহ. থেকে বর্ণিত হয়েছে-

قال: الفقه والعقل والإصابة في القول من غير نبوة.

তিনি বলেছেন, (হিকমাহ অর্থ,) জ্ঞান, বুদ্ধি ও সঠিক বক্তব্য- নবুওত ছাড়া। (তাফসীরে তবারী ১৮/৫৪৬)

আল্লামা শাব্বীর আহমদ উছমানী রাহ. বলেছেন, অধিকাংশ আলিমের মতে হযরত লুকমান পয়গাম্বর ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন নেককার মুত্তাকী ইনসান। আল্লাহ তাআলা তাঁকে উঁচু স্তরের বিবেক-বুদ্ধি এবং জ্ঞান ও পরিপক্কতা দান করেছিলেন। তিনি জ্ঞান-বুদ্ধির দ্বারা এমন সব কথা বলেছেন, যা নবীগণের শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। (ফাওয়ায়েদে উছমানী পৃ. ৫৩৪, ফায়েদা : ৬)

‘হিকমাহ’ এক সারগর্ভ শব্দ। আলিমগণ এর বিশদ বিশ্লেষণ করেছেন এবং এর শব্দ, মর্ম ও প্রায়োগিক বিভিন্ন রূপ আলোচনা করেছেন। আরবী ভাষাবিদগণ বলেন, ح ك م ধাতুমূল المنع বা المنع للإصلاح (নিবৃত্ত করা বা ভালোর জন্য নিবৃত্ত করা) মর্ম ধারণ করে। এই মর্মসূত্রেই অন্যায় থেকে নিবৃত্ত করার অর্থে বিচারকে حُكْمٌ বলে এবং এই মর্ম হিসেবেই লাগামের লোহারদ-, যা পশুর মুখের ভিতরে থাকে একে حَكَمَةُ الدابة বলা হয়, কারণ তা সওয়ারিকে নিয়ন্ত্রণ করে সওয়ারের ইচ্ছার বিপরীতে চলা থেকে বিরত রাখে।

এটা হচ্ছে ‘হিকমাহ’ শব্দের ধাতুগত মর্ম। এর সংজ্ঞা আলিমগণ বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন। সহীহ মুসলিমের ভাষ্যকার ইমাম নববী রাহ. বলেছেন-

হিকমাহ হচ্ছে, আল্লাহ্র মা‘রিফাত সম্বলিত জ্ঞান ও গভীর প্রজ্ঞা, স্বভাব-চরিত্রের পরিশুদ্ধি, সত্য-ন্যায়ের দৃঢ় উপলদ্ধি; সে অনুযায়ী আমল ও এর বিপরীত বিষয় থেকে পরহেয করার জন্য। আর এইসকল বৈশিষ্ট্যের যিনি অধিকারী তিনি ‘হাকীম’।

فِي تَفْسِيرِ الْحِكْمَةِ أَقْوَالٌ كَثِيرَةٌ مُضْطَرِبَةٌ صَفَا لَنَا مِنْهَا أَنَّ الْحِكْمَةَ الْعِلْمُ الْمُشْتَمِلُ عَلَى الْمَعْرِفَةِ بِاللهِ مَعَ نَفَاذِ الْبَصِيرَةِ وَتَهْذِيبِ النَّفْسِ وَتَحْقِيقِ الْحَقِّ لِلْعَمَلِ بِهِ وَالْكَفِّ عَنْ ضِدِّهِ وَالْحَكِيمُ مَنْ حَازَ ذَلِك.

(ফাতহুল বারী ১/৫৪৯)

হিকমাহ্-গুণের বিভিন্ন প্রকাশও সালাফের বাণীতে পাওয়া যায়। যেমন :

আবুল আলিয়া রাহ. يُؤْتَ الْحِكْمَةَ -এর ব্যাখ্যায় বলেছেন,

الخشية، لأن خشية الله رأس كل حكمة.

(হিকমাহ হচ্ছে) ভয়, আল্লাহ্র ভয়ই সর্বোচ্চ হিকমাহ্। (আদ্দুররুল মানছূর ১/৩৪৮)

মাত্র আল ওর্য়ারাক রাহ. বলেন-

بلغنا أن الحكمة خشية الله والعلم بالله.

আমাদের কাছে এই বর্ণনা পৌঁছেছে যে, হিকমাহ হচ্ছে আল্লাহর ভয় ও আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান। (প্রাগুক্ত)

উরওয়া ইবনুয যুবাইর রাহ. বলেন-

كان يقال: الرفق رأس الحكمة.

বলা হত, সহজতা ও কোমলতা হচ্ছে সর্বোত্তম হিকমাহ্। (প্রাগুক্ত)

ওয়াহ্ব ইবনে মুনাব্বিহ রাহ. বলেন-

أجمعت الأطباء (على) أن رأس الطب الحمية، وأجمعت (الحكماء) أن رأس الحكمة الصمت.

চিকিৎসকগণ একমত যে, চিকিৎসার চূড়ান্ত কথা হচ্ছে, পরহেয/পথ্যসংযম এবং জ্ঞানীগণ একমত যে, হিকমাহ্র চূড়ান্ত কথা হচ্ছে, নীরবতা। (হুসনুস সামতি ফিস সম্ত, সুয়ূতি ১/৮১

এগুলো হিকমার বিভিন্ন প্রকাশ বা শাখা, হিকমাহ সঠিক জ্ঞান ও যথার্থ কর্ম উভয়টিকে শামিল করে।

وَلَقَدْ آتَيْنَا لُقْمَانَ الْحِكْمَةَ.

‘আমি দান করেছি লুকমানকে হিকমাহ।’

وَلَقَدْ آتَيْنَا ‘আমি দান করেছি’। কে দান করেছেন? আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। লুকমান হাকীমের যে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা তা তাঁর নিজের নয়, আল্লাহ্র দান। মানুষের সকল গুণ আল্লাহর দান এটা এক বাস্তবতা। এই বাস্তব- জ্ঞান একজন মুমিনের মধ্যে জাগ্রত হতে হবে। বান্দার এই উপলব্ধি আল্লাহ তাআলা পছন্দ করেন-

وَ مَا بِكُمْ مِّنْ نِّعْمَةٍ فَمِنَ اللهِ.

তোমাদের যা নিআমত তা আল্লাহর পক্ষ থেকে। -সূরা নাহ্ল (১৬) : ৫৩

আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক জ্যোতির্ময় দুআ নি¤œরূপ

اللّهُمّ مَا أَصْبَحَ بِي مِنْ نِعْمَةٍ، أَوْ بِأَحَدٍ مِنْ خَلْقِكَ، فَمِنْكَ وَحْدَكَ لَا شَرِيكَ لَكَ، فَلَكَ الْحَمْدُ وَلَكَ الشّكْرُ.

অর্থ : ইয়া আল্লাহ! এই ভোরে আমার কাছে যা কিছু দান আছে কিংবা তোমার যে কোনো মাখলুকের কাছে, তা একমাত্র তোমারই তরফ থেকে, তোমার কোনো শরীক নেই। কাজেই প্রশংসা তোমারই, শোকরও তোমারই।

কুরআন মাজীদে বারবার বিভিন্ন নিআমতের ক্ষেত্রে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই বাস্তবতা ইরশাদ করেছেন।

সূরাতুল বাকারার শুরুতে মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে। একটি বৈশিষ্ট্য এভাবে বর্ণিত হয়েছে-

وَ مِمَّا رَزَقْنٰهُمْ یُنْفِقُوْنَ.

আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে তারা খরচ করে। -সূরা বাকারা (২) : ২

কথাটা কিন্তু লম্বা করে বলা হয়েছে। ‘তারা তাদের সম্পদ থেকে খরচ করে’ বলা হয়নি। বলা হয়েছে-

‘আমি তাদেরকে যা দান করেছি তা থেকে তারা খরচ করে।’ এতে এই সত্যের বর্ণনা রয়েছে যে, মানুষের যে সম্পদ, যা থেকে সে খরচ করে, তা আল্লাহ্রই দান।

তো মানুষ যদি এ সত্য ও বাস্তবতার উপলব্ধি পেয়ে যায়, আমার যা কিছু, সব আল্লাহ্র পক্ষ থেকে, তাহলে দ্বিতীয় যে উপলব্ধি তার মনে জাগবে তা হচ্ছে, আমাকে আল্লাহ্র শোকরগুযারী করতে হবে। আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞ হতে হবে। এই উপলব্ধি হচ্ছে ‘হিকমাহ’, যা মানুষের জীবনে বিপ্লব সাধন করতে পারে এবং তাকে মুমিন ও পূর্ণাঙ্গ মুমিন করে তুলতে পারে।

 

কাকে বলে ‘শোকর’

ইমাম ইবনে মানযূর রাহ. বলেন-

الشكر عرفان الإحسان ونشره.

শোকর হচ্ছে অনুগ্রহের উপলদ্ধি ও তার প্রচার। -লিসানুল আরব ৪/৪২৩

আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রাহ. শোকরের প্রায়োগিক দিক বর্ণনা করে বলেছেন-

(الشكر) ظُهُورُ أَثَرِ نِعْمَةِ اللَّهِ عَلَى لِسَانِ عَبْدِهِ: ثَنَاءً وَاعْتِرَافًا. وَعَلَى قَلْبِه: شُهُودًا وَمَحَبَّةً. وَعَلَى جَوَارِحِه: انْقِيَادًا وَطَاعَةً.

শোকর হচ্ছে, বান্দাকে আল্লাহ্ যে নিআমত দান করেছেন তা মুখে, অন্তরে  ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়া। মুখে তাঁর দান স্বীকার ও প্রশংসার মাধ্যমে; অন্তরে স্মরণ ও ভালবাসার মাধ্যমে আর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে মান্যতা ও আনুগত্যের মাধ্যমে। -মাদারিজুস সালিকীন ২/২৪৪

আল্লামা ফাইরোযাবাদী রাহ. বলেন-

والشكر مَبْنِىّ على خمس قواعد: خضوع الشاكر للمشكور، وحبّه له،  واعترافه بنعمته، والثناء عليه بها، وأَلا يستعملها فيما يكره.

 শোকরের ভিত্তি পাঁচটি বিষয় : এক. অনুগ্রহকারীর সমীপে বিনয়ী হওয়া। দুই. তাকে মহব্বত করা।  তিন. তাঁর অনুগ্রহ স্বীকার করা, চার. অনুগ্রহের কারণে প্রশংসা করা। পাঁচ. তার দান তার অসন্তুষ্টির ক্ষেত্রে ব্যবহার না করা। (বাসাইরু যাবিদ তাময়ীয ৩/৩৩৭)

সালাফের এই দু-তিনটি বক্তব্য নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করলেও আমাদের সামনে শোকরের মর্ম ও রূপরেখা স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

 

শোকরের যথার্থতা

আল্লাহ্র শোকগোযারি এমন এক বিষয়, চিন্তাশীল ব্যক্তি মাত্রই যার যথার্থতা উপলব্ধি করেন। আল্লাহ তাআলা এই বিশ্বজগৎকে সৃষ্টি করেছেন এবং একে মানুষের অনুকূল করেছেন। আল্লাহ তাআলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তাকে গুণ ও যোগ্যতা দান করেছেন, তার প্রয়োজনের সকল উপকরণ সৃষ্টি করেছেন, সর্বোপরি তাকে চিরশান্তির জান্নাতের পথ বাতলে দিয়েছেন। কাজেই আল্লাহ তাআলার শোকর বান্দাকে করতেই হবে, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতেই হবে। এর চেয়ে বড় যৌক্তিক ও যথার্থ বিষয় আর কিছুই হতে পারে না।

কুরআন মাজীদের পাতায় পাতায় আল্লাহ তাআলা বান্দার প্রতি তাঁর দানসমূহ বর্ণনা করেছেন এবং তাঁর করণীয় সম্পর্কেও সচেতন করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-

قُلْ هُوَ الَّذِیْۤ اَنْشَاَكُمْ وَ جَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَ الْاَبْصَارَ وَ الْاَفْـِٕدَةَ ؕ قَلِیْلًا مَّا تَشْكُرُوْنَ .

বলুন, তিনিই সেই সত্তা, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের জন্য বানিয়েছেন কান, চোখ ও অন্তর। তোমরা খুব সামান্যই শোকর কর। -সূরা মুলক (৬৭) : ২৩

وَ اللهُ اَخْرَجَكُمْ مِّنْۢ بُطُوْنِ اُمَّهٰتِكُمْ لَا تَعْلَمُوْنَ شَیْـًٔا  وَّ جَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَ الْاَبْصَارَ وَ الْاَفْـِٕدَةَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ.

এবং আল্লাহ তোমাদেরকে নির্গত করেছেন তোমাদের মাতৃগর্ভ থেকে এমন অবস্থায় যে, তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং হৃদয়, যাতে তোমরা শোকর কর। -সূরা নাহ্ল (১৬) : ৭৮

মানুষের জীবনোপকরণও আল্লাহ্রই দান, আল্লাহ্রই সৃষ্টি। সূরা ওয়াকিয়ায় কীভাবে তিনি তাঁর বান্দাদের খিতাব করেছেন-

اَفَرَءَیْتُمْ مَّا تَحْرُثُوْنَ، ءَاَنْتُمْ تَزْرَعُوْنَهٗۤ اَمْ نَحْنُ الزّٰرِعُوْنَ، لَوْ نَشَآءُ لَجَعَلْنٰهُ حُطَامًا فَظَلْتُمْ تَفَكَّهُوْنَ، اِنَّا لَمُغْرَمُوْنَ، بَلْ نَحْنُ مَحْرُوْمُوْنَ، اَفَرَءَیْتُمُ الْمَآءَ الَّذِیْ تَشْرَبُوْنَ، ءَاَنْتُمْ اَنْزَلْتُمُوْهُ مِنَ الْمُزْنِ اَمْ نَحْنُ الْمُنْزِلُوْنَ، لَوْ نَشَآءُ جَعَلْنٰهُ اُجَاجًا فَلَوْ لَا تَشْكُرُوْنَ، اَفَرَءَیْتُمُ النَّارَ الَّتِیْ تُوْرُوْنَ، ءَاَنْتُمْ اَنْشَاْتُمْ شَجَرَتَهَاۤ اَمْ نَحْنُ الْمُنْشِـُٔوْنَ، نَحْنُ جَعَلْنٰهَا تَذْكِرَةً وَّ مَتَاعًا لِّلْمُقْوِیْنَ،  فَسَبِّحْ بِاسْمِ رَبِّكَ الْعَظِیْمِ۠.

তোমরা যে বীজ বপন কর সে সম্পর্কে চিন্তা করেছ কি? তোমরা কি তা অঙ্কুরিত কর, না আমি অঙ্কুরিত করি? আমি চাইলে একে খড়-কুটায় পরিণত করতে পারি, তখন হতবুদ্ধি হয়ে বলবে, আমরা তো দায়গ্রস্ত হয়ে পড়েছি; বরং আমরা হত-সর্বস্ব হয়ে গেছি।

তোমরা যে পানি পান কর সে সম্পর্কে চিন্তা করেছ কি? তোমরা কি তা মেঘ থেকে নামিয়ে আন, না আমি তা বর্ষণ করি? আমি চাইলে একে লবণাক্ত করে দিতে পারি। তবুও কেন শোকর করছ না?

তোমরা যে অগ্নি প্রজ্জ্বালিত কর সে সম্পর্কে ভেবেছ কি? তোমরাই কি এর বৃক্ষ সৃষ্টি কর, না আমি সৃষ্টি করি? আমি একে করেছি নির্দশন ও মরুচারীদের প্রয়োজনীয় বস্তু। সুতরাং তোমার মহান প্রতিপালকের নামের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর। -সূরা ওয়াকিয়া (৫৬) : ৬৩-৭৪

তার ঈমানদার বান্দাদের সম্বোধন করে বলেছেন-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا كُلُوْا مِنْ طَیِّبٰتِ مَا رَزَقْنٰكُمْ وَ اشْكُرُوْا لِلهِ اِنْ كُنْتُمْ اِیَّاهُ تَعْبُدُوْنَ .

হে মুমিনগণ! তোমাদের আমি যেসব পবিত্র বস্তু দিয়েছি তা থেকে আহার কর এবং আল্লাহ্র শোকরগোযারি কর, যদি তোমরা শুধু তাঁরই ইবাদত করে থাক। -সূরা বাকারা (২) : ১৭২

প্রকৃতির দিকে তাকালে মানুষ দেখতে পাবে প্রকৃতির গোটা ব্যবস্থাপনা আল্লাহ তাআলা মানুষের জন্য ও মানুষের অনুকূল করেছেন।

রাত-দিনের ব্যবস্থা তো মানুষের জন্যই-

وَ مِنْ رَّحْمَتِهٖ جَعَلَ لَكُمُ الَّیْلَ وَ النَّهَارَ لِتَسْكُنُوْا فِیْهِ وَ لِتَبْتَغُوْا مِنْ فَضْلِهٖ وَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ .

তিনিই আপন দয়ায় তোমাদের জন্য করেছেন রজনী ও দিবস যেন তাতে বিশ্রাম করতে পার এবং যেন তাঁর অনুগ্রহ অন্বেষণ করতে পার এবং যেন শোকর কর। -সূরা কাসাস (২৮) : ৭৩

চতুষ্পদ গবাদিপশুকেও মানুষের অনুগত করে দিয়েছেন, যেন সেসবের মাধ্যমে তার নানাবিধ প্রয়োজন পূরণ হতে পারে।

اَوَ لَمْ یَرَوْا اَنَّا خَلَقْنَا لَهُمْ مِّمَّا عَمِلَتْ اَیْدِیْنَاۤ اَنْعَامًا فَهُمْ لَهَا مٰلِكُوْنَ، وَ ذَلَّلْنٰهَا لَهُمْ فَمِنْهَا رَكُوْبُهُمْ وَ مِنْهَا یَاْكُلُوْنَ، وَ لَهُمْ فِیْهَا مَنَافِعُ وَ مَشَارِبُ  اَفَلَا یَشْكُرُوْنَ.

ওরা কি লক্ষ্য করেনি যে, আমার হাতে সৃষ্ট বস্তসমূহের মধ্যে ওদের জন্য আমি সৃষ্টি করেছি ‘আনআম’। অতপর ওরাই এগুলোর অধিকারী? এবং আমি এগুলোকে তাদের  বশীভূত করে দিয়েছি। এগুলোর কতক তাদের বাহন এবং এগুলোর কতক তারা আহার করে।

তাদের জন্য এগুলোতে আছে বহু উপকরিতা আর আছে পানীয়বস্তু। তবুও কি তারা কৃতজ্ঞ হবে না? -সূরা ইয়াসীন (৩৬) ৭১-৭৩

মানুষ কি নদী-সাগর নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছে? নদী-সাগরের ব্যবস্থাপনা মানুষের কত অনুকূল, কত স্বাভাবিক?

وَ هُوَ الَّذِیْ سَخَّرَ الْبَحْرَ لِتَاْكُلُوْا مِنْهُ لَحْمًا طَرِیًّا وَّ تَسْتَخْرِجُوْا مِنْهُ حِلْیَةً تَلْبَسُوْنَهَا، وَ تَرَی الْفُلْكَ مَوَاخِرَ فِیْهِ وَ لِتَبْتَغُوْا مِنْ فَضْلِهٖ وَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ.

তিনিই সমুদ্রকে বশীভূত করেছেন, যাতে তোমরা তা থেকে তাজা মৎস আহার করতে পার এবং যাতে তা থেকে আহরণ করতে পার রত্নাবলি, যা তোমরা ভূষণরূপে পরিধান কর এবং তোমরা দেখতে পাও, তার বুক চিরে নৌযান চলাচল করে এবং যাতে তোমরা তাঁর অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং যেন তোমরা শোকর কর। -সূরা নাহল (১৬) : ১৪

وَ مَا یَسْتَوِی الْبَحْرٰنِ، هٰذَا عَذْبٌ فُرَاتٌ سَآىِٕغٌ شَرَابُهٗ وَ هٰذَا مِلْحٌ اُجَاجٌ ،  وَ مِنْ كُلٍّ تَاْكُلُوْنَ لَحْمًا طَرِیًّا وَّ تَسْتَخْرِجُوْنَ حِلْیَةً تَلْبَسُوْنَهَا، وَ تَرَی الْفُلْكَ فِیْهِ مَوَاخِرَ لِتَبْتَغُوْا مِنْ فَضْلِهٖ وَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ.

দরিয়া দুইটি একরূপ নয় : একটির পানি সুমিষ্ট ও সুপেয়, অপরটির পানি লোনা, খার। প্রত্যেকটি হতে তোমরা তাজা গোশত আহার কর এবং আহরণ কর অলঙ্কার, যা তোমরা পরিধান কর এবং তোমরা দেখ, ওর বুক চিরে নৌযান চলাচল করে, যাতে  তোমরা তাঁর অনুগ্রহ অনুসন্ধান করতে পার এবং যাতে শোকর কর। -সূরা ফাতির (৩৫) : ১২

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

وَ مِنْ اٰیٰتِهٖۤ اَنْ یُّرْسِلَ الرِّیَاحَ مُبَشِّرٰتٍ وَّ لِیُذِیْقَكُمْ مِّنْ رَّحْمَتِهٖ وَ لِتَجْرِیَ الْفُلْكُ بِاَمْرِهٖ وَ لِتَبْتَغُوْا مِنْ فَضْلِهٖ وَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ .

তাঁর নিদর্শনাবলির একটি এই যে, তিনি বায়ু প্রেরণ করেন সুসংবাদ দেওয়ার জন্য এবং তোমাদেরকে তাঁর অনুগ্রহ আস্বাদন করানোর জন্য এবং যাতে তাঁর বিধানে নৌযানগুলি বিচরণ করে, যাতে তোমরা তাঁর অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং যাতে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হও। -সূরা রূম (৩০) : ৪৬

এভাবে কুরআন মাজীদ মানুষকে সচেতন করছে আল্লাহ তাআলার দান ও অনুগ্রহ সম্পর্কে এবং সচেতন করছে তার এক অনিবার্য করণীয় সম্পর্কে। আর তা হচ্ছে আল্লাহ্র শোকরগোযারি।

আল্লাহ তাআলা মানুষের শুধু ইহকালীন প্রয়োজন পূরণেরই ব্যবস্থা করেননি; নিজ দয়া ও করুণায় মানুষের চিরস্থায়ী জীবনের মুক্তি ও সাফল্যের ব্যবস্থাও করেছেন। মানুষের কি কর্তব্য নয় মহান আল্লাহ্র এই মহা নিআমতের মূল্য দেওয়া এবং তাঁর শোকরগোযার বান্দা হওয়া?

মানুষের হেদায়েতের জন্য আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদ নাযিল করেছেন এবং সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, করণীয়-বর্জনীয় সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন। শরীয়তের বিধানাবলিতেও মানুষের নানাবিধ দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতার লেহাজ করে সহজতা দান করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-

شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِیْۤ اُنْزِلَ فِیْهِ الْقُرْاٰنُ هُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الْهُدٰی وَ الْفُرْقَانِ ،  فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْیَصُمْهُ ،  وَ مَنْ كَانَ مَرِیْضًا اَوْ عَلٰی سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ اَیَّامٍ اُخَرَ ،  یُرِیْدُ اللهُ بِكُمُ الْیُسْرَ وَ لَا یُرِیْدُ بِكُمُ الْعُسْرَ،  وَ لِتُكْمِلُوا الْعِدَّةَ وَ لِتُكَبِّرُوا اللهَ عَلٰی مَا هَدٰىكُمْ وَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ.

রমযান মাস, এতে মানুষের দিশারী, সত্যপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস পাবে তারা যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে এবং কেউ পীড়িত থাকলে কিংবা সফরে থাকলে অন্যসময় এই সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ  তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান এবং যা তোমাদের জন্য ক্লেশকর তা চান না। এজন্য যে, তোমরা সংখ্যা পূর্ণ করবে এবং তোমাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করার কারণে তোমরা আল্লাহ্র মহিমা ঘোষণা করবে এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পার। -সূরা বাকারা (২) : ১৮৫

আল্লাহ তাআলা মানুষকে সুপথ সুস্পষ্টরূপে বাতলে দিয়েছেন এখন মানুষ হয় এই নিআমতের শোকর করবে ও ঈমান আনবে অথবা এই নিআমতের না-শোকরি করবে ও ঈমান থেকে বিরত থাকবে।

اِنَّا هَدَیْنٰهُ السَّبِیْلَ اِمَّا شَاكِرًا وَّ اِمَّا كَفُوْرًا.

 

ঈমান ও শোকর

আল্লাহ তাআলার শোকরগোযারির একমাত্র উপায় তাঁর প্রতি ঈমান আনা।  ঈমান ও এর শাখা-প্রশাখা আল্লাহ তাআলার শোকর ও কৃতজ্ঞতারই বিভিন্ন রূপ। পক্ষান্তরে কুফর, শিরক ও ফিস্ক-ফুজুর হচ্ছে আল্লাহ তাআলার না-শোকরির বিভিন্ন রূপ ও পর্যায়।

কুরআন মাজীদে ঈমান ও শোকরকে একসাথে আনা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-

مَا یَفْعَلُ اللهُ بِعَذَابِكُمْ اِنْ شَكَرْتُمْ وَ اٰمَنْتُمْ ، وَ كَانَ اللهُ شَاكِرًا عَلِیْمًا .

তোমরা যদি শোকরগোযার হও এবং ঈমান আন তবে তোমাদের শাস্তিতে আল্লাহ্র কী কাজ? আল্লাহ পুরস্কারদাতা, সর্বজ্ঞ। -সূরা নিসা (৪) : ১৪৭

আর এ তো বলাই বাহুল্য যে, ঈমান হচ্ছে সত্য, সরল ও যথার্থ পথ।

আল্লাহ তাআলা শোকর পছন্দ করেন আর না-শোকরি অপছন্দ করেন। কাজেই বান্দার কর্তব্য আপন কল্যাণার্থে আল্লাহ্র পছন্দনীয় বিষয়টি গ্রহণ করা।

اِنْ تَكْفُرُوْا فَاِنَّ اللهَ غَنِیٌّ عَنْكُمْ،  وَ لَا یَرْضٰی لِعِبَادِهِ الْكُفْرَ ،  وَ اِنْ تَشْكُرُوْا یَرْضَهُ لَكُمْ،  وَ لَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِّزْرَ اُخْرٰی، ثُمَّ اِلٰی رَبِّكُمْ مَّرْجِعُكُمْ فَیُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُوْنَ ،  اِنَّهٗ عَلِیْمٌۢ بِذَاتِ الصُّدُوْر .

তোমরা অকৃতজ্ঞ হলে আল্লাহ তোমাদের মুখাপেক্ষী নন। তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য কুফর পছন্দ করেন না। তোমরা যদি কৃতজ্ঞ হও- তিনি তোমাদের জন্য এ-ই পছন্দ করেন। একের ভার অপরজন বহন করবে না। অতপর তোমাদের প্রতিপালকের নিকট তোমাদের প্রত্যাবর্তন এবং তোমরা যা করতে তিনি তোমাদের তা অবহিত করবেন। অন্তরে যা আছে তিনি তা সম্যক অবগত। -সূরা যুমার (৩৯) : ৭

শোকরের পরিণাম শুভ আর না-শোকরির পরিণাম অশুভ। তাহলে বুদ্ধিমান মানুষ কেন শোকরের পথ ছেড়ে না-শোকরির পথে যাবে?

وَ اِذْ تَاَذَّنَ رَبُّكُمْ لَىِٕنْ شَكَرْتُمْ لَاَزِیْدَنَّكُمْ وَ لَىِٕنْ كَفَرْتُمْ اِنَّ عَذَابِیْ لَشَدِیْدٌ.

স্মরণ কর, তোমাদের প্রতিপালক ঘোষণা করেছেৎন, তোমরা কৃতজ্ঞ হলে অবশ্যই তোমাদেরকে অধিক দিব আর অকৃতজ্ঞ হলে অবশ্যই আমার শাস্তি হবে কঠোর। -সূরা ইবরাহীম (১৪) : ৭

 

সরল পথ-বক্র পথ

শোকর আম্বিয়া ও সালেহীনের পথ, পক্ষান্তরে না-শোকরি ইবলীসের পথ। কুরআন মাজীদে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের গুণ ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

اِنَّ اِبْرٰهِیْمَ كَانَ اُمَّةً قَانِتًا لِّلهِ حَنِیْفًا،  وَ لَمْ یَكُ مِنَ الْمُشْرِكِیْنَ، شَاكِرًا لِّاَنْعُمِهٖ،  اِجْتَبٰىهُ وَ هَدٰىهُ اِلٰی صِرَاطٍ مُّسْتَقِیْمٍ .

ইবরাহীম ছিল এক উম্মত, আল্লাহ্র অনুগত, আল্লাহ তাকে মনোনীত করেছিলেন এবং তাকে সরল পথে পরিচালিত করেছিলেন। আমি তাকে দুনিয়ায় দিয়েছিলাম মঙ্গল এবং আখিরাতেও, সে নিশ্চয়ই সৎকর্মপরায়ণদের অন্যতম। -সূরা নাহ্ল (১৬) : ১২০-১২২

সেই ইবরাহীম আ.-এর মিল্লাতের অনুসরণের আদেশই আমাদের করা হয়েছে। পূর্বোক্ত আয়াতসমূহের পরের আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন-

ثُمَّ اَوْحَیْنَاۤ اِلَیْكَ اَنِ اتَّبِعْ مِلَّةَ اِبْرٰهِیْمَ حَنِیْفًا،  وَ مَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِیْنَ.

এখন তোমার প্রতি ওহী করলাম, তুমি একনিষ্ঠ ইবরাহীমের ধর্মাদর্শ অনুসরণ কর এবং সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। -সূরা নাহ্ল (১৬) : ১২৩

আল্লাহ্র রাসূল খাতামুল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ ও সীরাতে শোকরগোযারির যে শিক্ষা ও আদর্শ রয়েছে তা অতুলনীয়।

তিনি নিজেও ছিলেন আল্লাহ্র শ্রেষ্ঠ শোকরগোযার আর উম্মতকেও আল্লাহ্র শোকগোযারির সর্বোত্তম শিক্ষা দান করেছেন।

হযরত মুগীরা ইবনে শো‘বা রা. বলেন-

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এত দীর্ঘ নামায পড়তেন যে, তাঁর পদদ্বয় ফুলে যেত। এ সম্পর্কে তাঁকে বলা হলে তিনি বলতেন, আমি কি (আল্লাহ্র) অতি শোকগোযার বান্দা হব না?

إِنْ كَانَ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ لَيَقُومُ أو لَيُصَلِّيَ حَتّى تَرِمُ قَدَمَاهُ - أَوْ سَاقَاهُ - فَيُقَالُ لَهُ فَيَقُولُ: أَفَلاَ أَكُونُ عَبْدًا شَكُورًا

-সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৩০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৮১৯

হযরত আবু বাকরা নুফাই ইবনুল হারিছ রা. বর্ণনা করেন-

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি  ওয়াসাল্লামের কাছে যখন কোনো আনন্দের বিষয় আসত বা আনন্দের সংবাদ দেয়া হত তিনি আল্লাহ্র শোকরগোযারিতে সিজদায় লুটিয়ে পড়তেন-

أَنّهُ كَانَ إِذَا جَاءَهُ أَمْرُ سُرُورٍ خَرّ سَاجِدًا شَاكِرًا لِلهِ.

 -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৭৪; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৩৯৪

আল্লাহ্র সাহায্য ও তাওফীক ছাড়া আল্লাহ্র শোকরগোযার বান্দা হওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাই উম্মতকে আল্লাহ্র কাছে শোকরগোযারির দুআ করতে শিখিয়েছেন।

হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হাত ধরলেন এবং বললেন-

يَا مُعَاذُ!  وَاللهِ إِنِّي لَأُحِبّكَ ،وَاللهِ إِنِّي لَأُحِبّكَ.

হে মুআয! আল্লাহ্র কসম আমি তোমাকে ভালবাসি। আল্লাহ্র কসম! আমি তোমাকে ভালবাসি।

এরপর বললেন-

أُوصِيكَ يَا مُعَاذُ! لَا تَدَعَنّ فِي دُبُرِ كُلِّ صَلَاةٍ تَقُولَ: اللّهُمّ أَعِنِّي عَلى ذِكْرِكَ وَشُكْرِكَ وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ.

তোমাকে অসীয়ত করছি হে মুয়ায! তুমি প্রতি নামাযের পর বলতে ভুলো না-

اللّهُمّ أَعِنِّي عَلَى ذِكْرِكَ وَشُكْرِكَ وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ

ইয়া আল্লাহ! আমাকে আপনার যিকর, শোকর ও উত্তম ইবাদতে সাহায্য করুন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৫২২; সুনানে নাসায়ী ৩/৫৩

দৃষ্টান্ত স্বরূপ শুধু একটি দুআ পেশ করা হল, মাসনূন দুআসমূহের এক বিরাট অংশই এমন, যাতে আল্লাহ্র শোকরগোযার বান্দা হওয়ার তাওফীক প্রার্থনা করা হয়েছে।

মোটকথা, আল্লাহ্র শোকরগোযারি হচ্ছে আম্বিয়ায়ে কেরামের পথ ও শিক্ষা। পক্ষান্তরে ইবলীসের পথ হচ্ছে আল্লাহ্র না-শোকরি। আদমসন্তানের এই প্রধান শত্রুর সেই সংকল্প ও কর্মপন্থা কুরআন মজীদে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। সূরা আ‘রাফে আছে-

قَالَ فَبِمَاۤ اَغْوَیْتَنِیْ لَاَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِیْمَ، ثُمَّ لَاٰتِیَنَّهُمْ مِّنْۢ بَیْنِ اَیْدِیْهِمْ وَ مِنْ خَلْفِهِمْ وَ عَنْ اَیْمَانِهِمْ وَ عَنْ شَمَآىِٕلِهِمْ،  وَ لَا تَجِدُ اَكْثَرَهُمْ شٰكِرِیْنَ، قَالَ اخْرُجْ مِنْهَا مَذْءُوْمًا مَّدْحُوْرًا،  لَمَنْ تَبِعَكَ مِنْهُمْ لَاَمْلَـَٔنَّ جَهَنَّمَ مِنْكُمْ اَجْمَعِیْنَ .

সে (শয়তান) বলল, তুমি আমাকে পথভ্রষ্ট করলে, এই জন্য আমিও তোমার সরল পথে মানুষের জন্য নিশ্চয়ই ওঁত পেতে থাকব। অতপর আমি তাদের নিকট আসবই- তাদের সামনে, পিছনে, ডান ও বাম দিক থেকে এবং তুমি তাদের অধিকাংশকে শোকরগোযার পাবে না। -সূরা আ‘রাফ (৭) : ১৬-১৭

শয়তানের কর্মপন্থার মূলকথাই হচ্ছে আল্লাহ্র নিআমত সম্পর্কে মানুষকে উদাসীন করা এবং আল্লাহ্র শোকরগোযার বান্দা হতে না দেয়া। কাজেই মানুষের কর্তব্য, নিজের মুক্তি ও কল্যাণের স্বার্থে ঐ সকল উপায় উপকরণ বর্জন করা, যা মানুষকে আল্লাহ থেকে বিমুখ করে। ঈমান ও আমলে ছালিহ থেকে বিমুখ করে। ঈমান ও আমলে  ছালেহের পথই আল্লাহ্র শোকরগোযারির পথ। আর আল্লাহ্র শোকরগোযারিই হচ্ছে হিকমাহ- প্রকৃত ও যথার্থ জ্ঞান।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement